ইনসাইড পলিটিক্স

৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছাত্রলীগ: কোন পথে বর্তমান নেতৃত্ব?


প্রকাশ: 04/01/2022


Thumbnail

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম সরকার বিরোধী ছাত্রসংগঠন। পাশাপাশি এই শতাব্দীর বিশ্বের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠনের নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি সময়ের দাবিতেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সময়ের প্রয়োজন মেটাতেই এগিয়ে চলেছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া এই সংগঠনটি সেই ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র দফা থেকে শুরু করে তৎকালীন ডাকসু ভিপি ও ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান এবং ৭১ এর মুক্তিসংগ্রামে রণাঙ্গণের প্রথম সারিতে থেকেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও দলটির অবদান অনীস্বীকার্য। ৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় ছাত্রলীগ। পাশাপাশি মূল দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সংকটের সময়েও ভূয়সী অবদান রাখে ছাত্রলীগ।

কবি সুকান্ত ভট্টচার্যের কবিতার একটি লাইন আছে যে, ‘সাবাস বাংলাদেশ...  এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,/ জ্বলে-পুড়ে মরে ছারখার,/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ এই পংক্তি হতে পারে ছাত্রলীগের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল কর্মকাণ্ডের যুতসই উদাহরণ।

বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রসমাজের ঐতিহ্যবাহী ও সবচেয়ে পুরোনো সংগঠন ছাত্রলীগ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয় মুক্তি, তথা স্বাধীনতার আন্দোলনে ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন করে। বলা হয়ে থাকে ৫০ ও ৬০ এর দশকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের থেকেও বেশি ভাইব্রেন্ট ছিল দলটির অঙ্গ সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ। তবে এগুলো এখন সোনালী অতীত। পানি শুকিয়ে সেই খরস্রোতা নদী আজ মৃতপ্রায়। অতীত ঐতিহ্য ধরে রেখে সামনের পথ চলাই এখন এই সংগঠনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। নানা ঘটনায় সমালোচনায় পড়তে হয় সংগঠনটিকে।

গত কয়েক বছরে নানা বিতর্কে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃত্ব পরিবর্তন হলেও কমিটি বাণিজ্য ও চাঁদাবাজিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ এখনও উঠছে সংগঠনের ভেতর থেকেই।

শীর্ষ নেতৃত্ব পরিবর্তন হলেও রয়ে গেছে বিতর্ক

বর্তমানে ছাত্রলীগের সুনাম কম, অভিযোগ বেশি। অপরাধে জড়িত থাকায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতার ধর্ষণের ঘটনা দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রোধ তৈরি করেছে। বলতে গেলে দেশে চলমান সব বিনষ্টিগুলোতেই এ দলটির নেতাকর্মীদের নাম আসে। ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, প্রশ্নফাঁস, দখলবজি, নারী কেলেঙ্কারি, ধর্ষণ সব জায়গায় তাদের পাওয়া যায়। প্রতিপক্ষ ছাত্রদলের অনুপস্থিতিতে ছাত্রলীগ নিজেরাই কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। গত ১২ বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারের জন্য সংঘর্ষ, গোলাগুলি, টেন্ডারবাজি, দখল বাণিজ্য, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, হলের সিট নিয়ন্ত্রণসহ নানা ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে কোন্দলে ছাত্রলীগের প্রায় একশ ৩০জন নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছে।

পুরান ঢাকায় প্রকাশে ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক দৃশ্য দেশের মানুষ দেখেছে। বরিশালে কলেজের অধ্যক্ষকে চ্যাংদোলা করে পানিতে ফেলে দেয়া, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গায়ে এসিড নিক্ষেপ, সিলেটের এমসি কলেজের হোস্টেলে অগ্নিসংযোগ, শরিয়তপুরসহ সম্প্রতি কয়েকটি এলাকায় ছাত্রলীগের নেতার নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের দৃশ্য ধারণ করে ভিডিও প্রচার কাহিনীসহ অসংখ্য ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাদের নাম জড়িয়েছে।

২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের পর ৩১ জুলাই রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে দুই বছর মেয়াদি কমিটি গঠিত হয়েছিল। পদ পেয়ে টাকার বিনিময়ে কমিটিতে পদ দেওয়া, বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডসহ সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ থেকে চাঁদা দাবির অভিযোগে ২০১৯ সালে শোভন-রাব্বানীকে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ নেতৃত্বের ক্ষমতা দেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। দায়িত্ব পেয়েও সাংগঠনিক দায়িত্ব ভাগ করে না দেওয়া, নিয়মিত সাধারণ সভা না করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কমিটিসহ ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ শাখাগুলোতে সমম্মেলন করে নতুন কমিটি ঘোষণা না করায় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার অভিযোগ, বিতর্কের মুখে পদচ্যুত শোভন-রাব্বানীর পথেই হাঁটছেন জয় ও লেখক।

শীর্ষ পদে আসার পর ছাত্রলীগ সভাপতি জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখকের সম্মেলন না করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি ঘোষণা ও কেন্দ্রীয় পরিষদের মতামত ছাড়া দুজনের সিদ্ধান্তে সংগঠন পরিচালনা ফের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ৫ দিনব্যাপী নানা বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রলীগ। তবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কোনো প্রস্তুতি সভা বা সাধারণ সভা করেনি সংগঠনটি।

অনেকেই সন্দেহ করছেন, ছাত্রলীগের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী অনেক বছর ধরেই ঢুকছে। বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা পোশাক বদলে, স্লোগান পাল্টে ছাত্রলীগে ভিড়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পেতে ছাত্রলীগকে নিবিড় মনিটরিং ও নার্সিং করার বিকল্প নেই বলে অনেকে মনে করছেন।

কবে মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলন?

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে দুই বছর পর পর জাতীয় সম্মেলন করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনে কথা বলা হলেও চার বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে সর্বশেষ ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের; তবে জয়-লেখকের পূর্ণ দায়িত্ব পাওয়ার দুই বছর হচ্ছে। নতুন সম্মেলনের তারিখ নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছেন ছাত্রলীগ নেতারা।

ছাত্রলীগের ৭৪ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার দ্বিতীয় দিন রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের মিলনায়তনে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে ৩০তম জাতীয় সম্মেলনের বিষয়ে সংগঠনটির অভিভাবক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দেবেন বলে প্রত্যাশা ছাত্রলীগ নেতাদের।

এসব বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এবং সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে দুদিন ধরে একাধিকবার ফোন ও এসএমএস পাঠানো হলেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭