ইনসাইড থট

রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি: শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত কর্মী

প্রকাশ: ০৯:১৪ এএম, ২১ মে, ২০২৩


Thumbnail

আজ ২১ মে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র জন্মদিন। ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই এক অনুষ্ঠানে ছোট বোন শেখ রেহানার এই ছেলের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন- ‘ববি সিআরআই এ পরিচালক হিসেবে কাজ করে। ইউএনডিপিতেও কাজ করে। সরকারের অনেক উদ্ভাবনী আইডিয়াতে সে কাজ করছে। সে নীরবে কাজ করে।’ ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেন নিজেকে। এর আগে অবশ্য ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের আক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পে দুই বছর মেয়াদে দায়িত্বে ছিলেন তিনি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাইবার প্রচার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ববি ওই প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন। তখন জাতীয় নির্বাচনে অনলাইন প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আর অনলাইনভিত্তিক প্রচার বা সাইবার স্পেসের মূল দায়িত্বে ছিলেন ববি। সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক মাঠ দখল ও নির্বাচনে জয়লাভের কৌশল হিসেবে ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কাজ নিয়ে ‘আপনি জানেন কি’ শিরোনামে ১৭টি প্রামাণ্য চিত্র এবং অন্যান্য সরকারের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নের তুলনামূলক ১৯টি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি এবং নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে আসার অনুষ্ঠান ‘ইয়াংবাংলা’র পেছনের অন্যতম মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ববি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একইভাবে আওয়ামী লীগের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ সকল রাজনৈতিক দল সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ফলে প্রচার-প্রচারণা করে যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচনে জয়ী করার কৌশল গ্রহণ করতে হয় শেখ হাসিনার দলকে। রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র নেতৃত্বে একঝাঁক তরুণ অনলাইন মিডিয়া ব্যবহার করে তৃণমূল জনগোষ্ঠীর কাছে নৌকা প্রতীক পৌঁছে দিতে সক্ষম হন সেসময়। এজন্য ভারতের ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ লিখেছিল- ‘ভারতের লোকসভা নির্বাচনে নেতৃত্ব দেন ইন্দিরা গান্ধীর দৌহিত্ররা তেমনি ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ববি ও জয়।’


বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছেন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। এক্ষেত্রে ‘ইয়াংবাংলা’, ‘জয়বাংলা কনসার্ট’ এবং ‘মুজিব’ সিরিজের কাজের কথা প্রথমেই মনে আসবে। তিনি ভাগ্য পরিবর্তনের আইকন। তিনি আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) এর ট্রাস্টি। সিআরআই’র হেড অব স্ট্রাটেজি অ্যান্ড প্রোগ্রাম হিসেবে কাজ করছেন যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করা ববি।

তার সুযোগ্য নেতৃত্ব ও পরামর্শে পরিচালিত ‘সিআরআই’ ও ‘ইয়াংবাংলা’র ব্যানারে তিনি নতুন জীবনের সন্ধান দিচ্ছেন যুবসমাজকে। নতুন প্রজন্মকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে নেওয়া অন্যতম কর্মসূচি ‘ইয়াংবাংলা’ সারাদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একইসঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে করে তুলেছে উজ্জীবিত। এই কর্মসূচির অন্যতম পরিকল্পনাকারী তিনি। তার নির্দেশনায় প্রকাশিত হচ্ছে ‘মুজিব’ নামের একটি শিশুতোষ প্রকাশনা। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অবলম্বনে গ্রাফিক নভেল সিরিজ মুজিব-৬ পর্বের পর নতুন পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে সিআরআই-এর উদ্যোগে। জীবনীভিত্তিক এই প্রকাশনার মধ্য দিয়ে দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এই গ্রাফিক নভেলটি। ইংরেজির পাশাপাশি আরো কয়েকটি বিদেশি ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছে বইটি। আসলে রাদওয়ান মুজিব রাজনৈতিক কোনো পদে না থাকলেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি সুপরিচিত নাম। বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় থেকেও তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর জয়বাংলা কনসার্টের আয়োজন করে আসছে বাংলাদেশের তরুণদের অন্যতম বড় প্লাটফর্ম ইয়াংবাংলা। মুজিববর্ষ এবং তার আগে তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় চেতনায় উদ্দীপিত করেছে আয়োজিত এসব কনসার্ট। কারণ কনসার্টের বড় অংশ জুড়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের গান। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণ উপলক্ষে ২০১৮ সালে জয়বাংলা-কনসার্ট আয়োজন করে ইয়াংবাংলার সেক্রেটারিয়েট সেন্টার ফর রিসার্চ এ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। চতুর্থবারের মতো চলা ইয়াংবাংলার ওই আয়োজনে উপস্থিত ছিল এ প্রজন্মের সম্ভাবনাময় মুখগুলো। দেশাত্মবোধে নিজের চেতনাকে আরও একবার ঝালিয়ে নিতে কনসার্টকে দারুণভাবে স্বাগত জানায় তরুণ প্রজন্ম।

রাদওয়ান মুজিব ববি ২০১৮ সালে বলেছেন, তরুণদের লবিস্ট হিসেবে কাজ করবে  ‘ইয়াংবাংলা’। সেসময় তিনি মাইক্রোসফট ইয়াংবাংলা সামিটের সমাপনী অনুষ্ঠানে ছিলেন যে সামিটে অংশ নেয় সারাদেশের ২৫০ টি দল। অংশগ্রহণকারী দল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ অবকাঠামো নানা বিষয়ে উদ্ভাবনী প্রস্তাবনা নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। বিজয়ী দলগুলোকে সম্মাননাসহ প্রস্তাবিত আইডিয়া বাস্তবায়নের অর্থ দেয়া হয়। ২০২০-২০২২ সালে মুজিববর্ষে তরুণদের চিন্তা চেতনার সঙ্গে মিল রেখে ইতিহাসকে উপস্থাপন করা উচিত বলে জানিয়েছিলেন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক। এ সময় তিনি তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ পদ্ধতি কেমন হবে তা নিয়ে সকলের ভাবা উচিত বলে মন্তব্য করেন।

দুই

বঙ্গবন্ধু-দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র অবদানের কথা বলতে গেলে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিবারের উল্লেখযোগ্য দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা দরকার। ১৯৭৫ সালে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক বছর আগে দশম জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, তিনি ও তার সন্তান এবং বোন রেহানা ও তার সন্তানদের নিয়েই তার পরিবার। এর বাইরে তার পরিবারে আর কোনো সদস্য নেই। তবে তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে লিখেছেন- ‘একদিকে জনগণ এবং অন্যদিকে আমার সন্তান কাউকেই আমি ভিন্ন চোখে দেখতে পারি না।’ প্রধানমন্ত্রীর পিতা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিশারি, স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী, ছেলে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, মেয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। একটি পরিপূর্ণ আলোকিত পরিবারের প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী বাল্যকাল থেকেই পিতার রাজনৈতিক আদর্শে বেড়ে উঠেছেন। এজন্য শেখ হাসিনা পরিবারের ঔদার্য বিশাল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক ঘটনা দিয়ে সেই উদার-হৃদয়ের মানুষদের আমরা চিনতে পারি।

মহাজোট সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানার নামে বরাদ্দকৃত বাড়িটি সরকারি কাজে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার ঘটনাটি অধিকাংশ মানুষের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে ২০০১ সালে ১১ জুলাই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধানমণ্ডিতে এক বিঘা জমির প্লটে একতলা একটি বাড়ির মালিকানা পান শেখ রেহানা। তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বিক্রয় দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন করে দেয়া হয় এবং বাড়িটি তার নামে ‘নামজারি’ও হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে সেই বরাদ্দ না মেনে বাড়িটি ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশকে দিয়ে দেয়। তবে শেখ রেহানার পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট করায় মামলাধীন বাড়িটির বরাদ্দপত্র বাতিল করতে ব্যর্থ হয় জোট সরকার। প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের সরকারিসূত্রে পাওয়া বাড়িটি নিজের দখলে আনার চেষ্টা না করে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছেন শেখ রেহানা। নামমাত্র ১০০১ টাকা মূল্যে সরকারের কাছে বাড়িটি দলিল করে দিয়েছেন তিনি। এ ঘটনা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সন্তান হিসেবে তার পক্ষেই ঘটানো সম্ভব। কারণ শেখ মুজিবুর রহমানও বাল্যকাল থেকে পরের দুঃখ-কষ্টকে উপলব্ধি করতে শিখেছিলেন আর নিজে ধনপতি না হয়ে সাধারণ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত ছিলেন। ২০০১-০৬ পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে জোট সরকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অনেককেই প্লট বা বাড়ি বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু কেড়ে নিয়েছিল এ দেশের গর্বিত সন্তান শেখ রেহানার বাড়িটি। মনে রাখা দরকার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর ধানমন্ডির পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক বাড়িটি বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা নিজেরা ভোগদখল না করে ‘স্মৃতি জাদুঘর’ করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অথচ জাতির পিতার কন্যাদ্বয়ের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা রাষ্ট্রেরই করা উচিত। আমরা দেখলাম বিপরীত চিত্র শেখ রেহানার বাড়িটি দখলের জন্য জোট সরকার ২০০৫ সালে থানা হিসেবে উদ্বোধন করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া উপস্থিত হয়েছিলেন সেখানে। বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি বিদ্বেষের কারণ কি? পক্ষান্তরে শেখ রেহানা নিজের বাড়িটি স্বেচ্ছায় জনস্বার্থে পুলিশকে দিয়ে দিয়েছেন।এটা বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঔদার্যের প্রকাশ। ব্যক্তিগত ভোগদখলের চিন্তা ত্যাগ করার এই মানসিকতা সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য। এ জন্যই শেখ রেহানা বলেছেন- ‘এক সরকার দেবে, আরেক সরকার নেবে, এই ঝামেলায় তার দরকার নেই।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকতে হয়েছে বড় বোন শেখ হাসিনাসহ শেখ রেহানাকে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো কেউ তাদের প্রতি সদয় হয়নি। বরং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মাত্র ১০১ টাকায় তার স্ত্রী-সন্তানদের জন্য গুলশানে ৩২ কাঠার প্লটে একটি বাড়ি বরাদ্দ করা হয়। সে সময় কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলেননি। ৩২ কাঠার গুলশানের বাড়িটি বরাদ্দ পাওয়ার পরও খালেদা জিয়া ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের ২২৮ কাঠার বিলাসবহুল বাড়িতেই থাকতেন। প্রচলিত আইন ভেঙে একইসঙ্গে দুটি সরকারি বাড়ি দখল করার ক্ষেত্রে দেশের মানুষ একটিবারও প্রশ্ন তোলেননি কেন? অবশেষে আদালতের রায়ে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি ছাড়তে হলেও তিনি প্রেস কনফারেন্স করে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানান। আশ্চর্যের বিষয় হলো সেনানিবাসে বসে দিনের পর দিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা নিয়েও প্রতিবাদ করেননি প্রতিক্রিয়াশীল ঘরানার বুদ্ধিজীবী মহল। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের দলীয় রাজনীতির দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধু কন্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ শেখ রেহানা কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এমনকি খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ঔদার্যের তুলনাও হয় না। শেখ রেহানার মাথা গোজার ঠাঁই কেড়ে নিয়ে তাঁর নামে রেজিস্ট্রি ও নামজারিকৃত বাড়ি থেকে কর্মরত ৯ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয় জোট সরকার। কেবল জাতির পিতার কন্যা হওয়ায় শেখ রেহানাকে সেদিন অপদস্ত করা হয়েছিল। সেই উপেক্ষা, কুরুচিপূর্ণ আচরণ মানুষ ভুলে যায়নি। জনগণ তার জবাবও দিয়েছে ভোটের মাধ্যমে।

শেখ হাসিনা ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়। তার তিন ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নৃশংসভাবে নিহত হন। একমাত্র বোন শেখ রেহানা তখন তার সঙ্গে জার্মানিতে। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং ১৭ মে ৬ বছর নির্বাসন শেষে দেশে ফেরেন তিনি। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পরে তাদেরও বন্দী করে রেখেছিল পাকিস্তানি আর্মি। বন্দী মুহূর্তগুলো ছিল উৎকণ্ঠায় ভরা। পিতা জীবিত আছেন জানতে পারেন স্বাধীন দেশে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু প্রথমে পরিবার নয় গিয়েছেন জনতার কাছে। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তে তার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন পরিবারটির প্রেরণা। মার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল দেশ স্বাধীন হবে। মায়ের কাছ থেকে শিখেছেন অনেক কিছু। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু মনে করতেন বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড এবং সাউথ এশিয়ার শক্তিশালী দেশ। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে এ দেশ। বঙ্গবন্ধুর এই ভাবনাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবনাও।

বাংলাদেশের মানুষের কথা চিন্তা করে শেখ হাসিনা কষ্ট পান; তেমনি রেহানাও। যে মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন কষ্ট করলেন, সেই মানুষের জন্যই নিজের জীবনটাই দিয়ে গেলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি আমলের মতো যে কষ্ট সেই কষ্টই পেয়েছিল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে বর্তমানে তিনি চেষ্টা করছেন মানুষের অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য। মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে হবে, মানুষের জন্য কিছু করতে হবে- এ ভাবনা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ সকল আওয়ামী লীগ বিশ্বাসীর।

ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার মতো শেখ রেহানারও টুঙ্গিপাড়ার প্রতি রয়েছে গভীর টান। হিজলের স্মৃতি তাকে ডাক দিয়ে যায়; জলে ঢাকা সবুজ ক্ষেত তাকে আহ্বান জানায়। মহান পিতার কবর স্নিগ্ধ সান্নিধ্য প্রদান করে। ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই শেখ হাসিনার সঙ্গে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন বলেই প্রাণে রক্ষা পান তিনি। কলেজ পড়ুয়া রেহানার লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছিল দেশে। কারণ তাদের ছোট বাড়িতে অনেক মানুষ; আর রাজনৈতিক পরিবারে বিচিত্র মানুষের আনাগোনা বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এজন্য বড় বোনের সন্তানদের দেখাশোনা ও নিজের পড়ার কাজের সুবিধার জন্য মাতৃনির্দেশ পালন করে বিদেশ পাড়ি দেন তিনি। রাষ্ট্রপতি হয়েও বঙ্গবন্ধু একটি ছোট বাড়িতে থাকতেন। কারণ বেগম মুজিবের বিশ্বাস ছিল বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার সন্তানরা নষ্ট হয়ে যাবে। এজন্য কখনো রাষ্ট্রপতি ভবনে বসবাসের উদ্দেশ্যে যাননি বরং সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন। দেশে ফিরতে না পেরে ১৯৭৬ সালে রেহানা লন্ডনে পৌঁছান। বিয়ে করেন পিতার পছন্দের পাত্রকেই। ১৯৭৭ সালে শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তিনি প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দেন সুইডেনে একটি কনফারেন্সে। ১৯৮০ সালে শেখ হাসিনা লন্ডনে বক্তব্য রাখেন। এ সময় দুই বোন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা নিয়ে সোচ্চার হন। ১৯৮১ সাল থেকে শেখ হাসিনা পার্টির জন্য নিরলস কাজ করেছেন; নেতৃত্ব দিয়েছেন; সততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। আর প্রেরণা জুগিয়েছেন ছোট বোন শেখ রেহানা। শেখ রেহানা লন্ডনে থাকেন। বাংলাদেশের স্থপতি ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বোন, তারপরও তাকে চাকরি করে চলতে হয়। একটা গাড়ি নেই, তার বিরুদ্ধেও মামলা করে জোট সরকার এবং পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)। বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী তখন তার ছেলে জামাল লন্ডনে সেলসম্যানের চাকরি করে নিজের পড়ার খরচ নিজে চালাতেন। পরিবারটি এ ধরনের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে বেড়ে উঠেছে। হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা দেয় ২০০৭ সালের কেয়ারটেকার সরকার। অথচ তারা কোনো দুর্নীতি খুঁজে পায়নি। যাদের গায়ে কালি নেই তাদের কালি দিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে বিএনপি-জামায়াতসহ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা। সৎ যোগ্য হয়েও তারা হয়রানির শিকার হয়েছেন বহুবার। এ দেশে মানুষের ভালোবাসা ছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিবার কিছুই পায়নি। উপরন্তু শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা রাষ্ট্রের কাছে থেকে কিছুই নেননি। রাষ্ট্রপতি পরিবার হিসেবে তো রাষ্ট্রের কাছ থেকে সবাই পায় শুধু তাঁরাই কিছু নেননি। কারণ তাঁদের ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ নেই; ছিল না কখনো।এজন্য জনগণের স্বার্থ রক্ষা করেছেন; জনগণের দিকে তাকিয়েছেন; জনগণের জন্য কিছু করেছেন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রীয় সম্পদে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা কর্তব্য মনে করে নিজের বরাদ্দকৃত বাড়িটি পুলিশকে দিয়ে দিয়েছেন। শেখ রেহানার মহানুভবতার তুলনা নেই। মানব দরদি ও মহৎ ব্যক্তির আদর্শ তিনি।

তিন

শেখ রেহানা, বঙ্গবন্ধুর এই ছোট মেয়ের (জন্ম ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৫) তিন সন্তান। একমাত্র ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং দুই মেয়ে হলেন টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী। ববি ১৯৭৮ সালের ২১ মে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্ত্রী পেপি কিভিনিয়ামি সিদ্দিক, মেয়ে লীলাতুলী হাসিনা সিদ্দিক (জন্ম ৩১ অক্টোবর, ২০১০), ছেলে কাইয়াস মুজিব সিদ্দিক (জন্ম ৩০ মার্চ, ২০১৩)। জীবনের একটা বড় অংশ দেশের বাইরে কাটালেও রাদওয়ান মুজিব শেখ রেহানার পরিবারের রাজনৈতিক আবহ ও আদর্শ নিয়েই বড় হয়েছেন। এখন একটানা এক দশকের বেশি সময় বাংলাদেশেই আছেন তিনি। এ সময়ে সরাসরি রাজনীতির মাঠে না থেকেও দেশ গড়ার কাজে সক্রিয়। বিশেষত বড় খালা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশ পরিচালনায় গবেষণাভিত্তিক তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে সহযোগিতা করছেন তিনি। সিআরআই থেকে এ কাজগুলো করা হচ্ছে।

লেখাবাহুল্য, বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স (এলএসই) থেকে গ্রাজুয়েট রাদওয়ান মুজিব বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। লন্ডনের ওই প্রতিষ্ঠানে তার অধ্যয়নের প্রধান বিষয়গুলো ছিলো গভর্মেন্ট অ্যান্ড হিস্টরি, পলিটিক্যাল থিওরিজ, ইন্টারন্যাশনাল হিস্টরি। ২০০২-২০০৩ সেশনে একই প্রতিষ্ঠান থেকে কমপারেটিভ পলিটিক্স, পলিটিক্যাল সায়েন্স, কনফ্লিক্ট রেগুলেশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি বিষয়ে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আর রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়ায় রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি প্রথম থেকেই রাজনীতিসচেতন। ২০০৮ সালের জুন মাসে শেখ হাসিনাকে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারাগার থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৭ সালে শেখ হাসিনা যখন গ্রেফতার হয়েছিলেন তখন লন্ডনে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেই সময় ববি বিখ্যাত ‘ফ্রস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর  স্যার ডেভিডকে প্রধানমন্ত্রীর গ্রেফতারের বিরুদ্ধে যে সাক্ষাৎকার দেন যা বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরিতে বিরাট ভূমিকা রাখে।

বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরে আওয়ামী লীগের হাল ধরার ক্ষেত্রে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও  সজীব ওয়াজেদ জয় বেশি উৎসাহী মনে করা হয়। অবশ্য জয় অতটা মাঠের রাজনীতি বা তৃণমূলের মানুষের সঙ্গে যুক্ত নন। তবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা। আবার প্রধানমন্ত্রীর কন্যা পুতুল রাজনীতির সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত না থাকলেও জনসেবামূলক কাজেই বেশি নিবেদিত। মার সঙ্গে সার্বক্ষণিক তার দেখা মেলে। যার ফলে অনেকেই বলেন রাজনীতিটা প্রধানমন্ত্রী হাতেকলমে শেখাচ্ছেন মেয়েকে। অন্যদিকে শেখ রেহানা রাজনীতিতে কখনো দলীয় পদে না থাকলেও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারিগর তাকে বলা হয়। প্রধানমন্ত্রী নানা সময়ে বলেছেন, ‘রেহানা আমার ছায়াসঙ্গী।’ শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেবার পার্টির তুখোড় রাজনীতিবিদ। তিনি ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে লন্ডনের হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সূত্রে খালা-মা ও বোনের পথ ধরে ববিই হতে পারেন আওয়ামী লীগের উত্তরসূরি। তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেশ গড়ার কাজে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তৃণমূলের নেতারা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর তাকে দলে ডেকে নেয়া উচিত। তাতে আওয়ামী লীগ একজন দক্ষ নেতা পাবেন। ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ৯ম বারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশ্য ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমি থাকতে নতুন নেতৃত্ব আসুক। আমি চাই বেঁচে থাকতেই নতুন নেতা নির্বাচিত করে দলকে শক্তিশালী করতে। কিন্তু তখন কাউন্সিলরা তাঁর বক্তব্য সমস্বরে প্রত্যাখান করেন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডয়চেভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে প্রধানমন্ত্রী রাজনীতি থেকে অবসরের কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে চতুর্থবার আমি প্রধানমন্ত্রী। আমি আর চাই না, একটা সময় এসে বিরতি দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি, যেনো তরুণ প্রজন্মের জন্য জায়গা করে দেওয়া যেতে পারে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি তার শেষ মেয়াদ, তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। নতুনদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে চান। অথচ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলেও তরুণ নেতৃত্বের বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

সবদিক বিবেচনায় তিনি না থাকলে তাঁর আদর্শকে বহন করতে পারবেন রাদওয়ান ববি। তাঁর হাতেই দেশ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত থাকবে। এই নেতা বাংলা ও বাঙালির আশার প্রতীক হবেন। ববি দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে সকলের বিশ্বাস। রাজনৈতিক দক্ষতা, দলীয় আনুগত্য ও পরিপক্বতা (ম্যাচিউরিটি) থাকায় ২০১৬ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের ২০ তম সম্মেলন হওয়ার আগে দলীয় নেতাকর্মীরা জয় ও ববিকে দলের মূল ধারার রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় দেখতে চেয়েছিলেন। তখন থেকেই তারা মনে করেন, আধুনিক প্রযুক্তিশীল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দলকে এগিয়ে রাখতে তরুণ নেতৃত্বের বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীপুত্র এবং শেখ রেহানাপুত্র দুজনই যোগ্য। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র হিসেবে রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সকলে। অন্যদের দাবি সত্ত্বেও ২০১৬ সালে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত না হলেও দলের বিভিন্ন কাজকর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন ববি।

বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক ধারা বহমান তা বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয় ও রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি- এই তৃতীয় প্রজন্মের নতুন নেতৃত্বের প্রতি আমাদের সকল আকর্ষণ এখন কেন্দ্রীভূত। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর বাংলাদেশে নেতৃত্বের বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। উপমহাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক ঐতিহ্য একটি ব্যাপক বিস্তারি প্রসঙ্গ। ভারতের দিকে তাকালে বর্তমান রাজনীতির পারিবারিক ধারা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। জওহরলাল নেহেরু গান্ধীর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী তাঁর পিতার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সময় মোরালি দেশাইয়ের মতো অনেক যোগ্য নেতা থাকলেও ইন্দিরা গান্ধীই হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। জুলফিকার আলী ভুট্টো, তাঁর কন্যা বেনজীর ভুট্টো, বেনজীরের স্বামী ও ছেলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা যেমন সত্য তেমনি শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েক পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় লক্ষণীয়। ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকেই রাজনৈতিক মঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন। পঁচাত্তর পরবর্তী তোফায়েল আহমেদ, প্রয়াত আবদুল জলিল, আবদুর রাজ্জাক, কামাল হোসেন প্রমুখ বড় বড় নেতারা দেশ পরিচালনায় শেখ হাসিনাকেই জনগণের সামনে দাঁড় করান। খালেদা জিয়া যেভাবে তারেক জিয়াকে রাজনীতিতে এনে দলের পদে সমাসীন করেছেন জয় কিংবা ববি’র জীবনে তেমনটি ঘটেনি। বরং জয় কিংবা ববি রাজনীতিতে নামতে পারেন ধরে নিয়ে ২০০৪ সালে ‘হাওয়া ভবনে’র মালিক তারেক জিয়াকে বিএনপি লুফে নিয়েছিল। জয় ও ববি বাংলাদেশের মৃত্তিকার সন্তান। তাঁদের রাজনীতিতে আসাটা আকস্মিক হলেও দলকে সংগঠিত করা, দলের কোন্দল মেটানো, দলকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ রাখা তাদের প্রধান কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় সবসময়।

রাদওয়ান ববি’র ভেতর রয়েছে বঙ্গবন্ধুর মতো জনগণের সঙ্গে মেশার তাগিদ। রয়েছে পরিশ্রমী ও তারুণ্যের প্রাণময়তা। এজন্য লন্ডন থেকে তাঁর এদেশে চাকরি নেয়া, রাজনীতিতে পরোক্ষভাবে যোগ দেয়া আমাদের জন্য শুভ সূচনা। দেশের মধ্যে যারা একসময় দুর্নীতি ও নাশকতার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে তাদের মসনদ কেঁপে উঠেছে তাঁর কার্যক্রমে। তিনি মূলত বঙ্গবন্ধুর মতোই তরুণসমাজকে আশাবাদী করে জাগিয়ে তোলার জন্য কাজ করে চলেছেন। একসময় তাঁর মতো বয়সে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষকে জাগিয়েছিলেন; ববিও তেমনি নির্বাচনে জয়ী এবং ইশতেহার বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দিতে সক্ষম। তাঁর ভেতর থেকে বঙ্গবন্ধুর মতোই সম্মোহনী চেতনা স্ফুরিত হচ্ছে। তিনি এদেশে অবস্থান করেই মানুষকে উজ্জীবিত করছেন। বিএনপি-জামায়াতের গাত্রদাহের কারণ এজন্য যে ববি উচ্চশিক্ষিত এবং যে বাংলাদেশ করোনা মহামারি জয় করে উন্নত রাষ্ট্রের পথে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে তার পুরোভাগে তিনি আছেন।

আমাদের মতে, শেখ হাসিনা যেমন নির্লোভ, মানুষকে ভালোবাসেন নিজের অন্তর থেকে ববিকেও তেমনিভাবে এগিয়ে যেতে হবে। বিরুদ্ধ মানুষের মন জয় করতে হবে। এজন্য ছাত্রলীগ-যুবলীগকে কাজে লাগাতে হবে। সাধারণ মানুষকে শেখ হাসিনা সরকারের কর্মসূচি ও সাফল্য বর্ণনা করতে হবে। অনেকে ভাবতে পারেন তিনি ব্রিটিশ সিটিজেন। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে শেখ রেহানা কিংবা শেখ হাসিনাও বিদেশে চলে যাবেন। যেহেতু বঙ্গবন্ধু কন্যারা এই মাটি ও মানুষের নিকটজন সেহেতু ববিও তারই ধারাবাহিকতায় মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন।

চার

এদেশে বিএনপির মতো দলের অপপ্রচার মোকাবেলা ও সরকারের সফলতা জনগণের সামনে তুলে ধরতে ভিন্ন রকম কৌশলী হতে হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের নেতারা সারা দেশে সফর করে অপপ্রচারের জবাব দিতে পারবেন না। তাই বিরোধী দলের অপপ্রচারের জবাব দিতে দলীয় নেতাকর্মীদের উৎসাহ প্রদান করতে হবে। রাদওয়ান ববি’র নেতৃত্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতোমধ্যে তরুণদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি আমাদের তরুণদের সামনে এগিয়ে যাবার প্রত্যাশায় উজ্জীবিত করেছে। একাধিক বেসরকারি টেলিভিশন-এ প্রচারিত অনুষ্ঠানে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি নানা প্রসঙ্গে গঠনমূলক রাজনৈতিক কথা বলেছেন। তিনি তরুণ শিক্ষার্থীদের নতুন চিন্তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। যদিও তাঁকে তৃণমূল জনগণ সরাসরি রাজনৈতিক মঞ্চে দেখেনি, কেবল তাঁর কথা অনুসারে শিক্ষিত যুবসমাজ কাজ করছে। তবু বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার মতো আন্তরিক হৃদ্যতায় সাধারণ মানুষকে কাছে টানার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। এর আগে তিনি দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আত্মসুখ ত্যাগ করে। বঙ্গবন্ধুর নাতি এবং শেখ হাসিনার পারিবারিক সূত্র ববিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। কারণ তিনি যে মানুষের জন্য আত্মত্যাগ করতে এসেছেন তা বোঝা সহজ। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের পক্ষে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করাটাই স্বাভাবিক।

ববি’র মতো নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব আমাদের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা ঘটাবে। রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের পদচারণা আমাদের এগিয়ে চলার পথে বাড়তি প্রাপ্তি। নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে প্রতিবছর ভোটার তালিকায় তরুণ ভোটার আসছে প্রায় অর্ধ লক্ষ। প্রায় ১০ কোটি ২১ লাখ ভোটারের মধ্যে ৫ কোটি ভোটারের বয়স ৪০ বছরের নিচে। মোট ভোটারের প্রায় ৫০ শতাংশ নতুন প্রজন্মের। তাদের জন্য নতুন প্রজন্মের নেতা অনিবার্য। ববি এসব নতুন ভোটারদের প্রত্যাশার ভাষাকে ঠিকই বুঝতে পারেন। ভবিষ্যতে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং আগামীতে আওয়ামী লীগের কমিটিতে দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি যথাযোগ্য মর্যাদায় তা পালন করতে সক্ষম হবেন।

এটা ঠিক যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ এখনো রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী দল। এখানে অন্য কোনো দলের এতো শক্তি নেই যে তারা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের সমান হতে পারে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের যে গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে তা অন্য কোনো দলের নেই। ববি সেই গৌরবকে কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যাবেন। মধ্যবিত্তের সন্তান বঙ্গবন্ধু মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের ফাঁসির ভয়কে উপেক্ষা করেছেন; জেল খেটেছেন মাসের পর মাস। সেই ত্যাগী নেতার নাতি হিসেবে ববিকে মনে রাখতে হবে, দেশের মূঢ়, মূক মানুষের মুখে দিতে হবে ভাষা। তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় নিয়েই। জাতির পিতা নিজের সন্তানকে (শেখ মনি, শেখ কামাল) রাজনীতিতে এনেছিলেন। আর তা ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। পারিবারিক পর্যায়ে তিনি যা করেছিলেন তা ছিল দেশের স্বার্থে, মানুষের মঙ্গল চিন্তা করে। অনেকেই তাঁর বাকশাল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধাচারণ করেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দেশের জন্য মমত্ববোধকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। ববি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচারে নিষ্ঠার পরিচয় দিবেন। 

পাঁচ

এখন জনগণের প্রত্যাশা নতুন ও আধুনিক একটি বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। মহামারি-কবলিত বাংলাদেশে করোনা মোকাবেলা করা এ শতাব্দীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই কাজে জয়ী হওয়ার জন্য তরুণ জনগোষ্ঠীর নেতা রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো দরকার। আগামী দিনের নেতৃত্বে মেধাবী, সৎ, ত্যাগী ও প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর তরুণদের সুযোগ দিলে দলের পাশাপাশি জাতি উপকৃত হবে। ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে দলকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। বিতর্কিত, দুর্নীতি ও পদবাণিজ্যে জড়িত, অযোগ্য ও সুবিধাবাদী প্রভাবশালী নেতাদের চেয়ে তরুণরা নিঃসন্দেহে বেশি অবদান রাখতে পারবেন। রাজনীতি স্থিতিশীল রাখা এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন গতিশীল করার জন্য ভালো নেতৃত্ব দরকার। আর দেশের কল্যাণের স্বার্থেই ববি’র মতো তরুণকে ক্ষমতায় দেখতে জনগণ উন্মুখ।

মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও শেখ রেহানার পুত্র ববি এগিয়ে এসেছেন মানুষের আকর্ষণে। শেখ হাসিনার মমত্বময় সান্নিধ্য তাঁকে রাজনীতির শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে আওয়ামী সমর্থক সকলেই খুশী হবেন। কারণ তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে নেতৃত্ব ও উন্নয়নকে একইসঙ্গে আলিঙ্গন করতে হবে। ববি হঠাৎ আবির্ভূত নেতা নন। তিনি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর আছে দৃঢ়চেতা অভিভাবকবৃন্দ। যাঁরা সকল বিষয়ে সুপরামর্শ দিতে পারঙ্গম। কখনও পথ চলতে ছিটকে পড়লে শেখ হাসিনা পরামর্শ দিয়ে ঠিক পথে আনতে পারবেন তাঁকে। কারণ ববি একান্তই খালা অনুগত।

তবে নতুন প্রজন্মের কাছে দলের আবেদন বাড়াতে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে অনেককিছু করতে হবে। ছাত্রলীগ-যুবলীগকে গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহী করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে পরিকল্পনা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজে নামতে হবে। যোগ্য ও জনগণের নেতাকে কাছে টানতে হবে। দেশ-বিদেশের রাজনীতিকে পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের কৌশলপত্র প্রণয়ন ও সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধিতে নিয়োজিত হতে হবে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীকে বাধ্যতামূলক প্রযুক্তিমুখী করতে হবে। মূল সংগঠন ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর দেশব্যাপী শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। সংগঠনের দুর্বলতা কাটানোর জন্য নেতাকর্মীদের নিয়ে সংকট উত্তরণের পথ আবিষ্কার করা খুবই জরুরি। শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনায় ববি যেমন তৎপর তেমনি নিজের নতুন নতুন ভাবনা-চিন্তা নিয়ে জনসমক্ষে হাজির হওয়া প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের নতুন কাণ্ডারী রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। তাঁর বিজয়ী অভিযাত্রা অব্যাহত থাকুক।


(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস,  বঙ্গবন্ধু গবেষক,বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

চরমপন্থীদের রূখতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্য দরকার


Thumbnail

বর্তমানে জামায়াত-বিএনপি এবং চরমপন্থী ডান এবং বাম এরা সবাই এক হয়ে গেছে। তারা প্রকাশ্যে এক হয়েছে কি হয়নি এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে তাদের কাজকর্ম দেখে বুঝা যাচ্ছে যে, তারা এক হয়েছে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপর চরম আঘাত আনার চেষ্টা করবে। এজন্য তাদের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী পাকিস্তানি আইএসআই থেকে শুরু করে সব রকম সাহায্য সহযোগিতা সবই তারা পাবে। বিদেশি অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিও তাদের টাকা পয়সা দেবে। দেশেরও বেশ কিছু ব্যবসায়ী তাদের দুকূল রক্ষার জন্য রাখার জন্য টাকা পয়সা দেবে। সুতরাং কোন দিক থেকে তাদের কোন অভাব হবে না। তারা এবার আগের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে গুছিয়ে আন্দোলন শুরু করবে। আর এই কারণে তারা এখন ভারত বিরোধী স্লোগান তুলেছে। এই ভারত বিরোধী স্লোগান তোলার পিছনে শুধু বিএনপি-জামায়াত বা চরমপন্থী বাম কিংবা ডানরাই আছে এমন না, এর সাথে বাইরের শক্তিও জড়িত।

মনে রাখতে হবে, এই শক্তি যদি কিছুটা শক্তিও ধারণ করে সেটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে। সেজন্য ‍মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যারা আছে তাদেরকে অবিলম্বে একতাবদ্ধ হতে হবে এই সমস্ত ষড়যন্ত্রকারী এবং ধর্মান্ধ ও চরমপন্থীদের প্রতিহত করার জন্য। আর এ ক্ষেত্রে আমি বলবো আওয়ামী লীগকেই এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিতে হবে, যেমনটি আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে দিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টিকেও আমি আহ্বান করবো তারাও যেন এই জোটে এক হয়ে যায়। তবে আওয়ামী লীগকে এখানে বদান্যতা দেখাতে হবে। বাম দলগুলোর কার কত ভোট কিংবা জনসমর্থন এটা মূল বিষয় হওয়ার উচিত নয়। এখানে উচিত চরমপন্থীদের প্রতিহত করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষকে এক হতে হবে। এই উদ্যোগ নিতে হবে আওয়ামী লীগকেই।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, এই মুহূর্তে এই দায়িত্ব দার্শনিক রাষ্ট্রনায়নক শেখ হাসিনা যদি আমির হোসেন আমুকে দেন তাহলে খুব ভালো হয়। কারণ আমু ভাই অত্যন্ত স্পষ্ট কথা বলেন। রাজনীতিতে চলার পথে ভুল ভ্রান্তি থাকবে। তার সমস্ত রাজনৈতিক জীবনে একটি মাত্র ভুল হয়েছে। তবে সেটা দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন। সুতরাং সেটা আর কোন বিষয় হতে পারে না। আমরা মতে, আমু ভাই ছাড়া হেভিওয়েট কোন নেতা এখন আমির ভাইয়ের মতো সক্ষম নেই। ছাত্রজীবন থেকে আমরা আমু ভাইকে দেখেছি তিনি টকশোতে অত্যন্ত পারদর্শী। আর মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত শক্তিকে এক করতে হলে এখানে আমাদের টকশো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমু ভাইয়ের নেতৃত্বে রাশেদ খান মেমন, হাসানুল হক ইনু, শেখ সেলিম সাহেব, মনজুরুল আহসান খান এরা সবাই মিলে যদি এক সাথে থাকেন তাহলে আমরা যেকোন ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে পারব।

আমাদের নিজেদের মধ্যে যতই মতপার্থক্য থাকুক না কেন আমরা অবশ্যই মিটাতে পারব। একবার না হলেও দুবার বসতে হবে, দুবারে না হলে তিনবার বসতে হবে। কিন্তু নিজেরা বসে মিটমাট করতেই হবে। আমি কোন রাজনৈতিক দলকে বিলুপ্তের কথা বলছি না। যে যে রাজনৈতিক দল থাকবে। কিন্তু সকলের সামনে একই বিপদ। যদি এই চরমপন্থীরা আবার কোন রকম ভাবে আমাদের আঘাত করে তাহলে সেখানে কে আওয়ামী লীগ, কে জাসদ, কে কমিউনিস্ট পার্টি তারা এই সব বুঝবে না। তারা যাকেই সামনে পাবে তাকেই আঘাত করবে, পুরো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপর আঘাত হানবে। এবার উপজেলা নির্বাচনগুলোতে সেরকম ঘটনা ঘটলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। কারণ সব চরমপন্থীরা এখন একত্র হচ্ছে। সেজন্য উপজেলা নির্বাচনে আমাদের একটা উপযুক্ত পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় সকলে একতাবদ্ধ হয়ে তাকে সমর্থন দিতে হবে। আমাদের আর সময় নষ্ট না করে একতাবদ্ধ হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলো যদি এক হয় তাহলে দেখা যাবে দেশের ১৮ কোটি জনগণ এক হয়ে গেছে। সুতরাং কার কতটা জোর আছে, কার কতটা জনসমর্থন আছে সেটি বিবেচনা না করে ১৪ দল সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোকে একত্রিত হতে হবে। এটাই এখন মুখ্য বিষয়। তাহলেই আমরা চরমপন্থীদের নতুন ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে পারবো। আর আমাদের তো একজন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা আছেনই। তবে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে লড়তে আমাদের একত্রিত হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।


অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী   চরমপন্থী   মুক্তিযুদ্ধ   জামায়াত-বিএনপি   ভারত বিরোধী আন্দোলন  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে কেন এই বিতর্ক


Thumbnail

স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষক বিষয়ে মাঝামাঝে কেউ কেউ অহেতুক বিতর্ক করেন। অথচ ইতিহাসের বাস্তবতা, সংবিধান এবং সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, স্বীকৃত এবং মীমাংসিত সত্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং স্বাধীনতার ঘোষক।

কয়েকদিন আগে বিএনপি নেতা মেজর অবসরপ্রাপ্ত হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম দাবি করেছেন মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা না করলে এদেশ নাকি আজও স্বাধীন হতো না। বঙ্গবন্ধুর ২৬ শে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি নাকি কল্পকাহিনী! কত বড় ধৃষ্টতা! চিন্তা করা যায়? তিনি দাবি করেছেন ২৩ শে মার্চ থেকে ইপিআর পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে। তাহলে ইপিআরের কন্ট্রোল রুম থেকে কিভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা ট্রান্সমিট করা সম্ভব? স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে মেজর হাফিজের এই মনগড়া, ভিত্তিহীন এবং অসত্য বক্তব্যের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং ইতিহাসের সত্য পাঠ থেকে তার বক্তব্য খন্ডন করছি। 

বঙ্গবন্ধু ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং সেটি দেশ-বিদেশে প্রচারিত হয়েছিলো সেটি প্রমাণের জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট। পাকিস্তানের জেনারেল টিক্কা খান এবং জেনারেল নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক রচিত "উইটনেস টু সারেন্ডার " গ্রন্থে তিনি লিখেছেন - " ২৫ শে মার্চ রাতে যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ঐ কণ্ঠের বাণী মনে হয় আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন।" বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে সিদ্দিক সালিক এর মন্তব্যের পর আর প্রমাণের কিছু বাকি থাকে? তারপরও আমরা আরো কয়েকটি ঘটনা দিয়ে প্রমাণ করবো মেজর হাফিজের বক্তব্য সর্বৈব মিথ্যা, বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন। 

আসুন দেখা যাক, ইতিহাস কি বলে? বঙ্গবন্ধু আসলেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন কি না? ইপিআরের সিগন্যাল কোরের সেন্ট্রাল সুবেদার মেজর শওকত আলি ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাত সাড়ে এগারোটা থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ইপিআর এর ওয়্যারলেসে তার নিজস্ব ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ইপিআর প্রধানের মাস্ট ব্যবহার করে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা ট্রান্সমিটরত অবস্থায় তিনি নাবিস্কো বিস্কুটের একটি টিনের কৌটা সহ রাত সোয়া বারোটায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন এবং নির্মমভাবে নিহত হন। মেজর শওকতের সাথে সে রাতে আটক হওয়া ইপিআরের সিগন্যালম্যান আব্দুল মোত্তালিব ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তার সাক্ষাৎকার থেকে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন মেজর শওকতের কন্যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিনা পারভীন। যিনি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত তার নিবন্ধে এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন। সুতরাং মেজর হাফিজের দাবি যে, ভিত্তিহীন, মনগড়া এবং বায়বীয় তা স্পষ্ট। 

এবার আসা যাক বেতারে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রসঙ্গে। ২৫ শে মার্চ বেতার কেন্দ্র পাকিস্তানীদের দখলে থাকলেও বঙ্গবন্ধু গোপনে তিনটি রেডিও ট্রান্সমিটার তিন জায়গায় প্রস্তুত রেখেছিলেন বলে বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায়। তিনটি ট্রান্সমিটারের একটি বঙ্গবন্ধুর  ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাসভবনে অতি গোপনে স্থাপন করা হয়েছিলো। বুয়েটের অধ্যাপক ডক্টর নূরুল উল্লাহ্'র সাক্ষাৎকার থেকে এ বিষয়টি জানা যায়। বঙ্গবন্ধু ডক্টর নূরুল উল্লাহ্কে তার বাসভবনে ডেকে একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিতে বলেন। ঐ ট্রান্সমিটারের সাহায্যে বঙ্গবন্ধু শেষবারের মতো দেশবাসীর উদ্দেশ্যে কিছু বলে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। পরবর্তীতে ডক্টর নূরুল তড়িৎ কৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সাথে কথা বলে একটি ট্রান্সমিটার তৈরির ব্যবস্থা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে স্থাপন করেন। এটির সম্প্রচার ক্ষমতা ছিল প্রায় বাংলাদেশব্যাপী। এই ট্রান্সমিটারের সাহায্যে বঙ্গবন্ধু তার স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করান। ডক্টর মোহাম্মদ হান্নান রচিত "বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস" গ্রন্থে এ বিষয়ের উল্লেখ আছে। 

আরেকটি ট্রান্সমিটার ছিলো বেতার বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী এ কে এম নুরুল হকের কাছে। বঙ্গবন্ধু তাকে একটি ট্রান্সমিটার জোগাড় করার কথা বললে তিনি খুলনা থেকে সেটি নিয়ে আসেন। ২৫ শে মার্চ রাত বারোটার আগে আগে সেটির সাহায্যে আগেই রেকর্ড করে রাখা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কন্যা শারমিন আহমদ তার রচিত তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা" গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর পার্সোনাল এইড হাজী গোলাম মোর্শেদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বিষয়টি উল্লেখ করেন। জনাব মোর্শেদ ২৫ শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে তাকেও সে রাতে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের সময় তার উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। পরবর্তীতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ছাড়া পান। 

হাজী গোলাম মোর্শেদ শারমিন আহমদ কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন- "২৫ শে মার্চ রাত বারোটার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসায় একটা টেলিফোন আসে। আমি সেটা রিসিভ করি।" ফোনকলে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, "আমি বলধা গার্ডেন থেকে বলছি, মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে। মেশিন নিয়ে কি করব?" পাশে থাকা বঙ্গবন্ধু কে জনাব মোর্শেদ বিষয়টি জানালে বঙ্গবন্ধু জনাব মোর্শেদের মাধ্যমে তাকে ট্রান্সমিটারটি ভেঙে ফেলে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। গোলাম মোর্শেদের সাক্ষাৎকার এবং ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলামের লেখা থেকে ফোনকলের অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে প্রকৌশলী এ কে এম নুরুল হক হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে। ২৯ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে তার মহাখালীর সরকারি বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এরপর তার আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ট্রান্সমিটারের সাহায্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কারণেই তাকে গুম করা হয়। উল্লেখ্য জনাব নুরুল হক ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের আত্মীয় এবং তার বাড়ি ছিলো কুষ্টিয়ায়। 

তাছাড়া বিবিসি বাংলা, ভয়েস অব আমেরিকা, দি ডেইলি টেলিগ্রাফ লন্ডন পত্রিকা, দি গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস সহ বিশ্বের প্রায় পঁচিশ টি গণমাধ্যম ফলাও করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর প্রকাশ করে ২৬ এবং ২৭ মার্চে। উপরের ঘটনাপ্রবাহ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বঙ্গবন্ধু ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। মেজর হাফিজ দাবি করেছেন জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক। অথচ ইতিহাসে এর বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায় না। মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাটস্থ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে ২৭ শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন মাত্র। 

ঘোষণাটি ছিল এরুপ " আই মেজর জিয়া অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হেয়ারবাই ডিক্লেয়ার্ড দি ইন্ডিপেন্ডেন্স অব বাংলাদেশ, জয় বাংলা।"

একই বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ শে মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান, বেতার কেন্দ্রের প্রধান সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, বেতার ঘোষক আব্দুল্লাহ্ আল ফারুক, মাহমুদ হোসেন, সুলতানুল আলম সহ আটজন স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন। অর্থাৎ মেজর জিয়াউর রহমানের আগে আরও ৮ জন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। মেজর হাফিজের দাবি সঠিক হলে তারা প্রত্যেকেই হবেন স্বাধীনতার ঘোষক! সেক্ষেত্রে জিয়াউর হবেন স্বাধীনতার নবম ঘোষক!! 

জিয়াউর রহমান ২৫ শে মার্চ ষোলশহর স্টেশন হেডকোয়ার্টারে ছিলেন। ২৫ শে মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা নতুনপাড়া সেনানিবাসের ঘুমন্ত বাঙালি সৈন্যদের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে প্রায় ২৫০ বাঙালি সৈন্যকে হত্যা করে। শতশত বাঙালি সৈন্য আহত এবং আটকে পড়েন। জিয়াউর রহমান এই খবর পেয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সদস্যদের প্রতিরোধ কিংবা আটকে পড়া আহত বাঙালি সৈন্যদের উদ্ধারে এগিয়ে না গিয়ে রাত তিনটার দিকে ষোলশহর স্টেশন হেডকোয়ার্টার থেকে তার সঙ্গে থাকা প্রায় আড়াইশো সৈন্য, গোলাবারুদ এবং যানবাহন নিয়ে বোয়ালখালী পালিয়ে যান। পরে সেখান থেকে পটিয়া চলে যান। চট্টগ্রামের বিখ্যাত গেরিলা যোদ্ধা সিরু বাঙালি'র লেখা "যুদ্ধের ময়দান থেকে মেজর জিয়ার পলায়ণ" গ্রন্থে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। 

২৭ শে মার্চ বেতার কেন্দ্রের সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ এবং আবুল কাশেম সন্দ্বীপ সহ কয়েকজন পটিয়ায় গিয়ে তাকে বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করলে তিনি ২৭ শে মার্চ ঠিক সন্ধ্যায় তাদের সাথে তার অধীনে থাকা ফোর্স সহ আসেন এবং বেলাল মোহাম্মদের অনুরোধে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। অবশ্য পরদিন ২৮ শে মার্চ তিনি হঠাৎ করেই বেতার ঘোষণায় নিজেকে সরকার প্রধান হিসেবে দাবি করেন। ঘোষণাটি ছিল- "আই হেয়ারবাই ডিক্লেয়ার্ড মাইসেল্ফ প্রভিশনাল হেড অব দ্যা গভর্নমেন্ট  অব বাংলাদেশ।""

এই ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বেতার কেন্দ্রের সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ সহ বেতারের সবাই অসন্তোষ প্রকাশ করেন। আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান তাকে টেলিফোন করেন। শমসের মোবিন চৌধুরী টেলিফোন কলটি রিসিভ করলে জিয়ার ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুর নাম না থাকায় হান্নান সাহেব বিস্ময় প্রকাশ করেন। শমসের মোবিন ও তার সাথে একমত পোষণ করেন। পরে রাতে জনাব মোবিন জিয়াউর রহমান কে এই বিষয়ে জানালে তিনি বলেন অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণায় থাকতে হবে। পরদিন ২৯ শে মার্চ জিয়াউর রহমান তার ঘোষণাপত্র সংশোধন করে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। 

সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটে ৩০ শে মার্চ। এদিন দুপুর আড়াইটার দিকে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্যাবর জেট থেকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের উপর গোলাবারুদ বর্ষণ করলে ভীতসন্ত্রস্ত মেজর জিয়া এক ঘন্টার নোটিশে ভারতে যাওয়ার কথা বলে রামগড়ে পালিয়ে যান! যার বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা তিনি তা না করে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেলেন! অথচ তাকেই আজকে স্বাধীনতার মহানায়ক বানানোর কতই না অপচেষ্টা! 

বাংলাদেশের দীর্ঘ ২৩ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ এতো ঠুনকো বিষয় নয় যে একজন সামান্য মেজর স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন আর দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের বিশালতা সমূদ্রসম এবং বঙ্গবন্ধু হলেন এককভাবে সেই সমূদ্র। জিয়াউর রহমানরা সেই সমূদ্রের কয়েকটি নুড়িপাথর মাত্র, তাকে বড় বানাতে চাইলে বড়জোর কয়েক বালতি পানি পর্যন্ত বিবেচনা করা যায়। এর বেশি নয়। 

যারা জিয়াউর রহমান কে স্বাধীনতার ঘোষক বানাতে চান কিংবা ঘোষক হিসেবে মনে করেন তাদেরকে মস্তিষ্কহীন মনে না করার কোনো কারন দেখি না। মেজর জিয়াউর রহমান  পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের  নির্বাচিত ৪৬৭ জনেরও একজন ছিলেন না। তাদের নেতা তো দূরের কথা। জাতীয় পরিষদের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং প্রাদেশিক পরিষদের নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। সুতরাং স্বাধীনতা ঘোষণার এখতিয়ার একমাত্র এই দু'জনের ছিল। এমনকি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবেরও ছিলো না, সরকারের কর্মচারী মেজর জিয়াউর রহমান তো দূরের কথা!

বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দ। বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যদি ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং স্বীকৃত ভূখন্ড, ১৭ কোটি মানুষ এবং একটি সরকারের সমষ্টি হয় তাহলে বঙ্গবন্ধু একাই হচ্ছেন সেই ভূখণ্ড, ১৭ কোটি মানুষ এবং সরকার। তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবরা হচ্ছেন সেই ভূখণ্ড, জনতা এবং সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জিয়াউর রহমান হলেন একজন ব্যক্তি যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো অংশ নন। দৈবক্রমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ভাগ্যক্রমে বীরউত্তম খেতাব পেয়েছেন। এমন বীরউত্তম আছেন আরও ৬৮ জন। জিয়াউর রহমানের তুলনা হতে পারে সেই ৬৮ জনের সাথে। জিয়াউর রহমান এগারো সেক্টর কমান্ডারের একজন। সুতরাং তার তুলনা হতে পারে ঐ এগারো জনের সাথে। সেক্ষেত্রে ও অবদানের বিবেচনায় তার অবস্থান হবে নিচের দিকেই।

মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, খুলনা মহানগর।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

ভারতীয় পণ্য বর্জন: রাজনীতির কানাগলিতে প্রবেশ বিএনপির


Thumbnail

যার গন্তব্য স্থান কোথায় সেটা ঠিক নাই, তিনি রাস্তায় গাড়ি বা রিক্সা যেভাবেই যান না কেন সে শুধু উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবেন। কারণ তার তো গন্তব্য ঠিক নাই। সে গুলশান যাবে, না নিউ মার্কেট যাবে কোথায় যাবে জানে না। বিএনপির অবস্থা এখন ঠিক তাই। তারা জানেই না তাদের আন্দোলনের গন্তব্য কোথায়। জানে না বলেই তারা একের পর এক ভুল করে রাজনীতির কানাগলিতে ঢুকে যাচ্ছে। এর একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো হঠাৎ করে তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে যে, ভারতীয় পণ্য বর্জন সম্ভব কিনা? এখানে একটা কথা উল্লেখ্য করতে চাই যে, এদেশের জনগণ কার কথায় বিশ্বাস করেন? জনগণ বিশ্বাস করেন একমাত্র দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কথা। কারণ তিনি যেটা বলেন সেটা করেন। তিনি যদি কোন প্রশ্নবোধক ডাকও দেন তাহলেও বহু লোক সেটাকে গ্রহণ করবে। কারণ তার প্রতি তাদের বিশ্বাস আছে। আর যে দলের নেতারা প্রায় সবাই হয় সাজাপ্রাপ্ত অথবা জামিনে আছে তাদের কথায় কোন লোক কানে দিবে না।

দ্বিতীয়ত হচ্ছে যারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের কথা বলছেন তারা তো ভোরে উঠেই আগে ভারতীয় টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করেন। দৈনন্দিন জীবনে যা ব্যবহার করি সবই তো ভারতীয় পণ্য। আমাদের বাজারে কোন জিনিস কিনতে গেলে তো ভারতীয় পণ্যটিই বেশি খুঁজি। তাহলে এখন কি আপনারা পেস্ট দিয়ে ব্রাশ না করে কয়লা ব্যবহার করতে চান? সেটা আপনারা করতে পারেন। কয়লার আজকাল দামও অনেক। আবার ঝামেলা হলো সহজে যাওয়া যায় না। সুতরাং সেটাও আপনাদের জন্য অসুবিধা।

কথায় আছে পাগলে কি না বলে ছাগলে কিনা খায়। সে ধরনের একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি আপনারা দিয়ে দিলেন কোন কিছু না ভেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর মধ্য দিয়ে আপনারা আরও রাজনৈতিক গহ্বরে ঢুকে গেলেন। এখন ভাবে ঢুকছেন সেখান থেকে আর কোন দিন বের হতে পারবেন কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।

আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে বাস করি। এখন বিশ্বের কোন দেশেরই নিজস্ব পণ্য বলে কিছু নেই। আমাদের সবাইকে সবার ওপর নির্ভর করতে হয়। সেখানে আপনারা ভারতকে বর্জন করবেন কি করে। ভারত তো সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশি দেশ। তার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করেছি। সে সময় আমাদের ৩০ লাখ সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। এর সাথে আরও ১০ থেকে ১৫ হাজজার ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের জন্য বাংলাদেশের মাটিতে তাদের রক্ত ঝড়িয়েছেন। আামরা না হয় আমাদের দেশের জন্য রক্ত দিয়েছি। কিন্তু ভারতীয়রা তো জীবন দিয়েছে প্রতিবেশির জন্য। সুতরাং ভারতের সাথে আমাদের কন্ধনটা হলো রক্তের। রক্ত দিয়ে ভারতের জনগণের সাথে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব আপনি পণ্য বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ করবেন কি করে? বাসায় আপনার বউ থেকে শুরু করে বাসার কাজের মেয়ে সবাই ভারতের শাড়ি ব্যবহার করেন। তাহলে আগে তাকে বলবেন যে, আপনারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করুন।

রিজভী সাহেব বঙ্গবাজার থেকে একটি চাদর কিনে এনে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে একটা নাটক করেছেন মাত্র। বঙ্গবাজারে আরও অনেক কিছু পাওয়া যায় যেগুলো ভারতের নামে চলে। এটা আমরা জানি। রমজান মাসে ইফতারে আপনি পিয়াজু রাখছেন। এটা বাঙালিদের ইফতারের একটা ঐতিহ্য বলতে পারেন। এটা আমরা খাবই। কিন্তু পেঁয়াজ তো আসে ভারত থেকে। তাহলে এখন তো আপনাকে ইফতারে পিয়াজুও বাদ দিতে হবে। এভাবে আপনি কত বাদ দিবেন। অনেক সময় ভারত থেকে ঝড় আসে। সে সময় তাহলে বাতাসও আপনি নিবেন না। এটা বর্জন করবেন। এটা কি সম্ভব? যদি সম্ভবই না হয় তাহলে পাগলের প্রলাপ বলে কি আর আন্দোলন হয়। পাগল তো তার নিজের ভালোটা বুঝে। আপনাদের ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান দিন শেষে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকেই লাভবান করবে। কারণ আপনাদের আন্দোলনের কোন গন্তব্যই নেই। কোন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আন্দোলন করলে জনগণের কাছে যেতে পারবেন সেটাও আপনারা বুঝেন না। আপনারা পড়ে আছেন ভারতরে পণ্য বর্জনের ডাক নিয়ে। ফলে জনগণের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এদিকে চাপা পড়ে যাবে। আর সরকারও মহা আরাশ আয়েশে চলবে। আমি জানি না, কোন উৎস থেকে টাকা পয়সা পেয়ে আপনারা নতুন করে এই স্লোগান শুরু করেছেন। কিন্তু আপনাদের এই ডাকে বেনিফিশিয়ারি আওয়ামী লীগই। কারণ আপনারা এবার বিএনপিকে দলগতভাবে কবরে নামানোর জন্য প্রচেষ্টায় নেমেছেন।


ভারতীয় পণ্য   রাজনীতি   বিএনপি  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

২৫ মার্চের ভয়ালরাত্রির গণহত্যা

প্রকাশ: ১২:০০ পিএম, ২৫ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়ালরাত্রি মর্মদাহিক চেতনা প্রবাহের কালখণ্ড। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। এর আগে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের দাবি ওঠে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে।

এ কথা সকলের কাছে পরিষ্কার যে, নয়মাসে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়া নিয়ে কোনো বিতর্ক চলতে পারে না। কারণ রবার্ট পেইন তার Massacre, The Tragedy of Bangladesh গ্রন্থে ইয়াহিয়া খানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে- Kill three million of them and the rest will eat out of our hands. পাকিস্তানি শাসকদের এই সিদ্ধান্তের কারণে দৈনিক গড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষ খুন হয় সারা বাংলাদেশে। এজন্য ১৯৭১ সালে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যা চালানোর অভিযোগ আনেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের ৫টি ভয়ঙ্কর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যালীলাকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন কূটনৈতিকরা সেসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক গণহত্যার বর্ণনা দিয়ে ওয়াশিংটনে বার্তা প্রেরণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা একাধিক লেখায় এবং বিশ্বখ্যাত পত্রিকা টাইম, নিউইয়র্ক টাইমস প্রভৃতির সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানিদের গণহত্যা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। উপরন্তু ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে গঠিত ‘হামাদুর রহমান কমিশন’ তাদের পরাজয় অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রমাণ পায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনে ঘটনার। আর এই ভয়ঙ্কর গণহত্যায় কেঁপে উঠেছিল বিশ্ববিবেক। জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবিশংকর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেন। দার্শনিক আঁদ্রে মালরোর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘আন্তর্জাতিক ব্রিগেড’। প্যারিস ও লন্ডনে সরব হয়ে ওঠেন মানবতাবাদী নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা ব্যাপক এবং নিষ্ঠুরতার দলিল হিসেবে আজও বিশ্বকে নাড়া দেয়।

আসলে বিংশ শতাব্দীতেই ঘটেছে কোটি মানুষের প্রাণসংহার। বিশ্বযুদ্ধ ও জাতিনিধনের সেই পরিকল্পিত ও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ‘জেনোসাইড’ অভিধা পেয়েছে। হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের বন্দিশিবির সেই জেনোসাইডের নির্মম ইতিহাসের কথা বলে। অ্যান্থনী মাসকারেনহাস তাঁর ‘দ্যা রেপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থের ‘গণহত্যা’ অধ্যায়ে লিখেছেন ‘সারা প্রদেশ জুড়ে হত্যাকাণ্ডের সুব্যবস্থার নমুনার সঙ্গে জেনোসাইড বা গণহত্যা শব্দটির আভিধানিক সংজ্ঞার হুবহু মিল রয়েছে।’ তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার মুখ থেকে জেনেছিলেন গণহত্যার লক্ষবস্তু ছিল- ক) বাঙালি সৈনিক, পুলিশ, আনসার প্রভৃতি খ) হিন্দু সম্প্রদায় গ) আওয়ামী লীগের লোক ঘ) কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ঙ) অধ্যাপক ও শিক্ষক যাঁরা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তবে তিনি এটাও লক্ষ করেছিলেন যে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ছিল নির্বিচার। নিরপরাধ, সাধারণ মানুষকেও শত্রু হিসেবে গণ্য করেছিল তারা। তাছাড়া তাদের গণহত্যা ছিল ‘শোধন প্রক্রিয়া’ যাকে শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান বলে মনে করত। সেই সঙ্গে এই বর্বরোচিত উপায়ে প্রদেশটিকে উপনিবেশে পরিণত করাও ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য। পাকিস্তানিদের ভাষ্য ছিল- ‘বিচ্ছিন্নতার হুমকি থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে চিরদিনের জন্য পবিত্র করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সেজন্য যদি বিশ লাখ লোককে হত্যা করতে হয় এবং প্রদেশটিকে তিরিশ বছরের জন্য উপনিবেশ হিসেবে শাসন করতে হয়, তবুও।’ শাসকদের এ ধরনের মানসিকতার সঙ্গে পশ্চিমাংশের মানুষের ঐক্য ছিল। আর এজন্যই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ হলেন গণহত্যার নীরব দর্শক।’

বাংলাদেশে ১৯৭১-এ পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দোসর আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ, ব্যাপক ধ্বংসলীলা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, হিন্দু জনগোষ্ঠী নিধন ও বিতাড়ন, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতন, মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল। বাঙালি জাতির প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে তাদের ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হয়েছিল। সুপরিকল্পিত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ জেনোসাইড হিসেবে গণ্য হয়েছে। হিটলারের নাজি বাহিনী ইহুদি ও রাশিয়ার যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে যে বর্বরতা দেখিয়েছিল ঠিক একইরকম আচরণ ছিল পাকিস্তানিদের। নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা এবং সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ছিল ঠিক ইহুদিদের প্রতি নাজিদের মতো। নাজিরা ইহুদিদের নিচুজাতের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করত এবং তাদের নিধনযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিল। অনুরূপভাবে পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের মনোভাব ছিল Bengalees have been cleansed and selected properly for at least one generation. নাজিরা প্রথমে তরুণ, যুবক এবং সমর্থ পুরুষদের হত্যা দিয়ে নিধনযজ্ঞ শুরু করলেও শিশু, বৃদ্ধ, নারীদের নির্বিচারে নিধন করতে থাকে ১৯৪১ সালে বলকান অঞ্চল থেকে। যুদ্ধবন্দি হত্যাসহ অন্যান্য নিষ্ঠুরতায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছায় তারা। তাদের অত্যাচারের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাদের আরো মিল রয়েছে হিন্দু নিধনের ঘটনায়। একাত্তরে হিন্দুদের প্রতি শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সুচিন্তিত ও নির্মম।

কারণ তারা ধর্মভিত্তিক হত্যাকাণ্ডকে বৈধ করে তুলেছিল। তারা মনে করত পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে এই উপমহাদেশের হিন্দু আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র আবাসভূমির জন্য মুসলমানদের বিদ্রোহের কারণে। এই হিন্দু বিদ্বেষ মনোভাব বছরের পর বছর লালিত হয়ে এসেছে। এজন্য জেনোসাইডে হিন্দু নিশ্চিহ্ন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। জনৈক গবেষকের ভাষায়- ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর গোটা দেশে কেবল একটি উদীয়মান ও অস্তগামী রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হয়নি একাধিক জাতিগত দ্বন্দ্বও শুরু হয়ে যায়। এতে উভয়পক্ষের নির্যাতন শুরু হয় তবে এর সূত্রপাত ঘটে ২৫শে মার্চের আক্রমণের পর।  পাকিস্তানি সরকারের পরিকল্পনার শিকার হয় দুই জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি। এর প্রথম শিকার হয় হিন্দু সম্প্রদায়, যাদের কেবল নির্যাতন করা হয়নি বরং তাকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি ধ্বংসও করা হয়।  হিন্দুরা তাদের হৃত অবস্থান কোনদিন উদ্ধার করতে পারেনি বাংলাদেশেও। সম্প্রদায়গতভাবে তারাই ১৯৭১ সালের  সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী।’ এমনকি ধর্ষণকেও তারা বৈধ বলে মনে করত। চীনের নানকিং-এ জাপানি সেনা কর্তৃক ধর্ষণ, রাশিয়াতে নাৎসিদের বলাৎকার এবং আর্মেনিয়া ও বসনিয়ার নারী নির্যাতনের সাযুজ্য রয়েছে বাঙালি নারী ধর্ষণের ঘটনায়। পাকিস্তানিদের বাঙালি নারী ধর্ষণের লক্ষ ছিল পরিবার, সম্প্রদায় ও জাতিকে মানসিকভাবে আহত ও পঙ্গু করা। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধে পরাজিত ও বাঙালি জাতিকে বশীভূত করতে না পারার যাতনা তারা মিটাত নারী ধর্ষণ করে। এটা ছিল ভয়ঙ্কর মনোবিকারজাত। সার্বরা মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করেছিল ইথনিক ক্লিনজিং-এর উপায় হিসেবে। দেশ-বিদেশী গবেষক ও সাংবাদিকদের রচনায় যুদ্ধকালীন এসব নির্মম বাস্তবতাই উন্মোচিত হয়েছে।     

বিশ শতকের জেনোসাইডের তালিকায় পাকিস্তান একটি অপরাধী রাষ্ট্রের নাম। কারণ লাখো বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে তারা সেদিন তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছিল। অথচ বাঙালি জাতিগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর কোনোরূপ অন্যায় পীড়ন করেনি। তবু বাঙালির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বর্বর ও নৃশংস আচরণ বিশ্বের কাছে তাদের ঘৃণ্য মানসিকতাকে প্রকাশ করে দিয়েছিল। পাকিস্তানিদের আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড ছিল ফ্যাসিস্টদের মতো। তাই তারা পোষণ করেছিল জাতি বা ধর্ম সম্প্রদায় বিদ্বেষ; হত্যা করেছিল নিরীহ নিরপরাধ জনসাধারণকে। সেই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড আমাদের ২৫ মার্চের দাবিকে আরো বেশি তাৎপর্যবহ করে তুলেছে। ২৫ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হবে পৃথিবীর মানব জনগোষ্ঠীকে নির্মম নিধনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উচ্চকণ্ঠ এবং হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একমাত্র ভরসার দিন। আশা করা যায় এই দিবসের চেতনা গণহত্যার বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করবে।


২৫ মার্চ   গণহত্যা দিবস  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বিএমআরসি আজ গবেষণায় পথিকৃৎ


Thumbnail

সাম্প্রতি ‘স্বাধীনতা সুফল পেতে চাই চিকিৎসা বিজ্ঞান গবেষণা জাতির পিতার হাতে সূচনা, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা দিলেন দিক নির্দেশনা’ শীর্ষক এক গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিপ্রেক্ষিতের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ বোরহান কবীর। বৈঠকে আলোচক হিসেবে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ যে আলোচনা করেছেন তার চুম্বক অংশ প্রকাশ করা হলো।

বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেশের উন্নয়নের জন্য চিকিৎসা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি সবচেয়ে জরুরি। চিকিৎসার যদি উন্নতি না হয়, চিকিৎসা ব্যবস্থার যদি উন্নতি না হয়, মানুষ যদি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হন তাহলে দেশ গড়া সম্ভব নয়। সেজন্য বঙ্গবন্ধু একটা সুন্দর নীতিমালা পরিকল্পনা গড়ে তোলেন। ওই সময়ই সেটা ছিল আধুনিক যুগোপযোগী এবং বিজ্ঞানসম্মত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বঙ্গবন্ধু যে নীতিমালা তখন চালু করে গিয়েছেন সেই পদ্ধতিতে আজকের দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা একে এক করে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। যার মূল ভিত্তি বঙ্গবন্ধু স্থাপন করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে শুধুমাত্র রাজধানী কেন্দ্রিক ছিল এমনটা না, এটা ছিল জেলা বা ওই সময় মহকুমা, থানা, ইউনিয়ন, এমনকি গ্রাম পর্যায়ে। যেটা আজকের কমিউনিটি ক্লিনিক এবং এটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। ওই সময় বঙ্গবন্ধু কমিউনিটি ক্লিনিক বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। কিন্তু আজ তারই উত্তরসূরি তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরেই এই কমিউনিটি ক্লিনিক পূর্ণতা পেয়েছে। যা সারা পৃথিবীর জন্য একটা রোল মডেল। জাতিসংঘ এটাকে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ স্বীকৃতি দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে জাতিসংঘে কোন ব্যক্তির নামে এরকম রেজ্যুলেশন নাই। 

স্বাধীনতার পর যে স্বাস্থ্য তা সম্পূর্ণ একটা নড়বড়ে ও ভঙ্গুর ছিল। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার পরপর ডাক্তারদের প্রথম শ্রেণির মযার্দা দেন। এমবিবিএস করার পর উচ্চশিক্ষা ছিলো না, গবেষণারও কোন সুযোগ ছিলো না। বঙ্গবন্ধু তখনই আইপিজিএমআর প্রতিষ্ঠা করেন। শেখ হাসিনার হাত ধরে আজ তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যতম বিদ্যাপীঠ হিসেবে সুপরিচিত। বিশ্বেও এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। 

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিএমআসি ছিল নখহীন, দন্তহীন ঘুমন্ত একটি প্রতিষ্ঠান। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিলে অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর হাতে তিনি দায়িত্ব দেন। দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বিএমআরসি আজ গবেষণায় পথিকৃৎ। তবে আমাদের আত্মতৃপ্তির সুযোগ নাই। কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডাক্তারদের গবেষণার কাজের মনোনিবেশ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নিজেই খবু আগ্রহী। সবক্ষেত্রে গবেষণা হচ্ছে শুধু ডাক্তাররাই মনে হয় এক্ষেত্রে একটু দুর্বল। গবেষণা আমরা এখনও পিছিয়ে। এটা আমাদের আরও এগিয়ে নিতে হবে। এর জন্য যা যা দরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তা করতে প্রস্তুত আছেন। এখন আমাদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন