এডিটর’স মাইন্ড

সুশীলদের তৈরি সূচকে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান কেন এগিয়ে?

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩


Thumbnail

দেউলিয়া হওয়ার পথে পাকিস্তান। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি; যা দিয়ে দেশটি মাত্র তিন সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে। পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ ২৭৪ বিলিয়ন ডলার। মুদ্রাস্ফীতি ২৯ শতাংশের বেশি। রকম চরম পরিস্থিতিতে দেশটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ৭৫০ কোটি ডলারের জরুরি ঋণ সহায়তা চেয়েছিল। আইএমএফ ১১০ কোটি ডলার পর্যন্ত ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। এজন্য বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে। শর্ত পূরণ করতে গিয়ে এখন আরও মুখ থুবড়ে পড়েছে পাকিস্তানের অর্থনীতি। কষ্টের মধ্যেই পাকিস্তানে একটা কৌতুক বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। পাকিস্তানের সাংবাদিকরা বলেছেন, আইএমএফের কাছে ঋণ নেওয়ার দরকার কী? বরং পারভেজ মোশাররফ, নওয়াজ শরিফ আসিফ আলী জারদারির কাছ থেকে ঋণ নিলেই পারে। রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, পাকিস্তানের এই তিন সাবেক সরকার রাষ্ট্র প্রধানের কাছে লুণ্ঠিত সম্পদের পরিমাণ হাজার কোটি ডলার। যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত সৌদি আরবে এদের লুণ্ঠিত অর্থ অলস পড়ে আছে। কৌতুক নিয়ে যখন পাকিস্তানে নানামুখী আলোচনা তখন ৩১ জানুয়ারি পাকিস্তানের জন্য এক সুখবর দিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। ওই দিন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রতিবেদন ২০২২ প্রকাশ করে। ১৮০টি দেশের তালিকায় পাকিস্তান বাংলাদেশ আফগানিস্তানের চেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২৫ পয়েন্ট পেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান যখন তালিকায় ১৪৭তম। সেখানে বাংলাদেশের চেয়ে পয়েন্ট (২৭) বেশি পেয়ে পাকিস্তান সাত ধাপ এগিয়ে (১৪০তম) এতে পাকিস্তানিদের নিশ্চয়ই খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তা নয় বরং পাকিস্তানিরা এতে বিস্মিত এবং হতবাক।দুনিয়া নিউজ’-এর জনপ্রিয়দুনিয়া কামরান খানকে সাথঅনুষ্ঠানে টিআইয়ের প্রতিবেদনকে বছরের সেরা কৌতুক বললেন একজন অর্থনীতিবিদ। রসিকতা করে বললেন, ‘ট্রান্সপারেন্সিকে নিশ্চয়ই পাকিস্তান সরকার নজরানা দিয়েছে, যেন পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের ওপর রাখা হয়। ওই অর্থনীতিবিদ বললেন, ‘পাকিস্তানে যেভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় লুণ্ঠন হয়েছে, তা বিশ্বে কোথাও হয়নি। দুর্নীতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। বাংলাদেশের চেয়ে যদি পাকিস্তানে কম দুর্নীতি হয়, তাহলে তো দেখতে হবে এত দুর্নীতি করেও বাংলাদেশ কেন পাকিস্তানের চেয়ে এত এগিয়ে। সে ক্ষেত্রে অর্থনীতির অনেক সূত্রই বদলে ফেলতে হবে।কয়েক বছর ধরেই পাকিস্তানে বাংলাদেশচর্চা বেশ জোরেশোরে চলছে। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া, বিস্ময়কর উন্নতি ইত্যাদি নিয়ে এখন খোলামেলা আত্মসমালোচনা হয়। পাকিস্তানের গণমাধ্যমকর্মী, বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যখন বাংলাদেশ বন্দনা, ঠিক সেই সময় বাংলাদেশে কিছু পাকিস্তানপ্রেমীর পাকিস্তানপ্রীতি লক্ষ করার মতো। তারা পাকিস্তানের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। পাকিস্তানের মতো সুপ্রিম কোর্ট চায়। পাকিস্তানের মতো ভারতবিরোধিতা চায়। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের করিৎকর্মা মহাসচিব বলেন, পাকিস্তান আমলই ভালো ছিল। টিআইয়ের দুর্নীতি সূচক প্রতিবেদনে তারা নিশ্চয়ই উল্লসিত হবেন। যে দেশটিতে রাজনীতিবিদ এবং সেনাবাহিনী মিলেমিশে লুণ্ঠনের উৎসব করে। যে দেশে ১২৬ হাজার কোটি রুপির উন্নয়ন কাগজে আছে বাস্তবে নেই। সিন্ধুতে ৪২টি সেতু নির্মাণের জন্য টেন্ডার হয়েছে। টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কাগজে-কলমে দেখানো হয়েছে সেতু নির্মাণ সমাপ্ত! ঠিকাদার টাকা তুলে হজম করে ফেলেছে। পাঁচ বছর পর আবিষ্কৃত হয়েছে, আদতে কোনো সেতুই নির্মিত হয়নি। টাকা স্রেফ সরকারি কোষাগার থেকে ঠিকাদারের কাছে গেছে। ঠিকাদার টাকা ভাগ করে দিয়েছে রাজনীতিবিদ, জেনারেলদের মধ্যে। আইএমএফ পাকিস্তান সম্পর্কে বলেছে, দেশটির ন্যূনতম জবাবদিহিতা নেই। মার্কিন কংগ্রেসে অভিযোগ করা হয়েছে, বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তা পাকিস্তানের সরকারি ব্যক্তিরা মেরে দিয়েছেন। সেই দেশকে বাংলাদেশের চেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ দেখিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কী প্রমাণ করল? শুধু পাকিস্তান কেন, টিআইয়ের প্রতিবেদনে শ্রীলঙ্কার দুর্নীতির অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভালো। রাজাপক্ষে পরিবারের নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে দেশটি এখন দেউলিয়া। মুদ্রাস্ফীতি ৯৫ শতাংশ। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘একটি পরিবারের সীমাহীন দুর্নীতির কারণেই শ্রীলঙ্কার এই পরিণতি।ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলএকটি পরিবারের লোভে ধ্বংসপ্রাপ্ত এক দেশ সেই শ্রীলঙ্কা টিআইয়ের দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে ৪৬ ধাপ এগিয়ে (১০১তম) শ্রীলঙ্কার পয়েন্ট ৩৬। দুর্নীতির পরীক্ষায় পাস করেও শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং স্বচ্ছতায়শ্রীলঙ্কাএক বড় প্রশ্ন। এর আগেও বার্লিনভিত্তিক এই দুর্নীতিবিরোধী সংগঠনটি বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা পাকিস্তানের চেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে। দুর্নীতির ধারণা সূচক বাংলাদেশকে আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দেশ হিসেবেই চিত্রায়ণ করে সংস্থাটি। তখন পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার অবস্থা ছিল না। দেশ দুটির ভিতরের দুর্নীতির চিত্র উঠে আসেনি ট্রান্সপারেন্সির আগের প্রতিবেদনগুলোয়। চরম সংকটে থাকা দেশ দুটির অর্থনৈতিক সংকটের আসল কারণ এখন নানাভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে দেশ দুটির সীমাহীন দুর্নীতি, প্রকাশ্য লুণ্ঠনের যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা ভয়ংকর। কোনো দেশের দুর্নীতির সঙ্গেই দুই দেশের তুলনা করা চলে না। টিআইয়ের প্রতিবেদন যে অর্ধসত্য, মনগড়া এবং রাজনৈতিকভাবে দুরভিসন্ধিমূলক, তা দুটি দেশের মান নির্ণয় থেকেই পরিষ্কার হয়। সম্প্রতি ভারতীয় শিল্পগোষ্ঠী আদানিকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে হুলুস্থুল চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গের এক গবেষণা প্রতিবেদনে তছনছ হচ্ছে আদানি সাম্রাজ্য। হিনডেনবার্গ দাবি করেছে, ‘ভারতের পতাকায় শরীর ঢেকে তারা দেশকে লুণ্ঠন করে চলেছে।এক আদানি শিল্প গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জালিয়াতি এবং দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে তার পরিমাণ বাংলাদেশের এক বছরের জাতীয় বাজেটের সমপরিমাণ। অথচ টিআইয়ের ধারণা সূচকে ভারতের অবস্থান ৮৭তম। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটির স্কোর ৪০। ভারত বাংলাদেশের দুর্নীতির কি এত পার্থক্য?

শুধু দুর্নীতির ধারণা সূচক কেন, যে কোনো সূচকে বাংলাদেশকে হতশ্রী, ব্যর্থ, খারাপ দেখানোর একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এই যে গত বছররিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারগণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক প্রকাশ করল। এতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২। ওই প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের চেয়েও পাকিস্তান (১৫৭), আফগানিস্তান (১৫৬) রাশিয়ার (১৫৫) গণমাধ্যম স্বাধীন। কী অদ্ভুত ব্যাপার! কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই সূচককে হাস্যকর, কাল্পনিক বলা যায়। পাকিস্তানের গণমাধ্যম সম্পর্কে এএফপির একটি প্রতিবেদন উল্লেখ করতে চাই। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের গণমাধ্যম বুটের তলায় পিষ্ট। সেখানকার গণমাধ্যম ততটুকু স্বাধীন যতটুকু সেনাবাহিনী চায়।ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট (আইপিআই) বছরের ১২ জানুয়ারি পাকিস্তানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০২২-এর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর সময়ের ওপর এই প্রতিবেদনে পাকিস্তানের ৩৮টি গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা শনাক্ত করে আইপিআই। এর মধ্যে এপ্রিলে তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার গণমাধ্যমের অবস্থা নিয়ে নতুন করে কিছু বলতে চাই না। ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘কমিউনিস্ট শাসনের সময়ও রাশিয়ার গণমাধ্যম বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে ভালো ছিল।রাশিয়ার গণমাধ্যম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত এবং শতভাগ সেন্সরশিপের আওতায়। আফগানিস্তানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বে গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে দুরূহ এবং দুর্গম জায়গা হলো আফগানিস্তান।গণমাধ্যমের জন্য এসব ভীতিকর দেশের পেছনে বাংলাদেশকে রাখা হয় কীভাবে? ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। সম্প্রতি বিবিসিতেইন্ডিয়া : দ্য মোদি কোশ্চেনশিরোনামে প্রায় এক ঘণ্টার একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই ভারত প্রামাণ্যচিত্রটির ব্যাপারে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে। ইউটিউবসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ওই প্রামাণ্যচিত্রটি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। ভারতে প্রামাণ্যচিত্রটির সব ধরনের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করে। বলে নেওয়া দরকার, ‘দ্য মোদি কোশ্চেনএকপেশে একটি তথ্যচিত্র। সাংবাদিকতার ন্যূনতম রীতিনীতি এতে অনুসরণ করা হয়নি। যে-কেউ প্রতিবেদনটি দেখলেই বুঝবেন এর পেছনে একটি রাজনৈতিক মতলব আছে। প্রতিবেদনের শেষ ভাগে এসে ভারতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়েও সংশয় এবং শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বিরোধীমত দমন করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। তার পরও ভারতের মতো মুক্তচিন্তার দেশে একটি তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ হওয়াটা অবশ্যই গণমাধ্যমের জন্য অস্বস্তিকর ঘটনা। সে তুলনায় বাংলাদেশ কি তাহলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দিক থেকে অনেক উদার নয়? বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও আলজাজিরায়অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেনশিরোনামে একটি অসত্য ভিত্তিহীন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার কিন্তু ওই প্রতিবেদনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। একপেশে, মনগড়া ভিত্তিহীন প্রতিবেদনটি এখনো ইউটিউবসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু ওই প্রতিবেদন কেন, ইউটিউব, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন চলছে ঘৃণা উৎসব। চরিত্রহননের খেলা। কিছু ব্যক্তি রাষ্ট্র, দেশ, সরকার এবং বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কুৎসিত আক্রমণ করছে। এসব লাগামহীন কনটেন্ট বন্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় না। অবাধে এসব কুরুচিপূর্ণ নোংরা প্রচারণা জনগণ দেখছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণহীন স্বেচ্ছাচারিতা এখন এক বড় ব্যাধির নাম। শুধু সোশ্যাল মিডিয়া কেন, টেলিভিশন টকশোগুলোয় সরকারকে কেটে ছিঁড়ে লবণ লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দু-একটি মূলধারার গণমাধ্যম তো পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়াচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক নিয়ে দুটি গণমাধ্যম যেভাবে অপতৎপরতা চালাল তা রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কিন্তু সরকার ক্ষেত্রে কোনো সেন্সরশিপ আরোপ করেনি। কোনো বিধিনিষেধও দেয়নি। এজন্য কেউ নিপীড়িত হয়েছেন কিংবা কাউকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে, এমন তথ্যও পাওয়া যায়নি। জনগণ মত প্রকাশের স্বাধীনতা উপভোগ করছে অবাধে। গণমাধ্যমকর্মীরা নিশ্চয়ই যে কোনো উৎস থেকে সংবাদ সংগ্রহ করবেন। অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকতা বিকশিত করবেন। কিন্তু সরকারি নথি চুরি তথ্য সংগ্রহের উপায় হতে পারে না। এটি শুধু সাংবাদিকতার নীতিবিরোধী নয়, নৈতিকতা পরিপন্থীও। চুরি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ বাংলাদেশে সরকারি নথি চুরি করা গণমাধ্যমকর্মীকেও কেউ কেউ হিরো বানিয়ে ফেলেছেন। নানান পুরস্কারে ভূষিত করে, তার আসল অপরাধ ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। কারও কারও মনোভাব এমন যে, নথি চুরি করাটাই আসল স্বাধীনতা। দেশে তথ্য অধিকার আইন রয়েছে। যে কোনো গণমাধ্যমকর্মী সরকারের যে কোনো বিভাগের তথ্য চাইতে পারেন। তথ্য না দিলে কমিশনে অভিযোগ করার ব্যবস্থাও আছে আইনে।  তার পরও কেন তথ্য চুরি করতে হবে? অনৈতিক কাজকে প্রশ্রয় দেওয়ার উদ্দেশ্য কী? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। কথা সত্য, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু কিছু ধারা আপত্তিকর। ধারাগুলো বাতিলের দাবি সাংবাদিক সমাজের দীর্ঘদিনের। আইনমন্ত্রী একাধিকবার আশ্বাস দিয়েছিলেন আইনের অসংগতিগুলো দূর করার। এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি। তবে সম্প্রতি আইনের অপপ্রয়োগ অনেক কমেছে। কিন্তু আইন স্বাধীন সাংবাদিকতার একমাত্র বাধা, তা আমি মানতে রাজি নই। আইনের আগে মানিক চন্দ্র সাহা (১৫ জানুয়ারি, ২০০৪), হুমায়ুন কবীর বালু (২৭ জুন, ২০০৪)সহ বহু সংবাদকর্মী পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হন। তাঁদের নির্মম হত্যাকান্ড গণমাধ্যমকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে কী ছিল গণমাধ্যমকর্মীদের অবস্থা? সেই ভয়ংকর সময় আমরা পেরিয়ে এসেছি। ধরনের ঘটনা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, অনলাইন মিডিয়ায় অবাধে সরকারের সমালোচনা হচ্ছে। সঙ্গে চলছে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে চরিত্রহনন। তার পরও সূচকে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার করুণ অবস্থা কেন? টিআইয়ের সূচকে যে কারণে বাংলাদেশ পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার চেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। ঠিক একই কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকেও বাংলাদেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে। এর কারণ বুঝতে হলে আগে আমাদের জানতে হবে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কিংবা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো সূচক তৈরি করে কীভাবে। সংস্থাগুলো রিপোর্টের জন্য তথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশ থেকেই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের কথাই ধরা যাক। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি বা বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের আর্থিক বিষয় নিয়ে বছরজুড়ে নানা জরিপ এবং গবেষণা করে। জরিপ গবেষণাগুলোর তথ্যই টিআইয়ের দুর্নীতির ধারণা সূচকের প্রধান উৎস। জরিপ গবেষণার কাজ করেন আমাদের সুশীল বুদ্ধিজীবীরা। তারা ব্যবসায়ী, বিভিন্ন সেবা গ্রহণকারীর সঙ্গে কথা বলেই জরিপ এবং গবেষণার কাজ করেন। দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের এই সুশীলরা দুই দোষে দুষ্ট। প্রথমত, তারা মনে করেন তাদের আয়-উপার্জন টিকিয়ে রাখতে হলে বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে দেখাতে হবে। বাংলাদেশ ভালো, সবকিছু ঠিক আছে দেখালে আন্তর্জাতিক বুদ্ধিবাজারে তাদের কদর কমে যাবে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যার কথাই ধরা যাক। রোহিঙ্গারা যদি তাদের দেশে ফিরে যায় তাহলে মুহূর্তে ছোটবড় প্রায় হাজার দেশি-আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বন্ধ হয়ে যাবে অথবা অর্থসংকটে পড়বে। কাজেই যে কোনো মূল্যে রোহিঙ্গা সংকট জিইয়ে রাখা তাদের মহান দায়িত্ব। এজন্য ইস্যুতে তারা নানান মনগড়া তথ্য দেন। রোহিঙ্গাদের উসকে দেন। তাদের অধিকারের লম্বা ফিরিস্তি তৈরি করেন। ঠিক তেমনি দুর্নীতির বিষয়টিও। বাংলাদেশে দুর্নীতি কমছে। কিংবা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার চেষ্টা করছে, এমন বার্তা অনেকের পাজেরো গাড়ি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসকে ঝুঁকিতে ফেলবে। ফলে দুর্নীতিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলাটাই তাদের রুটিরুজির জন্য জরুরি। কেউ বলবে না বাংলাদেশে দুর্নীতি নেই। একটি শ্রেণির লাগামহীন দুর্নীতি দেশের উন্নয়ন গ্রাস করছে। অর্থ পাচার বাংলাদেশের জন্য এক মরণঘাতী ব্যাধি। আগামী প্রজন্মের জন্য, বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি অব্যাহত রাখার জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাংলাদেশ পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার চেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত- কথা কোনো বিবেকবান, সুস্থ মানুষ বিশ্বাস করবে না। বাংলাদেশ তো নয়, বিশ্বে কোনো দেশেই নাগরিক সচেতনতা ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব না। কিন্তু ছিদ্রান্বেষণ এবং দোষারোপের সংস্কৃতি দুর্নীতিবাজদের আড়াল করবে।

বাংলাদেশে যেসব সুশীল বুদ্ধিজীবী দুর্নীতি, মানবাধিকার এবং গণমাধ্যমসংক্রান্ত জরিপ গবেষণা করেন তাদের আরেকটি সমস্যা রয়েছে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে বলা যায়, এদের একটিমতলবরয়েছে। মতলবটা হলো, বিরাজনীতিকরণ। বাংলাদেশের সুশীলসমাজের একটি অংশ গণতন্ত্রবিরোধী।৭৫ থেকে আজ পর্যন্ত যতবার অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা দখল করেছে, ততবার সুশীলদের অংশটি ছিল উচ্ছিষ্টভোগী। অগণতান্ত্রিক সরকারের পদলেহন করে এরা নিজেদের আখের গুছিয়েছে। জনগণের সমর্থন ছাড়া ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের নেশা এদের। এই উচ্ছিষ্টভোগী সুশীলদের লক্ষ্য হলো যে কোনো ধরনের রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক ধারা বিপন্ন করা। সর্বশেষ এরা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। দীর্ঘদিন এরা অভুক্ত, ক্ষুধার্ত। তাই দুর্নীতি, মানবাধিকার, সুশাসন ইত্যাদি শব্দমালায় এরা গণতন্ত্রকে ক্ষতবিক্ষত করতে চায়। সেজন্যই এরা এমন সব জরিপ করে যাতে বাংলাদেশের একটি বিবর্ণ চেহারা ফুটে ওঠে। যাতে জনগণ রাজনীতির প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে। অগণতান্ত্রিক শাসনকে স্বাগত জানায়। সে কারণেই এসব প্রতিবেদনে বাড়তি রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়। প্রকৃত অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ দেখানো হয় বাংলাদেশকে।

ছাড়া আরও একটি কারণ আছে। আমাদের এই উঁচুতলার সফেদ সুশীলরা বংশগতভাবে বাংলাদেশবিরোধী। পাকিস্তানপন্থি। পৈতৃকসূত্রে পাকিস্তানপ্রীতি এদের রক্তে প্রবাহিত। প্রকাশ্যে বলতে পারে না, কিন্তু পাকিস্তানের জন্য এদের মন কাঁদে। তাই এরা এমনভাবে তথ্য-উপাত্ত তৈরি করে যেন বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে আছে এটি প্রমাণ করা যায়। কিন্তু এবার পাকিস্তানপ্রেম দেখাতে গিয়ে এদের আসল চেহারাটাই ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেখাতে গিয়ে পাকিস্তানের চেয়ে খারাপ বানিয়ে ফেলেছে। এখন তো সুশীলদের মাথা হেঁট হওয়ার কথা। তাতে কী? এভাবেই তো সুশীলরা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সব ভবিষ্যদ্বাণী, অনুমান, প্রক্ষেপণ ভুল হওয়ার পরও তারা গর্বিত ভঙ্গিতে বলতেই থাকে, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন।বাংলাদেশ যতই এগিয়ে যায়, ততই এদের হতাশার দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ হয়।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

একজন আত্মস্বীকৃত খুনি এবং মার্কিন ভিসানীতি

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৩ জুন, ২০২৩


Thumbnail

রাশেদ চৌধুরী। আত্মস্বীকৃত খুনি। বীভৎস হত্যাকারী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে কিছু ঘৃণ্য ব্যক্তি।

ইতিহাসের এ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। আর এ নিকৃষ্টতম কাণ্ডটি যারা সরাসরি ঘটিয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম রাশেদ চৌধুরী। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের পর খুনি মোশতাক হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়েছিল। মোশতাকের অবৈধ সরকার জারি করেছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ।

সেনা অসন্তোষ এবং বিশৃঙ্খলার মুখে ’৭৫ -এর ৩ নভেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হয় মোশতাক। ক্যু এবং পাল্টা ক্যু-এর ধারায় ৭ নভেম্বর ক্ষমতা দখল করেন জিয়াউর রহমান। জিয়া ছিলেন ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রের অন্যতম কুশীলব। তাই ক্ষমতা দখল করে তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বহাল রাখেন।

হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের বিশেষ বিমানে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। ক্ষমতায় থিতু হয়ে জিয়া খুনিদের কূটনৈতিক চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন। এটি ইতিহাসের আরেক ভয়াবহ অধ্যায়। জিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন এরশাদ। তিনিও জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিদের দুধে-ভাতে রাখেন।

যারা কূটনৈতিক চাকরি করত তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরশাদের পতনের পরও খুনিদের গায়ে আঁচড় লাগেনি। ’৯১-এ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশে প্রথমবারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি জয়ী হয় সেই নির্বাচনে। ’৯১-এর সংসদে আওয়ামী লীগ-বিএনপি একমত হয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থায় ফিরে যায়। কিন্তু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলে বিএনপি রাজি হয় না। ’৭৫-এর ঘাতকদের বিচারের পথ রুদ্ধই থেকে যায়। বেগম জিয়া খুনিদের আরেক দফা পদোন্নতি দেন। এ সময় খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ব্রাজিলে বদলি করা হয়। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। রাশেদ চৌধুরী এ সময় ব্রাজিল থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয় যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পাহারাদার। তাদের হাতেই যেন দায়িত্ব বিশ্ব মানবাধিকার রক্ষার। বিশ্বে কোনো দেশে গণতন্ত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে দেখে দেশটি। গণতন্ত্র মেরামত না করলে কানমলা দিয়ে দেয় অথবা কঠোর শিক্ষকের মতো ক্লাস থেকে বের করে দেয়। মানবাধিকারের একটু বিচ্যুতিও মার্কিন কর্তাদের নজর এড়ায় না। নানা স্যাংশন দিয়ে শাস্তি দেয়। মাঝেমধ্যে ভাবি, আহা। যুক্তরাষ্ট্র না থাকলে কী হতো বিশ্বের গণতন্ত্রের, কী হতো মানবাধিকারের। এরকম মানবাধিকার রক্ষকের দেশে ঢুকে পড়ল পৃথিবীর ইতিহাসের নিকৃষ্টতম খুনি। যে কি না নিজেই তার পৈশাচিকতার কথা বুক ফুলিয়ে বলে বেড়ায়। অনেকেই আহলাদে আটখানা হয়ে গেল। পালাবি কোথায়? যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কী না পরিশ্রম করে। কত না ডলার ব্যয় করে। তাদের দেশে গেছে এরকম নৃশংসতম আত্মস্বীকৃত খুনি! ব্যাটার তো আর বাঁচার পথ নেই। আমরা নিশ্চিত হলাম রাশেদ চৌধুরীর আর রক্ষা নেই। অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকলাম, কখন খবর পাব তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাশেদকে গুয়ানতানামো বে কারাগারে পাঠানো হয়েছে নাকি অন্য কোথাও। কিন্তু কী আশ্চর্য আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পেল। বহাল তবিয়তে যুক্তরাষ্ট্রের এখানে-সেখানে অবাধে ঘুরে বেড়ায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন বিল ক্লিনটন। যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আত্মস্বীকৃত খুনিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করেন। ক্লিনটন বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেন। ব্যস, ওই পর্যন্তই। আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্বে এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের কার্যক্রম শুরু হয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে না করে শেখ হাসিনা প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। চলে দীর্ঘ আইনি লড়াই। এ সময় কয়েকজন খুনিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। কিন্তু রশীদ, ডালিম, নূর চৌধুরীসহ কয়েকজন পলাতক। এদের মধ্যে মানবাধিকারের ঠিকাদার রাষ্ট্রের কোলে বসেছিল খুনি রাশেদ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া চলে দীর্ঘদিন। অন্যদিকে চলে বিদেশে পলাতক আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর কূটনৈতিক উদ্যোগ। সে সময় আবুল হাসান চৌধুরী ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনিও মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। পরবর্তীতে একটি দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘আমার মনে আছে ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেন, ‘তারা (অভিযুক্তরা) এ দেশে থাকুক তা আমি দেখতে চাই না। ’ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সিরাজুল হক ছিলেন আশাবাদী মানুষ। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘প্রচলিত আইনে বিচার হলে বিদেশে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। খুনিদের ফেরত আনা সহজ হবে। ’ কিন্তু ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত রাশেদ চৌধুরী বহাল তবিয়তেই ছিল মার্কিন মুল্লুকে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। এ সময় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ হন আইনমন্ত্রী। তিনি তার নিজের লেখা গ্রন্থেই (কারাগারে কেমন ছিলাম, পৃষ্ঠা-১৪১) স্বীকার করেছেন, তার সরকার সর্বোচ্চ আদালতে এ বিচার প্রক্রিয়াকে আটকে দিয়েছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন একদিকে এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করেন, অন্যদিকে পলাতক খুনিদের চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। এদিকে ‘মানবাধিকার’ রক্ষক যুক্তরাষ্ট্রও ২০০৪ সালে আত্মস্বীকৃত খুনিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৬ সালে দেয় নাগরিকত্ব। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে। দ্রুত বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয় সরকার। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দণ্ড কার্যকর না হওয়ার দুঃখ নিয়েই ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর পরপারে চলে যান সিরাজুল হক। পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব নেন আনিসুল হক। আপিল বিভাগের রায়ের পর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার যুক্তি আরও দৃঢ় হয়। এ সময় রাশেদ চৌধুরীসহ খুনিদের ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে। যারা গ্রেফতার ছিল তাদের দণ্ড কার্যকর করা হয়। আমি আশা করেছিলাম দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র অন্তত দ্রুত রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেবে। কিন্তু বহুবার রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লিখিত আবেদন করেছে বাংলাদেশ। হায় মানবাধিকার! এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নির্বিকার। যুক্তরাষ্ট্র কোনো অভিবাসীকে নাগরিকত্ব দেয় ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট’ অনুযায়ী। গত ২৪ মে থেকে বাংলাদেশে এ আইনটি নিয়ে বেশ মাতামাতি চলছে। এ আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। কীভাবে একজন অভিবাসী মার্কিন নাগরিক হতে পারেন তার বিস্তারিত শর্ত আছে এ আইনে। একটি নির্দিষ্ট সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেই চলবে না, তাকে অন্তত ২০টি শর্ত পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো- কোনো ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তি (তা যে দেশেরই হোক না কেন), মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, হত্যাকারী, নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। শুধু তাই নয়, কোনো অভিবাসী যদি এ ধরনের কোনো তথ্য গোপন করে নাগরিকত্ব পান তবুও ভবিষ্যতে যদি প্রমাণ হয় যে তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা তথ্য গোপন করে নাগরিকত্ব পেয়েছেন তাহলে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাকে বহিষ্কার করা হবে। সাফ কথা। আইনে এরকম নির্দেশনার মধ্যে কোনো তবে, যদি, কিন্তু নেই। মানবাধিকারে চ্যাম্পিয়ন দেশে তো এমনই আইন হওয়া চাই। কিন্তু রাশেদ চৌধুরীর বেলায় এ আইন কি প্রযোজ্য হয়েছে? না হয়নি। ২০১৮ এবং ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুবার চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ট্রাম্প বিষয়টি অ্যাটর্নি অফিসকে দেখতে বলেন। কিন্তু জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সবকিছু থমকে গেছে। এখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলে বিষয়টি তাদের না, অ্যাটর্নি অফিসের। আইনমন্ত্রী নিজে মার্কিন অ্যাটর্নি অফিসে যোগাযোগ করেছেন। সময় চেয়েছেন। কিন্তু গত দেড় বছরে মার্কিন অ্যাটর্নি অফিস এ নিয়ে টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করেনি। ব্যস, এভাবেই চলছে। বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রই যখন একজন আত্মস্বীকৃত, সর্বোচ্চ আদালতে দণ্ডিতকে ফেরত দেয় না, তখন কানাডাও খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠায় না। কানাডার যুক্তি হলো- সে দেশে যেহেতু মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ তাই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে তারা ফেরত দেবে না। রশীদ, ডালিমসহ অন্য পলাতক খুনিদেরও বিভিন্ন দেশ রাখছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র খুনিকে আশ্রয় দিয়েছে। পাঠক একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্টকে খুন করে কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশে আশ্রয় নিল, তাকে কতক্ষণ বাংলাদেশ রাখতে পারত? তাকে বাংলাদেশ নাগরিকত্ব দিলে কী কেলেঙ্কারি হতো? কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সব পারে। তারা যা করবে সেটিই সঠিক। তারা যা বলবে এ বিশ্বে সেটিই আইন।

এখন যখন মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের উচ্ছ্বাসের বন্যা, তখন খুনি রাশেদ চৌধুরীর ঘটনাটি আমার মনে পড়ল। এ কারণেই দীর্ঘ ইতিহাস এক ঝলক স্মরণ করলাম। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের ঘোষণার পর প্রধান দুই দলের নেতারা এটি তাদের ‘বিজয়’ বলে চিৎকার, চেঁচামেচি করছেন। আওয়ামী লীগের নেতা ওবায়দুল কাদের আবিষ্কার করেছেন ‘ফখরুলের ঘুম হারাম হয়েছে। ’ মির্জা ফখরুলও কম যান না। তিনি গবেষণা করে পেয়েছেন ‘আওয়ামী লীগের সুর নরম হয়ে গেছে। ’ নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির নেতারা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় গিয়ে ধন্য হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র যা চেয়েছিল তা ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে অর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর একনিষ্ঠ আনুগত্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর প্রভুত্ব। এক ভিসানীতি নিয়ে রাজনীতিতে যে মাতম শুরু হয়েছে তাতে মনে হতেই পারে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ বোধহয় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে আছে। মার্কিন ভিসা না পেলে বাংলাদেশে যেন লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাবে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও অভয় দিচ্ছেন। গত মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘যারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে তাদের জন্য ভিসানীতি উদ্বেগের নয়। ’ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে খুব জানতে ইচ্ছা করে যে, রিকশাচালক দিনমান রোদে পুড়ে রিকশা চালান, তিনি তো সুষ্ঠু ভোট চান। ওই রিকশাচালক কি মার্কিন ভিসা পাবেন? কিংবা গ্রামের তরুণ মেধাবী অনেক কষ্টে লেখাপড়া করছে অথবা গ্রামের খেতমজুর কিংবা ড. ইউনূসের ঋণে নিঃস্ব হওয়া বিধবা নারী? তারা তো সুষ্ঠু ভোটের পক্ষে। তারা কি মার্কিন ভিসা পাবে? এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যারা ভিসা আবেদন করেন তাদের অনেকেই প্রত্যাখ্যাত হন। যাদের যুক্তরাষ্ট্র নানা কারণে ভিসা দেয় না তাদের নামের তালিকা কি ফলাও করে প্রকাশ করে? কিন্তু এক্ষেত্রে করা হবে। তাদের প্রকাশ্যে অপমানিত করা এ ভিসানীতির একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে কোন দেশে বছরে কতজনকে ভিসা (নন-ইমিগ্র্যান্ট) দেওয়া হয় তার সংখ্যা পাওয়া যায়। ওই তালিকায় দেখা যায়- ২০১৩ সালে ২৮ হাজার ৮০ জন বাংলাদেশের নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দিয়েছিল। ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার ২৫ জনকে ভিসা দেওয়া হয়। গত বছর বাংলাদেশ থেকে মার্কিন ভিসা পেয়েছেন ২৯ হাজার ২০২ জন। গত ১০ বছরে আনুমানিক প্রায় ২ লাখ বাংলাদেশি মার্কিন ভিসা পেয়েছেন। প্রায় সমান সংখ্যক আবেদনকারী প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। অর্থাৎ ভিসা নীতিমালা সাধারণ নাগরিকদের কোনো মাথাব্যথার বিষয় নয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা গুরুত্বপূর্ণ, হোমরাচোমরা তাদের জন্য এ ভিসানীতি অস্থিরতা তৈরি করেছে। প্রশাসনের যে বড় কর্তা যুক্তরাষ্ট্রে সন্তানদের পড়ান, সেখানে স্ত্রী থাকেন। কর্তা ঢাকায় এক ব্যাচেলর জীবনযাপন করেন। সব টাকা সেখানে পাঠিয়ে ‘সততা’র চাদরে নিজেদের ঢেকে রাখেন। এ ভিসানীতি তাদের উতালা করেছে। যেসব রাজনীতিবিদ কানাডায় সেকেন্ড হোম বানিয়ে, বেগমপাড়ায় রাজবাড়ী বানিয়েছেন। সন্তান-স্ত্রীকে সেখানে রেখেছেন। দেশের কিছু একটা হলেই উড়াল দেবেন। মার্কিন ভিসানীতি তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। যে ব্যবসায়ী হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এখন আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ হয়েছেন। ব্যাংক ফোকলা বানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় টাকা পাচার করে নব্য মুজিব সৈনিক হয়েছেন; মার্কিন ভিসানীতি তার জন্য দম বন্ধ করার মতো খবর। যুক্তরাষ্ট্র জেনে-বুঝেই এ ভিসানীতি করেছে। গণতন্ত্র, ভোট, মানবাধিকার দেশের আপামর জনগণ নষ্ট করে না। এসব ধ্বংস করে মুষ্টিমেয় কিছু মতলববাজ, লুটেরা, সুবিধাবাদী। এরা সব দলে আছে। সব সরকারের সময়েই প্রশাসনে এরা খবরদারি করে। এরাই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। মার্কিন ভিসানীতি এদের লক্ষ্য করেই করা হয়েছে। এ কারণে এ ভিসানীতি ধন্যবাদ পেতেই পারে। এরা যদি গণতন্ত্র, নির্বাচন নিয়ে জল ঘোলা না করে তাহলে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের এ দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় মার্কিন নীতি এবং আইন অনেকটা জলের মতো। মার্কিন প্রশাসন একে যখন যে পাত্রে রাখে সেই আকার ধারণ করে। যেমন ভিসানীতি যে আইনের দ্বারা ঘোষণা করা হয়েছে সেই আইন অনুযায়ী খুনি রাশেদ চৌধুরীর নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা নয়। অথচ ঘৃণ্য ঘাতক বহাল তবিয়তেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছে। ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিপোর্ট করার কথা। তিনি তো বেশ আছেন। একজন সামরিক কর্মকর্তা, তিনি র‌্যাবে থাকার সময় ‘ক্রসফায়ারের’ জন্য আলোচিত ছিলেন। এক-এগারোর সময় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন কোন নীতিমালায়? নিঃশর্ত মার্কিন অনুগতদের জন্য এ বিশ্বে সাতখুন মাফ। অনুগত হয়ে হামিদ কারজাইয়ের সীমাহীন দুর্নীতি কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু মার্কিন বশ্যতা স্বীকার না করায় চিলির আলেন্দেকে প্রাণ দিতে হয়। তাই প্রশ্ন, এ আইন ও নীতি কি বাংলাদেশে সমভাবে সবার জন্য প্রয়োগ হবে? মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশে যারা সুশীল সেজে বসে আছেন, যারা এক-এগারোর মতো আবার একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে চান, বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে দীর্ঘস্থায়ী একটি অগণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করতে চান- এরা গণতন্ত্রের শত্রু, সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান বাধা। তারা কি এ নীতির আওতায় আসবেন? সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে কারা তা কে নির্ধারণ করবে? এ দেশে অনুগত মার্কিন ভৃত্যগণ? এসব প্রশ্নের কারণ হলো- অতীত অভিজ্ঞতা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থে পক্ষপাতপূর্ণভাবে আইন ও নীতিমালা প্রয়োগ করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদেরই অবমুক্ত করা দলিলে। এসব দলিল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পিএল ৪৮০ এর ১০৩ (ঘ) (৩) ধারা প্রয়োগ করে বাংলাদেশে ৭৪-এ গম পাঠায়নি যুক্তরাষ্ট্র। কিউবায় চটের বস্তা রপ্তানি করা হয়েছে অভিযোগে সে সময় পিএল ৪৮০ এর ওই ধারা প্রয়োগ করা হয়েছিল। অবমুক্ত দলিলে পাওয়া যায় হেনরি কিসিঞ্জার এবং তৎকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট টম অ্যাডামের কথোপকথন। যাতে বাংলাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়া উভয়েই কিউবায় পণ্য রপ্তানি করলেও কিসিঞ্জার ইন্দোনেশিয়াকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে ৭৩ হাজার টন গম পাঠানো বন্ধ করেন।

মার্কিন অবমুক্ত দলিলে পাওয়া যায় ’৭৫-এর খুনিরা ১৯৭৩ থেকেই মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করেছিল। ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই মেজর রশীদ মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে জিয়াউর রহমানের পক্ষ থেকে সমরাস্ত্র কেনার ব্যাপারে কথা বলে। মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন কর্মকর্তা নিউবেরির নিশ্চয়ই জানার কথা, একজন মধ্যস্তরের সেনা কর্মকর্তা এভাবে অস্ত্র কেনার প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারে না। ১৯৭৪ সালে খুনি ফারুক বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনার কথা মার্কিন দূতাবাসকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ওয়াশিংটনে ২১৫৮ নম্বর তারবার্তার মাধ্যমে এ তথ্য জানান। মার্কিন দলিলেই প্রকাশ করা হয়েছে ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির আগে খুনি ফারুক একাধিকবার মার্কিন দূতাবাসে গেছে। অথচ মার্কিন ঘোষিত নীতি হলো- তারা কোনো রাষ্ট্রে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখল এবং সামরিক অভ্যুত্থান সমর্থন করে না। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে উৎখাত, তাঁকে সপরিবারে হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের নীরব সম্মতি ছিল। শুধু বাংলাদেশ কেন, বহু রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে তাদের পছন্দের পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার ইস্যুতে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার প্রতিবাদ করেনি। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল চায়নি। খুনিদের নাগরিকত্ব দিয়েছে। একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- একটি দেশ নিয়ে যখন যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত আগ্রহী হয়, যখন একটি দেশ নিয়ে নীতিমালা করে, সে দেশে তখনই বড় বিপর্যয় হয়। ক্ষমতা বদল হয়। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা হয়। অবশ্য যেসব দেশে দৃঢ়ভাবে তাদের আত্মমর্যাদা নিয়ে দাঁড়ায়, যে দেশের নেতারা জনগণকে এ ব্যাপারে সজাগ এবং ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন, তারা মার্কিন ইচ্ছার বিপরীতে অবস্থান নিতে পারেন। যেমন ছিল মাহাথিরের মালয়েশিয়া, এখন যেমন তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের নির্বাচনে এরদোগানকে হারাতে সব চেষ্টাই করেছিল। কিন্তু রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের দৃঢ় নেতৃত্ব এবং জনপ্রিয়তা তা প্রতিরোধ করেছে। মার্কিন অভিপ্রায়ের কথা আরেক দৃঢ়চেতা নেতা শেখ হাসিনা ভালো করেই জানেন। এ জন্যই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু ভিসানীতির পর আওয়ামী লীগের কিছু নেতার আত্মতুষ্টি আনন্দ আমাকে বিচলিত করেছে। আওয়ামী লীগের অতি মার্কিন ভক্তরা কি তা ’৭৫-এ বাংলাদেশ দেখেছে। শঙ্কা হয় বাংলাদেশ কি তাহলে আরেকটি আগস্ট ট্র্যাজেডির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

গাজীপুরে আওয়ামী লীগের স্বস্তি-অস্বস্তি

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৯ মে, ২০২৩


Thumbnail

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেছে। কিন্তু এ নির্বাচনে হেরেও জিতেছে ক্ষমতাসীন দলটি। এ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আওয়ামী লীগ একদিকে যেমন উৎসব করতে পারে, ঠিক তেমনি এ নির্বাচন আগামী নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে সতর্কবার্তা দিল। গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে দলটি। এ আন্দোলনের কৌশল হিসেবে সব নির্বাচন থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখছে বিএনপি। আগে বিএনপির জনপ্রিয় নেতারা স্থানীয় প্রভাব ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখার স্বার্থে স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হতেন। কিন্তু এবারের নির্বাচনে সে ব্যাপারেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে বিএনপি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদেরও আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল খুবই সোজাসাপ্টা। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, বিএনপি ভোট বর্জন করলেই নির্বাচন নিরুত্তাপ হবে। জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাবে না। ফলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কয়েকটি নির্বাচনে বিএনপির কৌশল কাজে লেগেছে। চট্টগ্রামের একটি উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ১৪ শতাংশের মতো। বিএনপি ছাড়া বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়—এটি প্রমাণের জন্যই বিএনপি ভোট থেকে দূরে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বলছে, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক। যুক্তরাষ্ট্র ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। যদিও তারা বিএনপির ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের দাবিকে সমর্থন জানায়নি। কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের শর্তপূরণের জন্য প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ জরুরি। বিএনপি কূটনীতিকদের বোঝাতে চাইছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় উত্তাপহীন, জনগণ সেই নির্বাচনে অংশ নেয় না, প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দল মিলে নির্বাচনের নামে প্রহসন করে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এরকম উত্তেজনাহীন নির্বাচন যত হবে, তত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জোরালো হবে। কিন্তু গাজীপুরে বিএনপির কৌশল ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি ছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, উৎসবমুখর, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যে করা যায়, গাজীপুর তার প্রমাণ। এটি আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জন্য স্বস্তির। এর ফলে বিএনপি ছাড়াই আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে এগোতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি গত এক বছর ধরেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন। তিনি বারবার বলছেন, নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। যুক্তরাজ্যের মতো নির্বাচন হবে বাংলাদেশে—এমন বক্তব্য তিনি একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন। শেখ হাসিনা এটিও বলেছেন, জনগণ ভোট দিলে সরকার গঠন করব। আর ভোট না দিলে ক্ষমতা ছেড়ে দেব। এটি যে কথার কথা নয়, গাজীপুর সিটি নির্বাচন তার প্রমাণ। এ নির্বাচনে পর্দার আড়ালে অনেক নাটক হয়েছে। অতি উৎসাহীরা নানাভাবে প্রশাসন দিয়ে নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ জোর করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জিতিয়ে দেওয়ার ফর্মুলা নিয়েও দৌড়াদৌড়ি করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা অর্বাচীনদের এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। এমনকি কোনো কোনো নেতাকে আওয়ামী লীগ সভাপতি সতর্ক করে দিয়েছেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কারচুপির চেষ্টা করলে তিনি কাউকে ছাড়বেন না। ফলে গাজীপুর নির্বাচনে কোনো কেলেঙ্কারি হয়নি। শেখ হাসিনা নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ দেননি। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ধারায় যদি বাকি চারটি নির্বাচন হয়, তাহলে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবি মুখ থুবড়ে পড়বে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব বলা যৌক্তিক হবে। গাজীপুর নির্বাচন প্রমাণ করেছে, একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচনের একমাত্র ফ্যাক্টর বিএনপির অংশগ্রহণ নয়। বিএনপি ছাড়াও যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব, গাজীপুর তার বিজ্ঞাপন। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য বিশাল স্বস্তির। এ নির্বাচনের আগের দিনই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় সৃষ্টিকারীদের যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না বলে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়। এরকম সতর্কবার্তার পর প্রথম পরীক্ষায় আওয়ামী লীগ সরকার খুব ভালোমতোই পাস করেছে। নির্বাচন নিয়ে চাপ বিএনপির কাঁধে তুলে দিতে গাজীপুর নির্বাচনে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাই প্রার্থীর জয়-পরাজয়ের চেয়ে এ নির্বাচন সরকারের জন্য একটি বড় বিজয়। গাজীপুর হেরেও জিতেছে আওয়ামী লীগ।

গাজীপুরের নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা বাড়াবে। কিন্তু নানা কারণে এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য অস্বস্তির। এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য সতর্কবার্তা। গাজীপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহ এবং বিভক্তির ভয়ংকর রূপ প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী লীগই যে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ, তা প্রমাণ হয়েছে গাজীপুরে। গাজীপুরে আওয়ামী লীগ এবার মনোনয়ন দেয় দলের প্রবীণ নেতা আজমত উল্লাকে। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। জাহাঙ্গীর গাজীপুরে জনপ্রিয়। আওয়ামী লীগের তরুণরা তাকে পছন্দ করে। সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ জনগণের মধ্যে জাহাঙ্গীরের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। মনোনয়নের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মনোনয়ন বোর্ডের সভায় এ বাস্তবতাগুলো উঠে আসেনি। জনমতের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ সভাপতিকে ভুল তথ্য দিয়েছেন। জাহাঙ্গীর আলমকে ‘কোণঠাসা’ করতে গিয়ে প্রভাবশালী নেতারা আওয়ামী লীগকে ঝুঁকিতে ফেলেছেন। আজমত উল্লাকে মনোনয়ন আরও সুন্দর এবং শালীনভাবে দেওয়া যেত। যেমনটি করা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের ক্ষেত্রে। সেখানে আওয়ামী লীগের দুই প্রতিপক্ষ নেতাকে গণভবনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দুজনের সঙ্গে কথা বলে একটি সমঝোতা করে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছিল। গাজীপুরে তেমনটি করা হলো না কেন? ২০১৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে অহংকার এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ মনে করেন, দল যাকে ইচ্ছা মনোনয়ন দেবে। প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে প্রভাব খাটিয়ে জিতিয়ে আনবে। গাজীপুরেও সেই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। রাজনীতি হুমকি, ধমকের বিষয় নয়। একটি সমঝোতার কৌশল। এ চিরন্তন সত্যটা আওয়ামী লীগ ভুলেই গিয়েছিল। জাহাঙ্গীর এবং তার মা যখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন, তখন আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ‘দমন নীতি’ কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। ভয় দেখিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে রাজনীতিতে জয়ী হওয়া যায় না। জাহাঙ্গীরের (এবং তার মা) বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ভুল কৌশল প্রয়োগ করেছেন। ভোটের আগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা, দুদকে তলব, তার কর্মীদের ওপর পেশিশক্তি প্রয়োগ—সবই জনগণের মধ্যে জায়েদা খাতুনের পক্ষে এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মীরা এটা পছন্দ করেননি। ভোটের দিন দেখা গেছে, নৌকার কার্ড গলায় ঝুলিয়ে তারা ঘড়ি মার্কায় ভোট দিয়েছেন। আওয়ামী লীগে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে সব নেতাই প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। জনগণকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেননি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং তার পরামর্শকরা গাজীপুরে আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তার ফলও ভালো হয়নি। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা কারও ক্রীতদাস নয়। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর তার মাকে নিয়ে সাধারণ ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গেছেন। কান্নাকাটি করেছেন। ভোটারদের সহানুভূতি আদায় করেছেন। যেটি আওয়ামী লীগের আদি নির্বাচন কৌশল। ভোটে জয়ী হওয়ার জন্য আজমত উল্লা ভোটার নয়, নানা শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। জাহাঙ্গীরের সমর্থদের গ্রেপ্তার, কাউকে কাউকে হুমকি দিতেও শোনা গেছে। জাহাঙ্গীরের সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হবে না। এমন পরিকল্পনার নিপুণ বাস্তবায়নে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন ঢাকা থেকে আসা কিছু নেতা। তারা বিশ্বাসও করেননি, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন এরকম অভাবনীয় নিরপেক্ষ হবে। ভোটের স্বাভাবিক সহজ কৌশলকে আওয়ামী লীগ পাত্তা দেয়নি। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর বুঝিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচনের অঙ্ক তিনি ভালোই বোঝেন। জাহাঙ্গীর তার মায়ের পক্ষে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটকে একাট্টা করেছেন। নীরব সমর্থদের সংগঠিত করেছেন। নিরপেক্ষ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে পেরেছেন। গাজীপুরের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত প্রশাসন নিরপেক্ষ ছিল। নির্বাচন কমিশন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সবকিছু উজাড় করে কাজ করেছে। ফলে গাজীপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপর্যয় হয়েছে।

জাতীয় নির্বাচনের আগে গাজীপুর থেকে আওয়ামী লীগ কি শিক্ষা নেবে? ২৫ মের নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো প্রার্থী বাছাই। প্রার্থী যদি যথাযথ না হয়, জনপ্রিয় না হয়, তাহলে ভরাডুবি অনিবার্য। জাতীয় নির্বাচনের বাকি ছয় মাস। এখনো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাতে সময় আছে। এখন যারা জনবিচ্ছিন্ন সংসদ সদস্য, দলের বাইরে সাধারণ জনগণের সঙ্গে যারা সম্পর্কহীন, তাদের বাদ দেওয়ার এখনই সময়। গাজীপুর শেখাল, জনবিচ্ছিন্ন, বিতর্কিত প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে না। এ নির্বাচনের দ্বিতীয় শিক্ষা হলো—তৃণমূলের শক্তিতে বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলটিকে প্রশাসননির্ভরতা কমাতে হবে। আগামী ভোটে প্রশাসন আর পুলিশ দিয়ে পার করা যাবে না। জনগণের মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছে যেতে হবে। ভোটাররাই রাজনৈতিক দলের আসল শক্তি। নতুন মার্কিন নীতিমালার পর অতি আওয়ামী লীগার হয়ে ওঠা প্রশাসনের লোকজন যে আওয়ামী লীগের পক্ষে কোনো ঝুঁকি নেবেন না, তার অনুধাবন করতে হবে দলের প্রার্থীদের। এ উপলব্ধি যত দ্রুত হয়, ততই তাদের জন্য মঙ্গল।

২০০৮-এর নির্বাচনের পর বিপুলসংখ্যক তরুণ ভোটার হয়েছেন। এমন প্রার্থী দিতে হবে যাতে তরুণরা আকৃষ্ট হন। ভোট একটি রাজনৈতিক বিজ্ঞান। এখানে গণিত গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের হিসাব ঠিকঠাক মতো করেই প্রার্থী চূড়ান্ত করতে হবে আওয়ামী লীগকে।

আগামী নির্বাচন হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর শেষ নির্বাচন। একটি অসাধারণ, অনবদ্য এবং অনন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে তিনি কোনো আপস করবেন না। একবিন্দুও ছাড় দেবেন না। গাজীপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতি সেটি ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা চাটুকার, সুবিধাভোগী, মতলববাজরা কি সেই বার্তাটা পেয়েছেন? না পেয়ে থাকলে সামনে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটির জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

সরকারের ঘরেই সর্বনাশের বসবাস

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৭ মে, ২০২৩


Thumbnail

‘তথ্য প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা কারও চরিত্র হননের লাইসেন্স দেয় না। ব্যক্তি আক্রমণ, মিথ্যা অপপ্রচার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়।’ গত সোমবার (২২ মে) দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি সচিন দত্ত এ মন্তব্য করেন। ‘ইন্ডিয়া : দ্য মোদি কোশ্চেন’ শিরোনামে বিতর্কিত প্রামাণ্যচিত্র ইস্যুতে এক মামলায় বিচারপতি দত্তের এ উক্তি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এক আদেশে বিবিসিকে হাই কোর্টে তলব করেছেন।  ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে বিবিসি ওই প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করে গত ১৭ জানুয়ারি। প্রামাণ্যচিত্রটি ছিল গুজরাট সহিংসতা নিয়ে। প্রামাণ্যচিত্রে সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করা হয়। তথ্যচিত্রটি ছিল অনেকটাই একপেশে এবং পক্ষপাতদুষ্ট। ভারত সরকার বিবিসিকে কোনো প্রতিবাদ পাঠায়নি। কঠোর ভাষায় ওই বিতর্কিত প্রামাণ্যটি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। ফেসবুক, ইউটিউবসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ‘আপত্তিকর’ ভিডিওটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নামিয়ে ফেলার নোটিস দেওয়া হয়। ফেসবুক, ইউটিউব বাধ্য ছেলের মতো বিতর্কিত এ প্রামাণ্যচিত্রটি সরিয়ে ফেলে। এটুকু করেই ভারত সরকার সন্তুষ্টির ঢেকুর তোলেনি। আয়কর বিভাগ এক মাসের মধ্যে (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিবিসির দিল্লি এবং মুম্বাইয়ের ভারতীয় কার্যালয়ে অভিযান চালায়। সর্বশেষ ২২ মে দিল্লি হাই কোর্ট এ ধরনের ‘ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক’ প্রামাণ্যচিত্র প্রচারের অভিযোগে বিবিসির সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সমন জারি করলেন। এ মামলা তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানোর লাগাম টেনে ধরার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক।

ঠিক দুই বছর আগে প্রায় একই রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশকে ঘিরেও। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ব্যাপারে একটি মনগড়া, প্রতিহিংসামূলক এবং অসত্য প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করে আলজাজিরা। ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার মেন’ শিরোনামে ওই প্রামাণ্যচিত্রটিতে জোর করে অসংলগ্নভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জড়ানো হয়। প্রামাণ্যচিত্রটি প্রকাশের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভুলেভরা এক প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছিল আলজাজিরায়। কাতারভিত্তিক এ টেলিভিশন চ্যানেলটি ওই প্রতিবাদলিপিকে পাত্তা দেয়নি। এটি প্রকাশের পর বিভিন্ন মহল প্রামাণ্যচিত্রটিকে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এখন অবধি। ফেসবুক, ইউটিউবে এর নানা খন্ডিত অংশ এবং পুরোটা প্রচার হচ্ছে। বিটিআরসি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে এ বিদ্বেষমূলক, হিংসাত্মক প্রামাণ্যচিত্রটি নামিয়ে ফেলার কোনো উদ্যোগ পর্যন্ত নেয়নি। ভারত দেশের স্বার্থরক্ষায় ‘প্রধানমন্ত্রী’ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষায় সম্ভাব্য সবকিছু করেছে। আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্তরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে। ভারত পেরেছে, বাংলাদেশ পারেনি কেন? সরকারের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা মিচকে ষড়যন্ত্রকারীরা মিনমিন করে বলে ‘ভারত অনেক বড় দেশ। অনেক জনসংখ্যা, তাদের সঙ্গে কি আমরা পারি।’ তাদের এ কথা শুনে মনে হয় তারা বোধহয় দূর গ্রহে বাস করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেদের দেশের আত্মমর্যাদার ব্যাপারে কতটা সচেতন তা তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যেই দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ক্ষমতার ‘ওলটপালট’ করতে পারে জেনেও প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করছেন। এ সমালোচনা একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, বরং দেশের স্বার্থে, মর্যাদার জন্য। সরকারে বিভিন্ন পদে যেসব ব্যক্তি বসে আছেন তারা কি এ থেকে এতটুকু সাহসী, দৃঢ় হতে পারেন না? তারা পারছেন না এ কারণে যে, তারা ষড়যন্ত্রকারী।

ভারত যখন মতপ্রকাশের নামে স্বেচ্ছাচারিতার লাগাম টেনে ধরেছে। বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রভাবশালী মিডিয়াকে তলব করেছে, তখন বাংলাদেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী হাঁটু গেড়ে ফেসবুককে কুর্নিশ করছে। গত ১১ মে ফেসবুকের চাকর-বাকরদের সঙ্গে বৈঠক করেন একদা জাসদের বিভ্রান্ত বৈজ্ঞানিক বিপ্লবী ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। ফেসবুকের লোকজনকে তিনি জামাই আদর করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আপত্তিকর, ঘৃণাসূচক, চরিত্র হননের কনটেন্টগুলো বন্ধের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি। প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, ফেসবুক বাংলাদেশে অফিস করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ফেসবুক এটাও বলেছে, কনটেন্ট মনিটরিং সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ফেসবুকের এসব আপত্তিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী খুশিতে বাকবাকুম। তিনি বলেছেন, ‘ফেসবুক বর্তমানে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত অনুরোধ রাখছে।’

বাংলাদেশ এখন যে গুজবের ফ্যাক্টরিতে পরিণত হয়েছে তা মূলত ফেসবুক এবং ইউটিউবের কারণে। শুধু গুজব নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন রাষ্ট্র এবং সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর প্রধান বাহনে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র এবং সরকার প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। বাংলাদেশ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে বিকৃতি এবং কুৎসার বীভৎস উৎসব। লন্ডনে পলাতক বিএনপি নেতা তারেক জিয়ার অর্থে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স থেকে কিছু সাইবার সন্ত্রাসীর ভয়ংকর তথ্যসন্ত্রাস এবং কদর্য আক্রমণের শিকার আজ বাংলাদেশ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এগুলো বোধহয় সরকারবিরোধী অপপ্রচার। কিন্তু যেভাবে একযোগে এসব নোংরা আবর্জনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে গোটা বাংলাদেশই দূষিত এবং দুর্গন্ধময় হয়ে উঠছে। অথচ অবিরত এসব অশ্রাব্য প্রচারণা বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্যোগ নেই। নেই কোনো মাথাব্যথা। তাহলে কি সাইবার-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টদের গোপন যোগাযোগ রয়েছে? এ প্রশ্ন উঠছে এ কারণে যে, সাইবার-সন্ত্রাসীদের আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য যারা কাজ করছেন তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো আওয়াজ নেই বিদেশে বসে মিথ্যাচার প্রচারকারীদের। কদিন আগে দেখলাম এক প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রিপোর্ট আসছে বলে ঘোষণা দেওয়া হলো। কিন্তু তারপর আর রিপোর্ট নেই। সংশ্লিষ্ট বমি উগলানোর ইউটিউব চ্যানেল কার্ডটি পর্যন্ত নামিয়ে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ আমলে একাধিক ব্যাংকের মালিক বনে যাওয়া এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রিপোর্ট আসছে বলে ঘোষণা চলল কয়েক দিন। কিন্তু রিপোর্ট আর আসে না। সরকারের সঙ্গে হঠাৎ করে ঘনিষ্ঠ হওয়া কিছু ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা লক্ষ্য করলাম। কেন? একটু খোঁজখবর নিলেই দেখা যায় এর পেছনে রয়েছে ভয়ংকর সর্বনাশা ষড়যন্ত্র। ১৪ বছর আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্বে। এ সময় অনেক ব্যবসায়ী ফুলেফেঁপে উঠেছেন। নাম-পরিচয়হীন ব্যক্তিরাও হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মুদির দোকানদার ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা লোপাট করেছেন। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে যাদের টিকিটি পর্যন্ত পাওয়া যায়নি তারাই এখন ক্ষমতার চারপাশে ফেভিকলের মতো সেঁটে আছেন। এসব অনুপ্রবেশকারী, হঠাৎ বনে যাওয়া আওয়ামী লীগার একদিকে যেমন সীমাহীন দুর্নীতি করছেন, বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচার করছেন, তেমনি ভবিষ্যতে তাদের লুণ্ঠিত সম্পদকে নিরাপদ করতে লন্ডনে যোগাযোগ করছেন। সাইবার-সন্ত্রাসীরা তাদের ব্ল্যাকমেল করছে। এদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হবে ঘোষণা দেওয়ার পরপরই এরা বিদেশে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। লুণ্ঠিত সম্পদের ছিটেফোঁটা দিয়ে ওইসব সংবাদ বন্ধ করছেন। শুধু যে অর্থ দিচ্ছেন তা-ই নয়, সরকারের অনেক স্পর্শকাতর গোপন তথ্যও তারা তুলে দিচ্ছেন সাইবার-সন্ত্রাসীদের হাতে। অন্যদিকে যেসব ব্যবসায়ী তিল তিল করে ত্যাগে, শ্রমে মেধায় দেশের উন্নয়নের অংশীদার হয়েছেন তারা সাইবার-সন্ত্রাসীদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন না। এসব কুৎসিত মিথ্যাচারের কাছে নতিস্বীকার করছেন না দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা। তাই তাদেরও এখন টার্গেট করা হয়েছে। এখন অবিরাম কুৎসিত প্রচারণা চলছে। বিটিআরসি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাজ যেন শুধু তামাশা দেখা। গণকণ্ঠে যারা বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন সেই বিপ্লবীরাই এখন বর্তমান সরকারের মন্ত্রী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দেখভালের দায়িত্ব তাদেরই। তখন তারা নিজেরাই বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার করতেন গণকণ্ঠে। আর এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেখ হাসিনা ও তাঁর বিশ্বস্তদের বিরুদ্ধে কুৎসিত অপপ্রচারের পথ করে দেন। এরা ষড়যন্ত্রকারী। প্রধানমন্ত্রীর জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য সফর ছিল কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক অর্বাচীন প্রতিমন্ত্রী বিমানে আরও কজন মন্ত্রী এবং সফরসঙ্গীকে নিয়ে এক সেলফি তুললেন। মনে হচ্ছে পিকনিকে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনিই ছবিটা ছেড়ে দিলেন। তিনি কি ইচ্ছা করেই সাইবার-সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন? তার এ ছবি তোলা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া যেমন আপত্তিকর, অনুচিত, তার চেয়েও গর্হিত হলো সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ার পর এটি নিজের আইডি থেকে অপসারণ করা। শুধু এ প্রতিমন্ত্রী কেন? প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে এমন অনেকে যাচ্ছেন তারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এরা সাইবার-সন্ত্রাসীদের তথ্যের অন্যতম উৎস। এদের পাঠানো ছবি, তথ্যকে রংচং দিয়ে বিদেশ থেকে ফেসবুক আর ইউটিউবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সত্যিকারের বিশ্বস্তদের বিরুদ্ধে যে মাত্রায় নোংরামি চলছে তা যে কোনো দেশের মানদন্ডে  ঘৃণিত, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দেশে বসে কেউ যদি এর একাংশও করে তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তা অপরাধ। কিন্তু বিদেশে বসে করলে? বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত একাধিকবার এ ধরনের কনটেন্ট বন্ধ করতে বলেছেন। কিন্তু বিটিআরসি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলেছে, ফেসবুক এবং ইউটিউবের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। আমার মাঝে মাঝে ভ্রম হয়, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং কর্মকর্তারা আসলে কার প্রতিনিধিত্ব করছেন? সরকারের না সাইবার-সন্ত্রাসীদের? বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তারেক জিয়া একজন দন্ডিত ফেরারি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির এ পলাতক নেতা দন্ডিত। হাই কোর্ট এক আদেশে ওই ফেরারি ব্যক্তির কোনো বক্তব্য বাংলাদেশে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিদিন এ পলাতক ব্যক্তি লাইভে এসে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছেন। কর্মিসভা করছেন, মিটিং করছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কুৎসিত মিথ্যাচার করছেন। এসব প্রচারণা বন্ধে যারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন না তারা তো আদালত অবমাননা করছেন। পচা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী মন্ত্রীর বদৌলতে, বিটিআরসির পৃষ্ঠপোষকতায় এবং আশীর্বাদে বিএনপি-জামায়াত এখন সোশ্যাল মিডিয়া দখল করে নিয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোও সাইবার-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে। আজ পর্যন্ত শুনিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স কিংবা কানাডায় বাংলাদেশের দূতাবাস এদের অপতৎপরতা সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে সে দেশের সরকারকে অনুরোধ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা তো দূরের কথা, নোংরামির প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি দূতাবাসগুলো। কদিন আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরকম ২২ জনের নামের তালিকা পাঠিয়েছে বিভিন্ন দূতাবাসে। তালিকা পাওয়ার পর কোনো দূতাবাসের তৎপরতা নেই। সরকারের ঘরেই এভাবে সর্বনাশ বসবাস করছে। বাংলাদেশে ফেসবুকের গ্রাহক ৫ কোটির বেশি। ফেসবুক, ইউটিউবের জন্য বাংলাদেশ এক বিরাট বাজার। তাদের আইনের আওতায় আনা অত্যন্ত সহজ। বাংলাদেশে এখন যা হচ্ছে ঠিক একই অবস্থা হয়েছিল ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। বর্ণবাদ, হিংসাত্মক প্রচারণা, বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে দেশে দেশে অভিযুক্ত হয়েছে ফেসবুক, ইউটিউব। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন দেশে ফেসবুকের বিরুদ্ধে সহস্রাধিক মামলা হয়েছে। প্রায় সব মামলাতেই ফেসবুক আত্মসমর্পণ করেছে। ফেসবুক মার্কিন প্রতিষ্ঠান। মার্কিন আইন অনুযায়ী মানহানিকর কোনো তথ্য প্রকাশিত হলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। আর্থিক ক্ষতিপূরণের মামলায় হেরে গেলে দিতে হয় বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ। মামলার ক্ষতিপূরণ কে দেবে, এ নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু নিউইয়র্কের এক ক্ষতিপূরণ মামলায় আদালত জানিয়ে দেন ফেসবুক তার দায় এড়াতে পারে না। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ফেসবুককেই। প্রতিষ্ঠানটি ঘোষিত হিসেবে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রেই ক্ষতিপূরণ দিয়েছে ৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। যে দেশ ফেসবুকে ভুয়া তথ্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ, বর্ণবাদ, হেইট ক্রাইমের বিরুদ্ধে যত সোচ্চার হয়েছে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তাদের কাছেই নমনীয় হয়েছে। ফেসবুক পৃথিবীর কোনো দেশেই স্বেচ্ছায় অফিস করেনি। স্বপ্রণোদিত হয়ে করও দেয়নি। যেসব দেশ তাদের আইন, রীতির ব্যাপারে দৃঢ় ছিল ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ব্রাজিলে একজন গর্ভবতী নারীর ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করেন তার এক প্রতিবেশী। ওই নারী তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণেœœর অভিযোগে মামলা করেন। ব্রাজিলের আদালত ফেসবুককে ওই ছবি অপসারণের নির্দেশ দেন। কর্তৃপক্ষ আদালতের রায় অস্বীকার করে। আদালত সরকারকে নির্দেশ দেন, ফেসবুক যদি আদালতের নির্দেশ না মানে তাহলে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সরকার ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে এক মাসের মধ্যে ব্রাজিলে নিজস্ব অফিস করতে বলে। ২১ দিনের মাথায় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ব্রাজিলে অফিস করে। ওই ছবিও অপসারণ করে। মেক্সিকোর একজন মন্ত্রীকে মাদক ব্যবসায়ী বলে মন্তব্য করেন মার্কিন এক সিনেটর। তার এ বক্তব্য দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী এক মেক্সিকান নাগরিক। মন্ত্রী মামলা করেন। মেক্সিকো সরকার এ নিয়ে শক্ত অবস্থান নেয়। অবশেষে মাথানত করে মেক্সিকোতে অফিস করে ফেসবুক। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকককে যৌন ব্যবসার স্বর্গ বলে মন্তব্য করা হয়েছিল। থাইল্যান্ড সরকার তাৎক্ষণিকভাবে ফেসবুক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। দুই দিনের মধ্যে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চায়। ওই কনটেন্টটি অপসারণ করে এবং তিন মাসের মধ্যে থাইল্যান্ডে নিজস্ব অফিস করার অঙ্গীকার করে। এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। ফেসবুক কিংবা ইউটিউব যখন একটি দেশে অফিস করে তখন তাকে সে দেশের আইনকানুন মানতে হয়। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা জবাবদিহিতার আওতায় না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফেসবুক তো একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা উপার্জন করছে প্রতিষ্ঠানটি। আগে তারা ভ্যাট, করও দিত না। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টার উদ্যোগে এবং এনবিআরের সঠিক পদক্ষেপের কারণে এখন ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে কিছু ভ্যাট ও কর দিচ্ছে বটে। কিন্তু এখনো অনেক টাকার কর ফাঁকির অভিযোগও আছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে হইচই চলছে। এ আইনটি বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোর মতো। এটি দিয়ে কেবল প্রতিপক্ষকে হয়রানি করা যায়, সাইবার-সন্ত্রাসীদের দমন করা যায় না। সাইবার- সন্ত্রাসীদের দমন করতে দরকার ডাটা প্রটেকশন আইন। সব উন্নত দেশে এটি আছে। সম্প্রতি ‘গাইডলাইন অ্যান্ড ডিজিটাল মিডিয়া ইথিকস কোড’কে আইনে পরিণত করছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত। দেশটির তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ বলেছেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়াকে আরও দায়িত্বশীল এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্যই এ নীতিমালা।’ এ নীতিমালা অনুযায়ী সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত যে কোনো অভিযোগ তদন্তে ফেসবুক, ইউটিউব বা টুইটার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ প্রাপ্তির ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সহযোগিতা করতে হবে। এ ধরনের আপত্তিকর কনটেন্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ করতে হবে। ভারত সরকারের এ নীতিমালাকে স্বাগত জানিয়েছেন ভারতে ফেসবুকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অজিত মোহন। তিনি ভারতের আইনের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলেছেন, ‘এটি নিয়ে দর কষাকষির সুযোগ নেই।’ ভারতে যখন মার্কিন টেক জায়ান্ট একান্ত অনুগত তখন বাংলাদেশে তার রূপ অন্যরকম। তার চেয়েও নির্লিপ্ত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। ডাটা প্রটেকশন আইন নিয়ে আইসিটি মন্ত্রণালয় কাজ করছে, এমনটি শুনছি বহুদিন। কিন্তু এটি হচ্ছে না। আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর মনোযোগ লাভজনক প্রকল্পে। আইন করে তার কী লাভ? সম্প্রতি সরকার ওটিটি গাইডলাইন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। ‘রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফরমস ২০২১’ শিরোনামে এ নীতিমালার ব্যাপারে অংশীজনের মতামত নেওয়া হচ্ছে। এখানে ফেসবুকও তাদের মতামত দিয়েছে। বিটিআরসি খসড়া নীতিমালার ব্যাপারে ৪৫টি মতামত পর্যালোচনা করছে। এর মধ্যে ৩৩টি মতামতই হলো মেটা বা ফেসবুকের। বাংলাদেশে যাদের অফিস নেই, যারা এ দেশের আইনের ঊর্ধ্বে, ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাদের মতামত দেওয়ার অধিকার আছে? বিটিআরসি তাদের মতামত নেয় কেন? ফেসবুক, ইউটিউবকে আইনের আওতায় আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং কর্তৃপক্ষের এত অনীহা কেন? সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারের স্বার্থেই কি তাদের এ উদারতা। বিরোধী আন্দোলন নয়, বরং সোশ্যাল মিডিয়ার মিথ্যা প্রচারণা জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। সরকারকে বিব্রত করছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু পিশাচের চিৎকার চেঁচামেচিতে দেশের জনগণ অস্থির।  শেখ হাসিনা যদি স্যাংশন দেওয়া দেশের কাছ থেকে কিছু কিনবেন না বলে দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা দিতে পারেন, তাহলে ৫ কোটি গ্রাহকের দেশের মন্ত্রী কেন সাহস করে বলতে পারেন না বাংলাদেশে অফিস না করলে ফেসবুক, ইউটিউব কাউকেই ব্যবসা করতে দেব না। ফেসবুক, গুগলকে এমন সতর্কবার্তা দিতে মন্ত্রীরা কেন শরম পান? নাকি তাদের অন্য মতলব আছে?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

গাজীপুরে জয় হলো গণতন্ত্রের, ধন্যবাদ শেখ হাসিনা

প্রকাশ: ০১:২৯ এএম, ২৬ মে, ২০২৩


Thumbnail গাজীপুরে জয় হলো গণতন্ত্রের, ধন্যবাদ শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ। জনগণ যাকে ভোট দেবে তাকে আমরা মাথা পেতে নেব। এই কথাটি যে স্রেফ কথার কথা নয়, এই কথাটি যে তিনি বিশ্বাস থেকে বলেছেন এবং অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে যে শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর-  তা প্রমাণিত হলো গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অভাবনীয় ফলাফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন, বিজয়ী হয়েছেন জাহাঙ্গীর আলমের মা প্রতীকী প্রার্থী জায়েদা খাতুন। ১৬ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু এই নির্বাচনে আসলে জয় হয়েছে গণতন্ত্রের। অনেক প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়েছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াও যে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব-  তা প্রমাণিত হলো গাজীপুর সিটি করপোরশেনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। 

গাজীপুর সিটি করপোরশেনের নির্বাচনের দ্বিতীয় তাৎপর্য হলো অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন। দলীয় সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে- তা গাজীপুর সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আরেকবার প্রমাণিত হলো। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছিলো আজমত উল্লাকে। আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র এবং গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু ঋণ খেলাপির অভিযোগে তার প্রার্থীতা বাতিল হয়ে যায়। তার এই প্রার্থীতা বাতিল হওয়ার বিরুদ্ধে তিনি আপিল করে ফলাফল পাননি। আর সে কারণেই তিনি আগে থেকেই তার মাকে প্রার্থী করেছিলেন। এই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর আলমের মা বিজয়ী হয়ে প্রমাণ করলেন যে, জনগণ যাকে ভোট দিতে চায়, জনগণের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে জনগণ কখনও পিছপা হয় না। কাজেই এই নির্বাচনে দৃশ্যত আওয়ামী লীগ হেরে গেলোও এই নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ তৈরী করলো। 

জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করতে সক্ষম হলো যে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে এবং দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন সম্ভব হবে। জাহাঙ্গীর আলমের মা বিজয়ী হয়েছেন এটি বড় কথা নয়। এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে গণতন্ত্র। আর এজন্য অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে পারেন শেখ হাসিনা। কারণ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আর তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞতার ফলে গাজীপুরের নির্বাচনে একটি সুষ্ঠু ফলাফল হয়েছে। যেটি সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গাজীপুর   গণতন্ত্র   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

একমাত্র টার্গেট শেখ হাসিনা

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৪ মে, ২০২৩


Thumbnail

শেখ হাসিনাই এখন রাষ্ট্রদ্রোহী, ষড়যন্ত্রকারী, গণতন্ত্র বিনাশী শক্তির একমাত্র বাধা।

শেখ হাসিনাকে হটাতে পারলেই নির্বাসনে পাঠানো যাবে গণতন্ত্রকে।

শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দিতে পারলেই জঙ্গিবাদের উত্থান হবে বাংলাদেশে। শেখ হাসিনাকে নিঃশেষ করলেই বাংলাদেশ পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান হবে। শেখ হাসিনাকে মাইনাস করলে এদেশের উন্নয়নের চাকা থেমে যাবে।

শেখ হাসিনা না থাকলেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

আর তাই বিরোধী দলের আন্দোলন, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার সবকিছুর একমাত্র টার্গেট হচ্ছেন শেখ হাসিনা। তাঁকেই আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। গত ১৪ বছর একাই লড়ছেন তিনি স্রোতের বিপরীতে। নিঃসঙ্গ একাকী একযোদ্ধা আগলে রেখেছেন বাংলাদেশকে, এদেশের জনগণকে। সরকারের অনেকে প্রকাশ্যে বা গোপনে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে আপস রফার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা লক্ষ্যে অবিচল নির্ভীক। তিনি তাঁর বিশ্বাস চিন্তায় অটল রয়েছেন। আর এ কারণেই তাঁকে একমাত্র টার্গেট করা হয়েছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই কুৎসিত এবং হিংসাত্মক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাজশাহীতে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন বিএনপির আহ্বায়ক আবু সায়ীদ চাঁদ। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কিন্তু এই হত্যার হুমকি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বিভিন্ন সময়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার সবচেয়ে বীভৎস ষড়যন্ত্রের প্রকাশ্য রূপ। কিন্তু এ ছাড়াও তাকে দুই ডজন বার হত্যার চেষ্টা হয়েছে। কাজেই এবারের ঘটনা সেই ঘৃণ্য অভিপ্রায়ের আরেকটি প্রকাশ। এটি স্রেফ কথার কথা নয়। মেঠো বক্তৃতা নয়। আন্দোলনের মূল লক্ষ্য বিএনপির ওই নেতা ফাঁস করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতিপক্ষরা, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি, গণতন্ত্র বিরোধী অপশক্তি সবাই এখন একটি স্থির বিশ্বাসে এসে উপনীত হয়েছে যে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে বা সরিয়ে দিতে পারলেই আওয়ামী লীগকে সরকার থেকে হটানো যাবে। শেখ হাসিনা থাকলে কোনো ষড়যন্ত্রই কাজে আসবে না। আর এ কারণেই তিনিই টার্গেট।

বিএনপি নেতা চাঁদের এই ঘোষণা দেওয়ার দুদিন আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা করেছিলেন যে, তাদের দাবি ১০ দফা বা ২০ দফা নয়। দাবি একটাই। সেটি হলো শেখ হাসিনার পদত্যাগ। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ছাড়া তারা ঘরে ফিরে যাবেন না এমন ঘোষণাও তিনি দেন। এখন মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের সঙ্গে চাঁদের বক্তব্যের যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে।

বিএনপির পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ করা হচ্ছে এবং সেখানে কূটনীতিকদের বলা হচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা থাকতে পারবেন না। তাদের একমাত্র আক্রোশ শেখ হাসিনার প্রতি। শেখ হাসিনাতেই তাদের যত আপত্তি। শুধু বিএনপি নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কিছু দেশের কাছে শেখ হাসিনা এখন প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশ গত ১৪ বছরে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের জন্য বিস্ময়। এ কারণে বাংলাদেশ পরনির্ভরতা থেকে স্বনির্ভরতার পথে যাত্রা করেছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এটিকে পছন্দ করছে না প্রভাবশালী কিছু দেশ। তারা চায় বাংলাদেশ সব সময় নতজানু হয়ে থাকুক। তাদের আদেশ নির্দেশ অনুগত ভৃত্যের মতো অক্ষরে অক্ষরে পালন করুক। তাদের তুষ্ট করতে দেশের স্বার্থ বিলিয়ে দিক। কিন্তু শেখ হাসিনা নতজানু হন না। তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। এ কারণেই শেখ হাসিনাকে তারা টার্গেট করেছে। তাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগের ডালি নিয়ে বসেছে পশ্চিমারা। শেখ হাসিনা বিরোধী অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে আমাদের সুশীল সমাজ। বিএনপি জামায়াত শেখ হাসিনাকে শারীরিকভাবে হত্যা করতে চায়। আর সুশীলরা তার রাজনৈতিক মৃত্যুর জন্য অহর্নিশ কাজ করে যাচ্ছে। এ কারণেই তারা শেখ হাসিনার নীতি ও কৌশলের সমালোচক। সুশীল সমাজের একটি বড় অংশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেক হোমরাচোমরা নেতার সখ্য রয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই তাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে এবং গোপনে বৈঠক করেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের একসঙ্গে দেখাও যায়। সেসব আড্ডায় শেখ হাসিনার সমালোচনা মুখর থাকেন দুই পক্ষ। শেখ হাসিনা কী কী ভুল করছেন তা নিয়ে তাদের আধো আর্তনাদ, আধো উল্লাস বোঝা যায় সহজেই। এরা সবাই একটি ব্যাপারে একমত। তারা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে চান। এক-এগারোর কুশীলবরাই বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একটি বড় প্রতিনিধিত্বশীল অংশ। এই কুশীলবরা মাইনাস ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দৃঢ়তায় সেটি শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। কিন্তু এখনো তারা সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এ কারণেই এখনো শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার নতুন করে ষড়যন্ত্রের চেষ্টা চলছে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের তকমা লাগিয়ে তার অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টায় ব্যস্ত সুশীলরা।

শেখ হাসিনা যে এখন প্রধান টার্গেট সেটি লক্ষ্য করা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপপ্রচার এবং কুৎসিত মিথ্যাচারগুলোতে। তারেক জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় সাইবার সন্ত্রাসীরা কিছুদিন আগেও সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি আক্রমণ করত। কিন্তু এখন টার্গেটের এর মূল কেন্দ্র হচ্ছেন শেখ হাসিনা। ফেসবুক, ইউটিউবে দিনরাত অবিরত শেখ হাসিনাকে অকথ্য নোংরা ভাষায় গালাগাল করা হচ্ছে। জাসদ থেকে আমদানিকৃত এক গণবাহিনীর পরিত্যক্ত বিপ্লবীর হাতে দেওয়া হয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তার অধীনে বিটিআরসি। এসব নর্দমার চেয়ে নোংরা শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে তিনি নীরব। মন্ত্রী বলছেন, ফেসবুক, ইউটিউবের কনটেন্টের ব্যাপারে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এটি বলেই দায়িত্ব এড়িয়ে নিজস্ব আয় রোজগারে তিনি ধ্যানের মতো মনোনিবেশ করেছেন। কী আশ্চর্য! তাহলে ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড অসত্য, হিংসাত্মক কনটেন্ট আটকায় কীভাবে? ৫ কোটি ব্যবহারকারীর এই দেশে কেন এখন পর্যন্ত ফেসবুক অফিস করেনি? এই প্রশ্নের উত্তরে একদা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী লা জবাব। ফলে অপ্রতিরোধ্য গতিতে সাইবার সন্ত্রাসীরা মিথ্যাচারের বমি করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারকে লক্ষ্য করেই চলছে কুৎসিত অপপ্রচার। কারণ শেখ হাসিনা তার আদর্শের সঙ্গে আপস করেন না। সাইবার সন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে লড়াই করে তিনি টিকে আছেন। এভাবেই শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে বিরোধী পক্ষের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। সব পক্ষ একজোট হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। তাকে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, ’৭৫-এর খুনিচক্র বারবার শারীরিকভাবে হত্যা করতে চেয়েছে, তেমনি রাজনৈতিকভাবে হত্যারও চেষ্টা চলছে। বার বার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে কুৎসিত মিথ্যাচারের জবাব দিয়ে জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রজ্ঞা, মেধা এবং দূরদর্শিতায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদেরও হতাশ করেছেন বারবার। এবারও জিতবেন শেখ হাসিনাই। তাকে জিততেই হবে কারণ, শেখ হাসিনা হারলে হারবে বাংলাদেশ।

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন