জিয়াউর
রহমানকে "স্বাধীনতার ঘোষক" বলা সংবিধানের লংঘন
এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সরকার চাইলে এরকম
বিকৃতিরোধে আইন প্রনয়ণ করতে
পারে।"
উল্লেখ্য,
সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী
হাইকোর্ট বিভাগের উক্ত রায় সকল
কর্তৃপক্ষ ও ব্যক্তির জন্য
অবশ্যই পালনীয় এবং বাধ্যকর।
২০০৯
সালের ২১ জুন জিয়াউর
রহমান নন, বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক বলে উপর্যুক্ত
রায় দেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশ
সংবিধান প্রনয়ণ কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের
রচয়িতা ব্যারিস্টার আমীর বলেন, "হাইকোর্টের
রায়ের ওপর আপিল বিভাগের
মাননীয়চেম্বার জজ (মোঃ আব্দুল
আজিজ) স্থগিতাদেশ দেননি, ফলে হাইকোর্ট রায়ই
চূড়ান্ত। মেজর জিয়াকে স্বাধীনতার
ঘোষক বলে ইতিহাস
বিকৃত করা হয়েছিল, হাইকোর্ট
সেই বিকৃত ইতিহাস উড়িয়ে দিয়েছেন। এ সম্পর্কিত রিটের
অন্যতম আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, "রায় স্থগিত না
করায় হাইকোর্টের রায় বহাল থাকলো।"
এছাড়াও ২০১১সালের ৩০ জুন তারিখে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি এখন সম্পূর্ণ আকারে সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামো রূপে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দান করেছে। যার ফলে ঘোষণাপত্রটি সংবিধানের একটি অসংশোধনযোগ্য বিধানে পরিনত হয়েছে। আদালতের ঐতিহাসিক রায়ের পরেও স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে বিতর্কের অবসান ঘটেনি। বরং হরহামেশাই মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হচ্ছে। অথচ, আদালতের দিকনির্দেশনার আলোকে জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন করলে বিকৃতিরোধ সম্ভব।
উল্লেখ্য,
২০০৯ সালের ২১ জুন বিচারপতি
এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি
মমতাজ উদ্দিন আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ
মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ
সালামের দায়ের করা এক জনস্বার্থ
রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক - মর্মে রায়
প্রদান করেন। আদালত জিয়াউর রহমানকে ২০০৪ সালে স্বাধীনতার
ঘোষক উপস্থাপন করে প্রকাশিত "বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র"-এর তৃতীয় খণ্ড
বাতিল ঘোষণা করেন। এই খণ্ডটি দেশ-বিদেশের সব স্থান থেকে
বাজেয়াপ্ত ও প্রত্যাহারেরও নির্দেশ
দেন। আদালত এ বাজেয়াপ্তের আদেশ
যথাযথভাবে কার্যকর করতে সরকারকে নির্দেশ
দিয়ে বলেন, যারা এরকম ইতিহাস
বিকৃতির সঙ্গে জড়িত তারা সংবিধান
লংঘন করেছেন। যারা বিকৃত ইতিহাস
রচনা করেছেন সেই প্রত্যয়ন কমিটির
বিরুদ্ধে ধোকাবাজি ও সংবিধান লংঘনের
অভিযোগে সরকার চাইলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। আদালত
দেশের সব মাধ্যমের শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বাধ্যতামূলকভাবে
সন্নিবেশ করার জন্যও সরকারকে
নির্দেশ দেন।
তখন ওই রায় স্থগিতে অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান আপিল বিভাগে আবেদন জানান এবং এর ওপর শুনানি হয়। শুনানিতে হামিদ উল্লাহ খানের কৌঁসুলী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন আহমাদ বলেন, "রায়ের সার্টিফাইড কপি (নকল) পেলে আমরা লিভ টু আপিল করব। সে পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত রাখা হোক।"
কিন্তু
আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি
আব্দুল আজিজ কোনও স্থগিতাদেশ
না দিয়ে রায়ের নকল
নিয়ে লিভ টু আপিল
করতে বলেন। আদালতে হামিদউল্লাহ খানের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এবং ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন
সরকার। রিটকারী মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ এম এ
সালামের পক্ষে কৌঁসুলী ছিলেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম,
ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। সরকার পক্ষে ছিলেন, তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত
অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান।
অপরদিকে ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ঐতিহাসিক এক রায়ের আলোকে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়। যার দ্বারা সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১৫০ সংশোধন অর্থাৎ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ১৯৭১-এর ভাষণ, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাত শেষে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার কর্তৃক জারীকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ভাষণ ও দলিল উল্লেখ করে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ হতে ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্থাৎ সংবিধান প্রবর্তন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়কালের জন্য ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি হিসেবে গণ্য করা হয় এবং ওই ভাষণ ও দলিলসমূহ সংবিধানে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিল হিসেবে সংযোজিত হয়। ২৬শে মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুমোদিত।
সে মতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ১০ জানুয়ারি ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার কর্তৃক জারীকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওই ঐতিহাসিক রায়ে বলা হয় যে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭খ-এর দ্বারা সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ (নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সাপেক্ষে) এবং একাদশ ভাগের অনুচ্ছেদ ১৫০-সহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য করা হলো।
সুপ্রিমকোর্ট বলেন, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ২৬শে মার্চ ১৯৭১-এ প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বিতর্ক সৃষ্টি করার যেকোনো অপচেষ্টা গণপরিষদের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল এবং রাষ্ট্রদোহিতামূলক একটি অপরাধ। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ক(১)(খ)-এ উল্লেখ আছে, সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে বা তা কার্যকর করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে—তার এই কার্য ‘রাষ্টদ্রোহিতা’ হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবে। অনুচ্ছেদ ৭ক(২)-এ উল্লেখ করা হয়েছে কোনো ব্যক্তি যদি উপরোক্ত দফা (১)-এ বর্ণিত কার্য করতে সহযোগিতা বা উসকানি প্রদান করলে কিংবা কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করে, তবে তার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হবে।
বিশেষজ্ঞদের
মতে সুনির্দিষ্টভাবে আইনানুগ বাধানিষেধ না থাকায় হরহামেশাই
স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে। যেমন,
মরহুম রাষ্ট্রপতি ও সাবেক সামরিক
শাসক জিয়াউর রহমানকে "স্বাধীনতার ঘোষক" শুধু নন, বাংলাদেশের
প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করেছেন তার
পুত্র "একুশে আগস্ট হত্যাকাণ্ড" মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত (আইনের ভাষায় বিদেশে পলাতক আসামি) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রসঙ্গত বিএনপি নামক দলটির নিবন্ধন
যে ব্যক্তিটির নামে সেই প্রতিষ্ঠাতা
মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ একিউএম বদরুদ্দোজা
চৌধুরী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তার বানীতে
জিয়াউর রহমানকে "স্বাধীনতার ঘোষক" না বলেননি। ২০০১
সালের ১২ নভেম্বর বদরুদ্দোজা
চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ৩০ মে
জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীর এক বানীতে বলেন,
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসের গর্বিত সন্তান। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ঐতিহাসিক অবদান
এবং বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার অবিস্মরণীয় কর্মকাণ্ড
ইতিহাসে তার স্থান চূড়ান্তভাবে
নির্ণয় করেছে। তিনি ইতিহাসের অংশে
পরিণত হয়েছেন।"
রাষ্ট্রপতি
রাষ্ট্রের একনম্বর ব্যক্তি এবং সংবিধানেরও অভিভাবক,
আর এ জন্যই তিনি
দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে শপথ ভঙ্গ
করেননি। সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের
শপথ তিনি যথাযথভাবে পালন
করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতির পদই
হারান। বিএনপির সংসদীয় দলের বৈঠকে অনাস্থা
প্রস্তাব আনার প্রেক্ষিতে
২০০২ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির
পদ থেকে পদত্যাগ করেন
অধ্যাপক ডাঃ একিউএম বদরুদ্দোজা
চৌধুরী।
জিয়াউর রহমান যাকে হটিয়ে প্রধান
সামরিক আইন প্রশাসক ও
রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেছিলেন,
সেই বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ
সায়েমের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
বিচারপতি
সায়েম তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে
লিখেছেন, " "গত
১৫ আগস্ট কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত এবং চাকুরীরত সামরিক
অফিসার এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবার
পরিজনকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক
আহমদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক আইন
জারি করেন।
গত ৩০ মে জেনারেল
জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীর বানীতে বিএনপির মহাসচিব
মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন জিয়াউর রহমান "স্বাধীনতার
'ঘোষক"।
যাহোক ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’ পনেরো খণ্ডের সিরিজ গ্রন্থের ২০০৪ সালের পুনর্মুদ্রণকৃত তৃতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন মর্মে বর্ণনা করা হয়।
তখন
এর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ এম এ
সালাম ২০০৪ সালে পুনর্মুদ্রিত
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র গ্রন্থ সিরিজের তৃতীয় খণ্ডটি বাজেয়াপ্ত এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির
ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের
হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট পিটিশন
দায়ের করেন।
২০০৯ সালে হাইকোর্ট
এক রায়ে ২০০৪ সালে
পুনর্মুদ্রিত ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খণ্ডের
প্রথম পৃষ্ঠায় ‘মেজর জিয়ার প্রথম
স্বাধীনতা ঘোষণা’ শিরোনামে মুদ্রিত বর্ণনা ১৯৭১ সালের ১০
এপ্রিল তারিখের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় সাংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০-এর সঙ্গেও
সাংঘর্ষিক এবং সংবিধান পরিপন্থী
মর্মে ঘোষণা করেন; এবং উপরোক্ত খণ্ডটি
বাজেয়াপ্ত করার জন্য সরকারকে
নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) এম ইনায়েতুর রহিম বলেছিলেন, "দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ক্ষমতায় বসে স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছেন তা বিকৃত করার যে অপচেষ্টা করছিল এ রায়ের মাধ্যমে তার মৃত্যু হলো।
১৯৭১
সালের ২৬ মার্চ যুক্তরাজ্য
ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক প্রত্রিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আদালতের রায়ে
বলা হয়, ১৯৭১ সালের
২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের পূর্বেই
শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিএনপি নেতা প্রয়াত মওদুদ
আহমেদের লেখা 'ইরা অব শেখ
মুজিব' গ্রন্থের কথা উল্লেখ করে
রায়ে বলা হয়, শেখ
মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। ১৯৭২ সালের ২৬
মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত তৎকালীন লে. কর্নেল জিয়াউর
রহমানের লেখা জাতির জনক
শিরোনামের প্রবন্ধের উল্লেখ করে আদালত বলেন,
জিয়াউর রহমান ওই প্রবন্ধে ২৫
মার্চের বিস্তারিত বিবরণ দেন। কিন্তু কোথাও
নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি।
তিনি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলে আখ্যায়িত
করেন। এতে জিয়াউর রহমানের
সততার প্রকাশ পায়। ১৯৭৭ সালের
১৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের দেওয়া ভাষণের উল্লেখ করে রায়ে বলা
হয়, ১৯৭১ সালের ২৭
মার্চ সম্পর্কে জিয়াউর রহমান তার ভাষণে বলেন
'কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে আপনাদের উদ্দেশে
কথা বলার সৌভাগ্য আমার
হয়েছিল।' কিন্তু তিনি ওই ভাষণেও
নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি।
শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে এতে বলা হয়,
ছাত্রনেতা থেকে তিনি আওয়ামী
লীগ নেতা এবং এরপর
বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার হয়েছেন। জীবনের তিন ভাগের একভাগ
শেখ মুজিব কারাগারে কাটিয়েছেন। তিনি একাত্তুরের ২৫
মার্চ রাতে গ্রেফতারের পর
৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে
ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সরকার তার মনোবলে একটুও
চির ধরাতে পারেনি। কোনো মুচলেকায় তিনি
স্বাক্ষর করেননি। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়,
বঙ্গবন্ধু ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি কেবল শ্রেষ্ঠ
মুুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার ঘোষকই
ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার
ঘোষণা একাত্তুরের ২৬ মার্চ দেশের
আনাচে কানাচে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এই ঘোষণার কথা
সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে। "
জিয়া
তার ঘোষণাতেই স্পষ্ট করে বলেছেন: "মহান
জাতীয় নেতা, বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের
পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।" এমনকি এই ঘোষণার তৃতীয়
বাক্যটিতেও জিয়াউর রহমান আবারও on behalf শব্দযুগল ব্যবহার করে বলেন: "অতএব
আমাদের মহান নেতা শেখ
মুজিবুর রহমানের পক্ষে…"
জিয়াউর
রহমান কর্তৃক এই ঘোষণা পাঠে
স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে শেখ
মুজিবুর রহমানের কৃতিত্বই স্বীকার্য।
জিয়াউর
রহমান এখানে শেখ মুজিব কর্তৃক
স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের পাঠক মাত্র। টেলিভিশনে
সংবাদ পাঠক (News caster) যেমন পাঠের সূত্রে
সংবাদের নায়ক হতে পারেন
না, বরং নিছকই পাঠক,
তেমনি জিয়াউর রহমান ঘটনাক্রমে এর পাঠক মাত্র।
এমনকি তিনি এর প্রথম
পাঠকও নন, কারণ স্থানীয়
আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান
তার আগেই স্বাধীনতার ঘোষণা
পাঠ করেছিলেন। ফলে পাঠক হিসেবেও
তিনি প্রথম নন। আর ঘোষক
হিসেবে তিনি প্রথম বা
দ্বিতীয়– কোনোটাই নন। কবিতার আবৃত্তিকার
যেমন আবৃত্তির সূত্রে কবিতাটির রচয়িতা বলে নিজেকে দাবি
করতে পারেন না, ঠিক একইভাবে
জিয়াউর রহমানকে কোনোভাবেই স্বাধীনতার ঘোষক বলা যায়
না। জিয়ার শাসনামলে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত "বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র"তে স্বাধীনতার ঘোষক
হিসেবে শেখ মুজিবের নামটিই
লেখা। বঙ্গবন্ধুর পর ২৬ মার্চ
দুপুর আড়াইটায় চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের তৎকালীন সভাপতি এম এ হান্নান
স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রটি পাঠ করেন। রাত
সাড়ে সাতটায় পাঠ করেন আবুল
কাশেম সন্দীপ।
জিয়া
যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তা এই
দুজনার পাঠ করারও একদিন
পর। তখন তার পাশেই
উপস্থিত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কর্মরত বেলাল মোহাম্মদ। তিনি জীবিত থাকতেই
জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষনার প্রেক্ষাপট লিখে গেছেন। ১৯৭১
সালের ২৫ মার্চ রাতের
ঢাকার পরিস্থিতি ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের
ঘটনা ২৭ মার্চেই বিশ্বের
অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা
ও সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশ হয়।
আ ফ ম সাঈদ
তার ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা: ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস’ বইতে স্বাধীনতার ঘোষণা
সম্পর্কে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টের একটি সংকলন প্রকাশ
করেছেন। ওই সংকলন অনুযায়ী
বিবিসির খবরে তখন বলা
হয়, ‘.কলকাতা থেকে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের
খবরে প্রকাশ করা হয়, পূর্ব
পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর
রহমান এক গোপন বেতার
থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক
দিয়েছেন।’ ভয়েস অব আমেরিকার খবরে
বলা হয়, ‘ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। শেখ
মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন
এবং সারা বিশ্বের কাছে
সহযোগিতার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।’ দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান-এর
খবর ছিল, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে শেক মুজিবুর রহমানের
পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার
থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান
পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।’
দ্য
ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন ২৭ মার্চের পত্রিকায়
‘সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান:
শেখ এ ট্রেইটর, সেইস
প্রেসিডেন্ট' শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান
কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খানর
ভাষণে শেখ মুজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতক’
বলার কথা উল্লেখ করা
হয়।
ব্রিটেনের
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় বলা হয়, ‘২৬
মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে
রেডিওতে ভাষণ দেওয়ার পরপরই
দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে
একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে
শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর
এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি
পাঠ করেন।’ এর বাইরে ভারতের
বহু সংবাদপত্র এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল,
ক্যানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে
স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা
ঘোষণার খবর। আর্জেন্টিনার বুয়েনস
এইরেস হেরাল্ডের ২৭ মার্চের সংখ্যার
একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘বেঙ্গলি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডিক্লেয়ার্ড বাই মুজিব।’ নিউইয়র্ক
টাইমস-এও শেখ মুজিবুর
রহমান ও ইয়াহিয়ার ছবি
ছাপানো হয়। পাশেই লেখা
হয় ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব
আটক। বার্তা সংস্থা এপির খবর ছিল,
‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ
মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে
গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।’ আয়ারল্যান্ডের
দ্য আইরিশ টাইমস-এর শিরোনামেও ছিল
পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা, আর সঙ্গে ছাপানো
হয় বঙ্গবন্ধুর ছবি।
ব্যাংকক
পোস্ট-এর খবরে বলা
হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব
পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের
পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
চট্টগ্রামে
পৌঁছানো বার্তা ছড়ায় সারা বিশ্বে।
ঐতিহাসিক বার্তাটি রাতের মধ্যেই পৌঁছে যায় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম
সংগ্রাম পরিষদের নেতা জহুর আহমদ
চৌধুরীর বাসার ৮০৭৮৫ নম্বরে ২৫ মার্চ রাতে
একটি কল আসে। ফোনটি
ধরেন তাঁর স্ত্রী, মহিলা
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ডা. নুরুন্নাহার জহুর।
তিনি বার্তাটি রাত ৩টার দিকে
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডর ছলিমপুর আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ওয়্যারলেস স্টেশনের কোস্টাল অপারেশনাল বিভাগের কর্মীদের কাছে পৌঁছে দেন।
বার্তাটি লিখে নেন টেলিফোন
রেডিও টেকনিশিয়ান জালাল আহমেদ। রাতের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটির হাতে লেখা কপি
চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের
সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান,
নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী,
এম আর সিদ্দিকীসহ কয়েকজনের
কাছে পৌঁছে বলে এম এ
হান্নান জানিয়েছেন গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হককে। জহুর আহমদ চৌধুরীর
বাসায় আসা বার্তাটি ওই
রাতেই হাজারি গলির বিনোদা ভবনে
আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নিয়ে
বাংলায় অনুবাদ করে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে
কপি করে কর্মীদের কাছে
পৌঁছানো হয় বলেও তিনি
জানান। পরে আওয়ামী লীগ
নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরীর পাথরঘাটার বাসার সাইক্লোস্টাইল মেশিনেও বার্তাটি কপি করে বিলিয়ে
দেওয়া হয়। ছলিমপুর আন্তর্জাতিক
মেরিটাইম ওয়্যারলেস স্টেশনের কর্মীরা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা সমুদ্রে অবস্থিত বিদেশি জাহাজ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী
ইন্দিরা গান্ধীর নামে কলকাতা বেতারের
উদ্দেশে পাঠিয়ে দেন, যা ২৬
মার্চ সকাল ৭টা-৮টার
মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন
স্থান, এমনকি বহির্বিশ্বে।
ছলিমপুর
ওয়্যারলেস স্টেশনের কর্মী আবদুল কাদের গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে
জানান, সকাল প্রায় সাড়ে
৬টা-৭টার দিকে বার্তাটি
ইন্ডিয়ান জাহাজ ‘ভিভি গিরি’, অন্য
বিদেশি জাহাজ ‘সালভিটা’, ইউনাইটেড নেশনের জাহাজ ‘মিনি লা-ট্রিয়া’সহ বেশ কয়েকটি
জাহাজে ডুপ্লেক্স চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। সকাল ৯টায়
ভারতের বেতার আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে সংবাদ প্রচার
করা হয়, ঢাকা ও
অন্যান্য অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।
সকাল
১০টায় নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল
মালেক উকিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা
ঘোষণার তারবার্তা জনসমাবেশে পাঠ করেন। পৌনে
২টার সময় চট্টগ্রামের কালুরঘাট
ট্রান্সমিটার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার
ঘোষণা প্রচার করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী
লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান।
সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে
এই ঘোষণা আবার প্রচার করেন
আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। ২৭ মার্চ ঘোষণটি
পাঠ করেন মেজর জিয়াউর
রহমান।
২৭ মার্চ নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত দ্য
স্টেটসম্যান পত্রিকায় বলা হয়, ২৬
মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান
দুটি বার্তা সম্প্রচার করেছেন। একটি অজ্ঞাত রেডিও
স্টেশন থেকে বিশ্বের কাছে
পাঠানো এক বার্তায় আওয়ামী
লীগ নেতা (শেখ মুজিব) ঘোষণা
দিয়েছেন যে ‘শত্রু’ আঘাত
হেনেছে এবং জনগণ বীরের
মতো লড়াই করছে। বার্তাটি
কলকাতা থেকে শোনা হয়েছে।
রেডিও স্টেশনটি নিজেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করেছে। শিলং থেকে শোনা
স্টেশনটির পরবর্তী সম্প্রচারে শেখ মুজিব বাংলাদেশকে
একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছেন। ২৭ মার্চ মুম্বাই
থেকে প্রকাশিত দ্য টাইমস অব
ইন্ডিয়াও ওই সম্প্রচার থেকে
পাওয়া বার্তার বিষয়বস্তু প্রকাশ করে।
১৯৭৪
সালের ২৬ মার্চ দৈনিক
বাংলার তৃতীয় পৃষ্ঠায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণাপত্র’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত
হয়। এতে বলা হয়,
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর
আহমদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু
করার নির্দেশ পাঠান। জনাব চৌধুরী চট্টগ্রামের
কাছে বঙ্গোপসাগরে নোঙর করা জাহাজের
সাহায্যে টেকনাফ থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত
সারা বাংলাদেশে ও কয়েকটি ভ্রাতৃপ্রতিম
দেশকে বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার কথা
জানিয়ে দেন।’ ছলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনের কর্মীরা ১৯৭২ সালে ঢাকায়
এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
মগবাজার
ওয়্যারলেস স্টেশন থেকে ছাড়াল বার্তা।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত একটি কপি ২৬
মার্চ রাত সাড়ে ৪টা-৫টার দিকে মগবাজার
ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি)
ওয়্যারলেস স্টেশনে পৌঁছে যায়। এটি গ্রহণ
করেছিলেন সহকারী প্রকৌশলী মো. আবদুল কাইউম
ও ইঞ্জিনিয়ার সুপারভাইজার মেজবাহ উদ্দিন। তাঁরা বার্তাটি সকালেই চট্টগ্রামের ছলিমপুর স্টেশনসহ দেশের বিভিন্ন ওয়্যারলেস স্টেশনে পাঠিয়ে দেন। আবদুল কাইউম
গবেষককে দেওয়া সাক্ষৎকারে জানান, ভোররাতে সাদা ফুলস্কেপ কাগজে
লেখা বার্তাটি তাঁদের কাছে আসে। একজন
লোক সেটা পৌঁছে দিয়ে
বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
একটি মেসেজ পাঠিয়েছেন। তখন মগবাজার ভিএইচএফ
ওয়্যারলেস স্টেশনের সঙ্গে বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ অংশের
যোগাযোগ ছিল। সকাল ৬টার
দিকে ওয়্যারলেসযোগে পয়েন্ট টু পয়েন্ট, বিশেষ
করে যেসব স্থানে ওয়্যারলেস
স্টেশন চালু ছিল, সেসব
জায়গায় বার্তাটি পাঠিয়ে দিই।
পিলখানা
থেকে ঘোষণা প্রচারকারী শহীদ হলেন।
রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সেলিনা পারভীন ওরফে রীতা গবেষককে
দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, ২৫ মার্চ রাতে
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পিলখানা থেকে সারা দেশে
ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা পিলখানায়
ইপিআর সিগন্যাল কোরের সুবেদার মেজর শওকত আলী।
ওই রাতেই তাঁকে হত্যা করে পাকিস্তানির।
বঙ্গবন্ধু
প্রয়োজনীয় মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের জন্য একাধিক ব্যক্তির
মাধ্যমে ট্রান্সমিটার তৈরি করে রেখেছিলেন
বলে আওয়ামী লীগের নেতা ও বিভিন্ন
সূত্র থেকে জানা যায়।
ঢাকা থেকে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমেও
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার হয়েছিল বলে জানা যায়।
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী হাজি মোরশেদ ৩২
নম্বর বাড়িতে ছিলেন বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার সময় পর্যন্ত। ট্রান্সমিটারে
বঙ্গবন্ধুর বার্তা প্রচার সম্পর্কে তিনি জানান, “...রাত
১১টা বেজে গেল, ১২টা
প্রায় বাজে বাজে, এমন
সময় একটা টেলিফোন আসল।
বলে, ‘আমি বলধা গার্ডেন
থেকে বলছি। মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে, মেশিন
নিয়ে কী করব?’ আমি
মুজিব ভাইয়ের কাছে দৌড়ে গিয়ে
তাঁর কথা বললাম। বঙ্গবন্ধু
বললেন, ‘মেশিনটা ভেঙে ফেলে পালিয়ে
যেতে বল।’ আমি তাঁকে
(বার্তা প্রেরক) সে কথা বললাম।”
পূর্ব
পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার টিক্কা খানের গণসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তাঁর উইটনেস টু
সারেন্ডার বইয়ে ট্রান্সমিটারে বঙ্গবন্ধুর
কণ্ঠে রেকর্ড করা স্বাধীনতার ঘোষণা
শুনেছেন। ১৯৭১ সালের ১৬
ডিসেম্বর আত্মসমর্পণকারী
পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল নিয়াজীও তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে
বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান
পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ও স্বাধীনতার ঘোষণাকারী,
এজন্যই তাকে সামরিক আদালতে
মৃত্যুদন্ড দেয়। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপটে এবং জুলফিকার আলী
ভুট্টোর ক্ষমতায় উত্থান দৃশ্যপট বদলে যায়। যে
কারণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের
মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে পারেনি বরং
ভুট্টোকে মুক্তি দিতে হয় শেখ
মুজিবকে।
মন্তব্য করুন
পটভূমি
সিএনএন
এর সাংবাদিক ট্যাপার, জন বোল্টনকে জিজ্ঞাসা
করেছিল, "কোন দেশে অভ্যুত্থানের
চেষ্টা করার জন্য একজনকে
কি মেধাবী হতে হবে না?"
বোল্টন উত্তর দিয়েছিল: "আমি এমন একজন
যে ভিন্ন দেশে, এখানে নয়, অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা
করতে সাহায্য করেছি। তাই আমি বলতে
পারি অভ্যুত্থান/শাসন পরিবর্তনের জন্য অনেক পরিকল্পনা
আর কাজ করতে হয়”।
সুতরাং
এটি কেবল কথার কথা
বা ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের,
যাকে তারা পছন্দ করে
না বা যারা তাদের
স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস করে, তার
বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করে শাসন পরিবর্তন
করার অভিজ্ঞতা আর ক্ষমতা তাদের
রয়েছে। আসুন কিছু অতীত
এবং সাম্প্রতিক শাসন পরিবর্তন এবং
অভ্যুত্থান সম্পর্কে কথা বলি।
ইরান:
ক্ষমতায়
বসার পর নির্বাচিত ইরানের
প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেঘের প্রথম কাজগুলির মধ্যে একটি ছিল নিজস্ব
গ্যাস এবং জ্বালানী থেকে
উপকৃত হতে অ্যাংলো-ইরানীয়
তেল কোম্পানিকে জাতীয়করণ করা (যা পরে
BP হয়ে ওঠে)। এই
কাজটি অবিলম্বে যুক্তরাজ্যের সাথে তাদের সম্পর্কের
মধ্যে একটি সংকট তৈরি
করে। MI6 এবং CIA একত্রে ১৯৫৩ সালে ইরানের
পেট্রোলিয়াম সম্পদের পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে এবং সোভিয়েত
ইউনিয়নকে ইরানের তেলের প্রতিযোগিতা থেকে বিরত রাখতে
ইরানের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার জন্য একটি
সমন্বিত বিদ্রোহ এবং অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা
করে। কিছু ইরানী আলেম
পশ্চিমা গুপ্তচর সংস্থাকে সহযোগিতা করেছিল কারণ তারা মোসাদ্দেগের
ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। ২০০০ সালে,
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ জেমস রাইজেন
উইলবার অভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী গোপন সিআইএ সংস্করণটি
হাতে পান। তিনি এর
বিষয়বস্তুগুলিকে সংক্ষিপ্ত করে প্রকাশ করেন
যার মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি তথ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল:
“আগস্টের শুরুতে, সিআইএ তার চাপ বাড়ায়।
মিথ্যা কমিউনিস্ট নেতার ভান করে সিআইএর
ইরানি কর্মীরা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কমিউনিস্ট-বিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলার জন্য মুসলিম নেতাদের
এই বলে হুমকি দেয়
"মোসাদেঘের বিরোধিতা করলে তাদের বর্বর
শাস্তি দেওয়া হবে”। এছাড়া,
গোপন ইতিহাস আরো বর্ননা করে
- “কমিউনিস্ট বলে পরিচয় দিয়ে
সিআইএর দেশী এজেন্টরা অন্তত
একজন বিশিষ্ট মুসলিমের বাড়িতে বোমা ফোটায়। এই
হামলায় কেউ হতাহত হয়েছে
কিনা তা বলা যায়
না। সিআইএ বিভিন্ন ভাবে তার নেতিবাচক
প্রচার প্রচারণা জোরদার করে। একজন শীর্ষস্থানীয়
সংবাদপত্রের মালিককে প্রায় $৪৫,০০০ এর
ব্যক্তিগত ঋণ দেওয়া হয়,
"এই বিশ্বাসে যে তার সংবাদপত্র
জনমত এবং আন্দোলন তৈরি
করতে সিআইএর মিথ্যা বর্ণনা প্রতিফলিত করে সংবাদ এবং
নিবন্ধ প্রকাশ করবে।” মোসাদ্দেগকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাদের পুতুল
শাহকে বসানো হয়।
মিশর:
ইউসি
বার্কলে ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং প্রোগ্রাম দ্বারা প্রাপ্ত নথিগুলিতে দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্য
অঞ্চলে গণতন্ত্রকে উন্নীত করার একটি প্রোগ্রামে
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট অর্থায়ন করে। ফেব্রুয়ারী ২০১১
সালে একটি জনপ্রিয় অভ্যুত্থানে
স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি হোসনি মুবারককে ক্ষমতাচ্যুত করার পর এই
প্রোগ্রামটি সক্রিয়ভাবে নির্বাচিত সরকার বিরধী কর্মী এবং রাজনীতিবিদদের সমর্থন
করে মিশরে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
ফেডারেল সরকারের কয়েক ডজন নথির পর্যালোচনা
করে দেখা যায় যে
ওয়াশিংটন নিঃশব্দে মিশরের সিনিয়র বিরোধী ব্যক্তিদের অর্থায়ন করেছে যারা দেশটির বর্তমান
ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুরসির পতনের আহ্বান জানিয়েছিল। বিরোধী কর্মসূচীর জন্য অর্থায়ন করা
কর্মীদের মধ্যে রয়েছেন একজন নির্বাসিত মিশরীয়
পুলিশ কর্মকর্তা যিনি মুরসি সরকারকে
সহিংসভাবে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছিল; ছিল একজন ইসলামবিরোধী
রাজনীতিবিদ যিনি মসজিদ বন্ধ
করার এবং প্রচারকদের জোর
করে টেনে নিয়ে যাওয়ার
পক্ষে ছিলেন আর সেইসাথে ছিল
বিরোধী রাজনীতিবিদদের একটি দল যারা
মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য চাপ
দিয়েছিল। তারপর দেশের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দল আর নেতাকে,
সামরিক বাহিনি ক্ষমতাচুত করে। গণতন্ত্রকে গলাটিপে
মারা হয়।
ইউক্রেন:
যুক্তরাষ্ট্রের
স্টেট ডিপার্টমেন্টের উপদেষ্টা ল্যারি ডায়মন্ডের সফল প্রযোজনাগুলির মধ্যে
একটি হল "আমি একজন ইউক্রেনীয়"
ভিডিও যা ২০১৩-১৪
সঙ্কটের সময় ভাইরাল হয়েছিল।
এটি তরুণ ইউক্রেনীয়দের একটি
দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উত্তেজিত
হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসার চেতনা দেয়।
ইউএস ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি (দুষ্টু
লোকেরা এটিকে ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর রেজিম চেঞ্জ
নামেও পরিচিত করে) দ্বারা অর্থায়নে
একটি প্রযোজনা সংস্থা ভিডিও টি তৈরি করে।
ইউক্রেনে ফেব্রুয়ারী ২০১৪ সালের বিদ্রোহের মূল মার্কিন খেলোয়াড় ছিলেন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। ফাঁস হওয়া টেপগুলি দেখে এটা এখন স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে এবং ইউক্রেনের অভ্যুত্থানকে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ হিসাবে চিত্রিত করার জন্য পশ্চিমা মিডিয়াগুলিকে কাজে লাগিয়েছে। তারপরের ঘটনা সবার জানা।
এখন
বাংলাদেশে উদ্ঘাটিত ঘটনা, চলমান নাটকের প্রতিটি অধ্যায় সম্পর্কে কথা বলা যাক:
প্রথম
অধ্যায়, একটি নতুন এজেন্ডা
নিয়ে নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত
বাংলাদেশে আসেন। আর তা হল
বাক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু নির্বাচন অন্য কথায় গণতন্ত্র
ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার কথা বলে সরকারের
উপর চাপ সৃষ্টি করা
যাতে বাংলাদেশ চীনের ওপর নির্ভরশীল না
হয় আর যাতে বাংলাদেশ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের মধ্যে থাকে তা নিশ্চিত
করা। তদনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি এবং প্রভাবের উপর
পূর্ণ আস্থা রেখে নুতন রাষ্ট্রদূত
কূটনৈতিক নিয়ম আর শালীনতার বাইরে
গিয়ে বাংলাদেশের ভাইসরয়ের মতো কাজ করতে
শুরু করে।
পরবর্তীতে
র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ
করা হয়। এই র্যাব প্রতিষ্ঠানটি বিএনপি
সরকার তৈরি করে এবং
তখনকার র্যাডের একজন
প্রধান, একটি প্রেস ব্রিফিংএ
ক্রস ফায়ার এবং বিচারবিহীন হত্যাকে
ন্যায়সঙ্গত বলে দাবী করেছিল।
কিন্তু সেসময় আশ্চর্যজনকভাবে তার উপর কোনও
নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি।
এরপর
আসে ভিসা প্রত্যাহারের নীতি।
যুক্তরাষ্ট্র জানে বাংলাদেশের অনেক
ধনী বিজনেস টাইকুন যারা রাজনৈতিক অর্থ
যোগান দেয়, উচ্চপদস্থ সরকারী এবং সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত
বা চাকরিরত কর্মকর্তা, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, বিচারক, আইনজীবীসহ অন্যান্য কর্মকর্তা; বিদেশী অর্থায়নের উপর নির্ভরশীল দেশী
ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলির বাংলাদেশের কর্মকর্তারা, সংবাদপত্র, টেলিভিশনের মালিক ও সম্পাদক; শাসক
এবং বিরধী রাজনৈতিক নেতাদের অনেকের যুক্তরাষ্ট্রে রিরাট অংকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আর সম্পত্তি আছে
এবং তাদের পরিবার ও সন্তান-সন্ততি
সেখানে বসবাস করে। এই গোষ্ঠীর
প্রত্যেকের উপর ভিসা প্রত্যাখ্যান,
নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ইউএস
ব্যাঙ্কে জমা রাখা তাদের
বিশাল ডলারের ক্ষতির ভীতী তৈরি করা
হয়। দুর্ভাগ্যবশত এই ক্ষুদ্র সুবিধাবাদী
গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে। আমাদের কোন সন্দেহ থাকা
উচিত নয় যে এই
গোষ্ঠীর কিছু লোকেরা মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অর্থ আর সম্পত্তি
সংরক্ষণের জন্য যা করতে
বলা হবে তাই করতে
কোন দ্বিধা করবে না। তাদের
অর্থ ও ক্ষমতার লোভে
প্রভাবিত করা কোন কঠিন
কাজ না।
গণতন্ত্র,
বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার, দুর্নীতি
দমনের একই নাটকের গান
গাইতে একের পর এক
উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সফর শুরু করে।
এখন অক্টোবরে তাদের আরেকটি দল বাংলাদেশ সফরে
আসবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তাদের গানের সাথে তাল মিলিয়ে
একই গান গাইছে এবং
ঘোষণা করেছে যে তারা কোনো
নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। হঠাৎ তাদের
বাংলাদেশের প্রতি এত বড় আগ্রহ
কেন? তাদের কি অন্য আর
কোন বৈশ্বিক নিরাপত্তা অগ্রাধিকারের চিন্তা নেই?
বাংলাদেশে
যে খাদ্য উৎপাদন কম, তা নয়,
তাহলে হঠাৎ করে কেন
আমরা দেখতে পাই সিন্ডিকেট করে
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে!!? কারা
এর পিছনে কাজ করছে? নিত্যপণ্যের
দাম বাড়ার কারনে সাধারন মানুষ বিশেষ করে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত
লোকেরা ক্ষুব্ধ হচ্ছে এবং সরকার সম্পর্কে
নেতিবাচক কথা বলতে শুরু
করেছে?
শুধু
বাংলাদেশ নয়, ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার
ব্যয়ও ইউরোপীয় মানুষকে মরিয়া করে তুলছে। কিন্তু
বাংলাদেশের কিছু ভালো প্রচলনের
সংবাদপত্রের দিকে তাকান, দেখবেন
প্রথম পৃষ্ঠায় দিনের পর দিন খাদ্যের
মূল্য বৃদ্ধি, দৈনন্দিন জীবন সংগ্রাম, দুর্নীতি,
মেগাপ্রজেক্টের ব্যর্থতা, চীনের কাছে বাংলাদেশ বিক্রি
বা ভারতের নিপীড়ন সম্পর্কে কথা বলে দেশে
সংশয়, উত্তেজনা ও অস্থিরতা সৃষ্টি
করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বিদেশে এবং
বাংলাদেশে বসবাসকারীরা গুজব ও ঘৃণা
ছড়াচ্ছে। আমি অবাক হব
না যদি তারা প্রধানমন্ত্রীকে
স্বৈরশাসক, দুর্নীতিবাজ হিসাবে চিত্রিত করতে শুরু করে,
যা ইতিমধ্যেই কিছু বিরধীদলের নেতা
অহরহ বলা শুরু করেছে।
পশ্চিমা
অর্থের ওপর নির্ভরশীল আন্তর্জাতিক
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দিচ্ছে। হঠাৎ করে ডঃ
ইউনুস ও আদিলুর রহমানের
ইস্যু এখন বড় খবর।
বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ব্যক্তিরা তাদের সম্পর্কে লিখছেন, প্রায় বাংলাদেশকে তাদের মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিচ্ছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ নিয়ে লিখছে,
তাদের মুক্তি দাবি করছে। তথাকথিত
কিছু বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরাও আওয়াজ তুলছেন। তারা পণ্যের উচ্চ
মূল্য সম্পর্কে তাদের উদ্বেগের কথাও লিখছেন। এ
যেন একই শুরে গাওয়া
একই নাটকের গান।
জানলাম,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী এজেন্ট,
বিচারক, আইনজীবী এবং রাজনৈতিক নেতাদের
ভিসা প্রত্যাহারের নীতি/নিষেধাজ্ঞা আরোপ
শুরু করেছে। এর মানে তারা
তাদের লিখিত নাটকের শেষ কয়েকটি পর্ব
ইতিমধ্যে শুরু করেছে।
এখন
বিএনপি ও জামায়াত তাদের
পেশী শক্তি ঝাঁকাতে শুরু করেছে, ঢাকাকে
রক্তাক্ত করার চেষ্টা করছে।
বাস, সম্পত্তি এবং মানুষ পোড়ানো
এবং সম্পত্তি ধ্বংসের পরিকল্পনা করছে। এটি সুষ্ঠু নির্বাচন,
বাকস্বাধীনতা বা মানবাধিকার নয়,
চূড়ান্ত লক্ষ্য তৃতীয় শক্তির ক্ষমতা দখলের জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি
করা। এই সব ধীরে
ধীরে ঘটা কিন্তু প্রতিদিনই
বৃদ্ধি হয়া সুপরিকল্পিত এবং
সমন্বিত শাসন পরিবর্তনের প্রচেষ্টার
একই নাটকের যদি অংশ না
হয়, তাহলে আমার আর বলার
কিছু নাই।
পত্রিকায়
ছবি দেখে অবাক হলাম,
মার্কিন রাষ্ট্রদূত নির্বাচন কমিশন পরিদর্শনের পর সংবাদ সম্মেলনে
রাষ্ট্রদূত যখন সাংবাদিকদের সাথে
কথা বলছিলেন তখন আমাদের নির্বাচন
কমিশনার, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পিছনে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন।
মনে হতে পারে ইসি
যেন রাষ্ট্রদূতের অধীনে কাজ করেন। আমি
তাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই তার
আত্মমর্যাদা কোথায় ছিল? ইসি তার
অফিসে রাষ্ট্রদূতের সাথে আলোচনা করে
যথেষ্ট সৌজন্য দেখিয়েছেন, তাহলে ইসির একসাথে সংবাদ
সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার কি দরকার ছিল?
রাষ্ট্রদূত চলে যাওয়ার পর
তিনি একাই সাংবাদিকদের মুখোমুখি
হতে পারতেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে
না নির্বাচন কমিশনার সাংবিধানিকভাবে একজন স্বাধীন কর্মকর্তা।
আ.লীগ নেতারা মার্কিন
রাষ্ট্রদূতের সাথে গদ গদ
হয়ে হাসিমুখে ফুল দিয়ে ছবি
তুলে সামাজিক মাধ্যমে পাঠান, তার বাসভবনে ভোরের,
দিনের বা রাতের খাবারের
জন্য ছুটে যান। বিরোধী
দলের নেতারা রাষ্ট্রদূতদের ভগবান হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন, যেন
জনগন নয় ক্ষমতাবান বিদেশারা
তাদের ক্ষমতায় বসাবেন।
সিঙ্গাপুরের
সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিআইএ-এর একজন আমেরিকান
এজেন্টকে গ্রেফতার করেছিলেন কারণ সেই এজেন্ট
তার এক উচ্চ নিরাপত্তা
কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে চেয়েছিল।
আমেরিকাকে গোপনে মামলাটি নিষ্পত্তি করতে হয়েছিল। কিন্তু
আমাদের সমস্যা হল আমাদের দেশে
আগেও ছিল এবং এখনও
কিছু মিরজাফর আছে। এমন কিছু
মানুষ আছে যারা এখনও
আমাদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না এবং
আমাদের অগ্রগতি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ক্ষুণ্ন
করার জন্য যেকোনো কিছু
করতে তারা প্রস্তুত। ক্ষমতা
এবং অর্থের বিনিময়ে সহজেই কেনা যায় এমন
অনেক লোক আমাদের মাঝে
আছে। কিছু মানুষ আছে
যারা চোখ থাকতেও অন্ধ
এবং আমরা যে বিশাল
অগ্রগতি করেছি তা তারা দেখতে
পান না। তারা আমাদের
জাতি এবং এর আত্মসংকল্পকে
অবমূল্যায়ন করতে পেরে গর্বিত
বোধ করে। তারা বিশ্বাস
বা পছন্দ করে না মাথা
উঁচু করে এবং পারস্পরিক
সম্মান নিয়ে বাঁচতে। কিন্তু কখনোই আমাদের বাঙ্গালী সাধারণ মানুষের শক্তিকে অবমূল্যায়ন করবেন না। তারা কখনই
পরাধীনতা মেনে নেবে না।
আমি
মনে করি, বিদেশী এজেন্ট,
স্বার্থান্বেষী, দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতার ক্ষুধার্ত, স্বার্থপর ব্যক্তিদের দলগুলো নিখুঁত আর সুপরিকল্পিত নাটকের
খেলা ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে।
আমাদের একমাত্র ভরসা স্বাধীন মনের
সাহসী প্রধানমন্ত্রী আর আমাদের নীরব
কিন্তু শক্তিশালীর ৯০% জনসংখ্যা, যারা
শান্তিতে, সমমর্যাদা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে সহ
বাঁচতে চায়।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
সম্প্রতি
(১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩)বাংলাদেশের তথাকথিত
একটি মানবাধিকার সংস্থা ‘‘অধিকার’’-এর সম্পাদক আদিলুর
রহমান খান এবং পরিচালক
নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছর করে
কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালে মতিঝিলের
শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের সরিয়ে
দেওয়ার অভিযানে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে 'বিভ্রান্তি ছড়ানোর' অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল।একই সাথে
তাদেরকে ১০ হাজার টাকা
করে জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে
আরো এক মাসের সাজার
আদেশ দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য,
২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে
পুলিশি অভিযানের পর সরকার বিরোধী
রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ তুলেছিল যে পুলিশের অভিযানে
'বহু মাদ্রাসার ছাত্র নিহত' হয়েছে। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রচারণাও চালিয়েছিল
সরকার বিরোধীরা।তখন মানবিধকার সংস্থা অধিকার তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে বলা
হয়, শাপলা চত্বরে পুলিশের অভিযানে ৬১জন নিহত হয়েছে।
এই মিথ্যা তথ্য নিয়ে তীব্র
প্রতিক্রিয়া আসে সরকারের তরফ
থেকে। এরপর মামলা দায়ের
করা হয় মানবাধিকার সংস্থা
অধিকার-এর দুই শীর্ষ
কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। রায় ঘোষণার পর
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, "৬১ জনের তালিকা
প্রকাশ করে তিনি শুধু
বাংলাদেশ না বরং সারা
বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া
সৃষ্টি করেছেন। এটা অত্যন্ত জঘন্যতম
একটা অপরাধ করেছেন মিথ্যা তথ্য দিয়ে।"
২০১৩
সালের ৫ এবং ৬ই
মে ঢাকার মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ এবং সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানকে ঘিরে অসত্য তথ্য
প্রচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছিল মানবাধিকার
সংগঠন, অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে।এর জের ধরে একই
বছরের ১১ই অগাস্ট গ্রেফতার
করা হয়েছিল তাকে। পরে জামিনে মুক্তি
পান তিনি।সেসময় পুলিশ জানিয়েছিল, মানবাধিকার সংস্থা অধিকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের সমাবেশে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর
অভিযানে ৬১ জন নিহত
হওয়ার যে তালিকা প্রকাশ
করেছে তা অসত্য এবং
বিকৃত। সরকারের পক্ষ থেকে নিহতের
সংখ্যা ১৩ বলে জানানো
হয়।এরপর সরকারের পক্ষ থেকে বলা
হয়েছে যে তারা অধিকারের
কাছে ‘নিহত’ ৬১ জনের নাম
পরিচয় চেয়ে চিঠি দিলেও অধিকার
তথ্য দিতে অস্বীকার করে।এ
প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক টুইটে বলেছে,
দণ্ড প্রদানের মধ্য দিয়ে ‘‘ক্ষমতাসীনদের
বিরুদ্ধে সত্য বলার অধিকারের
উপর হামলা’’র সত্যতা প্রকাশ
করা হয়েছে।অবশ্য একথা সত্য “মানবাধিকার
লঙ্ঘনের ঘটনা নথিবদ্ধ করাটা
কোন অপরাধ নয়।’’ অন্যদিকে বলা হয়েছে- “গণতন্ত্রের
অপরিহার্য অংশ হিসেবে আমরা
মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রাণবন্ত নাগরিক
সমাজকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করি এবং মৌলিক
অধিকার নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করি।”
অথচ
শেখ হাসিনা সরকার সৎ মানুষের সংগঠনের
অধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে
২০০৯ সাল থেকে।গণতান্ত্রিক সমাজের
গুরুত্বপূর্ণ অংশ মত প্রকাশের
স্বাধীনতাকে সবসময় গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।তাছাড়া তথ্য
ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারার মামলায়
আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে। অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সত্য। আদিলুর
ও নাসির উদ্দিন ৬১ জনের মৃত্যুর
‘বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা’ তথ্যসংবলিত
প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচার
করে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেন, আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নের অপচেষ্টা চালান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনী, সরকার ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি
দেশে-বিদেশে চরমভাবে ক্ষুণ্ন করেন।পাশাপাশি তাঁরা মুসলমানদের মনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করেন, যা তথ্য ও
যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭(১) ও
(২) ধারায় অপরাধ। আসামিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির
অবনতি ঘটানোর এবং সরকারকে অন্য
রাষ্ট্রের কাছে হেয়প্রতিপন্ন করার
চেষ্টা চালান, যা দণ্ডবিধির ৫০৫
সি ও ডি এবং
৫০৫ এ ধারায় অপরাধ।
পশ্চিমারা
বলে থাকেন, ‘যারা নিপীড়ন চালাতে
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করবে, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র কথা বলবে।’ মানুষের
অধিকার রক্ষায় সদাসচেষ্ট শেখ হাসিনা সরকার।
এজন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই
এ সরকারের। বরং সংবিধান মেনে
দেশের মানুষের মঙ্গল করে চলেছেন আওয়ামী
লীগের নেতৃবৃন্দ।
অধিকারের
মতো প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ নিয়ে
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মানবাধিকারের
চিন্তা পুরোটাই হাস্যকর। কারণ তাদের নিজেদের
দেশেই রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও আইন
বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।২০২০ সালের জুন মাসে আমেরিকার
মিনিয়াপোলিসে পুলিশের নির্মমতায় প্রাণ হারানো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু
ছিল সেদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘৃণ্য ঘটনা।সেসময় যখন দেশটির নানা
জায়গায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছে, তখন সেসব বিক্ষোভের
সময়ও পুলিশি নির্মমতার বেশ কিছু ভিডিও
মানুষকে স্তম্ভিত করেছে।মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও পাকিস্তানের
মতো জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ।আর আমেরিকার বন্দিদের প্রতি আচরণের কথা তো বিশ্ববাসী
জানে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূ-খণ্ডের
বাইরে কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ক্যারিবীয় সাগরে
স্থাপিত(২০০২) গুয়ানতানামো কারাগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগার যা
বন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের
জন্য কুখ্যাত। এই কারাগারে বন্দীদের
বিনাবিচারে আটক রাখা হয়
এবং তথ্য আদায়ের লক্ষ্য
নিয়ে বন্দীদের ওপর যৌন অত্যাচার,
'ওয়াটার বোর্ডিং'-সহ বিবিধ আইনবহির্ভূত
উপায়ে নির্যাতন চালানো হয়।নির্যাতনের প্রকার ও মাত্রা এতই
বেশি যে এই কারাগারকে
‘মর্ত্যের নরক’ বলে আখ্যায়িত
করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই কারাগারটিকে অব্যাহতভাবে
নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করতে
থাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে একে মার্কিনীদের ‘লজ্জা’
হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।
পত্রিকান্তরে
প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, আন্তর্জাতিক
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডব্লিউ
মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
কঠোর সমালোচনা করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
এক প্রতিবেদনে তারা বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে
শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ উভয়
বর্ণের মানুষ সমপরিমাণে মাদক সংক্রান্ত অপরাধে
জড়িত রয়েছে। এ সত্ত্বেও মাদক
সংক্রান্ত অপরাধের দায়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকহারে
আটক এবং বিচার করা
হয়।আমেরিকার জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ
জনগোষ্ঠী হলেও মাদক সংক্রান্ত
অপরাধের দায়ে আটক ব্যক্তিদের
২৯ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। আমেরিকায় সাদাদের তুলনায় কালো মানুষদের ছয়
গুণ বেশি আটকের ঘটনা
ঘটে। পুলিশের হাতে অধিক হারে
নিরস্ত্র আফ্রিকান-আমেরিকান হত্যার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের জঘন্য ঘটনা।
আসলে
নানা অপকর্মর জন্য পশ্চিমাদের ‘লজ্জা’থাকলেও তারা অপর দেশের
সমস্যা নিয়ে বেশি উদ্বেগ
প্রকাশ করে হরহামেশায়।যেমন, ২০২১
সালের ১০ ডিসেম্বরে তারা
আসলে মানবাধিকারের কথা বলতে গিয়ে
‘‘র্যাব’কে টার্গেট করেছিল।মনে
রাখা দরকার যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও বাংলাদেশের
এলিট ফোর্স র্যাব নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য
ছড়িয়ে বিশ্ববাসীকে ভুল বার্তা দিতে
চেয়েছিল।যেমন, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭
সালে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার
রায়ের পর বাংলাদেশ সরকারের
‘র্যাব’ বিলুপ্ত করা উচিত বলে
মন্তব্য করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। র্যাবকে তারা ‘ইন হাউজ ডেথ
স্কোয়াড’ বলেছিল এবং বিচার বহির্ভূত
হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও গুমের ঘটনায়
তাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সরকারের ভূমিকারও
সমালোচনা করেছিল। অথচ নারায়ণগঞ্জে সাত
খুনের দায়ে এই বাহিনীর
২৫ সদস্য শাস্তি পেয়েছে। তাদের মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ড
এবং নয় সদস্যের বিভিন্ন
মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে। ফলে ১৪ বছরে
অর্জিত র্যাব-এর বিভিন্ন সাফল্যকে
ছোট করে দেখার প্রবণতা
লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু
এই সংস্থাটির ব্যর্থতার পাল্লার চেয়ে সাফল্যের দৃষ্টান্ত
বেশি। এজন্য র্যাব একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা।
আসলে
এদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর
সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চেয়ে সব সময়
মানবাধিকার রক্ষা করে থাকেন।যারা সন্ত্রাসী
কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, খুন করে,
ধর্ষণ করে, মাদক ব্যবসা
চালায়, দেশ এবং জনগণের
স্বার্থেই তাদের আইনের আওতায় আনা হয়। অপরাধীকে
আইনের আওতায় আনা নিশ্চয় মানবাধিকার
লঙ্ঘন নয়।দেশের স্বার্থেই কাজ করতে হয়
তাদের।২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের
উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও ধ্বংসযজ্ঞ
মোকাবেলা করে জানমালের নিরাপত্তা
বিধান করার জন্য যে
অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল তা ছিল নিয়ম
মাফিক এবং স্বচ্ছ। এজন্য
অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানরা অপপ্রচার চালিয়েও ৬১ জনের মৃত্যুর
বিষয়টি প্রতিষ্টা করতে পারেননি। বরং
মামলায় সঠিক তথ্যপ্রমাণ হাজির
না করতে পারায় শাস্তি
ভোগ করতে হচ্ছে তাদের।
সরকারের
বাহিনীগুলোর কাজ হলো-আইনশৃঙ্খলার
বিধান বলবৎ ও কার্যকর
করা। দেশের বিচারব্যবস্থার কাছে অপরাধীকে তুলে
দেওয়া। দেশকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের কবল
থেকে মুক্ত রাখা। সাইবার-ক্রাইম রোধ করা। সহিংসতা
রোধে মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় তাদের সব সময় আইনের
পথে পরিচালিত হতে হয়। বলা
হয়ে থাকে, দোষী ব্যক্তিকে আইনের
মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করলে অপরাধ কমে
যাবে; নির্মূল হবে অরাজকতা। আইন-কানুনের বৈধতা দিয়ে অপরাধীকে কারারুদ্ধ
করলে সমাজ থেকে অপরাধ
ক্রমান্বয়ে অপসৃত হবে। সকল নাগরিককে
বসবাস ও কাজের সুন্দর
এবং নিরাপদ আঙিনা তৈরি করে দেওয়া।
এ কাজে আইনের শাসন
প্রতিষ্ঠা করা, নাগরিকদের নিরাপত্তা
ও জানমাল রক্ষা করা, অপরাধ রোধ
করা, অপরাধীকে বিচারের সম্মুখীন করা তাদের প্রধান
কাজ। জনজীবনে শান্তি ও সুখ আনয়নে
এ সমস্ত ব্যবস্থাকে সর্বদা গুরুত্ব দিতে বাধ্য শেখ
হাসিনা সরকার।
মানুষের
অধিকার নিশ্চিত করতে হলে আইনশৃঙ্খলা
ভালো হতে হবে সেই
ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্য
পুলিশ ও র্যাবের ভূমিকা
অনন্য। দুর্ধর্ষ অভিযানে গিয়ে সন্ত্রাসী মারা
পড়লে কিংবা বোমা ও বিস্ফোরক
উদ্ধারে জীবন বাজি রেখে
অপারেশন চালালে তার প্রশংসা পান
না তারা। অথচ এই সদস্যরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তথ্যপ্রযুক্তি অপরাধীদের
শনাক্ত করতে সক্ষম হচ্ছেন।
সমাজে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য
তাদের কৃতিত্ব অনেক বেশি। অপরাধ
দমন করে মানুষকে নিরাপদ
জীবন নির্বাহ করার অক্লান্ত পরিশ্রম
সার্থক হবে তাদের প্রতি
আস্থার জায়গাটি চির জাগরুক থাকলে।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
গত মাসে একজন উপদেষ্টা হিসাবে, আমি জেনেভাতে একটি ডব্লিউএইচও উপদেষ্টা গ্রুপ মিটিংয়ে অংশ করি, যেখানে ছয়টি মহাদেশের বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিল। একজন মহিলা ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ, নারী অধিকারের প্রচারক এবং প্রবক্তা, সেও সেই বৈঠকে যোগ দিয়েছিল। আমি দীর্ঘদিন ধরে তাকে চিনি, অনেক সময় একসাথে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য বিষয় সম্পর্কে কাজ করেছি। আমি তাকে এবং তার প্রেমিককে (এখন স্বামী) ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি একটি আন্তর্জাতিক এনজিও কর্মী হিসেবে ঢাকা, বাংলাদেশে কাজ করার সময় থেকে চিনি। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে তার কিছুটা সখ্যতা রয়েছে। মধ্যাহ্নভোজের বিরতির সময় আমি এবং সে ডব্লিউএইচও রেস্টুরেন্টে গেলাম। দুপুরের খাবারের সময় আমাদের কথোপকথন শুরু হল। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো: “বাংলাদেশে কী হচ্ছে মনির? প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান সরকার চরম স্বৈরাচারী হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা নেই, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশে এখন কোন গণতন্ত্র নেই”। আমি জিজ্ঞেস করলাম সে এই তথ্য গুলো কোথায় পেয়েছে? সে বললো যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশের কয়েকজনের সাথে কথা বলে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন এবং কিছু পশ্চিমা মিডিয়া থেকে তথ্য গুলো পেয়েছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে শেষ কবে বাংলাদেশে গিয়েছিল? বললো ১৯৯০ এর দশকে শেষের দিকে বাংলাদেশ ছাড়ার পর আর সে বাংলাদেশে যাইনি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম বাংলাদেশে থাকা কালিন পুলিশ দ্বারা হয়রানির যে ঘটনা সে আমাকে বলেছিল তা তার মনে আছে কিনা? ঘটনাটা হল, সে এবং তার তৎকালীন প্রেমিক (দুই শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ নাগরিক) তারা যখন নিরবে সন্ধ্যায় একটি পার্কে অন্তরঙ্গভাবে একসাথে বসেছিল এবং জিজ্ঞাসার পর, পুলিশকে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি যে তারা বিবাহিত দম্পতি, পুলিশ তাদের লাঞ্ছিত করেছিল? আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম এখন বাংলাদেশে গিয়ে বাংলাদেশের নারীমুক্তি আর অধিকারের বিস্তার দেখার জন্য। বাংলাদেশের নারীরা কিভাবে সমান অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে অবদান রাখছে? সমস্ত সংগ্রাম এবং কুসংস্কার অতিক্রম করে, কিভাবে বাংলাদেশের নারী ফুটবল, ক্রিকেট খেলোয়াড় এবং শান্তিরক্ষা বাহিনী গর্বিতভাবে বিশ্বব্যাপী তাদের পদচিহ্ন তৈরি করছে। বর্তমানের বৃহত্তর, সেনানিবাসে একজন সামরিক স্বৈরশাসক দ্বারা তৈরি বিরোধী দল, চরম ডানপন্থী জামাত নেতাদের ক্ষমতায় আনে, যারা উন্নয়নের সমান অংশীদার হিসেবে নারীর স্বাধীনতা ও তাদের অধিকারে বিশ্বাসী নয়। শুরু হয়, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি আর নিপিরন, তাকি কি সে জানে? সে কি আর্টিজেন রেস্তোরাঁর নৈশভোজে জড়ো হওয়া নিরীহ বিদেশী বিশেষজ্ঞদের হত্যা সম্পর্কে পড়েছে? আরো অনেকের মত, যারা চরমপন্থী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর মতাদর্শে বিশ্বাস করে না, সে কি জানে আমার আপন খালাতো ভাই এবং তার বন্ধুকে আমার খালার সামনে সেই গোষ্ঠীর লোক জবাই করেছিল? তাদের দোষ তারা বিভিন্ন যৌন অভিমুখে বিশ্বাসী এবং তারা তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করছিল! সে কি মানবাধিকার গোষ্ঠীকে এই জঘন্য কর্মকাণ্ডকারীদের নিন্দা করতে বা কারো পছন্দ এবং মেলামেশার স্বাধীনতা প্রচার করার জন্য তাদের জীবন হারানো, তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলতে কখন শুনেছে?
সে কি জানে আজ কৃষকরা তাদের ফসলের সঠিক দাম পাচ্ছে এবং তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করতে, এবং খেয়ে পরে শান্তিতে বসবাস করতে সক্ষম হচ্ছে? সে কি জানে সারা দেশে আজ প্রায় সব বাড়িতেই বিদ্যুৎ আছে? সে কি জানে বাংলাদেশে আজ মা, নবজাতক ও শিশুমৃত্যু ভারতের তুলনায় অনেক কম? সে কি জানে যে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর যা ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও বেশি? সে কি জানে যে বেশীর ভাগ মহিলারা এখন সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে তারা কখন এবং কতবার গর্ভবতী হতে চায় এবং পরিবার পরিকল্পনার জন্য সহজে গর্ভনিরোধক পেতে পারে? আজ মোট উর্বরতা ( women total fertility) ৬ থেকে ২ এর নিচে নেমে এসেছে? সে কি জানে যে আজ বাংলাদেশের প্রতিটি কোণায় মোবাইল, ইন্টারনেট এবং ওয়াইফাই পরিষেবা পাওয়া যায় এবং মহিলারা এই সুবিধাটি সমান ভাবে উপভোগ করছে ? সে কি জানে আজ পুরুষ:মহিলা অনুপাত প্রায় ৫০:৫০, সেখানে পরিবারের কোন মেয়ে বা ছেলে অগ্রাধিকারের পছন্দ নেই। ছেলে মেয়েরা মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনামূল্যে বইসহ শিক্ষা পাচ্ছে? জনসংখ্যার সাক্ষরতার হার এখন ৭৫%। গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রেই দারিদ্র্যতা কমেছে। ২০২২ সাল নাগাদ, গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী ২০.২% বাংলাদেশি দারিদ্র্যের মধ্যে ছিল যখন শহর এলাকায় এই পরিসংখ্যান ১৪.৭% ছিল (যা ১৯৯০সালে ছিল প্রায় ৫৭%); ২০২২ সালে চরম দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান নেমে আসে গ্রামীণ এলাকায় ৬.৫% এবং শহরাঞ্চলে ৩.৮%। সে কি জানে বাংলাদেশে আজ ক্ষুধায় কেউ মরে যায় না? সে কি জানে শত শত ভূমিহীন পরিবার বিনামূল্যে ঘর পাচ্ছে? সে যখন বাংলাদেশে ছিল তখন বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার জন্য তাকে কত সময় ব্যায় করতে হত, আর এখন মেয়ে মানুষ হয়েও সে একা একাই বাংলাদেশের প্রতিটি কোণায় খুব সহজে এবং খুব অল্প সময়ে যেতে পারবে? অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ নয়, বাংলাদেশের জিডিপি মাথাপিছু ২৬৮৮ মার্কিন ডলার বা সমগ্র দেশের জন্য ৪৬০.২০বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। তাই বাংলাদেশ বর্তমানে প্রধান অর্থনীতির ৩৪তম স্থানে রয়েছে, ২০৪০ সালে হবে ২০তম। আমি তাকে বললাম, তুমি বলতে পারো, প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচারী, তুমি বলতে পারো বাকস্বাধীনতা বা মানবাধিকারের অভাব আছে কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও দৃঢ় নেতৃত্ব এবং তার নিষ্ঠা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে বাংলাদেশ বদলে গেছে। আপামর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাকে নিয়ে গর্বিত। ১৯৯০ এর দশকে তুমি যে বাংলাদেশকে দেখছো, বা চিনতে, বাংলাদেশ এখন সেই দেশ নেই। বাংলাদেশের মানুষ আজ গর্ব নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে এবং অন্যদের দ্বারা সম্মানিত হয়।
আমি জানতে চাইলাম সে কি আমাকে প্রমান সহ দেখাতে পারবে যে আমাদের দেশে কত শতাংশ মানুষ বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র খর্ব হবার কথা বলছে (সম্প্রতি একটি আমেরিকান সংস্থার বাংলাদেশে ১০০০ জন উত্তরদাতার মধ্যে করা জরিপে দেখা গেছে যে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গণতন্ত্র দেখতে চায়। আমি জানতে চাই যে ১০০০ জন যারা সাড়া দিয়েছেন তারা কোন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে এবং সমীক্ষার আত্মবিশ্বাসের ব্যবধান (confidence of interval) কী)। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের অস্ত্র যদি ভাগ্যবান কয়েকজনকে আরো উন্নীত করার জন্য ব্যবহার করা হয়, তাহলে ৯০% নীরব মানুষকে, যাদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না বা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করার কোন সুযোগ নেই, তাদের কে পিছনে ফেলে, বাংলাদেশের জন্য কী লাভ আনবে? হ্যাঁ, স্বীকার করি বাংলাদেশ এখনও নিখুঁত নয়, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রে ফাঁক রয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তার বিকল্প কী আছে? সেনা অভ্যুত্থান ও সেনানিবাসে সৃষ্ট দলগুলোকে ফিরিয়ে আনা? অথবা অনির্বাচিত তথাকথিত ধনী বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা শাসিত হওয়া? আমাদের কি ধর্মনিরপেক্ষ নীতি পরিত্যাগ করা উচিত এবং সেই চরম পন্থির ধর্মান্ধ দল গুলোকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা উচিত, যারা নারীমুক্তি, অঞ্চলের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না? যাদেরকে তারা পছন্দ করে না তাদের হত্যা করে? ভিন্ন ধর্মের লোককে হত্যা করে , যারা এখনো আমাদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না? যারা বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে চায়? প্রশ্ন করেছিলাম পশ্চিমা মতাদর্শীরা আমাদের সেই বিকল্পের দিকে ঠেলে দিতে চায় কিনা?
বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায় যখন নারীদের সমান ক্ষমতা নেই বা বলা যায়, যখন নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের নিজস্ব ঘর নেই, খাবার থালায় খাবার নেই, কৃষকরা তাদের ন্যায্য মূল্য পাচ্য় না, শিক্ষা নেই বা চাকরি ও অর্থনীতিতে প্রবেশাধিকার নেই, যারা তাদের বিশ্বাস ও ধর্মকে শান্তিপূর্ণভাবে অনুসরণ করে সমানভাবে সমৃদ্ধি করে সবার সাথে একই কাতারে চলতে চায় কিন্তু তাদের অধিকার খর্ব করা হয়? একটি দেশ কি সেই অল্প সংখ্যক উচ্চ শিক্ষিত এবং ধনীদের জন্য, নাকি নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য হওয়া উচিত যারা পিছিয়ে থাকতে চায় না? দুটি বড় ক্যান্টনমেন্টের দল দীর্ঘকাল বাংলাদেশ শাসন করেছে, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করেছে, তাদের বাংলাদেশের মানব উন্নয়নের অর্জন কী? সে বা তার মতো পশ্চিমা সুবিধাপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের জন্য কী বিকল্প প্রস্তাব করছে? আমার ব্রিটিশ সহকর্মী আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি বা দিতে পারেননি এবং আমরা আমাদের খাবার শেষে বৈঠকে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত নীরব ছিলাম। এখনও আমরা দুই বন্ধু। বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন ধারণা থাকার জন্য আমি আমার বৃটিশ সহকর্মীকে দোষ দেই না, সে যে তথ্য পাচ্ছে তার মাধ্যমে সে তার মতামত তৈরি করছে। প্রশ্ন হল এই ধরনের তথ্য কে বা কারা দারুন সফল ভাবে ছড়াচ্ছে, আর আমরা যারা বাংলাদেশ এবং এর উন্নয়নের প্রতি বিশ্বস্ত, তাঁরাইবা কি করছি বা প্রচেষ্টা চালাচ্ছি সেই মিথ্যা সম্প্রসারণ বন্ধ বা প্রতিহত করতে?
পশ্চিমের সব দেশেই আমাদের দূতাবাস আছে, সেসব দেশে প্রেস অ্যাটাশে আছে? প্রশ্ন করা দরকার ওই লোকেরা তাহলে কি করছেন? জেনেভা এবং অন্যান্য দেশে কাজ করার সময় আমি অনেক বাংলাদেশের কূটনীতিক এবং রাষ্ট্রদূতদের সাথে দেখা করার এবং কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সেখানে আমি অনেক প্রতিভাবান ও নিবেদিতপ্রাণ কূটনীতিক এবং রাষ্ট্রদূতদের দেখেছি। কিন্তু তাদের প্রয়োজন সময়মত সমন্বিত সহায়তা ও তথ্য। গতকাল রাতে ৭১ টেলিভিশনের ভূরাজনীতি ও বাংলাদেশ নিয়ে একটি টকশো শুনছিলাম। সেখানে দুজন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব, একজন সাবেক পুলিশ প্রধান ও রাষ্ট্রদূত, দুইজন অর্থনীতিবিদ, একজন সমাজ বিজ্ঞানী এবং একজন সাবেক প্রেস অ্যাটাশে ছিলেন। প্রাক্তন সাংবাদীক অ্যাটাশে ভারতে ছিলেন, যেখানে বেশিরভাগ আমেরিকান এবং পশ্চিমা মিডিয়ার আঞ্চলিক দপ্তর আর কর্মকর্তারা অবস্থিত। তিনি বলছিলেন অনেক আমেরিকান ও পশ্চিমা মিডিয়া আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিল কিন্তু বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তিনি তেমন সমর্থন পাননি। যদিও প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার খুব ভাল যোগাযোগ এবং বোঝাপড়া ছিল কিন্তু তুবুও সরকারি কর্মকর্তারা অনিচ্ছুক ছিলেন। তাই যদি হয়, তাহলে আমরা কীভাবে বিশ্ব সম্প্রদায়কে আমাদের কথা জানাব? আমি শুনছি ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা মন্ত্রীরা বার বার অভিযোগ করেন বিদেশে বাংলাদেশের বিরোধীরা বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে লবিস্ট বিনিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা দেশ এমনকি ইইউ পার্লামেন্টে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রভাব বিস্তার করছে। বিরোধীরা যদি তা করতে পারে তাহলে ক্ষমতাসীন দল কেন তা করতে পারছে না? বর্তমান সরকার এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশী অনেক বিজনেস টাইকুন প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন, তারা কি করছেন? ভবিষ্যতে উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে তারা কেন সত্য প্রচারে বিনিয়োগ করছেন না? আমাদের অনেক প্রবাসী রয়েছে, যারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সেলফি তুলতে এবং সেই ছবিগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে আগ্রহী, তারা সেলফি তোলা ছাড়া আর কী করছেন? আমাদের শাসক দলের প্রবাসীরা বা এমনকি যারা আমাদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে তারা ভবিষ্যতের আরো সুযোগ খোঁজা বা পাওয়া ছাড়া আর কী করছেন? আমি পড়ে খুব খুশি হয়েছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজ্যে বাংলাদেশী আমেরিকানরা একটি বৈঠকের আয়োজন করেছিল যেখানে একজন প্রজাতন্ত্রী কংগ্রেস সদস্য তার হতাশার কথা বলেছিল যে মার্কিন সরকার আমাদের জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিকে নির্বাসন দেয়নি বলে। লন্ডন বা প্যারিস বা ব্রাসেলসে কেন আমরা সেই কাজগুলো দেখতে পাচ্ছি না? আমি জানি যে কয়েকটি পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং ভবিষ্যতকে ক্ষুণ্ন করার জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সেই কর্মকাণ্ডে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে, তবুও আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি না।
আমি মনে করি, সময় এসেছে আক্রমণাত্মক হওয়ার যা টকশোতে সাবেক পুলিশ প্রধান ও রাষ্ট্রদূত বার বার বলছিলেন। চুপ করে বসে থাকার সময় এখন না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাই সব মোকাবেলা করবেন ভেবে আমরা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি না। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে সেই বাংলাদেশ বিরোধীদের মোকাবেলা করতে হবে এবং তাদের প্রতিহত করতে হবে। এটা আমাদের দেশ, ৯০% নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশের জন্য কি ভালো? গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের অজুহাতে, সেই ১০% ধনী এবং সুবিধাভোগীদের জন্য লড়াই না করে, নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য লড়াই করতে হবে যারা শান্তি, সম্মান এবং সমৃদ্ধিতে নিয়ে বাঁচতে চায়। আমার বৃটিশ সহকর্মীকে দোষারোপ না করে বরং আমাদের প্রচারণা ঘাটতির দিকে নজর দেওয়া উচিত এবং সেই ঘাটতিগুলো মেটাতে পদক্ষেপ নেওয়া আজই দরকার। আসুন সিঙ্গাপুরের পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীর মতো আগ্রাসী হয়ে উঠি এবং স্বার্থপর হয়ে নিজেদের ভালো, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য লড়াই করি। সিঙ্গাপুরের মত, যখন আমরা উন্নতি করব এবং সমৃদ্ধির সিঁড়ি বেয়ে উঠব তখন আমাদের সবাই সম্মান করবে, আমাদের সাথে সমান আচরণ করবে, আমাদের অধিকার সমুন্নত থাকবে। আমি খুব আত্মবিশ্বাসী বাঙ্গালী জাতি পরাধিনতা সহ্য করবে না।
মন্তব্য করুন
সিএনএন এর সাংবাদীক ট্যাপার, জন বোল্টনকে জিজ্ঞাসা করেছিল, "কোন দেশে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করার জন্য একজনকে কি মেধাবী হতে হবে না?" বোল্টন উত্তর দিয়েছিল: "আমি এমন একজন যে ভিন্ন দেশে, এখানে নয়, অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করতে সাহায্য করেছি। তাই আমি বলতে পারি অভ্যুত্থান/শাসন পরিবর্তনের জন্য অনেক পরিকল্পনা আর কাজ করতে হয়”।
পৃথিবী ব্যাপী খাদ্য, জ্বালানী ও নির্মাণ সামগ্রীর দাম উর্ধ্বমুখী। বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর মূল্যস্ফীতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এ জন্য খাদ্যসামগ্রীর মূল্য পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বেড়েছে রেকর্ড হারে। বাংলাদেশ ও তার বাইরে নয়। খাদ্য, জ্বালানী ও নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিতে সীমিত আয়ের বেশিরভাগ মানুষ তাই কষ্টে আছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন ও অর্জন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তাই এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মার্কিন অর্থনীতিবিদ জে আর পার্কিনসন এবং নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড একই সময়ে লন্ডনে প্রকাশিত 'বাংলাদেশ দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট' বইয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নের প্রমাণস্থল। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করতে পারে, তাহলে এটা উপলব্ধি করতে হবে যে প্রতিটি জাতিই এগিয়ে যেতে পারে। ২০৩৫ সালের মধ্যে, একসময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি হিসাবে পরিচিত দেশটি, বিশ্বের ২৫ তম বৃহত্তম অর্থনীতি হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।
গত মাসে একজন উপদেষ্টা হিসাবে, আমি জেনেভাতে একটি ডব্লিউএইচও উপদেষ্টা গ্রুপ মিটিংয়ে অংশ করি, যেখানে ছয়টি মহাদেশের বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিল। একজন মহিলা ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ, নারী অধিকারের প্রচারক এবং প্রবক্তা, সেও সেই বৈঠকে যোগ দিয়েছিল। আমি দীর্ঘদিন ধরে তাকে চিনি, অনেক সময় একসাথে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য বিষয় সম্পর্কে কাজ করেছি।