আজ ২১ মে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র জন্মদিন। ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই এক অনুষ্ঠানে ছোট বোন শেখ রেহানার এই ছেলের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন- ‘ববি সিআরআই এ পরিচালক হিসেবে কাজ করে। ইউএনডিপিতেও কাজ করে। সরকারের অনেক উদ্ভাবনী আইডিয়াতে সে কাজ করছে। সে নীরবে কাজ করে।’ ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেন নিজেকে। এর আগে অবশ্য ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের আক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পে দুই বছর মেয়াদে দায়িত্বে ছিলেন তিনি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাইবার প্রচার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ববি ওই প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন। তখন জাতীয় নির্বাচনে অনলাইন প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আর অনলাইনভিত্তিক প্রচার বা সাইবার স্পেসের মূল দায়িত্বে ছিলেন ববি। সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক মাঠ দখল ও নির্বাচনে জয়লাভের কৌশল হিসেবে ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কাজ নিয়ে ‘আপনি জানেন কি’ শিরোনামে ১৭টি প্রামাণ্য চিত্র এবং অন্যান্য সরকারের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নের তুলনামূলক ১৯টি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি এবং নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে আসার অনুষ্ঠান ‘ইয়াংবাংলা’র পেছনের অন্যতম মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ববি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একইভাবে আওয়ামী লীগের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ সকল রাজনৈতিক দল সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ফলে প্রচার-প্রচারণা করে যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচনে জয়ী করার কৌশল গ্রহণ করতে হয় শেখ হাসিনার দলকে। রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র নেতৃত্বে একঝাঁক তরুণ অনলাইন মিডিয়া ব্যবহার করে তৃণমূল জনগোষ্ঠীর কাছে নৌকা প্রতীক পৌঁছে দিতে সক্ষম হন সেসময়। এজন্য ভারতের ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ লিখেছিল- ‘ভারতের লোকসভা নির্বাচনে নেতৃত্ব দেন ইন্দিরা গান্ধীর দৌহিত্ররা তেমনি ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ববি ও জয়।’
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ভাগ্য পরিবর্তনে
কাজ করে যাচ্ছেন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। এক্ষেত্রে ‘ইয়াংবাংলা’, ‘জয়বাংলা কনসার্ট’
এবং ‘মুজিব’ সিরিজের কাজের কথা প্রথমেই মনে আসবে। তিনি ভাগ্য পরিবর্তনের আইকন। তিনি
আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) এর ট্রাস্টি।
সিআরআই’র হেড অব স্ট্রাটেজি অ্যান্ড প্রোগ্রাম হিসেবে কাজ করছেন যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা
করা ববি।
তার সুযোগ্য নেতৃত্ব ও পরামর্শে পরিচালিত
‘সিআরআই’ ও ‘ইয়াংবাংলা’র ব্যানারে তিনি নতুন জীবনের সন্ধান দিচ্ছেন যুবসমাজকে। নতুন
প্রজন্মকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে নেওয়া অন্যতম কর্মসূচি ‘ইয়াংবাংলা’ সারাদেশে
জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একইসঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে করে তুলেছে উজ্জীবিত। এই কর্মসূচির অন্যতম
পরিকল্পনাকারী তিনি। তার নির্দেশনায় প্রকাশিত হচ্ছে ‘মুজিব’ নামের একটি শিশুতোষ প্রকাশনা।
শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অবলম্বনে গ্রাফিক নভেল সিরিজ মুজিব-৬ পর্বের
পর নতুন পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে সিআরআই-এর উদ্যোগে। জীবনীভিত্তিক এই প্রকাশনার মধ্য দিয়ে
দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরতে ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হচ্ছে এই গ্রাফিক নভেলটি। ইংরেজির পাশাপাশি আরো কয়েকটি বিদেশি ভাষায় প্রকাশ
পাচ্ছে বইটি। আসলে রাদওয়ান মুজিব রাজনৈতিক কোনো পদে না থাকলেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক
অঙ্গনে একটি সুপরিচিত নাম। বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা
উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় থেকেও তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর জয়বাংলা কনসার্টের
আয়োজন করে আসছে বাংলাদেশের তরুণদের অন্যতম বড় প্লাটফর্ম ইয়াংবাংলা। মুজিববর্ষ এবং তার
আগে তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় চেতনায় উদ্দীপিত করেছে আয়োজিত এসব কনসার্ট। কারণ কনসার্টের
বড় অংশ জুড়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের গান। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণ
উপলক্ষে ২০১৮ সালে জয়বাংলা-কনসার্ট আয়োজন করে ইয়াংবাংলার সেক্রেটারিয়েট সেন্টার ফর
রিসার্চ এ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। চতুর্থবারের মতো চলা ইয়াংবাংলার ওই আয়োজনে উপস্থিত
ছিল এ প্রজন্মের সম্ভাবনাময় মুখগুলো। দেশাত্মবোধে নিজের চেতনাকে আরও একবার ঝালিয়ে নিতে
কনসার্টকে দারুণভাবে স্বাগত জানায় তরুণ প্রজন্ম।
রাদওয়ান মুজিব ববি ২০১৮ সালে বলেছেন, তরুণদের
লবিস্ট হিসেবে কাজ করবে ‘ইয়াংবাংলা’। সেসময়
তিনি মাইক্রোসফট ইয়াংবাংলা সামিটের সমাপনী অনুষ্ঠানে ছিলেন যে সামিটে অংশ নেয় সারাদেশের
২৫০ টি দল। অংশগ্রহণকারী দল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ অবকাঠামো
নানা বিষয়ে উদ্ভাবনী প্রস্তাবনা নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। বিজয়ী দলগুলোকে সম্মাননাসহ প্রস্তাবিত
আইডিয়া বাস্তবায়নের অর্থ দেয়া হয়। ২০২০-২০২২ সালে মুজিববর্ষে তরুণদের চিন্তা চেতনার
সঙ্গে মিল রেখে ইতিহাসকে উপস্থাপন করা উচিত বলে জানিয়েছিলেন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক।
এ সময় তিনি তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ পদ্ধতি কেমন হবে তা নিয়ে সকলের ভাবা উচিত
বলে মন্তব্য করেন।
দুই
বঙ্গবন্ধু-দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক
ববি’র অবদানের কথা বলতে গেলে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিবারের উল্লেখযোগ্য দিক সম্পর্কে
আলোকপাত করা দরকার। ১৯৭৫ সালে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা কয়েক বছর আগে দশম জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, তিনি ও তার সন্তান এবং বোন রেহানা ও
তার সন্তানদের নিয়েই তার পরিবার। এর বাইরে তার পরিবারে আর কোনো সদস্য নেই। তবে তিনি
রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে লিখেছেন- ‘একদিকে জনগণ এবং অন্যদিকে আমার সন্তান কাউকেই আমি
ভিন্ন চোখে দেখতে পারি না।’ প্রধানমন্ত্রীর পিতা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক
চেতনার দিশারি, স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী, ছেলে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, মেয়ে আধুনিক শিক্ষায়
শিক্ষিত। একটি পরিপূর্ণ আলোকিত পরিবারের প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী বাল্যকাল থেকেই পিতার
রাজনৈতিক আদর্শে বেড়ে উঠেছেন। এজন্য শেখ হাসিনা পরিবারের ঔদার্য বিশাল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
অনেক ঘটনা দিয়ে সেই উদার-হৃদয়ের মানুষদের আমরা চিনতে পারি।
মহাজোট সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন
শেখ রেহানার নামে বরাদ্দকৃত বাড়িটি সরকারি কাজে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার ঘটনাটি অধিকাংশ মানুষের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ
মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে ২০০১ সালে ১১ জুলাই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী
ধানমণ্ডিতে এক বিঘা জমির প্লটে একতলা একটি বাড়ির মালিকানা পান শেখ রেহানা। তৎকালীন
সরকারের পক্ষ থেকে বিক্রয় দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন করে দেয়া হয় এবং বাড়িটি তার
নামে ‘নামজারি’ও হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে সেই বরাদ্দ না
মেনে বাড়িটি ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশকে দিয়ে দেয়। তবে শেখ রেহানার পক্ষ থেকে হাইকোর্টে
রিট করায় মামলাধীন বাড়িটির বরাদ্দপত্র বাতিল করতে ব্যর্থ হয় জোট সরকার। প্রায় ২০০ কোটি
টাকা মূল্যের সরকারিসূত্রে পাওয়া বাড়িটি নিজের দখলে আনার চেষ্টা না করে আনুষ্ঠানিকভাবে
হস্তান্তর করেছেন শেখ রেহানা। নামমাত্র ১০০১ টাকা মূল্যে সরকারের কাছে বাড়িটি দলিল
করে দিয়েছেন তিনি। এ ঘটনা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সন্তান হিসেবে তার পক্ষেই ঘটানো সম্ভব।
কারণ শেখ মুজিবুর রহমানও বাল্যকাল থেকে পরের দুঃখ-কষ্টকে উপলব্ধি করতে শিখেছিলেন আর
নিজে ধনপতি না হয়ে সাধারণ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত ছিলেন। ২০০১-০৬ পর্যন্ত
রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে জোট সরকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অনেককেই প্লট বা বাড়ি বরাদ্দ
দিয়েছে। কিন্তু কেড়ে নিয়েছিল এ দেশের গর্বিত সন্তান শেখ রেহানার বাড়িটি। মনে রাখা দরকার
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর ধানমন্ডির পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত
ঐতিহাসিক বাড়িটি বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা নিজেরা ভোগদখল না করে ‘স্মৃতি জাদুঘর’
করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অথচ জাতির পিতার কন্যাদ্বয়ের নিরাপদ আবাসনের
ব্যবস্থা রাষ্ট্রেরই করা উচিত। আমরা দেখলাম বিপরীত চিত্র শেখ রেহানার বাড়িটি দখলের
জন্য জোট সরকার ২০০৫ সালে থানা হিসেবে উদ্বোধন করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া
উপস্থিত হয়েছিলেন সেখানে। বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি বিদ্বেষের কারণ কি? পক্ষান্তরে শেখ
রেহানা নিজের বাড়িটি স্বেচ্ছায় জনস্বার্থে পুলিশকে দিয়ে দিয়েছেন।এটা বঙ্গবন্ধু পরিবারের
ঔদার্যের প্রকাশ। ব্যক্তিগত ভোগদখলের চিন্তা ত্যাগ করার এই মানসিকতা সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য।
এ জন্যই শেখ রেহানা বলেছেন- ‘এক সরকার দেবে, আরেক সরকার নেবে, এই ঝামেলায় তার দরকার
নেই।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে দীর্ঘদিন নির্বাসনে
থাকতে হয়েছে বড় বোন শেখ হাসিনাসহ শেখ রেহানাকে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো কেউ তাদের
প্রতি সদয় হয়নি। বরং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মাত্র ১০১ টাকায় তার স্ত্রী-সন্তানদের
জন্য গুলশানে ৩২ কাঠার প্লটে একটি বাড়ি বরাদ্দ করা হয়। সে সময় কেউ এর বিরুদ্ধে কথা
বলেননি। ৩২ কাঠার গুলশানের বাড়িটি বরাদ্দ পাওয়ার পরও খালেদা জিয়া ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের
মইনুল রোডের ২২৮ কাঠার বিলাসবহুল বাড়িতেই থাকতেন। প্রচলিত আইন ভেঙে একইসঙ্গে দুটি সরকারি
বাড়ি দখল করার ক্ষেত্রে দেশের মানুষ একটিবারও প্রশ্ন তোলেননি কেন? অবশেষে আদালতের রায়ে
ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি ছাড়তে হলেও তিনি প্রেস কনফারেন্স করে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানান।
আশ্চর্যের বিষয় হলো সেনানিবাসে বসে দিনের পর দিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা নিয়েও
প্রতিবাদ করেননি প্রতিক্রিয়াশীল ঘরানার বুদ্ধিজীবী মহল। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের
দলীয় রাজনীতির দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধু কন্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ শেখ রেহানা কখনো
রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এমনকি খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ঔদার্যের তুলনাও হয় না।
শেখ রেহানার মাথা গোজার ঠাঁই কেড়ে নিয়ে তাঁর নামে রেজিস্ট্রি ও নামজারিকৃত বাড়ি থেকে
কর্মরত ৯ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয় জোট সরকার। কেবল জাতির
পিতার কন্যা হওয়ায় শেখ রেহানাকে সেদিন অপদস্ত করা হয়েছিল। সেই উপেক্ষা, কুরুচিপূর্ণ
আচরণ মানুষ ভুলে যায়নি। জনগণ তার জবাবও দিয়েছে ভোটের মাধ্যমে।
শেখ হাসিনা ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়। তার
তিন ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনদের
সঙ্গে নৃশংসভাবে নিহত হন। একমাত্র বোন শেখ রেহানা তখন তার সঙ্গে জার্মানিতে। ১৯৮১ সালে
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং ১৭ মে ৬ বছর নির্বাসন শেষে দেশে ফেরেন তিনি।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পরে তাদেরও বন্দী করে রেখেছিল পাকিস্তানি
আর্মি। বন্দী মুহূর্তগুলো ছিল উৎকণ্ঠায় ভরা। পিতা জীবিত আছেন জানতে পারেন স্বাধীন দেশে
৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু প্রথমে
পরিবার নয় গিয়েছেন জনতার কাছে। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তে
তার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন পরিবারটির প্রেরণা।
মার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল দেশ স্বাধীন হবে। মায়ের কাছ থেকে শিখেছেন অনেক কিছু। স্বাধীনতার
পরে বঙ্গবন্ধু মনে করতেন বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড এবং সাউথ এশিয়ার শক্তিশালী
দেশ। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে এ দেশ। বঙ্গবন্ধুর এই ভাবনাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার ভাবনাও।
বাংলাদেশের মানুষের কথা চিন্তা করে শেখ হাসিনা
কষ্ট পান; তেমনি রেহানাও। যে মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন কষ্ট করলেন, সেই মানুষের
জন্যই নিজের জীবনটাই দিয়ে গেলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষের
ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি আমলের মতো যে কষ্ট সেই কষ্টই
পেয়েছিল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে বর্তমানে তিনি চেষ্টা করছেন মানুষের
অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য। মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে হবে, মানুষের জন্য কিছু
করতে হবে- এ ভাবনা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ সকল আওয়ামী লীগ বিশ্বাসীর।
ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার মতো শেখ রেহানারও
টুঙ্গিপাড়ার প্রতি রয়েছে গভীর টান। হিজলের স্মৃতি তাকে ডাক দিয়ে যায়; জলে ঢাকা সবুজ
ক্ষেত তাকে আহ্বান জানায়। মহান পিতার কবর স্নিগ্ধ সান্নিধ্য প্রদান করে। ১৯৭৫ সালের
৩০ জুলাই শেখ হাসিনার সঙ্গে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন বলেই প্রাণে রক্ষা পান তিনি। কলেজ
পড়ুয়া রেহানার লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছিল দেশে। কারণ তাদের ছোট বাড়িতে অনেক মানুষ; আর
রাজনৈতিক পরিবারে বিচিত্র মানুষের আনাগোনা বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এজন্য বড় বোনের
সন্তানদের দেখাশোনা ও নিজের পড়ার কাজের সুবিধার জন্য মাতৃনির্দেশ পালন করে বিদেশ পাড়ি
দেন তিনি। রাষ্ট্রপতি হয়েও বঙ্গবন্ধু একটি ছোট বাড়িতে থাকতেন। কারণ বেগম মুজিবের বিশ্বাস
ছিল বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার সন্তানরা নষ্ট হয়ে যাবে। এজন্য কখনো
রাষ্ট্রপতি ভবনে বসবাসের উদ্দেশ্যে যাননি বরং সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন। দেশে ফিরতে
না পেরে ১৯৭৬ সালে রেহানা লন্ডনে পৌঁছান। বিয়ে করেন পিতার পছন্দের পাত্রকেই। ১৯৭৭
সালে শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তিনি প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দেন সুইডেনে একটি কনফারেন্সে।
১৯৮০ সালে শেখ হাসিনা লন্ডনে বক্তব্য রাখেন। এ সময় দুই বোন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা নিয়ে
সোচ্চার হন। ১৯৮১ সাল থেকে শেখ হাসিনা পার্টির জন্য নিরলস কাজ করেছেন; নেতৃত্ব দিয়েছেন;
সততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। আর প্রেরণা জুগিয়েছেন ছোট বোন শেখ রেহানা। শেখ রেহানা লন্ডনে
থাকেন। বাংলাদেশের স্থপতি ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর
বোন, তারপরও তাকে চাকরি করে চলতে হয়। একটা গাড়ি নেই, তার বিরুদ্ধেও মামলা করে জোট সরকার
এবং পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)। বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী
তখন তার ছেলে জামাল লন্ডনে সেলসম্যানের চাকরি করে নিজের পড়ার খরচ নিজে চালাতেন। পরিবারটি
এ ধরনের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে বেড়ে উঠেছে। হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা দেয় ২০০৭ সালের
কেয়ারটেকার সরকার। অথচ তারা কোনো দুর্নীতি খুঁজে পায়নি। যাদের গায়ে কালি নেই তাদের
কালি দিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে বিএনপি-জামায়াতসহ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা। সৎ যোগ্য হয়েও তারা
হয়রানির শিকার হয়েছেন বহুবার। এ দেশে মানুষের ভালোবাসা ছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিবার কিছুই
পায়নি। উপরন্তু শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা রাষ্ট্রের কাছে থেকে কিছুই নেননি। রাষ্ট্রপতি
পরিবার হিসেবে তো রাষ্ট্রের কাছ থেকে সবাই পায় শুধু তাঁরাই কিছু নেননি। কারণ তাঁদের
ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ নেই; ছিল না কখনো।এজন্য জনগণের স্বার্থ রক্ষা করেছেন; জনগণের
দিকে তাকিয়েছেন; জনগণের জন্য কিছু করেছেন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রীয় সম্পদে
জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা কর্তব্য মনে করে নিজের বরাদ্দকৃত বাড়িটি পুলিশকে দিয়ে দিয়েছেন।
শেখ রেহানার মহানুভবতার তুলনা নেই। মানব দরদি ও মহৎ ব্যক্তির আদর্শ তিনি।
তিন
শেখ রেহানা, বঙ্গবন্ধুর এই ছোট মেয়ের (জন্ম
১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৫) তিন সন্তান। একমাত্র ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং দুই
মেয়ে হলেন টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী। ববি ১৯৭৮ সালের ২১ মে লন্ডনে জন্মগ্রহণ
করেন। তার স্ত্রী পেপি কিভিনিয়ামি সিদ্দিক, মেয়ে লীলাতুলী হাসিনা সিদ্দিক (জন্ম ৩১
অক্টোবর, ২০১০), ছেলে কাইয়াস মুজিব সিদ্দিক (জন্ম ৩০ মার্চ, ২০১৩)। জীবনের একটা বড়
অংশ দেশের বাইরে কাটালেও রাদওয়ান মুজিব শেখ রেহানার পরিবারের রাজনৈতিক আবহ ও আদর্শ
নিয়েই বড় হয়েছেন। এখন একটানা এক দশকের বেশি সময় বাংলাদেশেই আছেন তিনি। এ সময়ে সরাসরি
রাজনীতির মাঠে না থেকেও দেশ গড়ার কাজে সক্রিয়। বিশেষত বড় খালা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে
দেশ পরিচালনায় গবেষণাভিত্তিক তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে সহযোগিতা করছেন তিনি। সিআরআই থেকে
এ কাজগুলো করা হচ্ছে।
লেখাবাহুল্য, বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স (এলএসই) থেকে গ্রাজুয়েট রাদওয়ান
মুজিব বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। লন্ডনের ওই প্রতিষ্ঠানে
তার অধ্যয়নের প্রধান বিষয়গুলো ছিলো গভর্মেন্ট অ্যান্ড হিস্টরি, পলিটিক্যাল থিওরিজ,
ইন্টারন্যাশনাল হিস্টরি। ২০০২-২০০৩ সেশনে একই প্রতিষ্ঠান থেকে কমপারেটিভ পলিটিক্স,
পলিটিক্যাল সায়েন্স, কনফ্লিক্ট রেগুলেশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি বিষয়ে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন
করেন। অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আর রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়ায় রাদওয়ান মুজিব
সিদ্দিক ববি প্রথম থেকেই রাজনীতিসচেতন। ২০০৮ সালের জুন মাসে শেখ হাসিনাকে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের কারাগার থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
২০০৭ সালে শেখ হাসিনা যখন গ্রেফতার হয়েছিলেন তখন লন্ডনে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেই
সময় ববি বিখ্যাত ‘ফ্রস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর
স্যার ডেভিডকে প্রধানমন্ত্রীর গ্রেফতারের বিরুদ্ধে যে সাক্ষাৎকার দেন যা বিশ্বব্যাপী
জনমত তৈরিতে বিরাট ভূমিকা রাখে।
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার পরে আওয়ামী লীগের হাল ধরার ক্ষেত্রে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও সজীব ওয়াজেদ জয় বেশি উৎসাহী মনে করা হয়। অবশ্য জয়
অতটা মাঠের রাজনীতি বা তৃণমূলের মানুষের সঙ্গে যুক্ত নন। তবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তি
বিষয়ক উপদেষ্টা। আবার প্রধানমন্ত্রীর কন্যা পুতুল রাজনীতির সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত
না থাকলেও জনসেবামূলক কাজেই বেশি নিবেদিত। মার সঙ্গে সার্বক্ষণিক তার দেখা মেলে। যার
ফলে অনেকেই বলেন রাজনীতিটা প্রধানমন্ত্রী হাতেকলমে শেখাচ্ছেন মেয়েকে। অন্যদিকে শেখ
রেহানা রাজনীতিতে কখনো দলীয় পদে না থাকলেও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাফল্যের
পেছনে অন্যতম কারিগর তাকে বলা হয়। প্রধানমন্ত্রী নানা সময়ে বলেছেন, ‘রেহানা আমার ছায়াসঙ্গী।’
শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেবার
পার্টির তুখোড় রাজনীতিবিদ। তিনি ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে লন্ডনের হ্যামস্টেড অ্যান্ড
কিলবার্ন আসন থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সূত্রে খালা-মা ও বোনের
পথ ধরে ববিই হতে পারেন আওয়ামী লীগের উত্তরসূরি। তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেশ গড়ার কাজে
অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তৃণমূলের নেতারা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর তাকে দলে ডেকে নেয়া উচিত।
তাতে আওয়ামী লীগ একজন দক্ষ নেতা পাবেন। ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের
কাউন্সিল অধিবেশনে ৯ম বারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা। অবশ্য ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন,
আমি থাকতে নতুন নেতৃত্ব আসুক। আমি চাই বেঁচে থাকতেই নতুন নেতা নির্বাচিত করে দলকে শক্তিশালী
করতে। কিন্তু তখন কাউন্সিলরা তাঁর বক্তব্য সমস্বরে প্রত্যাখান করেন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে
ডয়চেভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে প্রধানমন্ত্রী রাজনীতি থেকে অবসরের কথা জানিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, সব মিলিয়ে চতুর্থবার আমি প্রধানমন্ত্রী। আমি আর চাই না, একটা সময় এসে বিরতি
দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি, যেনো তরুণ প্রজন্মের জন্য জায়গা করে দেওয়া যেতে পারে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার
পর টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি তার শেষ মেয়াদ,
তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। নতুনদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে চান। অথচ বাংলাদেশের
রাজনৈতিক বাস্তবতায় শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত
আওয়ামী লীগের কাউন্সিলেও তরুণ নেতৃত্বের বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
সবদিক বিবেচনায় তিনি না থাকলে তাঁর আদর্শকে
বহন করতে পারবেন রাদওয়ান ববি। তাঁর হাতেই দেশ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত থাকবে।
এই নেতা বাংলা ও বাঙালির আশার প্রতীক হবেন। ববি দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে
পারবেন বলে সকলের বিশ্বাস। রাজনৈতিক দক্ষতা, দলীয় আনুগত্য ও পরিপক্বতা (ম্যাচিউরিটি)
থাকায় ২০১৬ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের ২০ তম সম্মেলন হওয়ার আগে দলীয় নেতাকর্মীরা
জয় ও ববিকে দলের মূল ধারার রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় দেখতে চেয়েছিলেন। তখন থেকেই তারা
মনে করেন, আধুনিক প্রযুক্তিশীল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দলকে এগিয়ে রাখতে তরুণ নেতৃত্বের
বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীপুত্র এবং শেখ রেহানাপুত্র দুজনই যোগ্য। তাছাড়া
বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র হিসেবে রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সকলে।
অন্যদের দাবি সত্ত্বেও ২০১৬ সালে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত না হলেও দলের বিভিন্ন কাজকর্মে
নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন ববি।
বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক ধারা বহমান তা বঙ্গবন্ধুর
পরিবারকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা এবং তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয় ও রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক
ববি- এই তৃতীয় প্রজন্মের নতুন নেতৃত্বের প্রতি আমাদের সকল আকর্ষণ এখন কেন্দ্রীভূত।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর বাংলাদেশে নেতৃত্বের বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল।
উপমহাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক ঐতিহ্য একটি ব্যাপক বিস্তারি প্রসঙ্গ। ভারতের দিকে
তাকালে বর্তমান রাজনীতির পারিবারিক ধারা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। জওহরলাল নেহেরু
গান্ধীর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী তাঁর পিতার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সময়
মোরালি দেশাইয়ের মতো অনেক যোগ্য নেতা থাকলেও ইন্দিরা গান্ধীই হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
জুলফিকার আলী ভুট্টো, তাঁর কন্যা বেনজীর ভুট্টো, বেনজীরের স্বামী ও ছেলের রাজনীতিতে
সম্পৃক্ততা যেমন সত্য তেমনি শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েক পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় লক্ষণীয়।
ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকেই রাজনৈতিক মঞ্চে নিয়ে
এসেছিলেন। পঁচাত্তর পরবর্তী তোফায়েল আহমেদ, প্রয়াত আবদুল জলিল, আবদুর রাজ্জাক, কামাল
হোসেন প্রমুখ বড় বড় নেতারা দেশ পরিচালনায় শেখ হাসিনাকেই জনগণের সামনে দাঁড় করান। খালেদা
জিয়া যেভাবে তারেক জিয়াকে রাজনীতিতে এনে দলের পদে সমাসীন করেছেন জয় কিংবা ববি’র জীবনে
তেমনটি ঘটেনি। বরং জয় কিংবা ববি রাজনীতিতে নামতে পারেন ধরে নিয়ে ২০০৪ সালে ‘হাওয়া ভবনে’র
মালিক তারেক জিয়াকে বিএনপি লুফে নিয়েছিল। জয় ও ববি বাংলাদেশের মৃত্তিকার সন্তান। তাঁদের
রাজনীতিতে আসাটা আকস্মিক হলেও দলকে সংগঠিত করা, দলের কোন্দল মেটানো, দলকে গণতান্ত্রিক
আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ রাখা তাদের প্রধান কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় সবসময়।
রাদওয়ান ববি’র ভেতর রয়েছে বঙ্গবন্ধুর মতো
জনগণের সঙ্গে মেশার তাগিদ। রয়েছে পরিশ্রমী ও তারুণ্যের প্রাণময়তা। এজন্য লন্ডন থেকে
তাঁর এদেশে চাকরি নেয়া, রাজনীতিতে পরোক্ষভাবে যোগ দেয়া আমাদের জন্য শুভ সূচনা। দেশের
মধ্যে যারা একসময় দুর্নীতি ও নাশকতার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে তাদের মসনদ কেঁপে উঠেছে তাঁর
কার্যক্রমে। তিনি মূলত বঙ্গবন্ধুর মতোই তরুণসমাজকে আশাবাদী করে জাগিয়ে তোলার জন্য কাজ
করে চলেছেন। একসময় তাঁর মতো বয়সে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষকে জাগিয়েছিলেন; ববিও তেমনি
নির্বাচনে জয়ী এবং ইশতেহার বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দিতে সক্ষম। তাঁর ভেতর
থেকে বঙ্গবন্ধুর মতোই সম্মোহনী চেতনা স্ফুরিত হচ্ছে। তিনি এদেশে অবস্থান করেই মানুষকে
উজ্জীবিত করছেন। বিএনপি-জামায়াতের গাত্রদাহের কারণ এজন্য যে ববি উচ্চশিক্ষিত এবং যে
বাংলাদেশ করোনা মহামারি জয় করে উন্নত রাষ্ট্রের পথে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে
তার পুরোভাগে তিনি আছেন।
আমাদের মতে, শেখ হাসিনা যেমন নির্লোভ, মানুষকে
ভালোবাসেন নিজের অন্তর থেকে ববিকেও তেমনিভাবে এগিয়ে যেতে হবে। বিরুদ্ধ মানুষের মন জয়
করতে হবে। এজন্য ছাত্রলীগ-যুবলীগকে কাজে লাগাতে হবে। সাধারণ মানুষকে শেখ হাসিনা সরকারের
কর্মসূচি ও সাফল্য বর্ণনা করতে হবে। অনেকে ভাবতে পারেন তিনি ব্রিটিশ সিটিজেন। এটা মনে
করার কোনো কারণ নেই যে শেখ রেহানা কিংবা শেখ হাসিনাও বিদেশে চলে যাবেন। যেহেতু বঙ্গবন্ধু
কন্যারা এই মাটি ও মানুষের নিকটজন সেহেতু ববিও তারই ধারাবাহিকতায় মানুষের জন্য নিজেকে
উৎসর্গ করবেন।
চার
এদেশে বিএনপির মতো দলের অপপ্রচার মোকাবেলা
ও সরকারের সফলতা জনগণের সামনে তুলে ধরতে ভিন্ন রকম কৌশলী হতে হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের
নেতারা সারা দেশে সফর করে অপপ্রচারের জবাব দিতে পারবেন না। তাই বিরোধী দলের অপপ্রচারের
জবাব দিতে দলীয় নেতাকর্মীদের উৎসাহ প্রদান করতে হবে। রাদওয়ান ববি’র নেতৃত্ব বাংলাদেশের
রাজনীতিতে ইতোমধ্যে তরুণদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি আমাদের
তরুণদের সামনে এগিয়ে যাবার প্রত্যাশায় উজ্জীবিত করেছে। একাধিক বেসরকারি টেলিভিশন-এ
প্রচারিত অনুষ্ঠানে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি নানা প্রসঙ্গে গঠনমূলক রাজনৈতিক
কথা বলেছেন। তিনি তরুণ শিক্ষার্থীদের নতুন চিন্তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। যদিও তাঁকে
তৃণমূল জনগণ সরাসরি রাজনৈতিক মঞ্চে দেখেনি, কেবল তাঁর কথা অনুসারে শিক্ষিত যুবসমাজ
কাজ করছে। তবু বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার মতো আন্তরিক হৃদ্যতায় সাধারণ মানুষকে কাছে টানার
অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। এর আগে তিনি দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আত্মসুখ
ত্যাগ করে। বঙ্গবন্ধুর নাতি এবং শেখ হাসিনার পারিবারিক সূত্র ববিকে গুরুত্বপূর্ণ করে
তুলেছে। কারণ তিনি যে মানুষের জন্য আত্মত্যাগ করতে এসেছেন তা বোঝা সহজ। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের
পক্ষে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করাটাই স্বাভাবিক।
ববি’র মতো নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব আমাদের
রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা ঘটাবে। রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের পদচারণা আমাদের
এগিয়ে চলার পথে বাড়তি প্রাপ্তি। নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে প্রতিবছর ভোটার তালিকায়
তরুণ ভোটার আসছে প্রায় অর্ধ লক্ষ। প্রায় ১০ কোটি ২১ লাখ ভোটারের মধ্যে ৫ কোটি ভোটারের
বয়স ৪০ বছরের নিচে। মোট ভোটারের প্রায় ৫০ শতাংশ নতুন প্রজন্মের। তাদের জন্য নতুন প্রজন্মের
নেতা অনিবার্য। ববি এসব নতুন ভোটারদের প্রত্যাশার ভাষাকে ঠিকই বুঝতে পারেন। ভবিষ্যতে
সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং আগামীতে আওয়ামী লীগের কমিটিতে দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি যথাযোগ্য
মর্যাদায় তা পালন করতে সক্ষম হবেন।
এটা ঠিক যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী
লীগ এখনো রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী দল। এখানে অন্য কোনো দলের এতো শক্তি নেই যে তারা রাজনৈতিকভাবে
আওয়ামী লীগের সমান হতে পারে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের যে গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে তা
অন্য কোনো দলের নেই। ববি সেই গৌরবকে কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যাবেন। মধ্যবিত্তের সন্তান
বঙ্গবন্ধু মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের ফাঁসির ভয়কে উপেক্ষা
করেছেন; জেল খেটেছেন মাসের পর মাস। সেই ত্যাগী নেতার নাতি হিসেবে ববিকে মনে রাখতে হবে,
দেশের মূঢ়, মূক মানুষের মুখে দিতে হবে ভাষা। তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে বঙ্গবন্ধুর পরিচয়
নিয়েই। জাতির পিতা নিজের সন্তানকে (শেখ মনি, শেখ কামাল) রাজনীতিতে এনেছিলেন। আর তা
ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। পারিবারিক পর্যায়ে তিনি যা করেছিলেন
তা ছিল দেশের স্বার্থে, মানুষের মঙ্গল চিন্তা করে। অনেকেই তাঁর বাকশাল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধাচারণ
করেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দেশের জন্য মমত্ববোধকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। ববি বঙ্গবন্ধুর
আদর্শ প্রচারে নিষ্ঠার পরিচয় দিবেন।
পাঁচ
এখন জনগণের প্রত্যাশা নতুন ও আধুনিক একটি
বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। মহামারি-কবলিত বাংলাদেশে করোনা
মোকাবেলা করা এ শতাব্দীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই কাজে জয়ী হওয়ার জন্য
তরুণ জনগোষ্ঠীর নেতা রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো দরকার।
আগামী দিনের নেতৃত্বে মেধাবী, সৎ, ত্যাগী ও প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর তরুণদের সুযোগ দিলে
দলের পাশাপাশি জাতি উপকৃত হবে। ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে দলকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে
হবে। বিতর্কিত, দুর্নীতি ও পদবাণিজ্যে জড়িত, অযোগ্য ও সুবিধাবাদী প্রভাবশালী নেতাদের
চেয়ে তরুণরা নিঃসন্দেহে বেশি অবদান রাখতে পারবেন। রাজনীতি স্থিতিশীল রাখা এবং অর্থনৈতিক
পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন গতিশীল করার জন্য ভালো নেতৃত্ব দরকার। আর দেশের কল্যাণের
স্বার্থেই ববি’র মতো তরুণকে ক্ষমতায় দেখতে জনগণ উন্মুখ।
মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র
ও শেখ রেহানার পুত্র ববি এগিয়ে এসেছেন মানুষের আকর্ষণে। শেখ হাসিনার মমত্বময় সান্নিধ্য
তাঁকে রাজনীতির শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে আওয়ামী সমর্থক
সকলেই খুশী হবেন। কারণ তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগকে
লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে নেতৃত্ব ও উন্নয়নকে একইসঙ্গে আলিঙ্গন করতে হবে। ববি হঠাৎ আবির্ভূত
নেতা নন। তিনি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর আছে দৃঢ়চেতা অভিভাবকবৃন্দ। যাঁরা সকল
বিষয়ে সুপরামর্শ দিতে পারঙ্গম। কখনও পথ চলতে ছিটকে পড়লে শেখ হাসিনা পরামর্শ দিয়ে ঠিক
পথে আনতে পারবেন তাঁকে। কারণ ববি একান্তই খালা অনুগত।
তবে নতুন প্রজন্মের কাছে দলের আবেদন বাড়াতে
রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে অনেককিছু করতে হবে। ছাত্রলীগ-যুবলীগকে গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে
উৎসাহী করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে পরিকল্পনা
নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজে নামতে হবে। যোগ্য ও জনগণের নেতাকে কাছে টানতে হবে। দেশ-বিদেশের
রাজনীতিকে পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের কৌশলপত্র প্রণয়ন ও সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধিতে নিয়োজিত
হতে হবে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীকে বাধ্যতামূলক প্রযুক্তিমুখী করতে হবে। মূল সংগঠন
ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর দেশব্যাপী শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। সংগঠনের
দুর্বলতা কাটানোর জন্য নেতাকর্মীদের নিয়ে সংকট উত্তরণের পথ আবিষ্কার করা খুবই জরুরি।
শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনায় ববি যেমন তৎপর তেমনি নিজের নতুন নতুন ভাবনা-চিন্তা নিয়ে
জনসমক্ষে হাজির হওয়া প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের নতুন কাণ্ডারী রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে
জন্মদিনের শুভেচ্ছা। তাঁর বিজয়ী অভিযাত্রা অব্যাহত থাকুক।
(লেখক
: ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক,বিশিষ্ট
লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী
কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ
বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৬:৩০ পিএম, ২৭ মে, ২০২৩
যে বিষয়টির সাথে আমি নিজে জড়িত, সে বিষয়টি নিয়ে একটু অবতারণা করছি। বেশ কিছু
দিন আগে- প্রায় ছয় থেকে আট মাস আগে বাংলাদেশ প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে একটি প্রতিবেদন
করে এবং তাতে বলা হয়, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক এমন জরাজীর্ণ অবস্থায়, যে কোনো সময় ভেঙ্গে
পড়ে যাবে। যারা সেবা গ্রহীতা, তারা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে বা মৃত্যুবরণ করতে পারে- এ
ধরনের একটি সংবাদ তারা প্রকাশ করে।
তখন স্বাভাবিক নিয়মে আমার কমিউনিটি ক্লিনিকে যারা কাজ করেন, তারা বললেন, ‘স্যার
একটা প্রতিবাদ দিতে হয়।’
তখন আমি বললাম, আমিতো পড়েছি। আমি ভোরবেলাতে যে পত্রিকাগিুলো পড়ি, তার মধ্যে নঈম
নিজাম এবং এখনকার যে বুদ্ধিভিত্তিক কলামিস্ট আমার অনুজপ্রতীম সৈয়দ বোরহান কবিরের লেখাগুলো
পড়ি। তারা একটা রৈখনি নিয়ে এসেছে। একটা প্রতিবাদ, সরকারিভাবে যা লেখা হয়, এটা না, ওটা।
আমি বললাম, ‘তোমরা ওই কমিউনিটি ক্লিনিকটা শেষ কে কবে পরিদর্শন করেছ?
তারা কেউই সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারে না। আমি বললাম, নঈম নিজাম এবং সৈয়দ বোরাহান
কবির- এরা কখনো ব্যক্তিগত সম্পর্কের সাথে তাদের যে পেশাগত সম্পর্ক সেটা জড়িয়ে ফেলে
না। উদাহরণসরূপ বলছি, আমি তখন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের পরিচালক। তখন ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অনুষ্ঠানটি
পরিচালনা করে সৈয়দ বোরহান কবির। আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিপক্ষে বেশ কিছু
বক্তব্য প্রচার করে। কিন্তু আমার সাথে তার যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সে সেটা বিবেচনা না
করে পেশাগত দায়িত্ব থেকে সে এটা করেছে। সেটা নিয়ে তার সাথে আমার কোনোদিন আলাপ হয়নি।
কারণ হচ্ছে, সে তার পেশায় ঠিক আছে, আমি আমার পেশায় ঠিক আছি।
আমার কোনো ভুলভ্রান্তি হলে সেটা উল্লেখ করা তার দায়িত্ব। নঈম নিজামের পত্রিকায়
যেহেতু সংবাদ ছাপা হয়েছে। সুতরাং নঈম নিজামকে আমি আলাদা চোখে দেখি।
তারা বললো, ‘স্যার সিভিল সার্জনের সাথে কথা হয়েছে।’
আমি বললাম, সিভিল সার্জন নয়, একজন বিশ্বস্ত লোককে পাঠাও। তারপর প্রতিবাদ ছাপাতে
হয়, আর্টিকেল লিখতে হয়, আমি দেখবো।
তারপর একজনকে পাঠানো হলো। তিন দিনে রিপোর্ট দিলো। তারপর দেখা গেলো, বাংলাদেশ
প্রতিদিনে যা ছাপা হয়েছে। সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্য। তখন আমি এইটার ব্যবস্থা গ্রহণ
করলাম, যেন ওটা ঠিকমতো চলে এবং সমস্যাটির সমাধান করলাম। বাংলাদেশ প্রতিদিনে কোনো লেখা
বা নঈম নিজামকে ফোন করার আর কোনো প্রয়োজন পড়লো না। আমি দেখেছি, আমার ভুল-ভ্রান্তি হচ্ছে।
সুতরাং এর দায়-দায়িত্বও আমার। যেহেতু এটা আমার দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, সুতরাং আমি
মনে করেছি, সে আমাকে সহায়তা করেছে। এখন আমার পক্ষে না বিপক্ষে গেলো, সেটা কোনো বিষয়
নয়।
সম্প্রতিককালে দেখলাম, আমাদের একটি মন্ত্রণালয়ের একজন মন্ত্রী এবং তাদের যে কাজের
গাফিলতি সম্পর্কে লিখেছে বলে তারা তার প্রতিবাদ পাঠিয়েছে। প্রতিবাদটি আমি পড়লাম। প্রতিবাদটি
বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপা হয়েছে। আমার কাছে মনে হলো, অনেক আমলারা কাঁচা হাতের কাজ করে
সেরকম। এই প্রতিবাদটি ছাপানোর আগে, যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সে বিষয়গুলোর সমাধান
করাতো বেশি দরকার। এরা দেশের ভালো করতেছে না খারাপ করতেছে, সেটা বিচার করার সময় এসেছে।
আমারতো কোনো পত্রিকার সাথে কোনো জমি নিয়ে বা কোনো বিরোধ বা কোনো গন্ডগোল নেই, সে আমার
বিরুদ্ধে কেন লিখবে? লিখলে আমিসহ সকলে যে যেখানে দায়িত্বে আছে, সকলের প্রধান দায়িত্ব
হচ্ছে জিনিসটা সঠিক কি না, সেটার চুলচেরা বিচার করা।
দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি নিয়ে লিখেছে, সেটাকে অবশ্যই দেখাশোনা করা, যাতে ওই ভুলটটা
ভবিষ্যতে আর না হয়। নঈম নিজাম কেন, দুনিয়ার কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু ভুলটা বুঝতে
পারা এবং ভুলটা সঠিক করা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যবশত অনেকেই আমরা
এটা করতে পারি না। সেজন্য সবাইকে বলবো, যে কোনো মিডিয়াতে কোনো কিছু আসলে প্রতিবাদ পাঠানোর
আগে কি লিখেছে, বরং সেটার সমাধান আগে করে তারপর প্রতিবাদ পাঠান।
মন্তব্য করুন
আমি আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যায়ন করিনি। তবে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো আমাকে আকৃষ্ট করে। একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুবই শংকিত! কারণ, বিশ্বে শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চললেও দীর্ঘদিন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যুদ্ধ, মানুষ হত্যা , নিপীড়ন , নারী ও শিশু নির্যাতন, মানব পাচার, অভিবাসন করতে গিয়ে প্রাণহানি আমাদেরকে শংকিত করে তুলছে। উন্নত দেশগুলো রাষ্ট্রীয় সীমারেখার দেয়াল তুলে শান্ত হয়নি, বিভিন্ন রকম আন্তর্জাতিক কৌশল অবলম্বন করে তারা দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষদেরকে আরও সুশীল বানাতে চাইছে। গণতন্রের পূজারী উন্নত বিশ্ব তাদের স্বার্থে সুশীল বানানো প্রক্রিয়ায় ধনী দেশগুলোতে সেভাবে চাপ প্ৰয়োগ করে না, যেভাবে দরিদ্র দেশগুলোতে শক্ত অবস্থান নিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বেলায় যেভাবে কূটনীতিবিদরা সক্রিয় তাতে আমাদের স্বাধীনতা কি ক্ষুন্ন হচ্ছে না ? এ দায় কি কেবল নিপীড়িত মানুষের ?
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নানা আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হয়েছে। কিছুদিন সেই চাপ কমেছিল। কিন্তু আবার নতুন করে চাপে ফেলা হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি হতে পারে? বিরোধী জোটে যারা আছেন তারা বলবেন- তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে একটি নির্বাচন করুন , সমস্যা প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে আসবে। কিন্তু আমার ভিন্ন রকম উপলব্ধি।
বাংলাদেশের সরকার নির্বাচিত নাকি অনির্বাচিত তাতে কারও কিছু যায় আসে না। যদি নির্বাচন মুখ্য বিষয় হতো তবে আরব রাষ্ট্রে বিরাজমান রাজতন্ত্র অবসানে তারা মনোযোগী হতো। সেখানে কেন গণতন্রের জন্য মনোযোগ দেয়া হয়না তার অনুসন্ধানে যারা লিখেছেন তাদের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। এখানে কার্ল মার্কস এর দর্শনের সাফল্য। অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেটাতে উন্নত দেশগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। তার পরেও আমাদের উপর একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ গভীর ভাবনার বিষয়। এটি দেশের বিরোধী দলের দেনদরবার বা তদবিরের ফলে হচ্ছে মনে করলে হয়তো ভুল হবে। সুষ্ঠু অবাধ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কি এক মাত্র ভাবনা ওই সব বিধিনিষেধ আরোপের কারণ ? একটি অবাধ সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট ? আমাদের সমাজে যারা বুদ্ধিজীবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাদের মনোযোগ এখানে একান্তভাবে কাম্য যাতে সরকার চাপের মুখে কোনো বড়োরকম ভুল না করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের বাতিঘর। গতকাল একটি বিবৃতিতে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বলেছে - তারা একটি অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন তিনিও সুষ্ঠু নির্বাচন চান এবং আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সারা বিশ্বে যেভাবে নির্বাচন হয়ে থাকে সেইভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে। সম্প্রতি একটি পোস্টার আমার নজরে এসেছে। সেখানে লেখা আছে "আমার ভোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দিতে চাই। " ওই পোস্টার নিয়ে দলের লোকদেরসঙ্গে কথা বলে জানা যায় তারা বিদেশী দূতাবাসের আশীর্বাদ পেয়েছেন। এবং আরেকটি মহল মনে করেন - যুক্তরাষ্ট্র যে সব বিধিনিষেধ দিচ্ছে তার লক্ষ্য হলো পর্যাক্রমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কৌশল। এটাকে বিস্তৃত করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংসদের বক্তব্যর অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।
পত্রিকাতে দেখেছি সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করবে , এবং এখন আগের তুলনায় সরকার বিরোধী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে না। অন্ততঃ গত মঙ্গলবার গাবতলীতে সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক ডাকসুর ভিপি অমানুল্লার জনসভা দেখে আমার ধারণা হয়েছে। ঐদিন ধানমন্ডিতে সভা হয়েছে বটে কিন্তু কিছু মানুষ বাস পোড়ানোর মতো বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিচার করছে। তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন। আমাদের কাছে অনেকেই বলেন আগামী নির্বাচন যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয় সেজন্য আন্দোলন করবেন। সেই আন্দোলন যে শান্তিপূর্ণ হবে সেটা ভাবা যায় কি ? আমার মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষই অবলম্বন করবে না যদি তারা কোনোভাবে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আমাদের মনে পড়ে অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছে তাতে আমাদের সামাজিক শান্তি ও অর্থনীতি হুমকিতে পড়েছে।আরেকটি ১/১১ সৃষ্টির যে পায়তারা চলছে তা কোনোভাবেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে বলে মনে হয় না।কারণ যেই হারবে সেই দাবি করবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।
জনগণের কষ্ট সৃষ্টি করে কেউই ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। ভোট ও ভাতের স্বাধীনতা অর্জনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি অর্জন করতে হয় তবে তা জনগণের কষ্টে পাশে দাঁড়ানোর মধ্যদিয়েই সম্ভব। বাংলাদেশ আশা করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু হয়েই থাকবে। তাদের আরোপিত বিধিনিষেধ কেন সেটা অনুসন্ধানে সময় না দিয়ে আমার সমস্যা নিয়ে আমি ভাবতে ও সমাধানের চেষ্টা করতে চাই। রাজনীতির লক্ষ্য হোক জনগনমুখী - কূটনীতিবিদমুখী নয়।আমাদের আরও সহনশীল হতে হবে এবং সৎ মানুষগুলোর মধ্যে একটি ঐক্য থাকতে হবে। আমি মনে করি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবার সুযোগ আছে রাজনীতিবিদেরকে আলোর পথের সন্ধান দিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বক্তব্য তারই প্রতিফলন।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সে স্বপ্ন আমাদের সকলের। বিদেশী কূটনীতিবিদরা যেভাবে যুক্ত হচ্ছে তা থেকে বের হয়ে আসার দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তায়। আমরা বঙ্গবন্ধুর শান্তি পুরস্কার বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি পালন করছি। বঙ্গবন্ধুর শান্তি ভাবনা যেন আমাদের রাজনীতিতে সুবাতাস বয়ে আনে সেই কামনা করছি। তাহলেই কূটনৈতিক বিজয় অর্জন সম্ভব হবে।
মন্তব্য করুন
‘‘কাটায়ে উঠেছি ধর্ম—আফিম—নেশা/
ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা,/ ভাঙি মন্দির, ভাঙি
মসজিদ/ ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,/ এক
মানবের একই রক্ত মেশা/
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা!’’
‘‘পূজিছে
গ্রন্থ ভণ্ডের দল মূর্খরা সব
শোন মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন।’’
‘‘গাহি
সাম্যের গান— মানুষের চেয়ে
বড় কিছু নাই, নহে
কিছু মহিয়ান। নাই দেশ—কাল—পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে
ঘরে—ঘরে তিনি মানুষের
জ্ঞাতি।’’
‘‘মানবতার
এই মহান যুগে একবার/গণ্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে,/তুমি
ব্রাহ্মণ নও, শূদ্র নও,
হিন্দু নও, মুসলমানও নও,/তুমি মানুষÑ তুমি
ধ্রুব সত্য।’’
উপরের উদ্ধৃতিগুলো স্মরণে রেখে কাজী নজরুল ইসলামের(১৮৯৯—১৯৭৬) ১২৪তম জন্ম—জয়ন্তীতে তাঁর প্রবন্ধে প্রকাশিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা সম্পর্কে আলোকপাত করা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই তাৎপর্যবহ। এদেশ এখনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। কিন্তু যে দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাঁধে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা ছিল তাও সম্পন্ন হয়নি। এজন্য একমাত্র ভরসা রবীন্দ্রনাথ—নজরুল। বিশেষত নজরুলের জীবনব্যাপী(সুস্থ ছিলেন ১৯৪২ পর্যন্ত) সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বলে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে অনুপ্রেরণার অজেয় উৎস। কেবল তাঁর কবিতা—গান নয় প্রবন্ধে রয়েছে বিবেক জাগানিয়া অনন্যসব ভাবনাসমূহ। সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ, অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু, সাপ্তাহিক লাঙল, গণবাণী, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য—পত্রিকা প্রভৃতি পত্রিকায়Ñ এ সম্পর্কে নজরুলের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ এবং অভিভাষণের বক্তব্য প্রকাশিত হয়। পরে সেগুলো যুগবাণী, রাজবন্দীর জবানবন্দী, দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্র—মঙ্গল গ্রন্থে প্রবন্ধ সংকলনে স্থান পায়। বলাবাহুল্য তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সমকালীন প্রসঙ্গ নিঃসৃত। আর এই সমসাময়িক প্রসঙ্গের অবতারণার জন্য তাঁর প্রবন্ধসমূহ মূল্যবান হয়ে উঠেছে। ১৯৪২ সাল পর্যন্ত বিশ্ব পরিমণ্ডল ও ভারতবর্ষের সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাস নজরুল—সাহিত্যকে আলোড়িত করেছে। তবে তিনি তাঁর অভিমতসমূহ ব্যক্ত করার সময় সর্বজনীন মানুষের কল্যাণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ সা¤প্রদায়িক বিভেদ ও বিদ্বেষের বিপরীতে তিনি সম্প্রীতির প্রত্যাশায় উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। একইসঙ্গে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে ধর্ম, শিক্ষা ও সমাজ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও তাঁর ভাবনাসমূহ গুরুত্ব বহন করে।
অধ্যাপক
ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ নজরুলের অসাম্প্রদায়িক
চেতনা সম্পর্কে লিখেছেনÑ‘উপনিবেশকে আঁকড়ে রাখার মানসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুচতুর
কৌশলে সাপ্রদায়িক বিভেদ
সৃষ্টি করেছিল ভারতবর্ষে ভারতের দুই বৃহৎ ধর্ম—সাপ্রদায় পরস্পর
বিভেদে জড়িয়ে পড়েছে বারবার। এর পশ্চাতে ছিল
একাধিক রাজনৈতিক দলের ইন্ধন। এই
সাম্প্রদায়িক বিভেদ নজরুলকে ব্যথিত করেছে। তাই তিনি সচেতনভাবে
হিন্দু—মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়—নিরপেক্ষ
স¤প্রীতি প্রত্যাশা করেছেন। সত্য—সুন্দর—কল্যাণের
পূজারি নজরুল চেয়েছেন স¤প্রদায়ের উর্ধ্বে
মানুষের মুক্তি। বস্তুত, সাম্যবাদী চিন্তা তাঁর মানসলোকে সম্প্রদায়—নিরপেক্ষ মানবসত্তার জন্ম দিয়েছেÑহিন্দু
ও মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে তাঁর
চেতনায় হতে পেরেছে জাতিসত্তার
পরিপূরক দুই শক্তি।’ (উত্তর—ঔপনিবেশিক তত্ত্ব ও নজরুলসাহিত্য, সৃষ্টি
সুখের উল্লাসে, ২য় খণ্ড, পৃ
৩৩৬) সম্প্রদায়ে
সম্প্রদায়ে বিভেদ ও অনৈক্য সম্পর্কে
নজরুল ইতিবাচক চিন্তা করেছেন। সা¤প্রদায়িক কলহের
দুর্বলতা দিয়ে ভারতের মুক্তি সম্ভব নয়। নজরুল এ—কারণেই ভারতীয়দের শক্তির দুর্বলতর সূত্রগুলি ‘যুগবাণী’ ও অন্যান্য পর্বের
সম্পাদকীয় রচনায় বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি জানতেন হিন্দু
মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ শক্তির দুর্বার আঘাতেই ব্রিটিশ শাসনশৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব। নজরুল
আহ্বানও জানিয়েছেন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের।
তিনি
হিন্দু—মুসলমান উভয়ের ইতিহাস—ঐতিহ্য—চিন্তা—চেতনার ভাব বিনিময়ে গুরুত্বারোপ
করেছিলেন। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম
এডুকেশন (মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা, রুদ্র—মঙ্গল) সোসাইটির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে অনুষ্ঠানের সভাপতির ভাষণে নজরুল বলেছেন : ‘ভারত যে আজ
পরাধীন এবং আজো যে
স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা
শুরু হয়নি শুধু আয়োজনেরই ঘটা
হচ্ছে এবং ঘটাও ভাঙছে
তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু—মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা।’
হিন্দু—মুসলমানের মিলন কামনার এই
তীব্রতা নজরুলের মানবতাবোধ থেকে উৎসারিত। তাঁর
সাহিত্যচিন্তার অন্যতম স্তম্ভও এটি ছিল। এজন্য
তাঁর ‘আমার সুন্দর’ প্রবন্ধের
একটি অংশ স্মরণীয়Ñ ‘আমার
কেবলই যেন মনে হত
আমি মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছি। জাতি—ধর্ম—ভেদ
আমার কোনদিনই ছিল না, আজও
নেই। আমাকে কোনোদিন তাই কোনো হিন্দু
ঘৃণা করেনি। ব্রাহ্মণেরাও ঘরে ডেকে আমাকে
পাশে বসিয়ে খেয়েছেন ও খাইয়েছেন। এই
আমি আমার যৌবন—সুন্দর,
প্রেম—সুন্দরকে দেখলাম।’
নিজে
মুসলিম হয়েও হিন্দু নারী প্রমীলাকে বিবাহ
করা এবং একাধিক ঘনিষ্ঠ
বন্ধু সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় নজরুলের পক্ষে এ ধরনের কথাই
স্বাভাবিক। তিনি সাম্য ও
মানবকল্যাণে বিশ্বাসী ছিলেন। ফলে সর্বপ্রকার বন্ধন
ও অধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। সমাজজীবনের অনাচার অসঙ্গতি তিনি অন্তর দিয়ে
উপলব্ধি করেছিলেনশুধু রাজনৈতিক সূত্র
থেকে তা অর্জন করেননি।
সমাজকে ভেঙে গড়বার স্বপ্ন
ও উদ্যম ছিল তাঁর ক্লান্তিহীন।
‘মোহররম’ প্রবন্ধে মাতম—অভিনয়কে ধিক্কার
দিয়ে সত্যের পক্ষ নিয়ে নির্যাতনের
প্রতিবাদে রক্ত দেবার আহ্বান
জানিয়েছেন নজরুল। প্রথার অন্তরে নিহিত সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। লিখেছেনÑ‘এস ভাই হিন্দু!
এস মুসলমান! এস বৌদ্ধ! এস
ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব
গণ্ডি কাটাইয়া, সব সঙ্কীর্ণতা, সব
মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে
পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।’
‘মন্দির
ও মসজিদ’ আর ‘হিন্দু—মুসলমান’
নামে দুটি রচনাতে ভারতবর্ষের
প্রধান দুই সম্প্রদায়ের পরস্পর
বিদ্বেষ এবং হানাহানিকে নজরুল
তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি
সবসময়ই সচেতন ছিলেন। ‘মন্দির ও মসজিদ’—এ
দাঙ্গা নিয়ে তাঁর বেদনাঘন কথা
আছে। মানবতার দিকে যারা ফিরেও
তাকায় না তারা ছোরা
আর লাঠি নিয়ে নিজের
ধর্মস¤প্রদায় রক্ষা করে! নজরুলের মতে,
‘ইহারা ধর্মমাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে
নাই, শাস্ত্রের অ্যালকোহল পান করিয়াছে।’ শাস্ত্রীয়প্রথাকে
নজরুল সবসময়ই মানবতার নিচে স্থান দিয়েছেন।
তাঁর মতে, ‘মারো শালা যবনদের!’
আর ‘মারো শালা কাফেরদের!’
হাঁক ছেড়ে মাতালের চিৎকার দিয়ে তারা নাকি আল্লাহ্র
এবং মা কালীর ‘প্রেস্টিজ’
রক্ষা করে। আর মারণ
আঘাতে লুটিয়ে পড়লে তারা সকলেই আল্লাহ্
বা মা কালীকে না
ডেকে ‘বাবা গো, মা
গো’ বলে চিরকালের বাঙালির
মতো একইভাবে কাতরায়! ‘হিন্দু—মুসলমান’ লেখাতেও রবীন্দ্রনাথের বরাত দিয়ে নজরুল
বলেছেন, ‘যে ন্যাজ বাইরের,
তাকে কাটা যায়, কিন্তু
ভিতরের ন্যাজ কাটবে কে?’ টিকি আর
দাড়ি হচ্ছে মানুষের সেই ন্যাজ। এ
ন্যাজ মাথায় আর মুখে নয়,
গজিয়েছে মনের গভীরে; তা
থেকেই এত বিদ্বেষ। আর,
দাড়ি কামানো খায়রু মিয়া ছুরি খেলে, কিংবা
‘তুর্কিছাঁট—দাড়ির শশধর বাবু’ ছুরি
খেলে প্রথম ক্ষেত্রে মুসলমান আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে
হিন্দু শব নিয়ে কবরস্থান
বা শ্মশানে ছোটে না। দুঃখ
এই, ‘মানুষ আজ পশুতে পরিণত
হয়েছে, তাদের চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে। পশুর ন্যাজ গজিয়েছে
ওদের মাথার ওপর, ওদের সারা
মুখে। ওরা মারছে... টিকিকে,
দাড়িকে। বাইরের চিহ্ন নিয়ে এই মূর্খদের মারামারির
কি অবসান নেই!’
আসলে
‘হিন্দু—মুসলমান ঐক্য’ নজরুলের অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল। যৌবনের প্রতি
এই কবির আবেদন, ‘আমার
ধর্ম যেন অন্য ধর্মকে
আঘাত না করে, অন্যের
মর্মবেদনার সৃষ্টি না করে।’ একই
দেশের ফুলে—ফসলে পুষ্ট
দুই স¤প্রদায়ের বিরোধ
অত্যন্ত নিন্দনীয়। অথচ সা¤প্রদায়িক—রাজনৈতিক নেতারা নিজ নিজ স¤প্রদায়কে ‘ধর্মের নামে উগ্র মদ
পান’ করিয়ে অযথা মাতাল করে
তুলে বিরোধ সৃষ্টি করছেন। আর শিক্ষা—বঞ্চিত
সাধারণ মানুষকে করে তুলেছেন নিজেদের
হাতের পুতুল। রাজনৈতিক নেতারা চারপাশে ‘ভাড়াটিয়া মোল্লা মৌলবি পণ্ডিত পুরুত’ জুটিয়ে নিয়ে তাদের দিয়ে আপন আপন স¤প্রদায়ের পক্ষে ওকালতির ব্যবস্থা করেন। নজরুলের কথা, তরুণরা যেন
‘কদর্য’ হানাহানির ঊর্ধ্বে থাকে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘ইসলাম ধর্ম কোনো অন্য
ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করিতে আদেশ
দেন নাই। ইসলামের মূলনীতি
সহনশীলতা। পরমত সহনশীলতার অভাবে
অশিক্ষিত প্রচারকদের প্রভাবে আমাদের ধর্ম বিকৃতির চরম
সীমায় গিয়া পৌঁছিয়াছে।’ যুবসমাজের উদ্দেশে বলেছেন, ‘মানুষকে মানুষের সম্মান দিতে যদি না
পারেন, তবে বৃথাই আপনি
মুসলিম।’ মুসলমানদের ভুল আর পশ্চাদ্পদতা
বিষয়ে লেখকের ওই দুর্ভাবনা এ
যুগের জন্যেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নজরুলের ‘শেষকথা’, ‘আমরা যৌবনের পূজারী,
নব—নব সম্ভাবনার অগ্রদূত...।’ পৃথিবীর অগ্রগামী
পথিকদের সঙ্গে সমতালে পথ চলব। পরস্পর
যাবতীয় বিভেদ ভুলে সঙ্ঘবদ্ধতায় উদ্বুদ্ধ
করবার চেষ্টা করেছেন তিনি।
কাজী
নজরুল ইসলাম লক্ষ করেছেন ভারতবর্ষের
অগ্রগতি বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, আভিজাত্যবোধের কারণে। হিন্দু—মুসলমানের ঐক্য সাধনের মাধ্যমে
অগ্রগতি ত্বরান্বিত করায় নজরুল ছিলেন আন্তরিক। হিন্দু—মুসলমান বিরোধের মূলে উভয় স¤প্রদায়ের পারস্পরিক জ্ঞানবিমুখতাকে নজরুল চিহ্নিত করেছেন। সমাজ—অন্তর্গত একটি
স¤প্রদায়ের মানুষ কুসংস্কার, গেঁাড়ামি, বৈষম্য, সংঘাত, দাঙ্গায় সভ্যতা—সমাজ—সময়—রাষ্টে্রর
গতিশীলতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে; নজরুল সেই স¤প্রদায়—অন্তর্গত সকল মানুষকে রক্ষণশীল
কুসংস্কারাচ্ছন্ন জগত থেকে আলোকিত
পৃথিবীতে পদচারণার আহ্বান জানিয়ে বলেছেনÑ ১. আজ বাঙালি
মুসলমানদের মধ্যে, একজনও চিত্রশিল্পী নাই, ভাস্কর নাই,
সঙ্গীতজ্ঞ নাই, বৈজ্ঞানিক নাই,
ইহা অপেক্ষা লজ্জার আর কি আছে?’(তারুণ্যের সাধনা) ২.
দেয়ালের পর দেয়াল তুলে
আমরা ভেদ—বিভেদের জিন্দাখানার
সৃষ্টি করেছি; কত তার নাম
সিয়া, সুন্নি, শেখ, সৈয়দ, মোগল,
পাঠান, হানাফি, শাফি, হাম্বলি, মালেকি, লা—মাজহাবি, ওহাবি
ও আরো কত শত
দল। ... সকল ভেদ—বিভেদের
প্রাচীর নিষ্ঠুর আঘাতে ভেঙ্গে ফেল।’(বাংলার মুসলিম বাঁচাও)
এভাবেই
উভয় স¤প্রদায়ের বিরোধের
প্রাচীর ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন
কবি। নজরুল অন্য ধর্মের কূপমণ্ডুকতা,
কুসংস্কার আর প্রাচীন প্রথার
অবরোধগুলো উন্মোচন করে মানুষের পারস্পরিক
মিলনের মাধ্যমে সম্প্রীতি তৈরি করতে চেয়েছেন।
হিন্দুসমাজের অস্পৃশ্যতা সম্বন্ধে কবির অভিমতÑ ‘হিন্দু
ধর্মের মধ্যে এই ঘূত্মা্করূপ কুষ্ঠ
রোগ যে কখন প্রবেশ
করিল তাহা জানি না,
কিন্তু ইহা যে আমাদের
হিন্দু ভ্রাতৃদের একটা বিরাট জাতির
অস্থিমজ্জায় ঘুণ ধরাইয়া একেবারে
নির্বীর্য করিয়া তুলিয়াছে, ...।’(ছঁুৎমার্গ)
আবার
কবি মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, হিন্দু যেমন আরবি—ফারসি—উর্দু জানে না, তেমনি
সাধারণ মুসলমান বাংলাও ভালো করে আত্মস্থ
করে না, সেখানে আরবি—ফারসি শিক্ষার প্রশ্ন অবান্তর। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে লিখিত একটি পত্রে নজরুল
জানিয়েছেনÑ ‘হিন্দু—মুসলমানের পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না
পারলে যে, এ পোড়া
দেশের কিছু হবে না...।’ সা¤প্রদায়িক
সম্প্রীতির জন্য নজরুল সাহিত্য
পাঠের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। কোনো স¤প্রদায়ের
সমাজে তিনি মানুষকে বন্দি
করেননি। শৃঙ্খলিত—নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম, হতভাগ্যের জাগরণ, পদানত—শোষিত মানুষের মুক্তি—প্রত্যাশায় তিনি মানুষকে জাতি—ধর্ম—সমাজ মন্দির—মসজিদ ও গ্রন্থের ঊর্ধ্বে
তুলে ধরেছেন, মানবতার সপক্ষে বাজিয়েছেন সাম্যের সুরধ্বনি। ১৯২৬ সালে হিন্দু—মুসলিম দাঙ্গার সময় অসা¤প্রদায়িক
চেতনায় বিশ্বাসী নজরুলের হৃদয়—উৎসারিত বাণী হলোÑ‘যিনি
সকল মানুষের দেবতা, তিনি আজ মন্দিরের
কারাগারে, মসজিদের জিন্দাখানায়, গীর্জার মধ্যে বন্দী। মোল্ল¬া—পুরুত, পাদরী—ভিক্ষু জেল—ওয়ার্ডের মত
তাহাকে পাহারা দিতেছে। আজ শয়তান বসিয়াছে
¯্রষ্টার সিংহাসনে।... মানুষের কল্যাণের জন্য ঐ—সব
ভজনালয়ের সৃষ্টি, ভজনালয়ের মঙ্গলের জন্য মানুষ সৃষ্টি
হয় নাই। আজ যদি
আমাদের মাতলামির দরুন ঐ ভজনালয়ই
মানুষের অকল্যাণের হেতু হইয়া উঠেÑ
যাহার হওয়া উচিত ছিল কল্যাণের।
সেহেতু ভাঙ্গিয়া ফেল ঐ মন্দির—মসজিদ!’(মন্দির ও মসজিদ)
ধর্মের
ব্যাপারে নজরুল ছিলেন উদার। ড. আহমদ শরীফ
লিখেছেনÑ‘নজরুল ইসলাম কোন বিশেষ ধর্মের
অনুসারী ছিলেন বলা যায় না।
তিনি দেশ জাতি ধর্ম
বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমান
উদারতায় ভালবাসতে পেরেছেন।’ (বিচিত্র—চিন্তা) এক ধর্মের সত্য—সন্ধানীরা অন্য ধর্মকে ঘৃণা
করতে পারে না বলে
তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মুসলমান সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তাঁর আন্তরিকতার
প্রকাশ রয়েছে ‘আমার লীগ কংগ্রেস’
প্রবন্ধে। নজরুল তাঁর এক ভাষণে
বলেছিলেন, ‘কেউ বলেন, আমার
বাণী যবন, কেউ বলেন,
কাফের। আমি বলি ও
দুটোর কিছুই নয়’। অসা¤প্রদায়িক চেতনায় উদ্বোধিত নজরুল হিন্দু—মুসলিম মিথকে একইসঙ্গে প্রবন্ধের বক্তব্যে ব্যবহার করেছেন। যেমনÑক) আজ
নারায়ণ আর ক্ষীরোদসাগরে নিদ্রিত
নন। (নবযুগ) খ) ঐ শোনো
মুক্তিপাগল মৃত্যুঞ্জয় ঈশানের মুক্তি—বিষাণ। ঐ শোনো মহামাতা
জগদ্ধাত্রীর শুভ—শঙ্খ! ঐ
শোনো ইসরাফিলের শিঙ্গায় নব সৃষ্টির উল্ল¬াস ঘন রোল!
(নবযুগ)। এ সম্পর্কে
কবি লিখেছেনÑ‘আমি হিন্দু—মুসলমানের
পরিপূর্ণ মিলনে বিশ্বাসী; তাই তাদের এ
সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই
মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি,
বা হিন্দু দেব—দেবীর নাম
নিই। অবশ্য এর জন্য অনেক
জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্যহানি
হয়েছে। তবু আমি জেনেশুনেই
তা করেছি।’
বস্তুত
বিশ শতকজুড়ে হিন্দু—মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ,
অভাব; অন্যদিকে লোভী মানুষের ব্যাংকে
কোটি কোটি টাকা পাষাণস্তূপের
মতো জমা হয়ে থাকাÑ
এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর
করতেই নজরুল বাংলা সাহিত্যে আবিভূর্ত হয়েছিলেন; কবিতা ও প্রবন্ধে সাম্য,
কল্যাণ ও ঐক্যের বাণী
শুনিয়েছিলেন। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার সেই প্রচেষ্টাকে স্মরণে
রেখে, অনুশীলন করে একুশ শতকে
সামনে এগিয়ে যেতে হবে। গড়ে
তুলতে হবে সাম্যবাদী সমাজ।
মন্তব্য করুন
সাম্প্রতিক দুটি অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি। কয়েক দিন আগে ভারতের লাক্ষাদ্বীপে জি২০-এর একটি সাইড কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে আগামী সেপ্টেম্বরে জি২০-এর যে শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের আলোচনার জন্য নানা বিষয়ভিত্তিক প্রস্তাব তৈরির জন্য ভারতজুড়ে ৬৫টি শহরে মোট ২০০টি মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে এই বছরজুড়ে। ইউনিভার্সাল হলিস্টিক হেলথের ওপর এমন একটি কনফারেন্সে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের মনোনয়নে আমার লাক্ষাদ্বীপ যাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে সেখানে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য।
বাংলাদেশ জি২০-এর সদস্য রাষ্ট্র না হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের যে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি, তার সূত্র ধরেই এ বছর জি২০-এ অবজারভার কান্ট্রির মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ। জি২০-এর বাইরে অবজারভার দেশগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশকেই লাক্ষাদ্বীপের এই কনফারেন্সটির মূল অধিবেশনে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এবং সে কারণেই এই কনফারেন্সে আমার বক্তব্য দেওয়া।
বাংলাদেশে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ নিয়ে বলতে গিয়ে আমার একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। সম্মেলনটিতে জি২০ সদস্য রাষ্ট্রগুলো ছাড়াও জি৭ভুক্ত বেশ কিছু সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
তাঁরা যত না অবাক হয়েছেন বাংলাদেশের প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিকের কথা জেনে, তার চেয়ে ঢের বেশি অবাক আমি হয়েছি এটি জানতে পেরে যে পৃথিবীর এই নেতৃস্থানীয় উন্নত দেশগুলোর কোনোটিতেই আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো অমন তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত এমন সুসংগঠিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য অবকাঠামো নেই। আর লাক্ষাদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে তাঁরা যতটা না বিস্মিত হয়েছেন, তার চেয়েও ঢের বেশি বিস্মিত তাঁদের মনে হচ্ছিল এটি জানতে পেরে যে এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে পাশাপাশি বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে ইনসুলিনসহ ২০টি কমন ওষুধ, কিন্তু অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কথা বিবেচনায় এনে তুলে নেওয়া হয়েছে যাবতীয় অ্যান্টিবায়োটিক।
লাক্ষাদ্বীপে আমার প্রেজেন্টেশনের পর বেশির ভাগ ডেলিগেট আমাদের ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ নিয়ে যে মন্তব্যটি আমার কাছে করেছেন, তার অনুরণন আমি শুনতে পেলাম এই কয়েক দিন আগে ঢাকায় একটি উচ্চ পর্যায়ের ইভেন্টে যোগদানের সুযোগ পেয়ে। সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে এই ইভেন্টটির আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিল স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কিভাবে আমরা বাংলাদেশে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজকে দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করতে পারি।
ইভেন্টটির প্রথম সেশনে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা নাতনি সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর বিশেষ অতিথির আসনটি অলংকৃত করেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাইট অনারেবল হেলেন ক্লার্ক, যিনি বর্তমানে চ্যাথাম হাউস কমিশন নামে ইউনিভার্সাল হেলথকেয়ার সংক্রান্ত বিশ্বের একটি শীর্ষস্থানীয় থিংকট্যাংকের কো-চেয়ারের গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। প্রাণবন্ত আলোচনার শেষ পর্যায়ে তিনি জানালেন যে তাঁর বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০৩০ সালে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টে গোলটি অর্জন করতে যাচ্ছে এবং অবশ্যই এই বিশাল অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো মূল ব্যাকবোনের ভূমিকাটি পালন করছে।
কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে সফল উদাহরণ। এই ক্লিনিকগুলো স্থাপনের জমি আসে ব্যক্তিগত কন্ট্রিবিউশিন থেকে আর ক্লিনিকগুলোর অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি আর মানবসম্পদ সরবরাহ করে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাস্থ্যকে এ দেশের নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যার মস্তিষ্কপ্রসূত কনসেপ্ট এই কমিউনিটি ক্লিনিক, যা মানুষের এই মৌলিক অধিকারটির নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে যাচ্ছে। জোট সরকারের শাসনামলে এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তখন দিনে চরত গরু। রাতে বসত মদ আর জুয়ার আসর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ দেশে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে আবারও রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব পেলে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। একে একে চালু করা হয় বিএনপির সময় বন্ধ করে দেওয়া ক্লিনিকগুলো আর পাশাপাশি স্থাপন করা হয় আরো নতুন নতুন কমিউনিটি ক্লিনিক। ওই সময়টায় সরকারের মাঠ পর্যায়ের একজন তরুণ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিকের এই ধ্বংসযজ্ঞ এবং অতঃপর নব-উত্থান আমার নিজ চোখে দেখা। বঙ্গবন্ধুকন্যার এই মৌলিক কনসেপ্ট, ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ এবার বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেল। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সম্প্রতি বাংলাদেশের উত্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিক সংক্রান্ত একটি রেজল্যুশন পাস হয়েছে। এই রেজল্যুশনটিতে জাতিসংঘ বিশ্বের তাবৎ সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিকের মডেল অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছে। কয়েক দিন আগেই শ্রদ্ধেয়া প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি মৌলিক কনসেপ্ট আশ্রয়ণ প্রকল্প তাঁর মেধাস্বত্ব হিসেবে কপিরাইট পেয়েছে। আর মাস ঘুরতে না ঘুরতে এবার তাঁর আরেকটি মৌলিক কনসেপ্ট কমিউনিটি ক্লিনিক পেল বিশ্বস্বীকৃতি। অজস্র ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী। আপনি জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি, আপনি জাতির গৌরব।
লেখক : অধ্যাপক ও ডিভিশন প্রধান ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্যসচিব সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
মন্তব্য করুন
আমেরিকার South Asia Perspectives পত্রিকায় ২৮ মে(২০২৩) প্রকাশিত মিথ্যাচারে পূর্ণ Jon Danilowicz এর U.S. Visa Policy: What Next? শিরোনামে লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়লে দেখা যাবে এক সময়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের এই সাবেক কর্মকর্তা কী কৌশলে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মনগড়া তথ্য দিয়ে বিরোধী শিবিরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।তিনি যেভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিগুলো তুলে ধরেছেন এবং বিএনপি-জামায়াতের অপতৎপরতাকে এড়িয়ে গেছেন তা সৎ লেখকের কাজ নয়। তিনি যেন কোনো লবিস্ট কর্তৃক নিযুক্ত লেখক। যার নুন খান তার গুণগান করেন। এ ধারার জন ড্যানিলভিচ মার্কা লেখক ও বক্তারা পৃথিবীর অনেক জায়গায় বসে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্রের কথা ব্যক্ত করার পরিবর্তে মিথ্যাভাষণে সরকার বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত। এদের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।
যে বিষয়টির সাথে আমি নিজে জড়িত, সে বিষয়টি নিয়ে একটু অবতারণা করছি। বেশ কিছু দিন আগে- প্রায় ছয় থেকে আট মাস আগে বাংলাদেশ প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে একটি প্রতিবেদন করে এবং তাতে বলা হয়, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক এমন জরাজীর্ণ অবস্থায়, যে কোনো সময় ভেঙ্গে পড়ে যাবে। যারা সেবা গ্রহীতা, তারা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে বা মৃত্যুবরণ করতে পারে- এ ধরনের একটি সংবাদ তারা প্রকাশ করে।
আমি আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যায়ন করিনি। তবে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো আমাকে আকৃষ্ট করে। একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুবই শংকিত! কারণ, বিশ্বে শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চললেও দীর্ঘদিন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যুদ্ধ, মানুষ হত্যা , নিপীড়ন , নারী ও শিশু নির্যাতন, মানব পাচার, অভিবাসন করতে গিয়ে প্রাণহানি আমাদেরকে শংকিত করে তুলছে।