ইনসাইড থট

"স্বাধীনতার ঘোষক" প্রশ্নে আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও কেন আইন করছে না সরকার?


Thumbnail

জিয়াউর রহমানকে "স্বাধীনতার ঘোষক" বলা সংবিধানের লংঘন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সরকার চাইলে  এরকম বিকৃতিরোধে আইন প্রনয়ণ করতে পারে।"

উল্লেখ্য, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের উক্ত রায় সকল কর্তৃপক্ষ ও ব্যক্তির জন্য অবশ্যই পালনীয় এবং বাধ্যকর।

২০০৯ সালের ২১ জুন জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক বলে উপর্যুক্ত রায় দেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশ সংবিধান প্রনয়ণ কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা ব্যারিস্টার আমীর বলেন, "হাইকোর্টের রায়ের ওপর আপিল বিভাগের মাননীয়চেম্বার জজ (মোঃ আব্দুল আজিজ) স্থগিতাদেশ দেননি, ফলে হাইকোর্ট রায়ই চূড়ান্ত। মেজর জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে  ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল, হাইকোর্ট সেই বিকৃত ইতিহাস উড়িয়ে দিয়েছেন। এ সম্পর্কিত রিটের অন্যতম আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, "রায় স্থগিত না করায় হাইকোর্টের রায় বহাল থাকলো।"

এছাড়াও ২০১১সালের ৩০ জুন তারিখে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি এখন সম্পূর্ণ আকারে সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে। ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামো রূপে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দান করেছে। যার ফলে ঘোষণাপত্রটি সংবিধানের একটি অসংশোধনযোগ্য বিধানে পরিনত হয়েছে। আদালতের ঐতিহাসিক রায়ের পরেও স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে বিতর্কের অবসান ঘটেনি। বরং হরহামেশাই মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হচ্ছে। অথচ, আদালতের দিকনির্দেশনার আলোকে জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন করলে বিকৃতিরোধ সম্ভব।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২১ জুন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ সালামের দায়ের করা এক জনস্বার্থ রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক - মর্মে  রায় প্রদান করেন। আদালত জিয়াউর রহমানকে ২০০৪ সালে স্বাধীনতার ঘোষক উপস্থাপন করে প্রকাশিত "বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র"-এর তৃতীয় খণ্ড বাতিল ঘোষণা করেন। এই খণ্ডটি দেশ-বিদেশের সব স্থান থেকে বাজেয়াপ্ত ও প্রত্যাহারেরও নির্দেশ দেন। আদালত এ বাজেয়াপ্তের আদেশ যথাযথভাবে কার্যকর করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, যারা এরকম ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে জড়িত তারা সংবিধান লংঘন করেছেন। যারা বিকৃত ইতিহাস রচনা করেছেন সেই প্রত্যয়ন কমিটির বিরুদ্ধে ধোকাবাজি ও সংবিধান লংঘনের অভিযোগে সরকার চাইলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। আদালত দেশের সব মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বাধ্যতামূলকভাবে সন্নিবেশ করার জন্যও সরকারকে নির্দেশ দেন।

তখন ওই রায় স্থগিতে অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান আপিল বিভাগে আবেদন জানান এবং এর ওপর শুনানি হয়। শুনানিতে হামিদ উল্লাহ খানের কৌঁসুলী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন আহমাদ বলেন, "রায়ের সার্টিফাইড কপি (নকল) পেলে আমরা লিভ টু আপিল করব। সে পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত রাখা হোক।"

কিন্তু আপিল বিভাগের চেম্বার জজ  বিচারপতি আব্দুল আজিজ কোনও স্থগিতাদেশ না দিয়ে রায়ের নকল নিয়ে লিভ টু আপিল করতে বলেন। আদালতে হামিদউল্লাহ খানের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এবং ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। রিটকারী মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ এম এ সালামের পক্ষে কৌঁসুলী ছিলেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। সরকার পক্ষে ছিলেন, তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান।

অপরদিকে ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ঐতিহাসিক এক রায়ের আলোকে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়। যার  দ্বারা সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১৫০ সংশোধন অর্থাৎ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ১৯৭১-এর ভাষণ, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাত শেষে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার কর্তৃক জারীকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ভাষণ ও দলিল উল্লেখ করে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ হতে ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্থাৎ সংবিধান প্রবর্তন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়কালের জন্য ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি হিসেবে গণ্য করা হয় এবং ওই ভাষণ ও দলিলসমূহ সংবিধানে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিল হিসেবে সংযোজিত হয়। ২৬শে মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুমোদিত।

সে মতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ১০ জানুয়ারি ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার কর্তৃক জারীকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওই ঐতিহাসিক রায়ে বলা হয় যে,  সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭খ-এর দ্বারা সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ (নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সাপেক্ষে) এবং একাদশ ভাগের অনুচ্ছেদ ১৫০-সহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য করা হলো।

সুপ্রিমকোর্ট বলেন, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ২৬শে মার্চ ১৯৭১-এ প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বিতর্ক সৃষ্টি করার যেকোনো অপচেষ্টা গণপরিষদের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল এবং রাষ্ট্রদোহিতামূলক একটি অপরাধ। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ক(১)(খ)-এ উল্লেখ আছে, সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে বা তা কার্যকর করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে—তার এই কার্য ‘রাষ্টদ্রোহিতা’ হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবে। অনুচ্ছেদ ৭ক(২)-এ উল্লেখ করা হয়েছে কোনো ব্যক্তি যদি উপরোক্ত দফা (১)-এ বর্ণিত কার্য করতে সহযোগিতা বা উসকানি প্রদান করলে কিংবা কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করে, তবে তার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে সুনির্দিষ্টভাবে আইনানুগ বাধানিষেধ না থাকায় হরহামেশাই স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে। যেমন, মরহুম রাষ্ট্রপতি ও সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে "স্বাধীনতার ঘোষক" শুধু নন, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করেছেন তার পুত্র "একুশে আগস্ট হত্যাকাণ্ড" মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত (আইনের ভাষায় বিদেশে পলাতক আসামি) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রসঙ্গত বিএনপি নামক দলটির নিবন্ধন যে ব্যক্তিটির নামে সেই প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তার বানীতে জিয়াউর রহমানকে "স্বাধীনতার ঘোষক" না বলেননি। ২০০১ সালের ১২ নভেম্বর বদরুদ্দোজা চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ৩০ মে জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীর এক বানীতে বলেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসের গর্বিত সন্তান। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ঐতিহাসিক অবদান এবং বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার অবিস্মরণীয় কর্মকাণ্ড ইতিহাসে তার স্থান চূড়ান্তভাবে নির্ণয় করেছে। তিনি ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়েছেন।"

রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের একনম্বর ব্যক্তি এবং সংবিধানেরও অভিভাবক, আর এ জন্যই তিনি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে শপথ ভঙ্গ করেননি। সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের শপথ তিনি যথাযথভাবে পালন করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতির পদই হারান। বিএনপির সংসদীয় দলের বৈঠকে অনাস্থা প্রস্তাব আনার প্রেক্ষিতে  ২০০২ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন অধ্যাপক ডাঃ একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।

 জিয়াউর রহমান যাকে হটিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেছিলেন, সেই বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য।

বিচারপতি সায়েম তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে লিখেছেন, "  "গত ১৫ আগস্ট কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত এবং চাকুরীরত সামরিক অফিসার এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবার পরিজনকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক আইন জারি করেন।

গত ৩০ মে জেনারেল জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীর বানীতে বিএনপির  মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন জিয়াউর রহমান  "স্বাধীনতার 'ঘোষক"।

যাহোক ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’ পনেরো খণ্ডের সিরিজ গ্রন্থের ২০০৪ সালের পুনর্মুদ্রণকৃত তৃতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন মর্মে বর্ণনা করা হয়।

তখন এর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ এম এ সালাম ২০০৪ সালে পুনর্মুদ্রিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র গ্রন্থ সিরিজের তৃতীয় খণ্ডটি বাজেয়াপ্ত এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন।

 ২০০৯ সালে হাইকোর্ট এক রায়ে ২০০৪ সালে পুনর্মুদ্রিত ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘মেজর জিয়ার প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা’ শিরোনামে মুদ্রিত বর্ণনা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় সাংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০-এর সঙ্গেও সাংঘর্ষিক এবং সংবিধান পরিপন্থী মর্মে ঘোষণা করেন; এবং উপরোক্ত খণ্ডটি বাজেয়াপ্ত করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

হাইকোর্টের স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) এম ইনায়েতুর রহিম বলেছিলেন, "দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ক্ষমতায় বসে স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছেন তা বিকৃত করার যে অপচেষ্টা করছিল এ রায়ের মাধ্যমে তার মৃত্যু হলো।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক প্রত্রিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আদালতের রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের পূর্বেই শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিএনপি নেতা প্রয়াত মওদুদ আহমেদের লেখা 'ইরা অব শেখ মুজিব' গ্রন্থের কথা উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত তৎকালীন লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের লেখা জাতির জনক শিরোনামের প্রবন্ধের উল্লেখ করে আদালত বলেন, জিয়াউর রহমান ওই প্রবন্ধে ২৫ মার্চের বিস্তারিত বিবরণ দেন। কিন্তু কোথাও নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। তিনি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলে আখ্যায়িত করেন। এতে জিয়াউর রহমানের সততার প্রকাশ পায়। ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের দেওয়া ভাষণের উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সম্পর্কে জিয়াউর রহমান তার ভাষণে বলেন 'কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে আপনাদের উদ্দেশে কথা বলার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।' কিন্তু তিনি ওই ভাষণেও নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে এতে বলা হয়, ছাত্রনেতা থেকে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা এবং এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার হয়েছেন। জীবনের তিন ভাগের একভাগ শেখ মুজিব কারাগারে কাটিয়েছেন। তিনি একাত্তুরের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের পর ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সরকার তার মনোবলে একটুও চির ধরাতে পারেনি। কোনো মুচলেকায় তিনি স্বাক্ষর করেননি। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি কেবল শ্রেষ্ঠ মুুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার ঘোষকই ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা একাত্তুরের ২৬ মার্চ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এই ঘোষণার কথা সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে। "

জিয়া তার ঘোষণাতেই স্পষ্ট করে বলেছেন: "মহান জাতীয় নেতা, বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।" এমনকি এই ঘোষণার তৃতীয় বাক্যটিতেও জিয়াউর রহমান আবারও on behalf শব্দযুগল ব্যবহার করে বলেন: "অতএব আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে…"

জিয়াউর রহমান কর্তৃক এই ঘোষণা পাঠে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের কৃতিত্বই স্বীকার্য।

জিয়াউর রহমান এখানে শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের পাঠক মাত্র। টেলিভিশনে সংবাদ পাঠক (News caster) যেমন পাঠের সূত্রে সংবাদের নায়ক হতে পারেন না, বরং নিছকই পাঠক, তেমনি জিয়াউর রহমান ঘটনাক্রমে এর পাঠক মাত্র। এমনকি তিনি এর প্রথম পাঠকও নন, কারণ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান তার আগেই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। ফলে পাঠক হিসেবেও তিনি প্রথম নন। আর ঘোষক হিসেবে তিনি প্রথম বা দ্বিতীয়– কোনোটাই নন। কবিতার আবৃত্তিকার যেমন আবৃত্তির সূত্রে কবিতাটির রচয়িতা বলে নিজেকে দাবি করতে পারেন না, ঠিক একইভাবে জিয়াউর রহমানকে কোনোভাবেই স্বাধীনতার ঘোষক বলা যায় না। জিয়ার শাসনামলে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত "বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র"তে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে শেখ মুজিবের নামটিই লেখা। বঙ্গবন্ধুর পর ২৬ মার্চ দুপুর আড়াইটায় চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের তৎকালীন সভাপতি এম এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রটি পাঠ করেন। রাত সাড়ে সাতটায় পাঠ করেন আবুল কাশেম সন্দীপ।

জিয়া যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তা এই দুজনার পাঠ করারও একদিন পর। তখন তার পাশেই উপস্থিত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কর্মরত বেলাল মোহাম্মদ। তিনি জীবিত থাকতেই জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষনার প্রেক্ষাপট লিখে গেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের ঘটনা ২৭ মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশ হয়।

আ ফ ম সাঈদ তার ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা: ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস’ বইতে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টের একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। ওই সংকলন অনুযায়ী বিবিসির খবরে তখন বলা হয়, ‘.কলকাতা থেকে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের খবরে প্রকাশ করা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গোপন বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।’ ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়, ‘ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের কাছে সহযোগিতার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।’ দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান-এর খবর ছিল, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে শেক মুজিবুর রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।’

দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন ২৭ মার্চের পত্রিকায় ‘সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান: শেখ এ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্ট' শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খানর ভাষণে শেখ মুজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলার কথা উল্লেখ করা হয়।

ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় বলা হয়, ‘২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে রেডিওতে ভাষণ দেওয়ার পরপরই দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।’ এর বাইরে ভারতের বহু সংবাদপত্র এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ক্যানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর। আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেস হেরাল্ডের ২৭ মার্চের সংখ্যার একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘বেঙ্গলি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডিক্লেয়ার্ড বাই মুজিব।’ নিউইয়র্ক টাইমস-এও শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়। পাশেই লেখা হয় ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক। বার্তা সংস্থা এপির খবর ছিল, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।’ আয়ারল্যান্ডের দ্য আইরিশ টাইমস-এর শিরোনামেও ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা, আর সঙ্গে ছাপানো হয় বঙ্গবন্ধুর ছবি।

ব্যাংকক পোস্ট-এর খবরে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’

চট্টগ্রামে পৌঁছানো বার্তা ছড়ায় সারা বিশ্বে। ঐতিহাসিক বার্তাটি রাতের মধ্যেই পৌঁছে যায় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসার ৮০৭৮৫ নম্বরে ২৫ মার্চ রাতে একটি কল আসে। ফোনটি ধরেন তাঁর স্ত্রী, মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ডা. নুরুন্নাহার জহুর। তিনি বার্তাটি রাত ৩টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডর ছলিমপুর আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ওয়্যারলেস স্টেশনের কোস্টাল অপারেশনাল বিভাগের কর্মীদের কাছে পৌঁছে দেন। বার্তাটি লিখে নেন টেলিফোন রেডিও টেকনিশিয়ান জালাল আহমেদ। রাতের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটির হাতে লেখা কপি চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান, নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকীসহ কয়েকজনের কাছে পৌঁছে বলে এম এ হান্নান জানিয়েছেন গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হককে। জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসায় আসা বার্তাটি ওই রাতেই হাজারি গলির বিনোদা ভবনে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নিয়ে বাংলায় অনুবাদ করে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে কপি করে কর্মীদের কাছে পৌঁছানো হয় বলেও তিনি জানান। পরে আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরীর পাথরঘাটার বাসার সাইক্লোস্টাইল মেশিনেও বার্তাটি কপি করে বিলিয়ে দেওয়া হয়। ছলিমপুর আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ওয়্যারলেস স্টেশনের কর্মীরা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা সমুদ্রে অবস্থিত বিদেশি জাহাজ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে কলকাতা বেতারের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেন, যা ২৬ মার্চ সকাল ৭টা-৮টার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থান, এমনকি বহির্বিশ্বে।

ছলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনের কর্মী আবদুল কাদের গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, সকাল প্রায় সাড়ে ৬টা-৭টার দিকে বার্তাটি ইন্ডিয়ান জাহাজ ‘ভিভি গিরি’, অন্য বিদেশি জাহাজ ‘সালভিটা’, ইউনাইটেড নেশনের জাহাজ ‘মিনি লা-ট্রিয়া’সহ বেশ কয়েকটি জাহাজে ডুপ্লেক্স চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। সকাল ৯টায় ভারতের বেতার আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে সংবাদ প্রচার করা হয়, ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।

সকাল ১০টায় নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মালেক উকিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তা জনসমাবেশে পাঠ করেন। পৌনে ২টার সময় চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে এই ঘোষণা আবার প্রচার করেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। ২৭ মার্চ ঘোষণটি পাঠ করেন মেজর জিয়াউর রহমান।

২৭ মার্চ নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় বলা হয়, ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান দুটি বার্তা সম্প্রচার করেছেন। একটি অজ্ঞাত রেডিও স্টেশন থেকে বিশ্বের কাছে পাঠানো এক বার্তায় আওয়ামী লীগ নেতা (শেখ মুজিব) ঘোষণা দিয়েছেন যে ‘শত্রু’ আঘাত হেনেছে এবং জনগণ বীরের মতো লড়াই করছে। বার্তাটি কলকাতা থেকে শোনা হয়েছে। রেডিও স্টেশনটি নিজেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করেছে। শিলং থেকে শোনা স্টেশনটির পরবর্তী সম্প্রচারে শেখ মুজিব বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছেন। ২৭ মার্চ মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়াও ওই সম্প্রচার থেকে পাওয়া বার্তার বিষয়বস্তু প্রকাশ করে।

১৯৭৪ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলার তৃতীয় পৃষ্ঠায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণাপত্র’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ পাঠান। জনাব চৌধুরী চট্টগ্রামের কাছে বঙ্গোপসাগরে নোঙর করা জাহাজের সাহায্যে টেকনাফ থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে ও কয়েকটি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশকে বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার কথা জানিয়ে দেন।’ ছলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশনের কর্মীরা ১৯৭২ সালে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

মগবাজার ওয়্যারলেস স্টেশন থেকে ছাড়াল বার্তা। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত একটি কপি ২৬ মার্চ রাত সাড়ে ৪টা-৫টার দিকে মগবাজার ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) ওয়্যারলেস স্টেশনে পৌঁছে যায়। এটি গ্রহণ করেছিলেন সহকারী প্রকৌশলী মো. আবদুল কাইউম ও ইঞ্জিনিয়ার সুপারভাইজার মেজবাহ উদ্দিন। তাঁরা বার্তাটি সকালেই চট্টগ্রামের ছলিমপুর স্টেশনসহ দেশের বিভিন্ন ওয়্যারলেস স্টেশনে পাঠিয়ে দেন। আবদুল কাইউম গবেষককে দেওয়া সাক্ষৎকারে জানান, ভোররাতে সাদা ফুলস্কেপ কাগজে লেখা বার্তাটি তাঁদের কাছে আসে। একজন লোক সেটা পৌঁছে দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি মেসেজ পাঠিয়েছেন। তখন মগবাজার ভিএইচএফ ওয়্যারলেস স্টেশনের সঙ্গে বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ অংশের যোগাযোগ ছিল। সকাল ৬টার দিকে ওয়্যারলেসযোগে পয়েন্ট টু পয়েন্ট, বিশেষ করে যেসব স্থানে ওয়্যারলেস স্টেশন চালু ছিল, সেসব জায়গায় বার্তাটি পাঠিয়ে দিই।

পিলখানা থেকে ঘোষণা প্রচারকারী শহীদ হলেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সেলিনা পারভীন ওরফে রীতা গবেষককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পিলখানা থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা পিলখানায় ইপিআর সিগন্যাল কোরের সুবেদার মেজর শওকত আলী। ওই রাতেই তাঁকে হত্যা করে পাকিস্তানির।

বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনীয় মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের জন্য একাধিক ব্যক্তির মাধ্যমে ট্রান্সমিটার তৈরি করে রেখেছিলেন বলে আওয়ামী লীগের নেতা ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। ঢাকা থেকে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার হয়েছিল বলে জানা যায়। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী হাজি মোরশেদ ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিলেন বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার সময় পর্যন্ত। ট্রান্সমিটারে বঙ্গবন্ধুর বার্তা প্রচার সম্পর্কে তিনি জানান, “...রাত ১১টা বেজে গেল, ১২টা প্রায় বাজে বাজে, এমন সময় একটা টেলিফোন আসল। বলে, ‘আমি বলধা গার্ডেন থেকে বলছি। মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কী করব?’ আমি মুজিব ভাইয়ের কাছে দৌড়ে গিয়ে তাঁর কথা বললাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘মেশিনটা ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বল।’ আমি তাঁকে (বার্তা প্রেরক) সে কথা বললাম।”

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার টিক্কা খানের গণসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তাঁর উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে ট্রান্সমিটারে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে রেকর্ড করা স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর  আত্মসমর্পণকারী পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল নিয়াজীও তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ও স্বাধীনতার ঘোষণাকারী, এজন্যই তাকে সামরিক আদালতে মৃত্যুদন্ড দেয়। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপটে এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর ক্ষমতায় উত্থান দৃশ্যপট বদলে যায়। যে কারণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে পারেনি বরং ভুট্টোকে মুক্তি দিতে হয় শেখ মুজিবকে।   



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

প্রথম আলোর পর কী ডেইলি স্টারও বিক্রি হবে?


Thumbnail

এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি হচ্ছে প্রথম আলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যদি প্রথম আলো কে বা কারা কিনবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তবে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান চাইবেন কোথায় গেলে তার চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। সেভাবেই তিনি বিক্রি করার চেষ্টা করবেন।

প্রথম আলো বিক্রির বিষয়টির পাশাপাশি একই রকম আরেকটি প্রশ্ন সামনে আসছে। আর সেটা হলো প্রথম আলোর পরে কে? তাহলে কি প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টার? তবে এটা নির্ভর করবে প্রথম আলোর কি ভাগ্য হয় তার ওপর। আমার ধারণা যারাই প্রথম আলো কিনেন না কেন তারা প্রথম দিকে মতিউর রহমান সাহেবকে রাখলেও পরবর্তীতে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে সম্পাদক পরিবর্তন করবে। আর প্রথম আলো যদি কোন যুক্তিপূর্ণ লোকের কাছে দেয় তাহলে আমার মতে এখানে সম্ভবত আনিসুল হক সাহেব সম্পাদক হবেন। কারণ তার প্রতি লোকের অনেক শ্রদ্ধাবোধ আছে এবং তিনি সবসময় একটা রেড লাইন রক্ষা করে চলেন। এটা আমরা সকলেই জানি। তার সাথে অনেকেরই  ভালো সম্পর্ক এবং তিনি খুবই জ্ঞানী লোক।

এর আগে মতিউর রহমান যখন একতা থেকে আজকের কাগজে যান, তখন তার উদ্দেশ্যই ছিল যে, একটি পত্রিকা কীভাবে চলে সেটা শেখা এবং এখান থেকে একসাথে সাংবাদিক নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। তিনি সেটা করেছিলেন। তারপর ভোরের কাগজ থেকে একই কাজ করেছেন। সুতরাং তার সত্যিকারের নীতিবোধ বলতে যেটা বোঝায় সেটা দুর্ভাগ্যবশত তিনি প্রমাণ করতে পারেননি।

তিনি এক সময় কমিউনিস্টদের সাথে থাকলেও এখন তার চেয়ে বড় দক্ষিণপন্থী পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। এ কারণে প্রথম আলো যে বিক্রি হবে এই ব্যাপারে সাধারণ লোকের ভিতরে এখন আর কোন সন্দেহ নেই।

এখন প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টারের কী হবে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে এবং এই আলাপ আলোচনা খুব দীর্ঘদিন যে চলবে তা না। আমার মনে হয় জুন-জুলাই মাসের ভিতরেই এর একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। কারণ স্বাভাবিক ভাবেই বুঝি যে, একটি পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তা পেতে বেশ সময় লাগে। এটা একদিন দুইদিনের ব্যাপার না। আবার ঠিক তেমনিভাবে যখন পাঠকপ্রিয়তা কমতে থাকে সেটাও একদিন দুইদিনে হয় না। ধীরে ধীরে হয়। এই মিডিয়া জগতের নিয়মই তাই।

আমি ১৯৬১ সালে পত্রিকা বলতে শুধুমাত্র ইত্তেফাক এর কথাই জানতাম। সেই ধারণা থেকে বলতে পারি এখন প্রথম আলোর যদি কিছু কর্মী এর চেয়ে ভালো কোন সুযোগ সুবিধা দেখেন তাহলে তারা বিক্রি হওয়ার আগেই চলে যাবেন। কারণ স্বাভাবিকভাবেই একজন সাংবাদিকের একটা ক্যারিয়ার আছে এবং প্রথম আলোর মতো পত্রিকাতে কাজ করে তিনি তো যে কোন পত্রিকায় যেতেও পারবেন না। তার কারণ গেলে তার ওই লেখার যে মান সেটা মূল্যায়ন নাও হতে পারে। তবে আমার ধারণা প্রথম আলোতে কাজ করেছেন এমন যে কাউকে টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আমি অবাক হব না যদি দু এক মাসের ভিতরে দেখা যায় যে আস্তে আস্তে প্রথম আলো বিভিন্ন কর্মী অন্য পত্রিকায় যাওয়া শুরু করে দিয়েছেন।

ব্যাংক মার্জারের যেমন একটি ঘটনা বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঠিক তেমনি পত্রিকা জগতেও শিল্প গোষ্ঠীর যে গন্ডগোলের ঘটনা ঘটেছে এটিও ব্যাংক মার্জারের ঘটনার পর্যায়ে চলে যাবে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুটি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। আর এদিকে দেখা যাবে, সংবাদকর্মীরা অন্য পত্রিকায় চলে যাচ্ছে।

তবে আমার মনে হয় না, এখন যে অবস্থা চলছে এতে প্রথম আলো আর আগের মতো প্রথম আলো থাকতে পারবে। এটা কিছুতেই সম্ভব না এটি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। তাই আমার মনে হয় প্রথম আলো সেই ব্যাংক মার্জারের পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন অন্য পত্রিকা যাদের আছে, তারাও প্রথম আলো কিনে নিতে পারেন। এটি সম্ভব। এরকম শিল্পগোষ্ঠীর কোন কমতি বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। যে কোন শিল্প গোষ্ঠীই এটা কিনবে।

তবে আমি আশা রাখব, যারাই প্রথম আলো কিনবে, তারা যেন অন্তত পক্ষে এটা খেয়াল রাখে যাতে সাংবাদিকদের কোন ক্ষতি না হয়। সুতরাং এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার দাবী হচ্ছে সাংবাদিকরা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।


প্রথম আলো   ডেইলি স্টার  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

ভুলের চোরাগলিতে আটকে গেছে বিএনপির রাজনীতি


Thumbnail

বিএনপির রাজনীতি এখন ভুলের চোরাগলিতে আটকে গেছে। রাজনীতিতে একের পর এক ভুল করার কারণে তারা এখন হতাশায় নিমজ্জিত। কোন কী বলতে হবে সেটার খেই হারিয়ে ফেলেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। 

বিএনপি এখন দাবি করছে যে, তাদের ৬০ লাখ নেতাকর্মী জেলে আছেন। এখানে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি হল যদি ৬০ লাখ কর্মী তাদের থাকত তাহলে এতদিনে তারা কেন আন্দোলনে ব্যর্থ হল? যদি এত সংখ্যক নেতাকর্মী থাকত তাহলে তো অনেক আগেই সরকারের পতন ঘটে যেত। কারণ সরকারের পতন ঘটানোর জন্য এক লাখ নেতাকর্মী হলেই যথেষ্ট। কিন্তু এত সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়েও তারা ব্যর্থ কেন! এত বড় সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে তারা তাদের নেত্রীকে জেল থেকে মুক্ত করতে পারেনি। কোন আন্দোলনই তারা করতে পারল না! বরং তাদের নেত্রীকে সরকারের অনুকম্পায় ফিরোজায় থাকতে হচ্ছে। ফলে স্বভাবতই বিএনপির নেতাকর্মীর সংখ্যা কত সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আর এত নেতাকর্মী থাকা সত্বেও তাদের নেতাকে লন্ডনে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে! 

দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হল বিএনপির ৬০ লাখ নেতাকর্মী যদি জেলে থাকেন তাহলে দেশের জেলখানা গুলোর ধারণ ক্ষমতা কত। এবং সেখানে যদি বিএনপির নেতাকর্মীর সংখ্যাই হয় ৬০ লাখ তাহলে এর মধ্যে সাধারণ কয়েদি কোথায় আছেন। তাদেরকেই বা কোথায় রাখা হয়েছে।

কথায় আছে, পথের মাঝে পথ হারালে আর কি পথ ফিরে পাওয়া যায়! বিএনপির অবস্থায় এখন তাই। তারা রাজনীতির পথের মাঝে রাজনীতির পথ হারিয়ে ফেলেছেন। কোনটা রাজনীতি আর কোনটা রাজনীতি নয় সেটাও বিএনপির নেতাকর্মীরা বোধহয় ভুলে গেছেন কিংবা বুঝতে পারছেন না। অন্য আরেকটি কথায় আছে যে, স্বপ্নে যখন কেউ কিছু খাবে তখন পান্তা খাবে কেন? পোলাও কোরমা খাওয়াই ভালো। বিরিয়ানিও খাওয়া যেতে পারে। সুতরাং ৬০ লাখ না বলে তাদের বলা উচিত ছিল বাংলাদেশে তো প্রায় ১৮ কোটি লোক আছে এর মধ্যে ৬ কোটি লোকই বিএনপির নেতাকর্মী। তাহলে অত্যন্ত লোকে আরও ভালো ভাবে বুঝত যে, বিএনপি আসলেই অনেক বড় একটি শক্তিশালী দল এবং তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিরা বুঝতে পারত যে, বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা অত্যন্ত ভালো। 

তবে বাস্তবতা হল বিএনপি ৬০ লাখ নেতাকর্মী দাবি করলেও আসলে তাদের কোন জনসমর্থনই নাই। যদি তাই থাকত তাহলে তারা নির্বাচন বিষয়টিকে এত ভয় পেত না। নির্বাচন বর্জনের মতো সিদ্ধান্ত নিত না। শুধু তাই নয়, বিদেশিও তাদের কোন বন্ধু নাই। যারা আছে সেই বন্ধুদের কথায় দলটি বরং এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাচ্ছে। দেশিয় বিএনপির যে সমস্ত বন্ধুরা ছিলেন, বিভিন্ন সময় বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে কিছু লেখালেখি করতেন, তাদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতার স্বপ্ন দেখাতেন তারাও এখন হারিয়ে গেছেন। সব কিছু মিলিয়ে দলটি এখন অনেকেটা এতিম হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত সামনে দলটির নাম নিশানাও থাকবে না। যারা নিজের দলের নেতাকর্মীর সঠিক সংখ্যা জানেন না তাহলে বুঝতে হবে সেই দলটি এখন কোন পর্যায় গেছে। কতটা দেউলিয়া হলে একটি দলের নেতাকর্মীর সংখ্যা নিয়ে তারা নিজেরাই বিভ্রান্ত হন। সুতরাং দলটি যে অচিরেই হারিয়ে যেতে বসছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বৈশাখে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে

প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ অর্থাৎ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক; নববর্ষে পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। রমজান ও ঈদের পর দেশের মানুষের জীবনে আরো একটি উৎসবের ব্যস্ততা নতুন বছরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উদ্ভাসিত।ফিলিস্তিনবাসীর উপর হামলা আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এর মধ্যে মারা গেছেন অসংখ্য মানুষ।তবু মৃত্যুর মিছিলে জীবনের গান ফুল হয়ে ফুটেছে। যুদ্ধের সংকট আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি কারণ পৃথিবীর মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে এদেশে বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে। 

১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের নববর্ষ। টি এস এলিয়টের ভাষায় ‘এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস’, দেখা যাচ্ছে কবির কথাই সত্য। তাপদাহে এই এপ্রিলই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তবে এই এপ্রিল আমাদের বৈশাখি/বৈসাবি/বিজু উৎসবের মাস- খররৌদ্র আর তীব্র ঝড়ের মাস হলেও। বৈশাখকে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন ‘মোহন ভীষণ বেশে’, দেখেছিলেন ‘অতলের বাণী খুঁজে পাওয়া মৌনী তাপসরূপে’। অন্য কবি লিখেছেন- ‘রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল/আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল/ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল লয়ে অশনি।’ বৈশাখে এই ‘অশনি’র খেলা নিশ্চয় কারো কাছে প্রত্যাশিত নয়।

বিশ্ব পরিস্থিতির সংকট আমাদের বৈশাখি আয়োজনের মধ্যে গরল উগড়ে দিলেও অতি সহজ-সরল, প্রশান্ত কিন্তু উদ্দীপনাময় আয়োজন এবারও। এখন আমরা প্রাণিত, আমাদের চিত্ত আনন্দিত এবং আমাদের চেষ্টা অব্যর্থ। অতীতের মতো এবারও সকালে হালখাতা খুলে দোকানে বসবে ব্যবসায়ী, বৈশাখি মেলায় নাগরদোলা, পুতুলনাচের উৎসবে শিশুদের কোলাহল শোনা যাবে। প্রতিবছর যেসব থিম অনুসারে সারাদেশে মঙ্গলশোভা যাত্রা অনুষ্ঠিত হতো তাও এবার হবে। রমনার বটমূলের প্রত্যুষের ছায়ায় আয়োজিত ছায়ানটের অনুষ্ঠান এবারও হচ্ছে।আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নতুন বছরকে বরণ করার জন্য তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানও শুরু হয়েছে।‘পাচন’ আর ‘পুণ্যাহে’র মতো নানাবিধ ব্রত ও বিধি পালনের সকল প্রথা অনুসৃত হচ্ছে।একসময় ভারতবর্ষে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি ফলনের খাজনা আদায় করা হতো। ফলে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল কৃষিকাজে ফসল না থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা দিতে বাধ্য হতো কৃষকরা। খাজনা আদায়ের সময়টিকে কৃষকদের জন্য সহনীয় করতে প্রবর্তিত হয় ‘ফসলি’ সন। আসলে হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন সনের নিয়ম প্রচলন করা হয়েছিল। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনার শুরু। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। ক্রমান্বয়ে ফসলি সন বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত লাভ করে। 

বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি সূচনা হয় সূর্যোদয়ের প্রত্যুষে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব। ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ২০২৩ অবধি ছায়ানটের রমনার বটমূলে বর্ষবরণ আয়োজন হয়ে এসেছে। অন্যদিকে নব্বই দশক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ সকালে মঙ্গলশোভাযাত্রা বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণের সূচনা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার পর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের উৎসাহে ২০১৩ সাল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। একইসঙ্গে ওইদিন গ্রামবাংলায় আয়োজিত হয় চড়ক মেলা।

নববর্ষের সকল আনন্দ, উৎসব ও অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা স্মরণ করেও আমরা আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, সংকটে আক্রান্ত বিশ্বে আমাদের কাছে এখন বেঁচে থাকার গৌরব অত্যন্ত বেশি। নিকট আত্মীয় হোক, দূরের বন্ধু হোক, দিনে হোক, দিনের অবসানে হোক, আমরা এখন ভালোভাবে বেঁচে থাকতে  চাই। সংকট এলে কী করি, কীভাবে অগ্রসর হই, কোথায় যাই, কোথায় সেবা করে আত্মবিসর্জন করতে হবে, এটাই শান্তচিত্তে আমরা খুঁজছি। ১৪ এপ্রিল শুরু হওয়া নতুন বছরের আগে ছিল কাজ, অকাজ, অকারণ কাজ, যে উপায়েই হোক, জীবনের শেষ নিমেষপাত পর্যন্ত ছুটাছুটি করে, মাতামাতি করে বেঁচে থাকা। ওই কর্ম-নাগরদোলার ঘূর্ণিনেশা আমাদের পেয়ে বসেছে বলেই পৃথিবী হয়েছে শান্তিতে পূর্ণ। অবশ্য দুর্গম হিমালয়শিখরের নিরুদ্বিগ্ন প্রাণিদের জীবন বিপন্ন; জনশূন্য তুষারমরুর বিশ্বস্তচিত্ত সীল এবং পেঙ্গুইনদের নির্বিরোধে প্রাণধারণ করার সুখটুকু বিলীন এখন। বাণিজ্যপুঁজি ও শিল্পপুঁজির দাপটে আফ্রিকা আর দক্ষিণ-আমেরিকার প্রত্যন্ত দরিদ্র অঞ্চলেও আধুনিকতার নামে মৃত্তিকাসংলগ্ন সভ্যতার তিরোধান ঘটেছে। বিচিত্র কর্মের পিছনে মানুষের ছুটে চলার বিপরীতে রয়েছে নির্জন প্রকৃতির স্তব্ধতা। তার রূপ অক্লিষ্ট অক্লান্ত, তার সাজগোজ বিস্তীর্ণ নীলাকাশ থেকে অরণ্যের সবুজে প্রসারিত। প্রকৃতি নিজেকে চিরকাল প্রকাশমান রেখেছে, মানুষের মতো ঊর্ধ্বশ্বাস কর্মের বেগে নিজেকে অস্পষ্ট করে তোলেনি। মানুষের কর্মের চতুর্দিকে অবকাশ ও চাঞ্চল্যকে ধ্রুবশান্তির দ্বারা মথিত করে সে চিরনবীনের বার্তাবাহক। এই একুশ শতকেও গ্রামীণ জীবনের প্রাধান্যের মধ্যে বাঙালি হিসেবে রাতদিনের কর্মযজ্ঞে ইউরোপ-আমেরিকার মতো আমাদের ব্যস্ত থাকার কথা নয়। এখনো প্রকৃতির উদার শান্তি, বিশাল স্তব্ধতার মধ্যে আমরা পরিভ্রমণ করতে পছন্দ করি। এজন্যই বৈশাখের তপ্ত আকাশ, তার শুষ্ক ধূসর প্রান্তরের নীরব মধ্যাহ্ন, নিঃশব্দ রাত্রি অথবা ঝড়ো হাওয়ার আলিঙ্গনে আমাদের জীবন মুখরিত হয়।

আজকের দিনের বহু আড়ম্বর, আস্ফালন, করতালি, মিথ্যাবাক্য, যা আমাদের স্বরচিত, যাকে বাংলাদেশের মধ্যে আমরা একমাত্র সত্য, একমাত্র বৃহৎ বলে মনে করছি, সেই কর্পোরেট কালচারের ঢেউ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারণ নববর্ষ সকলকে একই কাতারে নিয়ে আসে। সেখানে শ্রমজীবী আর বুদ্ধিজীবী একসঙ্গে চলেন, প্রত্যেকে নিজকে এবং জগৎকে ঠিকভাবে দেখতে পান, উৎসবের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিলনলাভ সম্ভব হয়। উৎসবের আয়োজনে ব্যক্তিগত ভোগের নিবিড়তা নেই বরং বৈশাখি আনন্দ আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীর মধ্যে ব্যাপ্ত করে দিয়েছে মহত্ত্ব। নববর্ষের আনন্দ আমাদের ঘরকে, মনকে, সমাজকে কলুষের ঘনবাষ্প থেকে অনেকটা পরিমাণে নির্মল করে রাখে, দূষিত বায়ুকে বদ্ধ করে রাখে না এবং মলিনতার আবর্জনাকে একেবারে গায়ের পাশে জমতে দেয় না। পরস্পরের কাড়াকাড়িতে ঘেঁষাঘেঁষিতে যে রিপুর দাবানল জ্বলে উঠে উৎসবে তা প্রশমিত থাকে; কর্মের সঙ্গে শান্তিকে জড়িত করে রেখে বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি করে। উৎসব আমাদের শিখিয়েছে মানুষ বড়ো, পদ বড়ো নয়; দারিদ্র্য লজ্জাকর নয়, সকল কর্মে, সকল অবস্থাতেই সহজে মাথা তুলে রাখা যায়। আমাদের দেশে স্বস্থানের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সকলেই আপনার নিশ্চিত অধিকারটুকুর মর্যাদা ও শান্তি লাভ করে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ধনি হওয়ার প্রচেষ্টা অন্যকে ছোটো করে দেখার দৃষ্টি তৈরি করে দেয় না। এজন্য নববর্ষের উৎসব সর্বজনীন।

এসেছে পহেলা বৈশাখ, ৩০ চৈত্রে ১৪৩০ বঙ্গাব্দ বিদায় নিয়েছে। এজন্য- ‘উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা/বিপুল নিঃশ্বাসে।’ রবীন্দ্রনাথ ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘পুরাতনই চিরনবীনতার অক্ষয় ভাণ্ডার।...নূতনত্বের মধ্যে চিরপুরাতনকে অনুভব করিলে তবেই অমেয় যৌবনসমুদ্রে আমাদের জীর্ণ জীবন স্নান করিতে পায়।’ এই ‘চিরপুরাতন’ হলো আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। আজকের এই নববর্ষের মধ্যে বাঙালির বহুসহস্র পুরাতন বর্ষকে উপলব্ধি করতে হবে। কারণ সেখানে রয়েছে সম্রাট আকবর কর্তৃক বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিহাস, সেখানে আছে গ্রামীণ বাংলার হালখাতা আর বৈশাখি মেলার আয়োজন, আছে বাঙালি জমিদারদের পুণ্যাহের উৎসব। ফসলের ঘ্রাণে গড়ে ওঠা আমার নববর্ষ শাশ্বত ও গৌরবের। নববর্ষে বৈশাখের খররৌদ্রে অগ্নিস্নানে শুদ্ধ হয়ে উঠুক আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। ‘হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি/পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে-/ ব্যাপ্ত করি, লুপ্ত করি, স্তরে স্তরে স্তবকে স্তবকে/ ঘনঘোরস্তূপে।’ ‘ঘনঘোরস্তূপে’ নতুনের এই আহ্বান প্রকৃতপক্ষে সংকট কবলিত বাঙালির জীবনে প্রত্যাশার অভিব্যক্তি। এ মুহূর্তে আমরা পৃথিবীতে যতটুকু কাজ করি তা যেন সত্যসত্যই দায়িত্ব পালনের জন্য করি, ভান না করি। কারণ অক্ষমরা বৃহৎ কাজ করতে পারে না বরং বৃহৎ ভানকে শ্রেয়স্কর জ্ঞান করে। জানে না যে মনুষ্যত্বলাভের পক্ষে বড়ো মিথ্যার চেয়ে ছোটো সত্য ঢের বেশি মূল্যবান। এই সত্য পথে হেঁটে আমরা নববর্ষের চেতনায় সংকট জয় করব। আর এই বৈশাখেই মানবজীবনকে অশান্তি মুক্ত করার শপথ নিতে হবে। কারণ- বৈশাখে ‘মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’।

লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘সংখ্যায় আধিক্য মানে অবনমন’


Thumbnail

সমাজ, রাষ্ট্রে নেতার ছড়াছড়ি। নেতাদের পোস্টার, ফেস্টুনে ভরে গেছে শহর, গ্রাম। তবে এদের বেশিরভাগই সুবিধাভোগী, অর্থলোভী। এদের মধ্যে আদর্শের লেশমাত্র নেই। সততা, দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতা নেই। এদের কোনো পেশা নেই। রাজনীতি কে এরা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নেতা নয়, বরং এদেরকে নির্দ্বিধায় চাঁদাবাজ, দখলদার, মাদক ব্যাবসায়ী বলা যায়। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এরা হেন অপকর্ম নেই যা করে না। এদের অনেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে দখল এবং মাদক ব্যাবসার মত জঘন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এসব আদর্শহীন, অসৎ, সুবিধাভোগী, অর্থলোভী নেতাদের ভীড়ে সৎ, দেশপ্রেমিক, আদর্শিক নেতাদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। সমাজ, রাষ্ট্রে এমন নেতাও আছেন যারা দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দেন। ষাট, সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এমন নেতার সংখ্যা ছিল বেশি। বর্তমানে হাজারো অসৎ নেতার মধ্যে এমন সৎ, আদর্শিক, দেশপ্রেমিক নেতা খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়। দিন দিন যেভাবে রাজনীতিতে অসৎ নেতাদের দাপট বাড়ছে, আগামিতে প্রকৃত নেতাদের খুঁজতে হয়ত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন হবে।

সময়ের সাথে সাথে এভাবে পৃথিবীতে প্রায় সবকিছুর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়লেও গুণগত মান এবং কার্যকারিতা নিম্নমুখী হচ্ছে। সবকিছুতেই যেন ভেজাল বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে তবে শিক্ষার মান নিম্নগামী হচ্ছে দিন দিন। শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক এবং সৃজনশীল হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের মননশীলতা এবং সৃজনশীলতার বিকাশ আশানুরূপ হচ্ছে না। চিন্তাশীলতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা অতিশয় প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে।

এক সময় সমাজে হাজীর সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। তবে সমাজে তাদের অনেক সম্মান ছিল। মানুষ তাদেরকে খুব ইজ্জত করতেন। তাদের চলাফেরা এবং আচার-আচরণ সমাজের আর দশজন মানুষ থেকে আলাদা ছিল যা দেখে তাদের খুব সহজেই চেনা যেত। তাদেরকে মানুষ অনুকরণ করতেন। এখন হজ্জব্রত পালন করা মানুষের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে, তবে তাদের ঈমানী শক্তিতে আর আগের সেই ধার নেই। হজ্জ করে আসা ব্যাবসায়ী হজ্জ করে এসে আগের চেয়ে অধিক মুনাফা করছে, ভেজাল পণ্য বিক্রি করছে। সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য রাতারাতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। হজ্জ করে আসা একজন চাকরিজীবী পবিত্র ঘর তাওয়াফ করে এসে আবার আগের মতই ঘুষ, দূর্নীতিতে জড়াচ্ছে। একজন হাজী'র কোনো চারিত্রিক এবং নৈতিক গুণাবলি তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে হাজীদেরকে এখন আর দেখে চেনা যায় না। সমাজে হাজীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও সমাজের মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক গুণাবলি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে; মানুষের মনুষ্যত্ববোধ দিন দিন লোপ পাচ্ছে। 

ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মানুষ দিন দিন আকৃষ্ট হচ্ছে। দেশে বিগত কয়েক বছরে মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এসব শিক্ষার্থী সমাজের মানুষের  ধর্মীয়, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারেনি। বরং এরা নিজেরাই অনেকে উগ্র, সাম্প্রদায়িক এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষী। ইসলাম যেখানে সহনশীলতা, সাম্য, শান্তি ও মানবিক মূল্যবোধের বার্তা দেয়, ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত এসব আলেমদের আচরণ ঠিক তার উল্টো! 

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার চলার পথে কাঁটা পুঁতে রাখা বুড়ী অসুস্থ হলে তার সেবাশুশ্রূষা করে তাকে সারিয়ে তুলেছেন। যাদের অত্যাচার, নির্যাতন এবং হিংস্রতার কারণে তিনি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত বাধ্য হয়েছিলেন- মক্কা বিজয়ের পর তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অথচ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া আলেম নামধারী কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষ ঈদ এর পরিবর্তে কেউ ইদ লিখলেই তাকে কাফির, নাস্তিক, মুরতাদ আখ্যা দিয়ে তাদের কল্লা কাটার ঘোষণা দেয়! চুন থেকে পান খসলেই এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষোদগার করে, অশালীন ভাষায় মন্তব্য করে। যাকে তাকে যখন তখন ইসলাম বিরোধী, নাস্তিক আখ্যা দিয়ে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। এরা আসলে কতটা কুরআন এবং রাসূলের অনুসারী! সমাজ, রাষ্ট্রে এমন আলেমের সংখ্যাই বেশি। প্রকৃত আলেমের সংখ্যা খুবই কম। 

সমাজে কেবল এরুপ সাম্প্রদায়িক আলেম নয়, সুশীল নামধারী নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করা অনেক শিক্ষিত সাম্প্রদায়িক মানুষ আছে। এরা দাঁড়ি, টুপিওয়ালা মানুষ দেখলেই তাদেরকে সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধ হিসেবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে। এরা দাঁড়ি, টুপীওয়ালা মানুষদের জঙ্গি এবং মৌলবাদী আখ্যায়িত করতে পারলেই নিজেদেরকে প্রগতিশীল ভাবে। দাঁড়ি, টুপি এবং মাদ্রাসার প্রতি এদের এলার্জি সাংঘাতিক রকমের। এরা নিজেদেরকে প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক মনে করলেও আসলে এরা নিজেরাও চরম সাম্প্রদায়িক। এরুপ প্রগতিশীলের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। সমাজে দিন দিন এরুপ সাম্প্রদায়িক আলেম এবং প্রগতিশীলতার ভান করা চরম সাম্প্রদায়িক শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এরা উভয়ই সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপস্বরুপ।

আগে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, গীর্জার সংখ্যা ছিল কম। যা ছিল তাও বাঁশ, কাঠের বেড়া আর তালপাতা, গোল পাতার ছাউনি ঘেরা নিতান্তই এক একটা কুঁড়ে ঘর। এসি তো দূরের কথা লাইট, ফ্যান ও ছিল না। মানুষের গায়ে তখন দামি পোশাক ছিল না, দামি গাড়ি, আলিশান বাড়ি ছিল না অথচ তখন সমাজে অনেক আদর্শবান মানুষ ছিলেন। যাদের দেশপ্রেম, সততা এবং নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ ছিল অনুকরণীয়। আজকে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, গীর্জার কোনো কমতি নেই। বাঁশ, কাঠের বেড়া আর তালপাতা, গোলপাতার ছাউনির পরিবর্তে এগুলো এখন একেকটা আলিশান ভবন। টাইলস কিংবা দামি মার্বেল পাথর বাঁধানো এসব ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ( এসি ) এর ছড়াছড়ি। আজকাল এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় উপাসনালয় মানুষের শরীরকে শীতল করলেও মনকে পরিশীলিত, নরম এবং পরিশুদ্ধ করতে পারছে না। মানুষ এখন দামি পোশাক, অভিজাত গাড়ি, প্রাসাদতুুল্য বাড়ির মালিক। তাদের এখন সব আছে। নেই কেবল সততা, দেশপ্রেম, নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধ।

লেখক- মোঃ নজরুল ইসলাম, তরুণ কলামিস্ট, খুলনা।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বাংলাদেশের নির্বাচন: ব্যাপক বয়কট নাকি সর্বজন গৃহীত?

প্রকাশ: ০১:৫৭ পিএম, ১০ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।  

তবুও, অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বয়কট করা হয়েছে। এর মূল কাওন হিসেবে তারা বলছেন, বিরোধী দলে নির্বাচন বয়কট এবং বিরোধীদের বয়কটের আহ্বানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাধারণ জনগণের ভোট বর্জন।

অংশগ্রহণ নাকি বয়কট?

দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও সব বিরোধী দল অবশ্য তাদের অনুসরণ করেনি। নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাতাশটি দল প্রার্থী দিয়েছিল। এছাড়া প্রায় ৩০০ আসনের বিপরীতে প্রায় ১৯০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তাই নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও, একাধিক নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে।

নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৮ শতাংশ। গত নির্বাচনের তুলনায় এই সংখ্যা কম হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সংখ্যাকে কম বলার সুযোগ নেই। অনেকে এটিকে বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট জনমনে প্রতিফলিত হয়েছে বলে দেখছে। বিরোধীদের বয়কট নিঃসন্দেহে ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলেলেও, কম ভোটার উপস্থিতি মানেই জনগণ ভোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে এওনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। মূলত বিএনপির বিভিন্ন নির্বাচন বিরোধী কর্মসূচী, বিক্ষোভ, সমাবেশ, গাড়িতে ট্রেনে বাসে অগ্নিসংযোগ, ভোটের আগের দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল-অবরোধের ডাক দেশের পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলে। যার ফলে নিজদের নিরাপত্তার জন্যই অনেক ভোটার নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে।

তবে যে সব নির্বাচনী এলাকায় একাধিক জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। আবার যেস এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম ছিল সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থতি ছিল কম। অর্থাৎ ভোটাররা বিএনপির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নির্বাচন বর্জন করেনি; প্রতিদ্বন্দ্বিতাই মূলত ভোটার উপস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।

তবে নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট করা ভোটারদের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। দুপুরে নির্বাচন কমিশনের করা প্রেস ব্রিফিংয়ে ভোটার উপস্থিতি মাত্র ২৭ শতাংশ ঘোষণা করা হলেও, শেষে ৪১.৮ শতাংশ চূড়ান্ত ভোটার উপস্থিত ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশন জানায়, দুপুরের সংখ্যাটি প্রকৃত সময়ে ছিল না। যেহেতু বাংলাদেশে ম্যানুয়াল পেপার ব্যালট সিস্টেম ব্যবহার করা হয় যেখানে ভোটগুলি হাতে গণনা করা হয় এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ফলাফল প্রেরণে কয়েক ঘন্টা পিছিয়ে ছিল। যা দুপুরের ভোটার উপস্থতি এবং সর্বশেষ ভোটার উপস্থিতির মধ্যে ব্যবধান ব্যাখ্যা করে। সেক্ষেত্রে মোট ভোটের ১৪ শতাংশ শুধু শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ সত্য নয়।  

নির্বাচন কমিশন হয়ত সঠিক। কিন্তু যেহেতু সন্দেহের তীর ছোড়া হয়েছে সেহেতু, নির্বাচন কমিশন সমস্ত ভোটকেন্দ্রের প্রতি ঘণ্টায় ভোট গণনার বিস্তারিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সন্দেহের সমাধান করতে পারে। এ ধরনের স্বচ্ছতা ভোটদানের প্রশ্নে স্পষ্টতা প্রদান করবে এবং যেকারো বিভ্রান্তি দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে কাজ করবে।

বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্র?

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আরেকটি নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর অনেকেই বাংলাদেশ একটি একদলীয় রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে এবং আওয়ামী লীগের অনুগত স্বতন্ত্ররা আরও ৬২টি আসনে জয়লাভ করে। যার ফলে সংসদে ৯৫ শতাংশ নির্বাচিত সংসদ সদস্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং সংসদে কোন অর্থবহ বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই।

তবে বিষয়টি এত সরল নয়। প্রথমত, সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের আওয়ামী লীগের ল্যাপডগ বলে উপেক্ষা করা বাংলাদেশের রাজ্নৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লী প্রার্থীর সাথে তীব্র নির্বাচনী লড়াইয়ের পরই বিজয়ী হয়েছেন। তারা সংসদে তাদের ভোট এবং তাদের বক্তৃতায়র পুরো স্বাধীনতা ভোগ করবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের তাদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী কোন দলের অধীনে না থাকায় তারা এই বিধিনিষেধের বাইরে। এই প্রেক্ষাপটে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আ.লীগ প্রশংসার যোগ্য। আ.লীগ দলের সিনিয়র ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দিয়ে, অবশ্যই সম্ভাব্য অন্তর্দলীয় বিরোধের ঝুঁকিতে পড়েছে। তবুও, এটি ভোটারদের প্রকৃত নির্বাচনী বিকল্প প্রদান এবং সংসদে মত বৈচিত্র্যকে প্রসারিত করেছে।

উপরন্তু, একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অপ্রতিরোধ্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা একটি দল একদলীয় রাষ্ট্রের সমতুল্য নয়। বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্র না বানিয়ে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। একইভাবে ভারত ও জাপান বহুদলীয় গণতন্ত্র না হারিয়ে একদলীয় আধিপত্য অর্জন করেছে। মূল প্রশ্ন হল আওয়ামী লীগ নিজে এই অতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদের আয়োজন করেছিল নাকি বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কারণে এটি অনেকটা অনিবার্য ছিল।

বিএনপি যদিও যুক্তি দেবে—যে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কখনোই ছিল না এবং ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর বিএনপি নেতাদের দমন-পীড়ন ও গণগ্রেপ্তার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ এবং তাদের অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে, ২৮ অক্টোবরের আগেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে ইতিমধ্যেই নির্বাচনে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশনের ডাকা একটি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্যই ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভ করেছিল দলটি। ফলে সেই সময়ে কমিশনের কর্তৃত্বের অধীনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অরাজকতা দমনে এবং নির্বাচনের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে শক্তি প্রয়োগ করেছিল। এটি কোনভাবে নির্বাচন বর্জনের কারণ হতে পারে। বলপ্রয়োগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার আলাদা মূল্যায়নের প্রয়োজন, তবে এটি নির্বাচনী নয় বরং আইন-শৃঙ্খলার চোখে দেখাই উত্তম।

দায়বদ্ধতা

এমন উদ্বেগজনক দাবি করার পরিবর্তে, পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল যে প্রাথমিক বিরোধী দল বিএনপি কেন মাঠ হারাল। সরকার যেমন শক্তিপ্রয়োগের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের পরোয়ানা দেয়, তেমনি বিএনপিকে তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব ছিল সংসদে ভোটারদের আওয়াজ দেওয়া। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এমন অনুমানের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন বর্জন করে, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং জনগণের অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। তর্কের খাতিরে আ. লীগের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না ধরে নিলেও, বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মে ২০১১ সালে এটিকে অসাংবিধানিক রায় দিয়েছিল। তাছাড়া, পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তার ম্যান্ডেটকে অতিক্রম করেছিল, জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেছিল এবং দলীয় নেতাদের বন্দী করেছিল রাজনীতিকে বাধাগ্রস্থ করেছিল।

নির্বাচন বয়কট শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুফল এনে দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণের ম্যান্ডেট অনুসরণ করার চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক শাসনের মধ্যে একটি সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা করেছিল। গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও মূলত বিএনপি’র এই আত্ম বিধ্বংসী এবং অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পথ সুগম করেছে।


বাংলাদেশের নির্বাচন   ব্যাপক   বয়কট   সর্বজন গৃহীত  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন