এডিটর’স মাইন্ড

কারা টাকা দিয়ে মন্ত্রী-এমপি হলো


প্রকাশ: 01/01/2022


Thumbnail

স্বাগত ২০২২। একটা নতুন বছর মানেই কিছু স্বপ্নের ডানা মেলা। কিছু সম্ভাবনার উঁকিঝুঁকি। আবার নতুন বছর মানে কিছু শঙ্কা, উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ। স্বপ্ন এবং শঙ্কার দোলাচলই হলো জীবন। বাংলাদেশে ২০২১ সালে স্বপ্ন এবং হতাশা সমান্তরালভাবে এগিয়েছে। নতুন স্বপ্নের মধ্যেই শঙ্কার কালো মেঘের আনাগোনা দেখেছি। একদিকে দৃশ্যমান পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল। অন্যদিকে সড়কে মৃত্যুর মিছিল, লঞ্চে আগুনে পোড়া লাশের স্তূপ, কক্সবাজারে ধর্ষিতা বোনের আর্তনাদ। অপার সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করে দেশ যেমন এগিয়েছে, তেমনি মানবিকতা কমেছে জ্যামিতিক হারে। বৈষম্য বেড়েছে। কমেছে সম্প্রীতি, ভালোবাসা। এর মাঝেই আমরা বরণ করছি ২০২২। কেমন যাবে ২০২২? ২০২১ সাল তার একটা পূর্বাভাস দিয়েই বিদায় নিয়েছে। বিদায়ী বছরের শেষ সপ্তাহে আওয়ামী লীগের এক নেতার অডিও টেপ ফাঁস হলো। অডিও টেপ ফাঁস হওয়াটা এখন রীতিমতো মহামারীতে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। কারা কোথায় কখন কার টেলিআলাপে আড়ি পাতছে কেউ জানে না। অথচ আইন আছে রাষ্ট্রের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কেবল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এ ধরনের রেকর্ড করতে পারবে, তা-ও রাষ্ট্রে নিরাপত্তার স্বার্থে। কিন্তু এখন প্রেমিক-প্রেমিকার ফোনালাপ, ইলিয়াস-সুবাহ অডিও ক্লিপ, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষিকা থেকে শুরু করে দোকানদার, নায়িকা থেকে পাহারাদার সবার টেলিআলাপের অডিও এখন বাজারে পাওয়া যায়। এগুলো ভাইরাল হয়। এগুলো কেউ চ্যালেঞ্জ করে না। একবার মাত্র অডিও ফাঁসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক। ফরিদপুরের এমপি নিক্সন চৌধুরীর আগাম জামিন চেয়ে হাই কোর্টে এক আবেদনে শাহদীন মালিক বলেছিলেন, ‘গোপনে ফোনালাপ রেকর্ড সংবিধান লঙ্ঘন’। নিক্সন চৌধুরীর সঙ্গে ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের টেলিআলাপ কে বা কারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এটি ছড়িয়ে দিয়ে ওই জেলা প্রশাসক রাজনৈতিক নেতার ঢঙে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছিলেন। এ নিয়ে আমলাদের সংগঠনও ট্রেড ইউনিয়নের মতো আচরণ করেছিল। সর্বোচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর নিক্সন চৌধুরী আর মামলাটি এগিয়ে নেননি। কিন্তু আমি মনে করি এ মামলাটির চূড়ান্ত একটা সমাধান হওয়া উচিত ছিল। কারণ এখন এ ধরনের টেলিআলাপ রেকর্ড করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার এক ভয়ংকর ব্ল্যাকমেলিং শুরু হয়েছে। সামনে এ প্রবণতার পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা নিয়ে আমি শঙ্কিত। এখন পর্যন্ত এ ধরনের অডিও টেপ ফাঁসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা কম নয়। একজন প্রতিমন্ত্রী, একজন সিটি মেয়র, একজন পৌর মেয়র এ টেলিআলাপ প্রকাশের জেরে পদ হারিয়েছেন। সর্বশেষ ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপটি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক রোশন আলী মাস্টারের। তিনি কথা বলেছেন বিএনপির স্থানীয় নেতা রুহুল আমিনের সঙ্গে। এ অডিও টেপে যেসব বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তা আঁতকে ওঠার মতো। তবে যাদের অডিও টেপ এ পর্যন্ত ফাঁস হয়েছে তার মধ্যে একমাত্র সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান ছাড়া সবাই ভাইরাল হওয়া অডিও টেপে বিকৃতি, সুপার এডিটিংয়ের অভিযোগ এনেছেন। বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, তার বক্তব্য বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভাইরাল হওয়া অডিও কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার হয়েছেন কাটাখালীর পৌর মেয়র আব্বাস আলী। তিনিও অভিযোগ করেছেন তার বক্তব্য খণ্ডিতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ ধরনের অডিও টেপের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। লন্ডনে পলাতক দণ্ডিত শহিদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের এক টেলিআলাপ ফাঁস হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) ডয়েচে ভেলেতে খালেদ মুহিউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জেনারেল আজিজ এ ধরনের অডিও টেপ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এখন ভয়েস ক্লোনিংসহ নানা উপায়ে যে কারও কথা হুবহু নকল করা যায়। আজিজ আহমেদ একজন সম্মানিত ব্যক্তি। কাজেই তাঁর বক্তব্যকে আমাদের বিবেচনায় নিতেই হবে। শুধু তাঁর বক্তব্য যে ক্লোন হয়েছে অন্য কারও বক্তব্যে ক্লোন হয়নি এ রকম কোনো বিজ্ঞানসম্মত তথ্য-প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। তাই মহামারীর মতো প্রতিদিন ভাইরাল হওয়া বিখ্যাত-অখ্যাত সব ব্যক্তির অডিওগুলোর ব্যাপারে নির্মোহ তদন্ত হওয়া দরকার। জানা দরকার, এ বক্তব্যগুলো আসলে তাদের কি না। এ বক্তব্যগুলো কারা রেকর্ড করল। এ ধরনের রেকর্ড সংবিধান এবং আইনের পরিপন্থী কি না। তা না করে অডিও প্রকাশ হলেই হইচই বাঁধিয়ে ফেলা সামনে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশে অডিও টেপ ফাঁস নাটকের সূচনা হয়েছিল মাহমুদুর রহমান মান্না এবং প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার অডিও ফাঁসের মাধ্যমে। এর জেরে মান্না গ্রেফতার হয়েছিলেন। তখন এ নিয়ে কেউ নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন তোলেননি। কেউ বলেননি, এভাবে আড়ি পাতা সঠিক নয়। এ ধারায় বিরোধী দলের অনেক নেতা-পাতিনেতার অডিও ফাঁস হয়। এগুলোর ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে উৎসাহের উচ্ছ্বাস দেখে অবাক হয়েছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কিংবা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে যে কারও ফোনালাপ রেকর্ড করতেই পারে। এ তথ্যের ভিত্তিতে কেউ যদি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক বিবেচিত হন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই পারেন। কিন্তু এগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া কতটা আইনসম্মত, কতটা নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ এ অস্ত্রবিরোধী দলকে ঘায়েলের এক অব্যর্থ কৌশল মনে করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন। এখন টেলিআলাপ রেকর্ড আওয়ামী লীগের জন্যই বুমেরাং হয়ে উঠেছে। ডা. মুরাদ হাসানের সঙ্গে একজন চিত্রনায়িকার টেলিআলাপের কথাই ধরা যাক। প্রায় দুই বছর আগে এ টেলিআলাপের ঘটনাটি ঘটেছিল। দুই বছর পর এটি ফাঁস করল কারা? তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি যে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও আড়ি পাতা জালের বাইরে নয়? তাদের একান্ত ব্যক্তিগত, গোপনীয় কথাগুলোও রেকর্ড করা হয়? সময় এলে সেসবও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। চূড়ান্ত আঘাত হানার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এটি যদি হয় তাহলে তো তা চরম বিপজ্জনক, শিষ্টাচারবহির্ভূত এবং অনৈতিক কাজ। ডা. মুরাদের বক্তব্য নিঃসন্দেহে কুৎসিত, অরুচিকর। কিন্তু যারা এটা আড়ি পেতে রেকর্ড করে মুখ বুজে থাকল তারা তো আরও ভয়ংকর। এরা যদি সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী হতো তাহলে তাদের উচিত ছিল এ তথ্যটি সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেওয়া। কিন্তু তারা এটা করেনি। যারা মুরাদের টেলিফোন কথোপকথন আড়ি পেতেছে তারা আর কারওটা করেনি সেটা কে বলবে।

আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বহুল পরিচিত একটা কথা হলো, আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শত্রু আওয়ামী লীগ নিজেই। বাইরের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে কখনো পরাজিত করতে পারেনি। ঘরের শত্রু মোশতাকদের হাতেই আওয়ামী লীগের যত পরাজয়। গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলি হলেন আওয়ামী লীগের হাতেই। জাহাঙ্গীরের বক্তব্য আপত্তিকর, ধৃষ্টতাপূর্ণ এবং চরম ইতিহাস বিকৃতি। এজন্য শাস্তিটা তার প্রাপ্যই ছিল। কিন্তু যে ব্যক্তি জাহাঙ্গীরের বক্তব্যে আরও হাওয়া দিল, নীরবে প্রতিবাদহীন থেকে তার বক্তব্যে সায় দিল তার তো কিছুই হলো না। বঙ্গবন্ধুর কোনো আদর্শের কর্মী এ ধরনের বক্তব্য নীরবে হজম করতে পারে না। জাতির পিতা সারা জীবন অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন অকপটে, নির্ভয়ে। স্কুলে, বেকার হোস্টেলে, কারাগারে কোথাও অসত্য বক্তব্যের প্রতিবাদ করতে এতটুকু ছাড় দেননি। এটাই জাতির পিতার শিক্ষা। এটাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। এ আদর্শের ওপরই আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়ে। তাই জাহাঙ্গীরের চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যে যেমন শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তেমনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলো তা চুপচাপ শুনে হজম করা। এরা আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী নয়। এরা আসলে অপকৌশলে জাহাঙ্গীরকে কুপোকাত করতে চেয়েছিল। একই কথা আব্বাস আলীর ঘটনায়ও প্রযোজ্য। যে অস্ত্র আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের ওপর প্রয়োগে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিল। সেই অস্ত্র এখন আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রয়োগ করছে। এতে জাহাঙ্গীর, আব্বাস কিংবা মুরাদ হাসানরা শাস্তি পাচ্ছে বটে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ সংগঠন। ভাবা যায় দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় দল থেকে গাজীপুরের মেয়র মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তি শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করেন! আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জয়ী হওয়া একজন পৌর মেয়র বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে কটূক্তি করেন! তাহলে কোথায় আদর্শ? কোথায় শিক্ষা? এখন প্রশ্ন উঠছে, শহীদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তি করায় যদি বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয় তাহলে জাহাঙ্গীর কেন আইনের আওতায় আসেন না? আওয়ামী লীগের অডিও ভাইরাল মিছিলে বছরের শেষ সংযোজন হলেন কুমিল্লার নেতা রোশন আলী মাস্টার। তার বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে মূলধারার গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তার বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর তিনিও অন্যদের মতো এ বক্তব্যকে বলেছেন, ‘আমার খণ্ডিত বক্তব্য ভাইরাল করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য প্রকাশিত হলে বাস্তব চিত্র উঠে আসত।’ অর্থাৎ তার বক্তব্য তিনি অস্বীকার করেননি। বলেছেন কিছু অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে (খণ্ডিত)। রোশন আলী মাস্টারের ভাইরাল হওয়া অডিওতে শোনা যাচ্ছে তিনি বলেছেন, ‘যারা নৌকা করে সব রাজাকারের বাচ্চারা। কী করবেন যে দেশে টাকা দিলে নমিনেশন পাওয়া যায়, যে দেশে টাকা দিলে মন্ত্রিত্ব পাওয়া যায়, যে দেশে টাকা দিলে সব আকাম চলে...’ অডিওটা ভালো করে শুনলে বোঝা যাবে কথাগুলোর মধ্যে কোনো গ্যাপ নেই। টানা এ কথাগুলো তিনি বলেছেন। এর আগে পরে তিনি যা-ই বলুন না কেন তাতে এসব কথা অর্থের কোনো পরিবর্তন হয় না। আওয়ামী লীগের এই নেতা কি জেনে-বুঝে এসব কথা বলেছেন? সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যে এক ধরনের হতাশা লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে দলে অনুপ্রবেশকারীদের দাপটে কোণঠাসা ত্যাগী নেতারা আওয়ামী লীগ এবং সরকার নিয়ে নানা হতাশার কথা বলেন। এর মধ্যে কে কী ছিল কীভাবে মনোনয়ন পেল, কীভাবে মন্ত্রী হলো তা নিয়ে নানা মুখরোচক আলোচনা কান পাতলেই শোনা যায়। এসব কতটা সত্য, কতটা কল্পনা তা কেউ যাচাই করে না। বঞ্চিতরা এসব আলোচনায় এক ধরনের স্বস্তি পায়। এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠছে ব্যাপকভাবে। টাকার বিনিময়ে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে- এসব অভিযোগ এখন প্রকাশ্যেই উঠছে। রাজাকারপুত্র, যুদ্ধাপরাধীদের নাতি, বিতর্কিত ব্যক্তি মনোনয়ন পেয়েছেন বলে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও খবর বের হয়। যেখানে কর্মীদের চাপ বেশি থাকে সেখানে প্রার্থী পরিবর্তন হয় (খুব কম ক্ষেত্রেই এটা হয়েছে)। আর যেখানে নেতা-কর্মীদের চাপ কম থাকে সেখানে ওই অযোগ্য প্রার্থীই নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের মাঠ দাপিয়ে বেড়ান। এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের বিদ্রোহ হয়েছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা যতই এটাকে হালকাভাবে নিন না কেন এর ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অবশ্যই আগামীতে আওয়ামী লীগকে সহ্য করতে হবে। তৃণমূলে সুস্পষ্ট বিভক্তি আওয়ামী লীগের জন্য একটি চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। বহিষ্কার, হুমকির পরও আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী প্রার্থীর অভাব নেই। এদের প্রায় ৪০ শতাংশ নৌকাকে হারিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণায় এরা অভিযোগ করেছে, রাজাকারের বাচ্চারা নৌকা প্রতীক পেয়েছে। কোন ইউনিয়ন পরিষদে কে কত টাকা দিয়ে মনোনয়ন পেয়েছে তা-ও প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে। তাই কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা যা বলেছেন, সে কথা এখন আওয়ামী লীগের অনেকেই বলেন। আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের এই সিনিয়র নেতা যদি সচেতনভাবে এ কথা বলে থাকেন তাহলে অবশ্যই তাকে এ সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। কারা কারা টাকা দিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন, তাদের নাম তাকে বলতে হবে। যদি তিনি এটা না করতে পারেন তাহলে বুঝতে হবে তিনিও পচে গেছেন। আওয়ামী লীগের ক্ষতির জন্যই তিনি এসব বলেছেন এবং বিএনপিকে উসকে দিচ্ছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেকেই মনোনয়ন নিয়ে নয়ছয় করতে পারেন। কিন্তু মন্ত্রী বানানো একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর একক এখতিয়ার। তাই রোশন আলী মাস্টারকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে, কে কাকে টাকা দিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। তিনি যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সত্যিই বিশ্বাস করেন তাহলে তিনি যা বলেছেন সে অবস্থানে অটল থাকবেন। তার বক্তব্যের পক্ষে তথ্য-প্রমাণ হাজির করবেন। অথবা ভুল বক্তব্যের জন্য দল থেকে সরে দাঁড়াবেন। কিন্তু মিন মিন করে যদি বলেন, তার বক্তব্য খন্ডিতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তাহলে তিনি হবেন আরেক মোশতাক। যারা আড়ালে ষড়যন্ত্র করে, প্রকাশ্যে চাটুকারিতা করে। আওয়ামী লীগে এখন এ ধরনের মোশতাকের সংখ্যা অনেক। আওয়ামী লীগের অনেক নেতারই এখন মুখে এক মনে আরেক। আড়ালে তারা কীভাবে দেশ চলছে তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। আওয়ামী লীগের কী ভবিষ্যৎ তা নিয়ে প্রায়ই আঁতকে ওঠেন। আবার প্রকাশ্যে দলের নেতাকে খুশি করতে এমন কোনো স্তুতিবাক্য বাদ রাখেন না। এরা আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ভিতরে নানা মত, নানা পথ থাকতেই পারে। দলের ভিতরে ভিন্নমত নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক হতেই পারে কিন্তু যখন একটা সিদ্ধান্ত হবে তখন তাকে সবার মানতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভিতর এখন সেই চর্চা আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাই মনে করেন খুশি করতে হবে। এজন্য শুধু ভালো কথা, সুন্দর কথা বলেন প্রকাশ্যে। দলীয় প্রধানকে কেউ সমালোচনার কথা, ব্যর্থতার কথা বলেন না। পাছে তিনি সুনজর থেকে নিক্ষিপ্ত হন- এ শঙ্কায়। এরা আসলে আওয়ামী লীগের ক্ষতি করছেন। এর ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে আড়ালে থেকে যাচ্ছে। কুমিল্লার নেতা যদি এসব অভিযোগ বিএনপি নেতাকে না বলে সরাসরি যথার্থ জায়গায় বলতেন তাহলে তিনি দলের উপকার করতেন। কিন্তু এখন তার অডিও শুনে মনে হলো আওয়ামী লীগের নেতারা যা বলেন তা বিশ্বাস করেন না। তাদের প্রকাশ্য বক্তব্য এবং গোপন কথা দুই মেরুতে।
আওয়ামী লীগে সমালোচনার সুযোগ দিতে হবে। দলীয় ফোরামে দলের এমপি ও নেতাদের ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে। তা হলেই দল বিকশিত হবে। তা হলেই এ ধরনের হতাশার কথা গোপন টেলিআলাপে বলতে হবে না। মনে রাখতে হবে সত্য নির্ভয়ে উচ্চারণই হলো বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি। অযোগ্য অনুগত মিথ্যাবাদী চাটুকাররা ভুল তথ্য দিয়ে সরকার ও দলকে বিভ্রান্ত করে। তারা অসত্য কথা বলে অযোগ্যতা আড়াল করে। আর যোগ্য ব্যক্তিরা সঠিক সমালোচনা করে, প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে, যেন নেতা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অযোগ্য আনুগত্যের চেয়ে যোগ্য সমালোচক উত্তম।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭