লিট ইনসাইড

স্বপ্ন ব্যবচ্ছেদ

প্রকাশ: ০৮:৪০ এএম, ০২ জুন, ২০২৩


Thumbnail

জীবনটা ছোটো হলেও কেউ ছোটো হয়ে বাঁচতে চায় না। অনেক স্বপ্ন নিয়ে পথচলা মানুষেরই ধর্ম। এই পথচলায় মানুষ অভ্যস্ত। পথ চলতে চলতে কেউ সফলতা বা ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে চিরতরে চলে যান পরকাল নামক বিস্ময়ভরা ভুবনে। সেখানে কি আছে না আছে কেবলই সৃষ্টিকর্তা জানেন। তারপরেও পরকাল নিয়ে মানুষের অযাচিত চিন্তাভাবনা। যে মানুষটি সারাদিনের ক্লান্ত শরীরের ঘাম ঝরিয়ে দিন শেষে জরাজীর্ণ ছোট্ট কুটির অথবা মধ্যবৃত্তের ঘ্রাণহীন দুর্বিসহ যন্ত্রণায় ছটফট প্রাণচঞ্চল পুরাতন কুটির অথবা বিলাসবহুল মোহময় অট্টালিকায় ফিরে আসে তখন আপনজনের মমতামাখানো মুখগুলো এনে দেয় প্রশান্তির ছোঁয়া। জীবন এরকমই যার যার স্থান থেকে উপভোগ্য। জীর্ণশীণ ছোট্ট কুটির, প্রাণচঞ্চল পুরাতন কুটির, বিলাসবহুল মোহময় অট্টালিকা যে যেখানে থাকি না কেন জীবন তো এমনই একদিন এ ভুবন থেকে চলে যেতে হয়। এ ভুবন ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে কি হয়? কি হবে? কারো জানা নেই। তবে পরকাল বিশ্বাসী স্ব স্ব ধর্মমতে দিনযাপন করেন। এমন ধ্রুব সত্যটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না বা পরকাল কেউই অস্বীকারও করে না।

৮২ বছর বয়সে খোকন মিয়াকে বার্ধক্য ছুঁতে পারলেও যৌবনের ভাবনা তাকে ঘিরে রাখে। খোকন তার আসল নাম নয়। খুব কাছের একজন মানুষ তাকে খোকন বলে ডাকতো। কাছের মানুষ বলতে স্ত্রীর বড়ো বোন। তার স্বামীর নামের সাথে মিল থাকায় আসল নাম ধরে কোনোদিন ডাকা হয়নি সালু বুজির। তাই ছোটো ভগ্নিপতিকে খোকন বলেই ডেকে তৃপ্তি পেতেন। স্ত্রীর বড়ো বোন মানে খোকনেরও বড়ো বোন। তার তুলনা হয় না। সালু বুজির দেওয়া নতুন একটা নাম পেয়ে খোকনও মহাখুশি। যা তিনি গর্ব করে অন্যদের বলতেন। অর্থ-বৃত্তের মধ্যে জীবন চালিকায় শক্তিমান এক অভিনেতা। তবে দুঃখ একটা, অভাবে যখন হাবুডুবু খাচ্ছিল তখনও তিনি বিচলিত হননি। টুকটুক করে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া তাদের বিয়ে দেয়া সবই সম্পন্ন করলেন। মোটাভাত মোটা কাপড়ের সন্ধান প্রতিটি সন্তানের জন্য তিনি পরম মমতায় নিশ্চিত করেছেন। শুধু একটা কষ্ট মনের মধ্যে হোঁচট খেতে লাগল। ছয়টি সন্তানই বিয়ে দিয়ে যার যার স্থান করে দিয়েছেন। কোথাও বড়ো রকমের তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল না। 

প্রতিটি সন্তানকে তিনি শাসন আর ভালোবাসা দিয়ে গেছেন। স্বভাবতই সব সন্তানের মধ্যে ছোটো ছেলে একরোখা আর জেদী ছিল। একরোখা স্বভাবের কারণে তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো। সে ভালোবাসার মূল্য সে রাখতে পারেনি। হয়তো তার একরোখা ভাষায় রেখেছে যা খোকন মিয়া বুঝতে পারেননি। সে রেগে গেলে তাকে কন্ট্রোল করা খুব সহজ ছিল না। মা‘র কাছে হার মানতো ছেলেটা। তার ওপর রাগও যেমন ছিল ভালোবাসাও ছিল প্রবল। বাবা সব সময় চাইতেন তার ছোট ছেলেটা ভালো থাকুক। তার ভালো থাকা নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না। ভালো ছাত্র, ক্লাসের ফার্স্ট বয়। খোকন মিয়া ভাবতো, হয়তো সে এ সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু তা আর হলো কই? বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে ছেলের। আয়-বরকত নাই। কেউ মেয়েও দিতে চায় না। ছোটো ছেলেটাকে নিয়ে খোকন মিয়ার পাহাড় সমান চিন্তা। 

অনেক প্রচেষ্টার পর বিয়েতে রাজি করা গেল ছেলেকে। ছেলে রাজী তাই খুটে-খুটে মেয়ে দেখার বিষয়টি বাদ দিয়ে দিনক্ষণ দেখে বিয়ে সম্পন্ন হলো। বিয়ের পরেও শান্তি নেই ছেলের সংসারে। তাদের খরচ চালাতে হচ্ছে। তাতে দুঃখ নেই খোকন মিয়ার। ছেলে তার বউকে নিয়ে সুখে শান্তিতে খাকুক- এটাই তার একমাত্র প্রার্থনা।

২০১৬ সালের ২১ মার্চ যে অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছেন তার জীবদ্দশায় সেটা তার শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। ছোটো ছেলেকে বিয়ে দেয়ার ছয় মাস পরের ঘটনা। হাসিখুশি অবস্থায় তার বউকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল তারা। কিন্তু বাবার বাড়ি থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, তাদের মেয়েকে আর পাঠাবে না স্বামীর ঘরে। এদিকে ছেলে বৃদ্ধ বাবা-মাকে চাপ দিচ্ছে বউকে বাপের বাড়ি থেকে এনে দেয়ার জন্য। একপর্যায় ছেলের বউকে আনার জন্য বৃদ্ধ খোকন মিয়া স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হলেন। 

খোকন মিয়ার বড়ো সন্তান সূচনাকে বলে গেলেন, দেড় দুই ঘণ্টার মধ্যে ছেলের বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। তিনটা... চারটা... পাঁচটাও বেজে গেল! তাদের আসার কোনো নামগন্ধ নেই! সূচনা ফোন দিচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছে না কেউ। চিন্তায় পড়ে গেল মেয়েটি। 

সূচনার একমাত্র মেয়ের জন্মদিন আজ। মেয়েটা কাছে নেই। লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় থাকে। সন্তান দূরে থাকলে যা হয়, মন সবসময় অস্থির হয়ে থাকে। তার ওপর বৃদ্ধ বাবা-মা ছোটো ভাই, বউকে নিয়ে বাড়ি  ফিরছে না। একসময় ফোনও বন্ধ হয়ে যায়! বাবা-মায়ের জন্য খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার।

রাত দশটায় বাবা ফোন দিলেন। সূচনাকে বাবার বাসায় যেতে হবে। বাবার বাসায় হাজির হয়ে দেখলো বৃদ্ধ মা-বাবা রীতিমতো কাঁপছে থরথর করে । কিছুই বলতে পারছে না। অসহায় দুইজন মানুষ। তাদের করুণ চাহনি বলে দিচ্ছে না বলা কিছু যন্ত্রণা। বাবা-মাকে দেখে বাসায় ফিরতে রাত প্রায় এগারোটা বাজলো সূচনার। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছে না। 

পরদিন ভোরে অন্ধকার না কাটতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যায়। দরজা খুলে দেখে মা দাঁড়িয়ে। কাক-পক্ষি জাগার আগে অন্ধকার ভোরে মা সূচনার বাসায় এসে হাজির! 

‘কি ব্যাপার মা, তুমি এত সকাল সকাল।’

মা বললেন, ‘কারো সামনে কথা বলা যাবে না।’

তিনি তখনও রীতিমতো কাঁপছেন।

‘ছোটো বউয়ের সামনে কথা বলা যাবে না, তাই তোর বাসায় এলাম।’ 

কথাগুলো বলা খুবই জরুরি। একপর্যায়ে গতকাল দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত তাদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্মম অত্যাচারের গল্প বলে ফেললেন এক নিঃশ্বাসে। 

ছেলের শ্বশুর বাড়িতে যেতেই তাদের ফোন কেড়ে নেয়া হয়। মায়ের সামনেই বাবাকে অপমান করা হয়। বউ নিতে হলে স্ট্যাম্পের ওপর সই করে বউ নিতে হবে। বউ তারা দেবে না। সে বাড়ির পাঁচ-ছয় জন লোক মিলে বৃদ্ধ খোকন মিয়া ও তার স্ত্রীকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করেছে। তাদের মেয়েকে নিতে হলে বাড়ি-জমি লিখে দিতে হবে, না হয় ছেলেকে দিয়ে খোরপোষসহ তালাক পাঠাতে হবে! বাবা সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করতে রাজি না হওয়ায় তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। একসময় বাধ্য হয়ে জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া নাবিকের মতো ফ্যালফ্যাল চাহনিতে ঘৃণাভরে স্ট্যাম্পের ওপর স্বাক্ষর করেন এবং ছেলের বউকে বাড়িতে আনার অনুমতি পায় তারা। 

বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ। বউকে কোনো কথা শোনানো যাচ্ছে না। তার একটাই কথা, বাড়ি বিক্রি করে তাকে টাকা দিতে হবে, সাথে ডির্ভোস। তোর বাবা কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাকে বাঁচানো যাবে না! রীতিমতো মরার ঘর থেকে ফিরে এসেছে।

সব শুনে মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ির রিকশায় তুলে দিলো। বিপদে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে। তবে সবার আগে জীবন বাঁচানোর জন্য সুস্থ থাকাটা জরুরি। মা নিরুপায় হয়ে বাসায় ফিরে গেলেন। একমাত্র মা-ই পারে এ সংকট সামাল দিতে। মায়ের ধৈর্য অপরিসীম। 

সপ্তাহখানেক পরে ছোটো বউ ঢাকায় ছেলের কাছে গেল এবং দিনে একাধিকবার কারণে-অকারণে ফোন করে হাজারও অভিযোগ জানায়। প্রতিদিন ছেলে-বউ এর ঝগড়াঝাটি, মারামারির খবর অতিষ্ট  করে তোলে খোকন মিয়াকে। বিষয়টি নিয়ে তার নাওয়া খাওয়া বন্ধ প্রায়। 

একপর্যায়ে তার কাছে মনে হলো, ছেলেকে সে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবেন। ছেলের পরামর্শে খোকন মিয়া উকিলের সাথে তার সাথে ঘটে যাওয়া সবকিছু খুলে বলেন। উকিল প্রথমে হাসেন আর বলেন, ‘ছেলে ত্যাজ্য করে কি করবেন? ত্যাজ্য করলেও সে আপনার সম্পত্তির ভাগ পাবে। ওসব করে কোনো কাজ নেই। আপনি বরং ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সম্পত্তি বন্টননামা করে দেন।’

খোকন মিয়া এবার বেঁকে বসলেন। মনে মনে ভাবলেন, বন্টননামা করলে তো সাথে সাথে ছেলে-মেয়ে মালিক হয়ে যাবে। তারপর তারা যদি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তখন কি হবে? না, তা করা যাবে না। বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রীকে নিয়ে বিপদে পড়া যাবে না। তিনি উকিল সাহেবের কাছ থেকে সময় চেয়ে ফিরে এলেন। কিন্তু  দুই চোখে ঘুম নেই তার। কি হবে শেষ পর্যন্ত!

অনেক চিন্তা-ভাবনার পর স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর আর ছোট ছেলের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে সব ছেলে মেয়ের ছবি এনআউডি কার্ড যোগাড় করে তার ওয়ারিশদের নামে ওছিয়তনামা রেজিস্ট্রি করান। যা তার মৃত্যুর পরে কার্যকর হবে। বিষয়টি বাড়ির সবাই কমবেশি জানতো, শুধুমাত্র ছোটো ছেলেকে বলা হয়নি।

কারণ ছোট ছেলে বিষয়টি মেনে নেবে না বলে খোকন মিয়ার মনে হয়েছিল।  ওছিয়তনামা করার পরে তার দু:চিন্তা অনেকটা লাঘব হয়েছিল এবং ওছিয়তনামা  করার মাসখানেক পরে ছেলের কাছে ঢাকায় বেড়াতে যান। সপ্তাহখানেক ঢাকায় থাকেন। তার মধ্যে দুইদিন থাকেন ছেলের কাছে। ছেলে আর বউ এখন বেশ মিলেমিশে আছে দেখে বেশ শান্তি পেলেন তারা।

এক রুমের বাসা । রাতে খোকন মিয়া বাসার পাশে মসজিদে ঘুমাতে যাবেন। ছেলের বউ মসজিদে যেতে দিলেন না শ্বশুরকে। তারা নিচে বিছানা করে খোকন মিয়াকে খাটে ঘুমাতে দিলেন। দুই দিনে ছেলের বউকে নিয়ে পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। 

এক সপ্তাহ ঢাকা থেকে বাড়িতে এসে বেশ স্বস্তিতে ছিলেন তিনি। দেখতে দেখতে ছয়মাস কেটে গেল। ছয়মাস পরে ছোটো ছেলের বউ এলো বাড়িতে। দুইদিন থাকার পরে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করা সেই কাগজ শ্বশুরের হাতে ফেরত দিলেন। কি ভেবে স্ট্যাম্প নিয়েছিল আর কি ভেবে স্ট্যাম্প ফেরত দিলো তা নিয়ে আর কোনো কথা হলো না। খোকন মিয়া দুই চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুর্বিসহ দিনগুলোর কথা মনে করলো। একপ্রকার খুশি ছেলের বউয়ের ওপর, তার একরোখা জেদি ছেলের সাথে মানিয়ে থাকছে বলে। আর একটাই চিন্তা তার মনের মধ্যে তোলপাড় করে যাচ্ছে, আমি যখন থাকবো না তখন আমার ছেলে-মেয়েগুলো পারবে তো মান-সম্মানের সাথে পথ চলতে! 

খোকন মিয়া তার ও তার স্ত্রী স্বাক্ষরিত ফাঁকা স্ট্যাম্প নেড়েচেড়ে দেখছেন আর ভাবছেন কি বিচিত্র দেনা-পাওনা। অবশেষে উকিল এর সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন তার এক খণ্ড স্বপ্ন ব্যবচ্ছেদ করার।  স্বপ্ন ব্যবচ্ছেদ হলো সব ওয়ারিশকে শরিক করে। মনের মধ্যে আর কোনো দ্বিধা রইলো না খোকন মিয়ার। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। তার স্বপ্ন ব্যবচ্ছেদপত্র এবং চাপের মুখে স্বাক্ষরিত ফাঁকা স্ট্যাম্প দায়িত্বশীল কারো কাছে তুলে দিয়ে তিনি নিশ্চিত হতে চান!

[তাসলিমা বেগম : কবি ও গল্পকার]



মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

ত্বরিত গতির সুকন্যা

প্রকাশ: ০১:০৮ পিএম, ০২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

ত্বরিত গতির সুকন্যা 

-শাহানা পরভীন 

তুমি সিঁদুর রঙে ভিজে, কলেজের সেই র‍্যাগিং ছলে,
এক পলকে দোওয়াত কালি খুঁজে ফিরে, চটাস করে হারিয়ে দিলে।
আচ্ছা করে রাঙিয়ে দিলে ওদেরই  বালতি ভরা রং ঢেলে।
ভুলে ভালে ক্লাস খুঁজে দিনটি হলো কাবার,
চায়ের কাপে ঝড় তুলে, আনন্দে মাতিয়ে সাবার।
প্রতিক্রিয়ার কী দারুণ ত্বরিত কোড তোমার !
বিধাতা দিয়েছেন বঙ্গমাতার গর্ভে, তোমার জন্মকালে।

সেই শিশুকালে মানবতার ত্বরিত গতিতে বলেছিলে-“আব্বা ,
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ,
রাজবন্দীদের মুক্তি চাই।”

সেই কৈশোরে সাহসিকতার বিদ্যুৎ গতির কোডে বলেছিলে-
“আমি করবো না সই ,
যদি না বাজেট বরাদ্দ পাই ।”
ইটের ‘পরে ইটে শহীদ মিনার গেঁথে,
ঘন্টার পর ঘন্টা বন্দি থেকে,
বুকের পাঁজরে অবিরত সুর তুলে বলেছিলে,
“এই কলেজে শহীদ মিনার চাই।”

তারুণ্যে মা বাবা ভাই সব প্রিয়জনকে হারিয়ে ,
বেদনার আগুনে পুড়ে-
সমস্ত শোককে শক্তি করে,
জন্ম -জন্মভূমি, বাংলা-বাঙালির উন্নয়নের তরে-নিত্য শুভার্থী তুমি।
প্রকাশ্যে সব সত্য জ্বেলে- ভয়হীন,আত্মমর্যাদার সুইফট কোডে -অতন্দ্র প্রহরী তুমি।
পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে-
স্মার্ট সোনার বাংলাদেশ বির্নিমানে-
এই প্রৌঢ়েও-
শত সাধনা- সংগ্রাম -তারুণ্যের সুইফট কোডে,
বাংলাদেশকে নিয়ে আনখমস্তক ছুটে চলো ,
তুমি  বাঙালির পরম আপনজনা, মুজিব সুকন্যা,
বিশ্ব সংসারে তুমিই একজনা, শেখ হাসিনা।

১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


কবিতা   শাহানা পরভীন  


মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

তসলিমা নাসরিনকে করা একটি কমেন্ট

প্রকাশ: ০৪:২৫ পিএম, ৩০ অগাস্ট, ২০২৩


Thumbnail

তসলিমা নাসরিন, অনেকেই আছে আপনার পাশে, অনেকেই আপনাকে ভালোও বাসে। এই যে কত ভক্ত অনুরাগী! কাঁটাতারের বেড়াকে ফাঁকি দিয়ে বিশ্বময় ছড়ানো ফেসবুকের বিনাতারের সংযোগে আপনার পাশে দাঁড়িয়েছে। আপনার লেখার প্রশংসা করছে। এই প্রাপ্যটুকুই ক'জনের ভাগ্যে জুটে? আসলে যে জন্য আপনি আফসোস করছেন, সেটা আপনার মনে পড়া অতীত, যেখানে এক সময় বসবাস করেছে আপনার দিন, রাত, সূর্য, চাঁদ আর আকাশ দেখা। যেখানে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসে নির্জনে, নিভৃতে কবিতার সাথে কথপোকথন। সেটাই আফসোস, সেটাই ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আসলে আপনি নিজেকে যে দোষে দোষী মনে করছেন না, সে দোষটাকেই অন্য কেউ দোষ মনে করছে, গুরুতর দোষ। এখানে দুইটি মতের ভিন্নতা, স্বাতন্ত্র। 

লেখক বা কবি মাত্রই ভিন্ন, স্বাতন্ত্র চিন্তা-চেতনার অগ্রগামী পথিক। সমাজের কুসংস্কারগুলো ভেঙ্গে-চুরে বেড়িয়ে আসার স্বপ্ন কেবল লেখক বা কবিরাই দেখেন। তারা সমাজের সত্যিকারের অসঙ্গতিগুলো অক্ষর অঙ্কনে প্রস্ফুটিত করার চেষ্টা চালান। লিখতে মন চায় না, কিন্তু সমাজের অসঙ্গতিগুলো চেতনার মস্তিস্কে যন্ত্রনা শুরু করে দেয়। লিখতে হয়। 

কবি বা লেখক মাত্রই তাই। আপনিও তার ব্যতিক্রম নন। একজন লেখক যে সমাজে বড় হয় বা বসবাস করে বা কালের বিবর্তনে সংযুক্ত, তার প্রতিটি লেখায় সেই সমাজের চিত্রটিই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আপনার লেখাতেও তাই হয়েছে। মানুষকে, সমাজকে, জীবনকে উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এটাই লেখকের সত্তা, ভিন্নতা। কিন্ত সে সমাজের মানুষেরা এই সত্য লেখার যে দুঃসাহসিকতা, সেটা মেনে নিতে পারেনি। কিংবা সংঘবদ্ধ কিছু মানুষ, কিছু সমাজ ব্যবস্থা এই সত্য লেখার সক্ষমতাকে মুছে দিতে চেয়েছে। যে কারণে আজ আফসোস। কিন্তু আপনি আপনার লেখনিতে যা বলেছেন, সমাজকে, মানুষকে যা জানিয়েছেন- তাই বা জানাতে পারে ক'জনা!

তসলিমা নাসরিন  


মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

প্রকাশ: ০৮:১৭ এএম, ২৭ অগাস্ট, ২০২৩


Thumbnail

আজ রোববার (২৭ আগস্ট) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের শোকের মাসের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত।

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।

কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবির সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, দোয়া মাহফিল এবং আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও বিভিন্ন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে।

নজরুলের সৃষ্টিকর্ম প্রসঙ্গে নজরুল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘নজরুল ইতিহাস ও সময় সচেতন মানুষ ছিলেন, যার প্রভাব তাঁর লেখায় স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের তরঙ্গকে নজরুল তাঁর সাহিত্যে বিপুলভাবে ধারণ করেছেন। সেই সময়ে ধর্মান্ধ মুসলমানদের তিনি পুনর্জাগরণের ডাক দিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল একজন বলিষ্ঠ নেতার মতো।’

প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। নজরুলের কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে।

নজরুল ছিলেন চির প্রেমের কবি। তিনি যৌবনের দূত। তিনি প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম চেয়েছিলেন। মূলত তিনি বিদ্রোহী, কিন্তু তার প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন, ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।’ 

কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মা জাহেদা খাতুন। 

স্বাধীনতার পরপরই কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন এবং ধানমণ্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন। 

জাতীয় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।

 



মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি (পর্ব-২০)


Thumbnail

চলছে শোকাবহ আগস্ট মাস। এ মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। আগস্ট ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত নিয়ে অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সারা জাগানো বই ‘পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি’ এর ধারাবাহিক পর্বের বিংশ পর্ব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-

ঢাকার একটি রেস্তোরাঁ। চা খেতে বসেছে দু বন্ধু। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলল যে কিছুদিনের মধ্যেই বর্তমান মহকুমাগুলোকে জেলায় পরিণত করা হবে। পুনর্গঠিত নতুন জেলায় নতুন প্রশাসক হবেন জেলা গভর্নর এবং তাঁর থাকবে নিরঙ্কুশ শাসনক্ষমতা। জেলা গভর্নরকে একমাত্র বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। নতুন জেলা গভর্নররা ক্ষমতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে অগণিত লোককে হত্যা করা হবে এবং বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা কেউ করলে সোজা জেলে ঢুকিয়ে দেবে। সমবায়ের নামে ঘরবাড়ি আর জায়গা-সম্পত্তি কেড়ে নেয়া হবে। বন্ধুর মুখে এই ধরনের কথাবার্তা শোনার পর অপর বন্ধুটি জানায়, সেও এসব কথা আগেই শুনেছে।

আসলে এ ধরনের অপপ্রচার হাবিবুর রহমান গং তাদের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সারা দেশেই ছড়াতে থাকে। সামান্য সত্যের সঙ্গে মিথ্যাকে মিশিয়ে অপপ্রচার চালালে তা সহজেই লোকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। কথাটা মনে রেখেই ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের কাজে নেমেছিল। তারা ভাল করেই জানত একটা সময় পর্যন্ত সাধারণ মানুষ এ ধরনের অপপ্রচারের মুখে মিথ্যাকে সত্য থেকে আলাদা করতে পারে না। আর ক্ষমতার কাছাকাছি যারা থাকে, তারা নিজেরাই যখন ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে তাদের জানা কিছু কিছু সত্য ঘটনার সঙ্গে মিথ্যার রং মিশিয়ে অপপ্রচারে নামে, তখন জন্গণ অনায়াসে বিভ্রান্ত হবে। জেলা গভর্নরসংক্রান্ত প্রসঙ্গের ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম দেখা গেল না।

প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে ঔপনিবেশিক আমলের মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে গভর্নর নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। তবে এসকল গর্ভনর হবেন জনগণের নির্বাচিত এবং তারা ক্ষমতাকে প্রয়োগ করবেন এমন এক কমিটির মাধ্যমে, যে কমিটিতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজন থাকবে। কমিটির এসকল সদস্য জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা থাকবে। কমিটির এসকল সদস্য জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই ইচ্ছেমতো কিছু করার সুযোগ পাবেন না। অন্যদিকে সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় প্রশাসনকে নিয়ে যেতে পারলে দেশের সাধারণ মানুষ সহজেই তাদের বিভিন্ন অভাব-অভিযোগের সুরাহা করতে পারবে। জবাবদিহিমূলক বিকেন্দ্রীকরণ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তক করলে জনগণ তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের একটি সুযোগ পাবে। এই নতুন পদ্ধতিতে যেহেতু নিরঙ্কুশভাবে কারো হাতে ক্ষমতা থাকবে না, কাজেই ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ না কারণে ঔপনিবেশিক আমলের মতো শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তারা জনগণের শক্তি আর মালিকসুলভ ব্যবহারের সুযোগ পাবে না। কিন্তু দুভাগ্য যে এ সরল সত্য জনগণকে বোঝানোর মতো লোকের তখন অভাব ছিল। 

পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছিল যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় ধরা জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছিল। এদিকে সহায়-সম্বলহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছিল। ধনী ও গরিবের মধ্যে বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই সমবায়ের ধারণাকে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপে পরিণত করার চেষ্টা করলেন। এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল যারা জমি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সম্পত্তির আরও উন্নতি ও উৎকর্ষসাধন করতে পারবে তেমনি যারা শ্রমিক তারা সম্পত্তির ভাগিদার হওয়ার ফলে নিজেদের শ্রম দিয়ে দেশে উৎপাদন বাড়িয়ে তুলবে। তাদের অধিকারও নিশ্চিত হবে। এ কারণে সমবায়পদ্ধতি পরিচালনার জন্যে এ ধরনের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যেখানে কারো নিজের ক্ষমতা অন্য কারোর উপর চাপিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগই ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর নতুন জেলা প্রশাসন ও সমবায়পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরে ষড়যন্ত্রকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা এতদিন ধরে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে এবং অপপ্রচার চালিয়ে এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়, যার ফলে তাদের ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, বঙ্গবন্ধুকে শেষ করবার পূর্বে জনগণ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। কিন্তু তারা হিসেব করে দেখল যে, একবার যদি নতুন পদ্ধতি চালু হয়ে যায় এবং জনগণ যদি বঙ্গবন্ধুর মূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়, তা হলে তাঁকে শেষ করে কিছুতেই পার পাওয়া যাবে না। নতুন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রের পক্ষে কাজ করে যাওয়া এক লক্ষ লোককেও রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কাজেই নতুন পদ্ধতির সুফল জনগণের কাছে পৌঁছানোর আগেই যা করার করতে হবে। আসলে ষড়যন্ত্রকারীরা আতঙ্কিত হলেও তা ছিল সাময়িক। তারা কুমিল্লায় বসে নতুন অবস্থার পর্যালোচনা করতে থাকে। তারা খুঁটিনাটি বিষয় পর্যালোচনা করে দেখল যে, তাদের ঘাবড়াবার কিছু নেই। শুধু জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যে একের পর এক গুজব সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে, যাতে বঙ্গবন্ধুকে জনগণের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা সম্ভব হয়। যেহেতু প্রশাসনযন্ত্র থেকে শুরু করে সর্বত্রই ষড়যন্ত্রকারীদের অবাধ গতি কাজটি করা তাদের পক্ষে তাই বেশি কঠিন হওয়ার কথা নয়।

বাস্তবেও ষড়যন্ত্রকারীদের কাজটি বেশি কঠিন হল না। অপপ্রচার বিশেষ করে একের পর এক গুজব এমনভাবে ছড়ানো হতে থাকল যে, জনগণ জেলা গভর্নর ও সমবায়পদ্ধতির আসল উদ্দেশ্যই বুঝতে সক্ষম হল না। গুজবে কান দিয়ে তারা হল বিভ্রান্ত। এ সুযোগে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুর উপর আঘাত হানার জন্যে তাদের সময় নির্দিষ্ট করল। ষড়যন্ত্রকারীরা একটি বিষয়ে নিশ্চিত হল যে, বঙ্গবন্ধুকে শেষ করতে হলে যে করেই হোক কাজটা করতে হবে নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ার আগেই। সময়ের বিষয়টি তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। সকল ষড়যন্ত্রকারী নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে এবং দেশের পরিস্থিতি সঠিকভাবে আঁচ করেই বঙ্গবন্ধুকে চূড়ান্তভাবে আঘাত হানার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল। যাদের দায়িত্ব ছিল যড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করা, তাদের অনেকেই ষড়যন্ত্রে শরিক হওয়ার ফলে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগীরা আঘাত সম্পর্কে কিছুই আঁচ করতে পারলেন না।



মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি (পর্ব-১৯)


Thumbnail

চলছে শোকাবহ আগস্ট মাস। এ মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। আগস্ট ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত নিয়ে অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সারা জাগানো বই ‘পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি’ এর ধারাবাহিক পর্বের ঊনবিংশ পর্ব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-

ঢাকার মগবাজার এলাকার একটি বাড়িতে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং শুরু হয়েছে। এতে অংশ নিয়েছে ৭১-এর ঘাতক আল-বদর, আল-শামসের সদস্যরা। আলোচনার মূল বিষয় হল, কিভাবে বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারকে খতম করা যায়। কেননা, বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় থাকলে এদেশকে কিছুতেই পাকিস্তানের অনুগত রাখা যাবে না। তা ছাড়া ৭১-এর পরাজয়কে আল-বদর, আল-শামসরা কিছুতেই ভুলতে পারেনি।

সভায় বক্তারা যেসকল বক্তব্য প্রদান করে চলল, তাতে স্পষ্ট হল যে, ইতিমধ্যেই তাদের সঙ্গে হাবিবুর রহমান গংদের যোগাযোগ হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান তাদের এই তৎপরতাকে সমর্থন করার জন্যে যা যা প্রয়োজন, তার সবকিছুই করতে প্রস্তুত। হাবিবুর রহমানদের তরফ থেকে তাদেরকে এই আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে, তারা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে তাদের কাজকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। কাজেই হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে বিষয়টি জটিল হওয়াতে তাদের সকলকে বাহ্যিকভাবে আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে যেতে হবে যাতে করে জনগণ কিছুতেই আঁচ করতে না পারে যে ষড়যন্ত্রকারীদের এক গ্রুপের সঙ্গে আরেক গ্রুপের কোনোপ্রকার যোগাযোগ আছে। কাজের সুবিধা এবং জনগণকে সহজে বিভ্রান্ত করার জন্যেই তারা গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন মগবাজারের মিটিং- ৭১-এর আল-বদর, আল-শামস হিসেবে যারা উপস্থিত হয়েছে, তাদেরকে সাংকেতিক নাম দেয়া হয়েছে মগবাজার গ্রুপ। কাজেই মগবাজার গ্রুপ বললেই বুঝে নিতে হবে, তারা কারা।।

ষড়যন্ত্রকারীদের একটি অঙ্গ হিসেবে মগবাজার গ্রুপ কাজ চালিয়ে গেলেও তাদের আসল নেতা দেশের বাইরে অবস্থান করছিল। এতে তাদের অসুবিধা নয়, বরং সুবিধাই হয়। কেননা, জনগণ থেকে শুরু করে সরকারের অধিকাংশ লোকই বুঝতে পারেনি যে, মগবাজার গ্রুপ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। বরং তাদের ধারণা ছিল যে, দেশের পরিস্থিতি ৭১-এর ঘাতকদের অনকূলে নয়। কারণেই তারা নিজেদের গা বাঁচাতে ব্যস্ত। সুতরাং ওদের তরফ থেকে কোনোরকম ক্ষতির আশঙ্কা নেই। অথচ প্রকৃত অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।

যা হোক, মগবাজারের সভায় উপস্থিত সদস্যদের আশ্বস্ত করা হয় যে, তাদের নেতা বিদেশে অবস্থান করলেও নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছেন। দেশের অভ্যন্তরে কার কার সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ চালিয়ে যেতে হবে, সে নির্দেশও তিনি বিদেশ থেকে দিয়ে চলেছেন। তারই নির্দেশে মগবাজার গ্রুপ কুমিল্লা গ্রুপ হিসেবে পরিচিত হাবিবুর রহমান। চলেছে এবং নিজেদের শক্তি সম্পর্কে অনেক বেশি আশাবাদী হয়েছে। তারা মনে করে, গং-এর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে একে অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করাটা এখন আর কোনো কঠিন কাজ নয় এবং হত্যাপরবর্তী জামেলাটা সামাল দেয়াও তেমন কঠিন কাজ হবে না।

মগবাজার গ্রুপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, তাদের সদস্যরা দেশের যে-কোনো স্থানেই অবস্থান করুক না কেন, তাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখতে হবে। জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের অংশ হিসেবে বেশি করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। এর ধর্মীয় অনুষ্ঠান মগবাজার গ্রুপের সদস্যরা কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করবে। ইয়লামের পবিত্র বাণী-প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে কৌশলে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যেতে হবে। একই লক্ষ্যে দেশের অধিকাংশ মসজিদের সঙ্গে গ্রুপ সদস্যদের সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান মসজিদের মাধ্যমে এদেশের ধর্মভীরু জনগণের যত কাছাকাছি যাওয়া যাবে, অন্য কোনো পন্থায় ততটা কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব নয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠান মসজিদের মাধ্যমে লোকজনকে ধীরে ধীরে বোঝাতে হবে, বঙ্গবন্ধু সরকারের এদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ থেকে ইসলামকে শেষ করে দেয়া। জনগণকে যদি কথাটা ভালভাবে বোঝানো যায়, তা হলে তাদের মধ্যে জেহাদি মনোভাব সৃষ্টি হবে। সাধারণ মানুষকে এভাবে বিভ্রান্ত করা গেলে বঙ্গবন্ধুকে সহজেই জনগণ থেক বিচ্ছিন্ন করা যাবে। জনগণকে আরো বোঝাতে হবে, ভারত থেকে অনেক হিন্দুকে আমদানি করা হয়েছে, যাদের কাজই হচ্ছে দেশ থেকে ইসলামকে উচ্ছেদ করে দেয়া। এসকল হিন্দু বিভিন্নভাবে মুসলমানদের বেশ ধারণ করে তাদের কাজ গোপনে গোপনে চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মুসলমান পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছে। কাজেই সাচ্চা মুসলমান হিসেবে এদেরকে রুখতে হবে। এটা সকলের জন্যে ফরজ হয়ে গেছে।

তখন ৭১ সালে ট্রেনিংপ্রাপ্ত আল-বদর, আল-শামসের সদস্যরাই সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। এমনকি বিভিন্ন উপায়ে ক্ষমতাসীন দল প্রশাসনে ঢুকতে সক্ষম হয় তাদের অনেকেই। ছাড়া নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থেই নতুন রাজনৈতিক দল জাসদে ভিড়ে যাওয়া সদস্যরা তো ছিলোই। মগবাজার গ্রুপ এসকল খুনীদেরকেই আবার সংগঠিত করতে থাকে। কারণ তারা জানত, সুসংগঠিত আল-বদর, রাজকাররা আবার মনোবল ফিরে পাবে এবং ৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগও হাতছাড়া করবে না। কথায় আছে, যে বাঘ একবার মানুষের মাংসের স্বাদ পেয়েছে, সে সুযোগ পেলেই মানুষ হত্যা করবে। ৭১- যারা একবার নিরীহ জনগণকে হত্যা করে হত্যার স্বাদ পেয়েছে, মা-বোনদের ধর্ষণ করে ধর্ষণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেসেইসকল সাচ্চা কর্মীদের দিয়ে দুনিয়ার এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করানো যাবে না।

মগবাজারের সভা শেষ হল। যে যার বাড়ির দিকে বেশ সন্তুষ্ট চিত্তেই পা বাড়াল। এতদিন পর কাজের মতো কাজ পেয়ে তারা যেন নিজেদের ধন্য মনে করল। এভাবেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র এগিয়ে চলল।



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন