ইনসাইড পলিটিক্স

সব হারিয়ে সর্বহারা


প্রকাশ: 04/01/2022


Thumbnail

সাল ১৯৪৮!

জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন ওই সময়ের তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এর নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার শুরুর সেই সময় থেকেই বাঙালি জাতির ভাষার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি স্বাধীনতা ও স্বাধিকার আন্দোলনের কেদ্রবিন্দুতে পরিণত হয় ছাত্রলীগ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের বাঙ্গালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা, ১৯৬৯ সালে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ! চোখ বন্ধ করলে ইতিহাসে এমনটাই ছিলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভিজুয়াল। 
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ১০ দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এবং গণতান্ত্রিক সরকারের পুনরুত্থানে যে নামটি সবার আগে উচ্চারিত হয়েছিলো সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

একটা সময় ছাত্রলীগ বলতে মানুষ বুঝতো ছাত্রদের অধিকার, বাংলাদেশের প্রগতি নিয়ে কাজ করা একটি ছাত্র সংগঠন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় শিক্ষা অধিকার আন্দোলনগুলোতে, ১৯৮৮ সালের বন্যা কবলিত বাংলাদেশে, ১৯৯৮ সালের বন্যাসহ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একই কার্যক্রম নিয়ে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ঘটনাগুলোতে। ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল সেই সময়ের ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগের সুনামের সেই সময়গুলোতে যারা ছাত্রলীগকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে নির্যাতিত, নিপীড়িত ছাত্র সমাজ তথা গোটা বাংলাদেশের সকল মানুষের অধিকার আদায়ের একটি সংগঠন হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আ.স.ম. আব্দুর রব, ওবায়দুল কাদের, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর সহ আরো অনেক মেধাবী ও সাহসী ছাত্রলীগ নেতারা। যে নামগুলো উচ্চারিত হয় ছাত্রলীগের নামের সাথে তারা আজকের বাংলাদেশের মেধাবী ও জাতীয় নেতাদের অন্যতম। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা ছাত্রনেতারাই পরবর্তীতে সোনার বাংলা বিনির্মানে রেখেছিলেন অবদান।

ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে ৭৪ বছর পার করলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ! তবে আজকের বাংলাদেশে বসবাসকারী কেউ চোখ বন্ধ করে ছাত্রলীগ নামটি উচ্চারণ করলে কি ভেসে ওঠে মনে! ৯০ পরবর্তী ছাত্রলীগ আর বাঙ্গালির স্বাধীনতা সংগ্রামে বুক চিতিয়ে স্বাধিকারের দাবিতে লড়ে যাওয়া ছাত্রলীগের সাথে আজকের ছাত্রলীগকে কি কেউ মেলাতে পারবেন! যে ছাত্রলীগ এক সময় প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির চর্চা করতো সেই ছাত্রলীগের হাতেই কিভাবে উঠলো অস্ত্র, কারা বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতিকে নিয়ে গেলো ভীতিকর অবস্থানে। ড্রাকুলার স্পর্শে যেমন একজন তরতাজা সুস্থ মানুষ রক্তপায়ী ড্রাকুলা হয়ে যায়, তেমনি ধীরে ধীরে বাঙ্গালির আশা আকাংখার প্রতীক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যেন কোনো এক চেতনানাশকের প্রভাবে ডুবে গেলো ধীরে ধীরে। কখনো কেউ এগিয়ে আসেনি ছাত্রলীগের এই পাল্টে যাবার কারণ খুঁজতে। এমনকি ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে অসন্তুষ্ট হয়ে আওয়ামীলীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের 'অভিভাবকত্বের' পদটি ত্যাগ করেছিলেন, তারপরেও কি ছাত্রলীগ চেষ্টা করেছিলো নিজেদের সংশোধনের? ফলাফলেই বা কি উপহার দিতে পারলো ৭৪ বছরের জন্মদিনের কেক কেটে ফেলা আজকের এই ছাত্রলীগ!

আচ্ছা!!! “বিচ্ছিন্ন ঘটনা” শব্দটির সাথে তো বেশ অনেকদিন ধরেই আমরা পরিচিত তাইনা? চলুন একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যাক! ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকায় রাজপথে যখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রদের গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছিল, তখন মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন বলেছিলেন, 'এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ভাষার দাবিতে আন্দোলনের নামে ভারত থেকে হিন্দুরা এসে পাকিস্তান ধ্বংস করার এই সাবোটাজ চালাচ্ছে। তাদের চক্রান্তেই কয়েকজন যুবক প্রাণ হারিয়েছে। এটি ছিলো একটি ঘটনাকে আড়াল করার একটি টার্ম মাত্র।

আজকের বাংলাদেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি বা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ঠিক তখনি কিছু নেতাদের দেখা যায় ঘটনাকে আড়াল করতে “বিচ্ছিন্ন ঘটনা” ট্যাগটিকে ব্যবহার করতে। অথচ যদি কতিপয় ছাত্রলীগ নামধারীদের বিচ্ছিন্ন ঘটনার ট্যাগে আড়াল না করে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেওয়া যেত তাহলে হয়তো আজকের এই ছিন্নভিন্ন খেই হারিয়ে টলতে থাকা ছাত্রলীগের চেহারা দেখতে হতো না। ছাত্রলীগকে হয়তো অতীত গৌরব ছারিয়ে অস্তিত্ব অস্তিত্ব খুঁজে ফেরা আজকের এই ছাত্রলীগ হতে হতো না। ছাত্রলীগকে কিছু নামধারী নেতা এবং আওয়ামীলীগেরই প্রাক্তন কিছু মন্ত্রী ও নেতা নিজেদের ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে বছরের পর বছর ধরে। ওপরে ওপরে ছাত্রলীগে বর্তমান নেতাদের কর্তৃত্ব বজায় থাকলেও আসলে ছাত্রলীগের পরস্পর বিবাদরত দল-উপদলকে নেপথ্যে বসে চালাচ্ছেন হয়তো অন্য কোনো গোষ্ঠী, যারাই মূলত আজকের ছাত্রলীগের এই অবস্থার জন্য দায়ী।

বর্তমানে ছাত্রলীগ নেতার নামের পাশে লাগছে ধর্ষক ট্যাগ। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা আজ ছাত্রলীগকে ভয় পায়। অথচ এসকল সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্য নিয়েই জন্ম হয়েছিলো ছাত্রলীগের। ছাত্রলীগের হাতে আজ বিশ্বজিৎ আর আবরার ফাহাদের রক্ত।  ছাত্রলীগ নেতাদের নাম দেখা যায় ধর্ষণের চার্জশিটে, ছাত্রলীগ নেতাদের চাঁদা চাইবার ফোনালাপ ঘুড়ে বেড়ায় সোশাল মিডিয়াতে, এমনকি ছাত্রলীগের জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের কমিটিতে নাম তুলতেও আজকাল লাগে বড় অঙ্কের টাকা, সেই টাকায় ফুলে ফেপে ওঠেন বড় বড় ছাত্রলীগ নেতারা। যে ছাত্রলীগ গণতান্ত্রিক আন্দোলের অগ্রসৈনিক ছিল, সেই ছাত্রলীগের কারণেই গণতন্ত্র আজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ছাত্রলীগের কিছু কিছু কর্মকান্ডে আওয়ামীলীগের অর্জন হচ্ছে ভুলিন্ঠিত।

গত কয়েক দশকে ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দলে প্রাণ হারিয়েছেন খোদ ছাত্রলীগেরই অনেক নেতাকর্মী। এমনকি দলীয় কোন্দল এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেই সংগঠনটির সভাপতি আল নাহিয়ান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে আহত হতে হয় নিজ দলের কর্মীদের হাতে।

গত এক দশকে গর্ব করার মতো কোনো অর্জন নেই ছাত্রলীগের। বরং কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরপদ সড়ক আন্দোলনে হেলমেট মাথায় চাপিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপরে চড়াও হওয়াতে নাম জড়িয়েছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ আজ এক ভয়ের নাম। ছাত্রলীগের নেতা হওয়া আজ এক উৎসবের উপলক্ষ্য, কারণ ছাত্রলীগের নেতা হতে পারলেই অগাধ টাকার হাতছানি। অতীতের ছাত্রলীগ যেখানে ছিলো সাবলীল বক্তৃতায়, অনিন্দ্য সুন্দর কবিতায়। অতীতের ছাত্রলীগ যেখানে ছিলো সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনগনের ভালোবাসায়। সেই ছাত্রলীগ আজ সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনগনের ঘৃণার পাত্র। অতীত গৌরব, ঐতিহ্য, সুনাম হারিয়ে ছাত্রলীগ যেন আজ দিকভ্রান্ত এক পথিক। সব হারিয়ে ছাত্রলীগ আজ সর্বহারা।

আজ ছাত্রলীগের ৭৪ তম জন্মদিন। নতুন এই জন্মদিনে জন্ম হোক নতুন এক ছাত্রলীগের, যে ছাত্রলীগের স্বপ্নই দেখেছিলেন জাতির পিতা। যে ছাত্রলীগ ছিলো আওয়ামীলীগের ভ্যানগার্ড, যে ছাত্রলীগ ছিলো অন্যায়ের সাথে আপোষহীনতার প্রতীক, যে ছাত্রলীগে ভরসা রাখতো সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে গোটা দেশ। শুভ জন্মদিন “বাংলাদেশ ছাত্রলীগ”।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭