নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:১৫ পিএম, ১২ নভেম্বর, ২০২১
‘আমি মায়ের কাছে যাব’। শেখ রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর মায়ের লাশ দেখে অশ্রু সিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন- ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন’।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রতুষ্যে হায়েনারুপী বিপদগামী একদল সেনা কর্মকর্তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সাথে শিশু শেখ রাসেলকেও হত্যা করে। হত্যার পূর্বে খুনীরা বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত কর্মচারী আব্দুর রহমান রমাসহ শেখ রাসেলকে আটক করে। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে উপরোক্ত কথাগুলো বলেছিলেন, বাঁচার জন্য আকুলভাবে কাকুতি-মিনতি করছিলেন, কিন্তু পাষন্ড খুনীরা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি।
পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারে একজন নতুন অতিথির আবির্ভাব হয়। শেখ ফজিলাতুন্নেচ্ছা মুজিবের কোলে হেমন্তের প্রহরে ভূমিষ্ঠ হয় ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান, আনন্দে উদ্ভাসিত পুরো শেখ পরিবার, খ্যাতিমান ব্রিটিশ লেখক ও দার্শনিক, নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে ছোট্ট শিশুটির নাম রাখা হয় রাসেল আর শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় তাঁর নাম হলো শেখ রাসেল। ১৮ অক্টোবর ২০২১, সরকারি উদ্যেগে প্রথমবারের মত ‘শেখ রাসেল দিবস’ উদযাপন করা হয় তাঁর আদর্শ, মানবিক গুণাবলি, মূল্যবোধ, আবেগ ও ভালোবাসা বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য। দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ শেখ রাসেল, দীপ্ত জয়োল্লাস, অদম্য আত্ববিশ্বাস’ এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁকে বিশেষভাবে উপস্থাপন করাই ছিল উদ্দেশ্য।
শিশু শেখ রাসেলের গন্ডি ছিল বাবা মা, অর্থাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম মুজিব। একই সাথে তাঁর সময় কাটাতো দুইবোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং দুইভাই শেখ জামাল ও শেখ কামালের সাথে। সেই আদরের শিশুটির জীবন খুব ছোট পরিক্রমার মধ্যে বেড়ে উঠছিলো। যে রাসেল ছোটবেলা থেকে খেলার সাথীদের নিয়ে প্যারেড করতো, স্বপ্ন দেখতো সে বড় ভাই শেখ জামালের মতো সেনা অফিসার হবে। আজ বেঁচে থাকলে হয়তো সে সেনাবাহিনীর বড় অফিসার হতো। বেঁচে থাকলে আজ ৮ নভেম্বর ২০২১ তাঁর বয়স ৫৭ পেরিয়ে আরো ২০ দিন হতো। কিন্তু সে চিরদিন ১১ বছরের শিশু শেখ রাসেল হয়েই বেঁচে থাকবেন ইতিহাসের পাতায় ।
১৯৭২ সালে জাপানী চলচ্চিত্রকার Nagisa Oshima নির্মিত `Rahman, Father of Bengal` স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে জাপানি সাংবাদিক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় প্রশ্ন করেছিলেন-, ‘লক্ষ করছি একটি ছোট্ট ছেলে সবসময় আপনার চারপাশে ঘুরঘুর করে। ছেলেটি কে? কেন তিনি সবসময় আপনার চারপাশে থাকে?’
উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-,‘ছেলেটির বাবা সবসময়ই কারাগারে থাকতো। ফলে সে তার বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি তার বাবা, তাই সবসময় তাকে কাছে রাখি।’
শেখ রাসেল, এক অনন্ত বেদনার কাব্য আলেখ্য। জেলজীবনে বঙ্গবন্ধুর দৈনন্দিন স্মৃতিকথা ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থেও তাকে নিয়ে লেখা আছে অনেক দুঃখগাঁথা। ১৯৬৬ সালের ৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-, ‘বাচ্চারা দেখতে চায় কোথায় থাকি আমি। বললাম, বড় হও, মানুষ হও, দেখতে পারবা।’ মায়ের কোলে চড়ে মাত্র দেড় বছর বয়সে বাবাকে একনজর দেখার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার যেতো শেখ রাসেল। তার কাছে জেলখানাটি ছিল আব্বার বাড়ি। ১৫ দিন পরপর বেগম মুজিব তার সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে তাদেও আব্বার বাড়ি অর্থাৎ জেলখানায় যেতেন। শেখ রাসেল বাবাকে রেখে আসতে চাইতো না। কিন্তু একবুক ব্যথা নিয়ে প্রতিবার তাকে ফিওে আসতে হতো, বাবা থেকে যেতেন তার বাড়িতে। একটি শিশু ও একটি পরিবারের ক্ষেত্রে এই গল্পগুলো অনেক কঠিন। এটি একটি পরিবারের হাসি কান্না, সুখ-দুঃখ এবং সেই পরিবারের মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন, প্রথমবারের মতো মুক্ত জীবনের স্বাদ পেলো শিশু শেখ রাসেল। ভর্তি হলো ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে। কচিকাঁচার দলের সঙ্গে ছিল তার অবাধ মেলামেশা। সুস¤পর্ক ছিল শিক্ষক থেকে গৃহকর্মী, সবার সঙ্গে। জাতির পিতার সন্তান হিসেবে তার মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। স্কুলের গেট থেকে খানিকটা দুরে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে স্কুলে প্রবেশ করতেন যেন অন্য সতীর্থরা কষ্ট না পায়। বাড়ি থেকে দেওয়া টিফিন ভাগ করে খেতেন বন্ধুদের সঙ্গে।
শেখ রাসেলের জীবনকাল স্বল্প কিন্তু ঘটনাবহুল ও উদ্দীপনাময়। এ সময়ে তিনি কিছু লিখে যাননি বা বলে যাননি। কিন্তু তার দৈনন্দিন কর্মকান্ড ও আচার-আচরণ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বিশেষ করে শিশুদের। তিনি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে তিনি কোনো সুবিধা নেননি বা প্রকাশ করেননি। এ ব্যাপারে তাঁর প্রিয় ‘হাসু আপা’ অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক স্মৃতিচারণে তার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া তাঁর গৃহশিক্ষক গীতালি দাশগুপ্তাও অনেক স্মৃতি রোমন্থন করেছেন।
২০১৯ সালে শেখ রাসেলের জন্মদিনের আলোচনা সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘বন্দিখানায় থাকা অবস্থায় যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেই যুদ্ধের সময় যখন আক্রমণ হতো, রাসেল পকেটে সব সময় একটু তুলা রাখতো। নিজের কানে দেওয়ার পাশাপাশি ছোট্ট জয়ের কানেও তুলা দিয়ে দিতো, যেন ওই আওয়াজে জয়ের কোনও ক্ষতি না হয়। রাসেল জয়ের প্রতি খুব খেয়াল রাখতো । সব সময়ই তার সেদিকে বিশেষ নজর ছিল।’ অপর এক আলোচনায় রাসেলের জীবনের ইচ্ছে এবং তার কোমল হৃদয়ের চাওয়া নিয়ে বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘রাসেলের খুব শখ ছিল সে বড় হয়ে আর্মি অফিসার হবে এবং সেভাবে কিন্তু সে নিজেকে তৈরি করতো। ছোট ছোট গরিব শিশুর প্রতি তার দরদ ছিল, যখন সে গ্রামে যেতো, গ্রামের অনেক শিশুকে সে জোগাড় করতো। সে কাঠের বন্দুক বানাতো। শিশুদের জন্য মাকে বলতো কাপড় কিনে দিতে হবে। মা ঠিকই কিনে দিতেন। বাচ্চাদের সে প্যারেড করাতো।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তি জীবনের অজানা-অদেখা গল্প নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘হাসিনা: অ্যা ডটারস টেল’-এ ছোট্ট রাসেল সম্পর্কে বলেছেন-, ‘রাসেল হওয়ার পরে আমরা ভাইবোনেরা খুব খুশি হই। যেন খেলার পুতুল পেলাম হাতে। ও খুব আদরের ছিল আমাদের। একটা ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলতো। ওইটুকু একটা মানুষ, খুব স্ট্রং পার্সোনালিটি।’ শেখ হাসিনা রচিত আমাদের ছোট রাসেল সোনা বইয়ে স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘আমাদের পাঁচ-ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রাসেল। ছোট্ট রাসেল আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। মা রাসেলকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সংসারের কাজ করতেন, স্কুল বন্ধ থাকলে তার পাশে শুয়ে আমি বই পড়তাম। আমার চুলের বেণি ধরে খেলতে খুব পছন্দ করতো ও। আমার লম্বা চুলের বেণিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিতাম। ও হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হাসতো । কারণ, নাড়াচাড়ায় মুখে চুল লাগতো তাতে খুব মজা পেতো।’
অন্যদিকে শেখ রাসেলের গৃহশিক্ষক গীতালি দাশগুপ্তা তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন-, ‘পড়ানোর জন্য একটু নিরিবিলি জায়গা পাওয়া সহজ ছিল না। তদুপরি রাসেল ছিল দূরন্ত। পড়ানো শুরুর মাস খানেক পর শেখ হাসিনা একটি শাড়ি গৃহশিক্ষকের হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘রাসেলকে টানা এক মাস পড়াতে পারার জন্য এই নাও উপহার। এর আগে কোনো শিক্ষক এক মাস টেকে নাই।’
গীতালি দাশগুপ্তা বলেন, ‘একবার শেখ জামালের ঘরে পড়াচ্ছি। গৌতম বুদ্ধের একটি পিতলের মূর্তি দেখিয়ে তাঁর জীবনের নানা ঘটনা বলি। মহাপুরুষদের জীবনী খুব উৎসাহ নিয়ে শুনত। পরদিন পড়াতে গেলে বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন, ‘মাস্টর, এত বড় সর্বনাশ করলি।’ স্বাভাবকিভাবেই শিক্ষক উদ্বিগ্ন হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর ছোট ছেলেকে কোনো ভুল শিক্ষা দিয়েছে কী? বঙ্গবন্ধু তাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, তুই গৌতম বুদ্ধের জীবন কাহিনী রাসেলকে বলেছিস? ও গত রাতে একটা পর্যন্ত জেগেছিল। আমি কাজ শেষে ঘুমাতে গেলে বুদ্ধদেব সম্পর্কে আরও জানতে চায়।’ এমন অদম্য কৌতূহল ছিল শেখ রাসেলের।
১৯৭২ সালের জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। সেখানে অস্ত্রোপচারের সময় পরিবারের অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধু সুস্থ হলে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাজারে আসা নতুন সিনথেটিক শাড়ি কিনলে রাসেল বায়না ধরে তার শিক্ষকের জন্যও একটা কিনতে হবে। দুই বোন শাড়ি নিয়ে ফিরলে রাসেলের মনে হয় যে, তাঁর শিক্ষকের জন্য কেনা শাড়িটির চেয়ে দুই আপার শাড়ি সুন্দর। এ নিয়ে অভিমান করে, কান্নায় বুক ভাসায়। শিক্ষক শাড়ি পেয়ে খুব খুশি হয়েছে এটা জানানোর পরই কেবল রাসেলের মন ভাল হয়। শিক্ষকের প্রতি তার এই অগার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নতুন প্রজন্মের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।
শেখ রাসেলের হাসু আপু ১৫ আগস্টের ভয়াবহ কালরাতের মাত্র কয়েকদিন পূর্বেই সুদূর জার্মানে স্বামীগৃহে চলে যান, সাথে আরেক বোন শেখ রেহানাও। হাসু আপু জার্মান যাওয়ার সময়, ‘আমি হাসু আপুর সাথে যাবো, দেনা আপুর সাথে যাবো’ বলে খুব কেঁদেছিল রাসেল। শেখ রেহানাকে ‘দেনা আপু’ বলে ডাকতেন শেখ রাসেল। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও সেই হাসু আপুর কাছে যাওয়ার জন্যেই আকুতি-মিনতি করেছিল, মায়ের পর হাসু আপুকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করেছিলেন তিনি।
শেখ রাসেল দিবস ২০২১ উদযাপন উপলক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয় আয়োজিত আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক একান্ত সচিব ওয়াহিদা আক্তার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘শেখ রাসেল এর হাসু আপু স্বামীর কর্মস্থল জার্মানে গিয়ে ছোট ভাই রাসেলের পছন্দের খেলনা কিনেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজও ঐসকল খেলা সামগ্রী আগলে রেখেছেন।’
বাঙালি জাতির জাগরণকালে সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে জন্মেছিল যে শিশু, জান্তাদের দানবীয় ষড়যন্ত্র তাকে নিয়ে গেছে ইতিহাসের ভাগ্যহত নক্ষত্রদের কাতারে। সেই দেবশিশুর নাম শেখ রাসেল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র। বন্দি পিতার দীর্ঘ জেলজীবনের সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে মায়ের কোলে চড়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়মিত যেতো ছোট রাসেল। কিন্তু বেগম ফজিলাতুন্নেচ্ছা মুজিবকে গোয়েন্দারা কোলের শিশু রাসেলকে নিয়ে জেরা করতেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেচ্ছা বিরুক্তি ও প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘বাপের পিছনে গোয়েন্দা লেগেছিল ২৮ বছর বয়সে, আর ছেলের পেছনে লাগলো দেড় বছর বয়সেই?`
ছোট্ট রাসেলের আর বড় হওয়া হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে, বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মাত্র দশ বছর দশ মাস বয়সের এক নি¯পাপ শিশু, কী দোষ ছিল রাসেলের! সেই বিভিষীকাময় রাতে, ঘাতকরা যখন বিশ্ব ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিলো, প্রাণে বাঁচার জন্য মিনতি জানিয়েছিল ছোট্ট রাসেল। মায়ের কাছে যাবে বলে যার আকুতি, গলা শুকিয়ে যাওয়া কান্না যার চোখেমুখে ছিল, ভয়ে থরথর করে যে কাঁপছিল তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাবে বলে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে নরপিশাচদের একজন। বাঁচতে দিল না রাসেলকে, সীমারদের মনে বিন্দুমাত্র দয়ামায়া ছিল না।
সকলের এতো আদরের ছোট্ট শেখ রাসেল ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালো রাতের শেষ প্রহরে আতঙ্কিত হয়ে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করতে থাকলে নরপিশাচরা, মায়ের কাছে নিয়ে যাবে বলে, গৃহকর্মী আব্দুর রহমান রমার হাত থেকে হেঁচকা টান দিয়ে শেখ রাসেলকে ছিনিয়ে নেয়। এরপর মৃত্যু পর্যন্ত পরবর্তি সময়টুকু তাঁর কেমন কেটেছিল, কতটুকু মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক হয়েছিল তা ঐ ঘাতকেরাই জানে। তবে মনের চোখ দিয়ে যদি দেখি বা অনুমান করি তবে হয়তো এভাবে বলা যায়-, ‘মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার পথে রাসেল দেখলো সিঁড়িতেই পড়ে আছে তাঁর পিতার লাশ । হতভম্ব সে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এ কি করে হয়? স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বাঙালি জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ পরে আছে সিঁড়িতে? কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই হায়েনারা তাঁকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গেল মায়ের কাছে। মায়ের লাশ দেখে, মায়ের নিথর বুকে আছড়ে পড়ে মা, মা বলে বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে আর্তনাদ করেছিল সে। না, মায়ের কোন সাড়া শব্দ নেই। মা তাঁকে বুকে জড়িয়ে আদর করে বলেনি, ‘ভয় নাই বাবা। কিচ্ছু হবে না। আমিতো আছি তোমার কাছে’। মা-বাবার পর ঐ ছোট্ট শিশু দেখলো তাঁর বড় ও মেঝ ভাই ও ভাবীদের লাশ।’
আমরা পরিবারের একজন নিকটাত্মীয়র মৃত্যুতে ভেঙ্গে পরি, চাপা ব্যথা অনুভব করি, সেই ব্যথা প্রশমনে আর্তনাদ করি, নীরবে অশ্রু ত্যাগ করি। তাহলে শিশু শেখ রাসেল অল্পক্ষণের মধ্যে বাবা-মা সহ নিজ পরিবারের এতজন সদস্যের মৃত্যু এবং তাঁদের সারিসারি লাশ দেখে কী অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করেছেন? হয়তো ভেবেছেন, হাসু আপু, দেনা আপুর সাথে জার্মানি বেড়াতে গেলেই ভালো হতো। হয়তো ভেবেছেন, হাসু আপু আমাকে নিয়ে গেল না কেন? এমনি অবস্থায়ই হঠাৎ গর্জে উঠে ঘাতকের আগ্নেয়াস্ত্র, ঝাঁঝড়া হয়ে যায় শেখ রাসেলের বুক, ঘাতক বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সাঙ্গ করে দেয় তাঁর জীবন প্রদীপ ।
স্বল্প ফুটেই সুরভী ছড়াতে শুরু করেছিল যে ফুল, সেটি অকালে ঝরে যাওয়ার শোকে আজও প্রতি ভোরে বাঙলার মাঠে-ঘাটে অজস্র বকুল ফুটে, ঝরে শেফালী-হাসনাহেনা। ঝরা বকুলের প্রতিবিম্বে বাংলার প্রতিটি শিশুর প্রাঞ্জল হাসির শব্দ ভেসে ওঠে- ভেসে ওঠে রাসেলের মায়াবী মুখখানি, শিশুদের ভেজা কপোল ছুঁয়ে নামে রাসেলের চোখের পানি। এ পানিতে পবিত্র হয়ে বর্তমান প্রজন্ম শহীদ শেখ রাসেলের আদর্শ, মানবিক গুণাবলী, মূল্যবোধের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করবে, ব্যক্তি জীবনে বয়ে আনবে ইতিবাচক পরিবর্তন সেই প্রত্যাশা সকলের।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালো রাতের শেষ প্রহরে শেখ রাসেল আতঙ্কিত হয়ে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করেছিল, সে দৃশ্য কল্পনায় আমার নিবেদন নিচের কাব্য-কথা।
আমি মায়ের কাছে যাবো
তোমরা আমাকে মেরো না
আমি মায়ের কাছে যাবো
তোমরা আমার দুবাহু ছাড়ো
আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো।
আমি ভোরের শিশির হবো
আগুনমুখার শুভ্র ঢেউ হবো
ধানের কচি ডগার বিন্দু হবো
স্নেহসুধায় বাংলাদেশকে ভরিয়ে দেবো।
তোমরা আমাকে মেরো না
আমি বন্ধুদের কাছে যাবো
নাড়ার আগুনে ছোলা পুড়িয়ে
বাংলার মাঠে বসে খাবো।
আজান দিয়েছে, ভোর হয়েছে
পড়াশোনার টাইম হয়েছে, স্কুলেতে যাবো
তোমরা আমাকে মেরো না
আমি আমার মায়ের কাছে যাবো।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক
সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২২ নভেম্বর, ২০২৩
মন্তব্য করুন
২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর
গৌরবের দিন। দিনটিতে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করা হয় এভাবে- ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত করার জন্য
দরকার একটি সুপ্রশিক্ষিত, সুশৃঙ্খল ও দক্ষ সশস্ত্র বাহিনী। তিনি ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল
এক সরকারি আদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংগঠনিক কাঠামো ‘বাংলাদেশ ফোর্সেস’ ভেঙে স্বতন্ত্র
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গড়ার নির্দেশ দেন
এবং দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে দক্ষ ও চৌকশ সশস্ত্র বাহিনী গঠনের কাজ শুরু করেন। জাতির পিতার
পরিকল্পনায় স্বাধীনতার পরপরই ঢাকায় ৪৬ পদাতিক বিগ্রেড, যশোরে ৫৫ পদাতিক বিগ্রেড এবং
কুমিল্লায় ৪৪ পদাতিক বিগ্রেড প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া
শুরু করা হয়। তাছাড়াও, তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিটি আর্মস ও সার্ভিসের গোড়াপত্তন
হয় এবং শতাধিক ইউনিট প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি ১৯৭২ সালে ঢাকায় দেশের প্রথম অফিসার প্রশিক্ষণ
একাডেমি চালুর ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সেনাবাহিনীর ০৮ জন এবং বিমান বাহিনীর
০১ জন অফিসারকে ভারত পাঠানো হয় নতুন ক্যাডেট নির্বাচন প্রক্রিয়ার উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণের
জন্যে। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের হাতেই গড়ে ওঠে ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড (আইএসএসবি)।
১৯৭৩ সালের ২৯ নভেম্বর কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি। দেশে নৌবাহিনী
প্রতিষ্ঠার জন্যে বঙ্গবন্ধু মূলত স্বাধীনতার পূর্বেই ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনে
এ ভূখণ্ডে নৌবাহিনী সদর দপ্তর স্থাপনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে নৌবাহিনীর ভিত রচনা
করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে জাতির পিতা প্রায় শূন্য থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের
কাজ শুরু করেন। একটি দক্ষ,শক্তিশালী ও আধুনিক নৌবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি তিনটি
নৌবাহিনী ঘাঁটি- বানৌজা হাজী মহসিন, বানৌজা ঈসা খান ও বানৌজা তিতুমীর স্থাপন করেন।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক প্রয়াসে সংগ্রহ করা হয় ০৫ টি আধুনিক রণতরী এবং বাংলাদেশ
নৌবাহিনীকে প্রদান করা হয় নেভাল এনসাইন। দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে মহান এ রাষ্ট্রনায়ক
১৯৭৪ সালে প্রণয়ন করেন ‘বাংলাদেশ টেরিটোরিয়াল ওয়াটার'স এন্ড মেরিটাইম জোনস এ্যাক্ট’।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও সামরিক কৌশলগত দিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের
পরিধি ও সম্ভাবনার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল একটি আধুনিক, শক্তিশালী
ও পেশাদার বিমান বাহিনী গঠনের। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তে
স্বাধীনতার পরপরই বিমান বাহিনীতে সংযোজিত হয় তৎকালীন অত্যাধুনিক মিগ-২১ সুপারসনিক যুদ্ধবিমান,
এএন-২৪ বিমান ও এএন-২৬ পরিবহন বিমান, এমআই -৮ হেলিকপ্টার ও এয়ার ডিফেন্স রাডার। বঙ্গবন্ধু
উন্নত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ১৯৭৪ সালে ‘প্রতিরক্ষা নীতি’
প্রণয়ন করেন।
বঙ্গবন্ধুর অবদানের সূত্র ধরেই
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিবসটি উপলক্ষ্যে তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেছেন-‘জাতির
পিতা স্বাধীনতার পর একটি আধুনিক ও চৌকস সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। সেনাবাহিনীর
জন্য তিনি মিলিটারি একাডেমি, কম্বাইন্ড আর্মড স্কুল ও প্রতিটি কোরের জন্য ট্রেনিং স্কুলসহ
আরও অনেক সামরিক প্রতিষ্ঠান এবং ইউনিট গঠন করেন। তিনি চট্টগ্রামে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর
ঘাঁটি ঈশা খাঁ উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৎকালীন যুগোশ্লাভিয়া
থেকে নৌবাহিনীর জন্য দু'টি জাহাজ সংগ্রহ করা হয়। বিমান বাহিনীর জন্য তিনি তৎকালীন
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সুপারসনিক মিগ-২১ জঙ্গি বিমানসহ হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান ও
রাডার সংগ্রহ করেন।বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের
পর থেকে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা সেনা, নৌ এবং
বিমান বাহিনীকে দেশে ও বিদেশে উন্নততর প্রশিক্ষণ প্রদানসহ আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন
সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করছি। জাতির পিতার নির্দেশে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের
উপযোগী ১৯৭৪ সালে প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতিমালার আলোকে ফোর্সেস গোল-২০৩০ প্রণয়ন করা
হয়েছে। এর আওতায় তিন বাহিনীর পুনর্গঠন ও আধুনিকায়নের কার্যক্রমসমূহ পর্যায়ক্রমে
বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী দুর্যোগ মোকাবেলা,
অবকাঠামো নির্মাণ, আর্ত মানবতার সেবা, বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা এবং বিভিন্ন জাতি
গঠন মূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিষ্ঠার সঙ্গে
দায়িত্ব পালন করে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যগণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি
উজ্জ্বল করছেন। এভাবে সশস্ত্রবাহিনী আজ জাতির আস্থার প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছে। আওয়ামী
লীগ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে
উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। আমি আশা করি, সশস্ত্র বাহিনীর
সদস্যগণ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দেশপ্রেম, পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার
সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাবেন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত
ও সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমরা সক্ষম হবো, ইনশাল্লাহ।’
প্রকৃতপক্ষে দেশের যে কোনো
দুর্যোগ মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনীর অবদান মূল্যায়ন করলে এই দিবসটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব। উপরন্তু গত সাড়ে ১৪ বছরে সশস্ত্র
বাহিনীর উন্নয়ন ও তাদের কার্যক্রমের সাফল্য গাথা বিশ্লেষণ করলেও স্পষ্ট হবে এই দিবসটি
উদযাপনের তাৎপর্য। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সম্মিলিতভাবে
পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের সূচনা করে। ৮০র দশকের মাঝামাঝি থেকে সম্মিলিতভাবে
২১ নভেম্বরকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর আগে ২৫ মার্চ
সেনা, ১০ ডিসেম্বর নৌ এবং বিমান বাহিনী ২৮ সেপ্টেম্বর আলাদাভাবে দিবসসমূহ পালন করা
হতো। পরে ২১ নভেম্বরের তাৎপর্য সমুন্নত রাখতে সম্মিলিত দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত
হয়। স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালনের পিছনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সক্রিয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর অবদানকে সাধারণ জনতার আত্মত্যাগের সঙ্গে একীভূত
করে দেখা হয় এ দিবসটিতে।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবলীলার
জবাবে অস্ত্র তুলে নেয় বিপ্লবী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ,
আনসার এবং অন্যান্য সদস্যরা। পরবর্তীতে এগিয়ে আসে পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত বাঙালি
নাবিক ও নৌ অফিসার, সেনা ও বিমান কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সর্বস্তরের মুক্তি
পাগল হাজার হাজার যুবক। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ধারণ করে সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ।
জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে পাকিস্তানি শাসকদের স্বপ্ন নস্যাৎ ও তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার
জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় একটি সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর। মুজিব নগরে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ
সরকার কর্নেল এমএজি ওসমানীকে (পরবর্তীতে জেনারেল) মুক্তিবাহিনীর প্রধান নিয়োগ করে।
তার ওপর মুক্তিবাহিনীকে পুনর্গঠনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকগণ
দ্রুত নিজেদের সুসংগঠিত করে পাল্টা আক্রমণ করে। সারাদেশকে বিভক্ত করা হয় ১১টি সেক্টরে
যার নেতৃত্ব প্রদান করা হয় একেকজন সুশিক্ষিত পেশাদার সেনা কর্মকর্তাদের। আট মাস পর
১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর চূড়ান্তভাবে সম্মিলিত আক্রমণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। সেদিন স্থল,
নৌ ও আকাশ পথে কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে চালানো হয় ত্রিমুখী আক্রমণ। উন্মুক্ত হয় বিজয়ের
পথ। এই আক্রমণ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফলতা লাভ করে জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে।
তারা বাধ্য হয় পশ্চাদপসারণে। সুশিক্ষিত একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে সূচিত হয় মুক্তিবাহিনীর
বিজয়ের ইতিহাস। তারপর মিত্র বাহিনীর সহযোগে ঘোষিত হয় সার্বিক যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি
জাতি ছিনিয়ে আনে চূড়ান্ত বিজয়। প্রকৃতপক্ষে এ বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল ১৯৭১ সালের
২১ নভেম্বরের সম্মিলিত আক্রমণ। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর
দপ্তর অবলুপ্ত হয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিনবাহিনীর পৃথক পৃথক সদর দপ্তর
প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ৬১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশ
প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহের সর্বাধিনায়কতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে এবং আইনের
দ্বারা তার প্রয়োগ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন সংকটে-বিপদে সশস্ত্র বাহিনী এদেশের
মানুষের পাশে থেকেছে সবসময়।ঝড়-তুফান-বন্যা তো আছেই, এর উপর বৈশ্বিক পরিস্থিতির উত্তাপও
এসে লাগে- আর তখন আমাদের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠেন।এজন্য শেখ হাসিনা
সরকারও তাদের উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ।
শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৪
বছরে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে আন্তরিক কর্মযজ্ঞ দেখা গিয়েছে। ইতোপূর্বে ১৯৯৬ সালে
এই আওয়ামী লীগ সরকারই তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এপিসি বা Armoured Personnel
Carrier, MIG-২৯ যুদ্ধ বিমান, অত্যাধুনিক Class-4 ফ্রিগেট ও অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র
সংগ্রহ করে। পেশাদারিত্ব বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, ওয়ার কলেজ,
আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ, BIPSOT বা Peace Keeping ইন্সটিটিউট, BUP বা Science
& Technology ইন্সটিটিউট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জনবল বাড়ানোর জন্য একটি
কম্পোজিট ব্রিগেড, একটি পদাতিক ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস ব্রিগেড ও বেশ কয়েকটি বিভিন্ন
ধরনের ব্যাটলিয়ানসহ অন্যান্য উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০০৯ সালে সরকার
গঠনের পর নতুন Armoured Personnel Carrier কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ
এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন সিস্টেমকে ডিজিটালাইজড করতে এবং তথ্য
-প্রযুক্তির উন্নয়নের লক্ষ্যে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যদিকে ফোর্সেস
গোল-২০৩০ এর আওতায় সেনাবাহিনীতে একাধিক পদাতিক ডিভিশন, বিগ্রেড এবং আর্মি ওয়ার গেম
সেন্টারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রতিটি কোর
ও সার্ভিসে সংযোজিত হয়েছে অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি। বাংলাদেশ নৌবাহিনী
আজ একটি পেশাদার ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এ বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে আধুনিক
সারফেস ফ্লিট, সাবমেরিন, নেভাল অ্যাভিয়েশন, নৌ কমান্ডো সোয়াডস এবং বৃদ্ধি পেয়েছে নৌঘাঁটি
ও অবকাঠামোগত সুবিধা। বিমান বাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে একাধিক বিমান ঘাঁটি, ইউনিট, অত্যাধুনিক
যুদ্ধবিমান, পরিবহন বিমান, হেলিকপ্টার, রাডার, ক্ষেপণাস্ত্র ও যুগোপযোগী সামরিক সরঞ্জাম।
সশস্ত্র বাহিনীতে প্রশিক্ষণের মান যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আন্তর্জাতিকমানের
উচ্চ শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান।
সেনাবাহিনীতে চতুর্থ প্রজন্মের
ট্যাংক-এমবিটি ২০০০, অত্যাধুনিক রাডার, সেল্ফ প্রপেলড গান এবং নতুন হেলিকপ্টার সংযোজন
করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নকল্পে আওয়ামী লীগ সরকার রাশিয়ার সঙ্গে ঋণ চুক্তি
অনুযায়ী সমরাস্ত্র ক্রয় করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বৈশ্বিক মানে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে
জুলাই ২০১৩ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে মেডিকেল কোরে মহিলা সৈনিক ভর্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়।
সাংগঠনিক এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সিলেটে একটি পদাতিক ডিভিশন
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩টি পদাতিক ব্যাটালিয়নকে রূপান্তর করে একটি ম্যাকানাইজড
পদাতিক ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
জাতিসংঘ সনদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে
আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা এবং সপ্তম অধ্যায়ে শান্তি প্রয়োগের বিধান রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা
কার্যক্রম সংঘর্ষে লিপ্ত দুপক্ষের সম্মতি এবং মতৈক্যের উপর ভিত্তি করে শুরু হয়। শান্তিরক্ষা
বাহিনীকে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ কর্তৃক অনুমোদিত একটি শান্তি চুক্তি বা শান্তি ব্যবস্থা
বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মোতায়েন করা হয়। এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ৬৮টি মিশনের মধ্যে ৫৪টিতে
১,১৮,৯৮৫ জন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী সদস্য অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান শান্তি
মিশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে এদেশের সেনাবাহিনীর ১৫ জন সদস্য জাতিসংঘের পতাকাতলে একত্রিত
হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী শান্তি মিশনে যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে। বাংলাদেশ পুলিশ
১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হয় নামিবিয়া মিশনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর
শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় বিবাদমান দলকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনে
সহায়তা প্রদান, সড়ক ও জনপথ এবং স্থাপনা তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। কঙ্গো, নামিবিয়া,
কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা/রুয়ান্ডা, লাইবেরিয়া, হাইতি, তাজিকিস্ততান, কসোভো, জর্জিয়া,
পূর্ব তিমুর প্রভৃতি স্থানে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল নাম।
মূলত বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
কারণ বিশ্বে সকল প্রান্তের দুর্গত, নিপীড়িত ও নিরীহ মানুষের সেবায় এ শান্তিরক্ষীদের
হাত সর্বদা প্রসারিত। সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও
তারা আর্তমানবতার সেবা করে চলেছে।
আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর স্বপ্নদ্রষ্টা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন সৎ, যোগ্য ও দক্ষ সেনা,
নৌ ও বিমান বাহিনীর মাধ্যমেই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন থাকবে, যা আজ
বাস্তবে প্রতিফলিত। দেশের শান্তি -শৃঙ্খলা রক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জাতি গঠনমূলক
কাজে অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিশ্ব শান্তিরক্ষায় আজ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর রয়েছে অসামান্য
অবদান। বর্তমান সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং কর্মদক্ষতার পরিচিতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। আসলে দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ
আর জনগণের জন্য ভালোবাসা- এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর
দেশপ্রেম। আজকের পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিন বাহিনীর ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনার
আধুনিকায়ন করে যেতে হবে। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী চ্যালেঞ্জ
নিয়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করছে। এই ধারা অব্যাহত রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের
চেতনার সমুন্নতি বিধান এবং সর্বোপরি দুর্যোগ মোকাবেলায় ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ উদযাপনের
গুরুত্ব অপরিসীম।
(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস,
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট
লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী
কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)
মন্তব্য করুন
জাতিগত
বিদ্রোহীদের উপর মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিমান হামলা এবং ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের কাছে
ভয়াবহ লড়াইয়ের ফলে প্রতিবেশী দেশ থেকে চিন শরণার্থীদের মিজোরামে নতুন করে আগমন ঘটেছে।
মিজোরাম-মায়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি সংঘর্ষের নতুন প্রাদুর্ভাব অনিশ্চয়তার মেঘের
সাথে মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দর ব্যবহার করে ভারতের কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট পরিবহন
প্রকল্পকে অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন করেছে। নতুন অশান্ত পরিস্তিতি মায়ানমারের পালেতওয়া
থেকে মিজোরামের জোরিনপুই পর্যন্ত কালাদান প্রকল্পের রাস্তার অংশে নির্মাণ কাজ পুনরায়
শুরু করার কথা থাকলেও এখন আশঙ্কা তৈরি করেছে। এই প্রকল্পটি ভারতকে লক্ষ্য করে, মায়ানমারের
সিটওয়ে বন্দর ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিকে একটি বিকল্প রুটের মাধ্যমে
ভারতের বাকি অংশের সাথে সংযুক্ত করা। এই রুটটি ভারত ছাড়াও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর
ব্যবহার করে ত্রিপুরার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলকে সংযুক্ত করে এবং ভারত-বাংলাদেশ প্রোটোকল
রুটের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবহার করে এবং আখাউড়া হয়ে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা
সংযোগকারী ব্রহ্মপুত্র ট্রেন লাইন ব্যবহার করে এই অঞ্চলের সাথে ত্রিপুরা-আসামের মধ্য
দিয়ে সংযোগ স্থাপন করে। আগরতলা-আখাউড়া আন্তর্জাতিক রেলপথ বাংলাদেশ ও ভারতকে সংযুক্ত
করার জন্য একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রকল্প। স্বাধীনতার আগে আগরতলা ও অন্যান্য
স্থানের মধ্যে ট্রেন যোগাযোগ ছিল। আখাউড়া এবং আগরতলাকে সংযুক্তকারী রেলপথটি এই পয়েন্টে
সমৃদ্ধ হতে শুরু করেছে। তদুপরি, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি চুক্তি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের
চট্টগ্রাম ও মংলা বাংলাদেশের বন্দর দিয়ে পণ্য পাঠানোর অনুমতি দেয়। বাংলাদেশ ও ভারত
একটি রেল প্রকল্পে সম্মত হয়েছে যা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং
পর্যটনকে সহজতর করবে। এই প্রকল্পটি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশী বন্দর দিয়ে পণ্য
পাঠাতে, উত্তর-পূর্বে পর্যটন বাড়াতে, সীমান্ত সংযোগ শক্তিশালী করতে এবং ছোট ব্যবসাকে
সমর্থন করতে সক্ষম করবে। রামগড় স্থলবন্দর ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমার বাণিজ্য ও আঞ্চলিক
উন্নয়ন বাংলাদেশকে উৎসাহিত করবে এবং ভারতের জাতীয় স্বার্থে পারস্পরিক বন্ধুত্ব প্রয়োজন।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের উন্নত সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচন
করবে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলায় নির্মাণাধীন রামগড়
স্থলবন্দর শুধু এই অঞ্চলের নয়, সমগ্র দেশের অর্থনৈতিক কল্যাণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
এটি আঞ্চলিক ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হতে পারে।
দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম, পর্যটন নগরী কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘সেভেন সিস্টার’ নামে পরিচিত সাতটি রাজ্য এই বন্দর ব্যবহারে
উপকৃত হবে। বাণিজ্য ও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ
বন্ধন আরও দৃঢ় হবে। একবার রামগড় বন্দর চালু হলে, ভারত কম সময়ে এবং কম খরচে পণ্য
গ্রহণ করতে সক্ষম হবে কারণ চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর মাত্র ১১২ কিলোমিটার দূরে এবং ভারতে
ট্রান্সশিপমেন্ট আরও সহজ হবে। মেঘালয়, আসাম, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচল
প্রদেশের সাথে ত্রিপুরার মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির সাথে সড়ক যোগাযোগ
স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ তাই তার জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে ভারতের সাথে বন্ধুত্ব
চায়। রামগড় সড়কের আধুনিকায়নসহ লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি) রুটের মাধ্যমে ভারত থেকে
বাংলাদেশে বেশ কিছু বিনিয়োগ এসেছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম ও ঢাকা
ত্রিপুরার সাবরুম এবং খাগড়াছড়ির রামগড়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। কাজটি ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪-এ
শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। অশোকা বিল্ডকন লিমিটেড, একটি ভারতীয় ঠিকাদার, রাস্তাটি নির্মাণের
দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শুধু চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর নয়, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরও ব্যবহার
করতে পারবে ত্রিপুরাবাসী।
রামগড়
স্থলবন্দর হবে দুই দেশের মধ্যে নতুন বাণিজ্যিক করিডর। ভারতীয় পর্যটকদের তখন বিশ্বের
দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ভ্রমণ করা সহজ হবে। এছাড়াও, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য
চট্টগ্রামের লোকেরা সহজেই উত্তর-পূর্ব ভারতে যেতে পারে এবং মিয়ানমারের রাখাইন এবং
চিন প্রদেশের সাথে ভারতের বাণিজ্য ত্বরান্বিত হতে পারে। রামগড় স্থলবন্দর চালু করা
নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং তিন দেশের জনগণের জন্য আশীর্বাদ হবে। ভারত ও বাংলাদেশের
ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাপান এই অঞ্চলে যুক্ত হতে আগ্রহী। উত্তর-পূর্ব-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক করিডোর
আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূ-অর্থনৈতিক উপাদান যোগ করতে পারে। উত্তর-পূর্ব
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি শিল্প মান-শৃঙ্খল তৈরিতে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলকে
(এনইআর) বঙ্গোপসাগরের সাথে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে জাপানের সম্পৃক্ততা আঞ্চলিক সংযোগের
ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ফলাফলের দিকে নিয়ে যেতে পারে। অস্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা উদ্বেগ
ছাড়াও, উল্লেখযোগ্যভাবে উত্তর-পূর্ব অঞ্চল এবং ভারতের বাকি অংশের মধ্যে ভ্রমণের সময়
এবং দূরত্ব হ্রাস করে, উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মধ্যে পৃষ্ঠ সংযোগের জন্য সরু চিকেন নেক
করিডোরের উপর নির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বিকল্প রুটগুলি কৌশলগতভাবে অনেক
বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। মিয়ানমারে নিরাপত্তা অস্থিরতা ভারতীয় ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী
এবং পর্যটন শিল্পের স্টেকহোল্ডারদের উদ্বিগ্ন করেছে যারা মিয়ানমারে সমুদ্রবন্দর এবং
সংযোগ প্রকল্প ব্যবহার করে নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ অন্বেষণ করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের
বন্দর ব্যবহার যেমন চট্টগ্রাম বন্দর, রেলওয়ে ও রুট সংযোগ প্রকল্প, অভ্যন্তরীণ নৌপথ
এবং সড়ক ও রেল যোগাযোগ ভারতের জন্য সেরা বিকল্প হতে পারে। মায়ানমারের চিন রাজ্যে
আরাকান আর্মির কলাম পালেতওয়া সহ বেশ কয়েকটি শহরে চলে যাওয়ার খবর, রাখাইন রাজ্য এবং
চিন রাজ্যের অঞ্চলে কালাদান প্রকল্পটি দীর্ঘ সময়ের জন্য ভঙ্গুর রয়ে যাওয়ায় শান্তির
জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কালাদান প্রকল্পে আরও বিলম্বের ফলে আরও সময় এবং ব্যয় বৃদ্ধি
পাবে। এই-অঞ্চলে শান্তি অস্থিতিশীল করতে চাইছে এমন ভারত-বিরোধী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে
ভারতের সতর্ক থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে এই ধরনের শক্তিগুলিকে অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি
অ্যান্ড নেবারহুড ফার্স্ট নীতির অধীনে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক সম্পৃক্ততা আরও গভীর
করার পরিকল্পনায় ঠান্ডা জল ঢেলে দেওয়া থেকে বিরত রাখা যায় এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে
নিরাপদ করে। প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ইতিমধ্যেই ২০১০ সালে ৫৩০ কোটি টাকা থেকে ২০২২
সালে ৩২০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে৷ প্রকল্পের উপাদানটির মধ্যে রয়েছে সিটওয়ে থেকে
পালেতোয়া পর্যন্ত কালাদান (১৫৮ কিমি) নদী বরাবর সিটওয়ে বন্দর এবং অভ্যন্তরীণ জলপথের
উন্নয়ন, যা ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। প্যালেটওয়া থেকে জোরিনপুই (১১০ কিমি) পর্যন্ত
মাল্টিমডাল প্রকল্পের রাস্তার অংশের অগ্রগতি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ঝামেলার কারণে
ধীর এবং বিলম্বিত হয়েছে, যার কারণে প্রকল্পটি এখনও চালু করা হয়নি, যদিও মে মাসে সিটওয়ে
বন্দরটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় বন্দর, নৌপরিবহন এবং জলপথ মন্ত্রী আয়ুষ সর্বানন্দ
সোনোয়াল এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রী, মিয়ানমারের
অ্যাডমিরাল টিন অং সান যৌথভাবে বন্দরটির উদ্বোধন করেন এবং প্রথম ভারতীয় কার্গো জাহাজটি
গ্রহণ করেন যা থেকে পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কলকাতা বন্দর এবং কলকাতা এবং সিত্তওয়ের
মধ্যে ৫৩৯ কিলোমিটার সমুদ্রপথ অতিক্রম করেছে। মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে
ভারত একটি শক্ত পথে হাঁটছে। মিয়ানমারের রেভেল গ্রুপগুলি উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে শান্তি
অস্থিতিশীল করতে স্প্রিংবোর্ড হিসাবে ব্যবহার করতে পারে এমন জটিলতা সম্পর্কে সচেতন
হওয়া উচিত। ভারতের স্বার্থের বিরোধিতাকারী এই ধরনের শক্তি উত্তর-পূর্বের বিদ্রোহী
গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করবে এবং মাদক ব্যবসায়ীদের এই অঞ্চলকে অবৈধ মাদকে প্লাবিত করতে
ঠেলে দেবে। অন্যদিকে, ভারতের বাংলাদেশ বিকল্প স্থিতিশীল, নিরাপদ, সময় এবং খরচ সাশ্রয়ী।
এইভাবে, বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর, করিডোর এবং স্থল বন্দর ব্যবহারের মতো বিকল্পগুলির
ব্যবহার ভারতের আন্তঃসীমান্ত সংযোগের স্থায়িত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা উত্তর-পূর্ব
অঞ্চলে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করে।
লেখক:
মেহজাবিন বানু
কলামিস্ট,
নিরাপত্তা ও কৌশলগত বিষয়ক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১১:২২ এএম, ১৮ নভেম্বর, ২০২৩
অনেক বিজ্ঞ লোক নির্বাচন কবে হবে, নির্বাচন হবে কি হবে না এ নিয়ে নানা আলাপ আলোচনা করেছেন। রাজনীতিবিদিরাও একেকজন একেক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাদের কথার ধরন এমন যে বাংলাদেশ যেন খুব ঘোড় কোন বিপদে পড়েছে এবং তারা বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশিদের নাক গলাবার সুযোগ করে দিয়েছে। যারা কোন দিন আমাদের নির্বাচন নিয়ে কোন কথা বলেনি তারা পর্যন্ত এখন নানা কথা বলছে। আমাদের সংবিধানে বলা আছে যে ৫ বছর পর পর নির্বাচন হতে হবে এবং নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে হতে হবে। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং তারাই নির্বাচন পরিচালনা করবে। ইতোমধ্যে কিছুটা উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করেছেন এবং তফশিল অনুযায়ী আগামী বছর (২০২৪) জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বধীন কমিশন। রেওয়াজ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচনের জন্য কিছু তারিখ প্রস্তাব করলে বলা হলে রাষ্ট্রপতি তাদেরকে জানান যে, কমিশন একটি সাংবিধানিক ভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। নির্বাচনের তারিখ কীভাবে নির্ধারিত হবে সেটি কমিশনের বৈঠকে হওয়া উচিত। নির্বাচন কমিশন তাদের নির্ধারিত বৈঠকে বসে এই তারিখ চূড়ান্ত করবেন বলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এছাড়া ২৯ জানুয়ারি মাথায় রেখেই যেন তারিখ নির্ধারন করা হয় এবং দেশ যাতে কোন সাংবিধানিক সংকটে না পরে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক করেন। নির্বাচন কমিশনও রাষ্ট্রপতির এই বার্তা মাথায় রেখেই শেষ পর্যন্ত তফশিল ঘোষণা করেছেন।
এই নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ষড়যন্ত্রে নামবে। তারা কি ষড়যন্ত্র করবে সেটিও বোঝা এখন কঠিন কোন বিষয় নয়। তাদের প্রথম চেষ্টা থাকবে নির্বাচনের তারিখ পেছানো। সেটা কিছুতেই করা যাবে না। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এখানে বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ বা অন্য কোন দল, কারোই কোন বক্তব্য থাকতে পারবে না। ৭ জানুয়ারিই নির্বাচন হতে হবে। যারাই নির্বাচন পেছানোর কথা বলবে ধরে নিতে হবে তারা ষড়যন্ত্রকারী। এ সকল ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধের আইন অনুযায়ী তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
যারা দেশের অগ্রগতি চায় না, দেশের উন্নয়নে যাদের হৃদয় কাঁদে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী এই নির্বাচনকে বিভিন্নভাবে বানচাল এবং বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছে এবং সামনেও করবে। এতমধ্যে বিএনপি জ্বালাও পোড়াও শুরু করেছে। বিচারপতির বাসভবনে আক্রমণ, পুলিশ পিটিতে হত্যা, বাস-গাড়ি ভাংচুর ইত্যাদি কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছে। যারা এতদিন ধরে অহিংস আন্দোলনের কথা বলে আসছিল, সন্ত্রাস সহিংসতার পথ পরিহার করার জন্য বলেছিল, তারা এক ধরনের মৌনব্রত অবলম্বন করছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এখন শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিক মহল থেকেও নানা তৎপরতা এবং ষড়যন্ত্র চলছে সেটি পরিষ্কার। তবে একটি কথা বলতে চাই যে, সামনে যে নির্বাচন আসছে এই নির্বাচন বাধাগ্রস্থ করার যেকোন প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার জন্য আমরা সকলে প্রস্তুত। বিশেষ করে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আমরা এখন জীবিত আছি। যদি প্রয়োজন হয় আমরা আবার নতুন প্রজন্মকে রাস্তায় নামবো। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধের ফসল, এই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে, আমার বিশ্বাস দেশের গণতন্ত্র রক্ষার প্রয়োজনে, দেশকে রক্ষার প্রয়োজনে তারাও রাস্তায় নামবে। আমরা কোন দল চিনি না। আমরা চিনি দেশকে, দেশের গণতন্ত্রকে এবং এই গণতন্ত্র রক্ষার উপাদান হিসেবে নির্বাচনকে। দেশের গণতন্ত্র রক্ষা করতে হলে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্থ হতে দেয়া যাবে না। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তারিখেই নির্বাচন হতে হবে।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত আলোচনা রাজনীতিবিদ
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১২:০২ পিএম, ১৩ নভেম্বর, ২০২৩
আমি
কোন কূটনীতিক নই। পেশায় একজন সাধারণ চক্ষু চিকিৎসক। তবে দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক
বিভিন্ন বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ না হলেও সাধারণ জ্ঞান আমার আছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে
চাই যে বর্তমানে বাংলাদেশে নিযুক্ত কিছু কিছু দেশের রাষ্ট্রদূতরা ভিয়েনা কনভেনশনের
কথা পুরোপুরি ভুলে গেছেন। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, কূটনীতিকদের সব ধরনের দাপ্তরিক কাজ-
যা প্রেরক দেশ কূটনীতিক মিশনের উপর ন্যস্ত করবে- তা গ্রাহক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
বা এ সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হতে হবে। এছাড়া ভিয়েনা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ-৪১.১
বলছে কূটনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ও অনাক্রম্যতা উপভোগ করা সব ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে তাঁদের
কর্মরত দেশের আইন ও প্রবিধানকে শ্রদ্ধা করা। এ ছাড়া কর্মরত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে
হস্তক্ষেপ না করাও তাঁদের (কূটনীতিকদের) একটি দায়িত্ব। তাঁদের সুযোগ-সুবিধা, প্রাধিকার
ও অব্যাহতি (ইমিউনিটিজ) উপভোগ করা সম্পর্কিত নীতিগুলো অনুসরণ করলেও অন্যান্য নীতিগুলো
তারা সঠিকভাবে মেনে চলছেন না। বাংলাদেশে নিযুক্ত কিছু কিছু রাষ্ট্রদূত নিয়মের তোয়াক্কা
না করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত না করেই বিভিন্ন মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের
সাথে বৈঠক করছেন। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের নির্বাচনসহ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘অতি উৎসাহ’
দেখানো পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের তলব করে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে
সরকার। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না। তারা হয়ত ভাবছেন চাইলেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ
বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যায়। চাইলেই তাদের সাথে নিয়ম অমান্য করে জোর খাটানো যায়। কিন্তু
আমি তাদের একটি জিনিস বলতে চাই যে, এমন কোন কাজ করবেন না যাতে দেশের জনগণ বিরক্ত হয়
এবং আপনার নিজের ও আপনাদের দেশের সম্মানহানি হয়।
আমাদের
দেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একদম সন্নিকটে। গণতান্ত্রিক দেশে হলেও একে দেশের কাঠামো
অনুযায়ী নির্বাচনের নিয়মে কিছুটা পার্থক্য থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম ও কাঠামোর
সাথে ভারতের নিয়ম ও কাঠামোর মিল থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এক দেশের নির্বাচন
কাঠামো নিয়ে অন্য দেশের কোন কূটনীতিক নাক গলান না। কারণ এটি একটি দেশের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ
বিষয়। তবে অনেক দেশেই কোন রাজনৈতিক দল বা কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি কূটনীতিকদের ভুল তথ্য
দিয়ে এসব অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ করে দেয়। তাই এটি সবসময় কূটনীতিকদের দোষ
না। কখনও কখনও এখানে রাজনীতির মার-প্যাঁচও থাকে। স্বার্থ হাসিলের জন্য অনেকেই জল ঘোলা
করার মিশনে নেমেছেন। যারা স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিদেশি কূটনীতিকদের প্ররোচিত করছে
তাদের উদ্দেশ্যে আমি একটি কথা বলতে চায় যে, আপনারা ভুল পথে আছেন এবং একসময় আপনাদের
খোঁড়া গর্তে আপনারাই পড়বেন।
এছাড়া
বাংলাদেশে নিযুক্ত যেসব কূটনীতিক তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলব যে, দয়া করে আপনারা যে দেশে
থাকবেন সেই দেশের নিয়মনীতি এবং সংস্কৃতি মেনে চলুন। একজন কূটনীতিক হিসেবে আপনাদের বাইবেল
হচ্ছে ভিয়েনা কনভেনশন। যেটি আপনারা প্রায়ই অনাম্য করছেন। আপনারা সেটিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন
না অথবা ভাবছেন বাংলাদেশকে এত গুরুত্বের সাথে নেয়ার কিছু নেই। একটি জিনিস খুব ভাল করে
মনে রাখবেন যে, বাংলাদেশ এখন আর সেই ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ নেই। বাংলাদেশ এখন ২০২৩ সালের
বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে ছোট এবং গুরুত্বহীন ভাবার কোন সুযোগ নেই। আপনাদের কাছে তাই
আমার অনুরোধ যে, কূটনীতিক শিষ্টাচারের বাইরে যেয়ে কোন কিছু করবেন না। তাহলেই আপনাদের
সম্মান বাড়বে এবং আপনারা যেটা চান সেটাও আপনারা অর্জন করতে পারবে।
আগামী
কয়েকদিনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। বাংলাদেশের নির্বাচন সঠিক
সময়েই হবে এবং অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হবে। কূটনীতিকরাও বাংলাদেশে একটি সঠিক নির্বাচন
দেখতে চায়। সঠিক নির্বাচন পেতে হলে সবাইকেই সঠিকভাবে নিয়ম মেনে কাজ করতে হবে। কূটনীতিকদেরও
ভিয়েনা কনভেনশন দাড়ি কমা মেনেই চলতে হবে।
মন্তব্য করুন
আমি গত তিন বছর ধরে বাংলা ইনসাইডার এবং অল্প কিছু লেখা বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখেছি। এর মূল সুর একটিই। আর তা হল বাংলাদেশে নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে এবং সংবিধান অনুযায়ী হবে। নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে এবং যার ভোট তিনিই দেবেন। এর মূল কারণও ছিল একটিই। বর্তমানে দেশ পরিচালনা করছেন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। তিনি এ দেশের মানুষের ভোটের এবং ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
জাতিগত বিদ্রোহীদের উপর মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিমান হামলা এবং ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের কাছে ভয়াবহ লড়াইয়ের ফলে প্রতিবেশী দেশ থেকে চিন শরণার্থীদের মিজোরামে নতুন করে আগমন ঘটেছে। মিজোরাম-মায়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি সংঘর্ষের নতুন প্রাদুর্ভাব অনিশ্চয়তার মেঘের সাথে মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দর ব্যবহার করে ভারতের কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট পরিবহন প্রকল্পকে অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন করেছে।
অনেক বিজ্ঞ লোক নির্বাচন কবে হবে, নির্বাচন হবে কি হবে না এ নিয়ে নানা আলাপ আলোচনা করেছেন। রাজনীতিবিদিরাও একেকজন একেক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাদের কথার ধরন এমন যে বাংলাদেশ যেন খুব ঘোড় কোন বিপদে পড়েছে এবং তারা বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশিদের নাক গলাবার সুযোগ করে দিয়েছে। যারা কোন দিন আমাদের নির্বাচন নিয়ে কোন কথা বলেনি তারা পর্যন্ত এখন নানা কথা বলছে। আমাদের সংবিধানে বলা আছে যে ৫ বছর পর পর নির্বাচন হতে হবে এবং নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে হতে হবে। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং তারাই নির্বাচন পরিচালনা করবে।