ইনসাইড থট

বৈশ্বিক মহামারির এ সংক্রমণের ঢেউয়ে আশার আলো - ওমিক্রন


প্রকাশ: 11/01/2022


Thumbnail

করোনা ভাইরাস সৃষ্ট কোভিড-১৯ নামের বৈশ্বিক মহামারিতে ইতোমধ্যে সারা বিশ্বে ৫০ লক্ষের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আক্রান্ত হয়েছে ৩০ কোটির বেশি। মৃত্যুর মিছিলের পাশাপাশি  জনজীবন ও জীবিকা হয়েছে অচল। এ মারণঘাতী ভাইরাসের মধ্যে আশার আলো থাকে কি করে? থাকে এ জন্য যে কোন মহামারী দীর্ঘকাল ধরে থাকেনা এবং ইতোমধ্যে জীব প্রযুক্তিসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে ব্যাপক। চতুর্দশ শতকে “ব্লাক ডেথ” নামে পরিচিত বৈশ্বিক মহামারী “বিউবোনিক প্লেগ” প্রায় ২০ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিল। ইউরোপের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেকের মৃত্যুর জন্য দায়ী এ মহামারীর বিস্তারকাল ছিল ৭ বছর (১৩৪৬ থেকে ১৩৫২)। বিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক মহামারী “স্পেনিশ ফ্লু”তে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ কোটি এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৫ কোটির বেশি। এ মহামারীর স্থায়িত্বকাল মাত্র ০৩ বছর (১৯১৮-১৯২০)। টিকা এবং ওষুধ আবিষ্কার না হলেও বিউবোনিক প্লেগ বা স্পেনিশ ফ্লু  মহামারী অনন্তকাল টিকে থাকতে পারেনি। ব্যাপক সংক্রমণের কারণে জনগণের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি (Herd Immunity) মহামারীকে টিকতে দেয়নি। বিউবোনিক প্লেগ রোগের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী টিকা তৈরী হয়েছে মহামারীর ৫৫০ বছর পরে ১৮৯৭ সালে। আর স্পেনিশ ফ্লু সংশ্লিষ্ট ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টিকা তৈরী হয়েছে ১৯৩৮ সালে, অর্থাৎ মহামারীর শেষ হবার ২০ বছর পরে। কোন মহামারী চলাকালে সে রোগের টিকা ও নিরাময়ের ওষুধ আবিষ্কারের নজির কোন কালেই ছিলনা। কিন্তু কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে টিকা ও ওষুধ দুটোই আবিষ্কার হয়েছে মহামারী চলাকালে, তাও আবার মহামারীর এক বছরের মধ্যে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি এবং টিকা উদ্ভাবনের পরিবর্তিত কৌশল সবকিছু বদলে দিয়েছে। কাজেই, রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের এ উন্নয়নের যুগে বৈশ্বিক মহামারি আরো দীর্ঘ সময় তান্ডব চালাবে, তা ধরে নেয়ার কোন কারণ নেই। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন হতে পারে সে ক্ষেত্রেু  আশার আলো।

যদিও ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক গুণ বেশী। ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর শরীরের এন্টিবডি বা পূর্বে করোনার অন্য ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে সৃষ্ট এন্টিবডি এড়িয়ে ওমিক্রনের পুনরায় দ্রুত সংক্রমণ করার ক্ষমতা আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এজন্য ওমিক্রনকে “উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট (Variant of Concern)” হিসেবে ঘোষণা করেছে। ভাইরাস পূর্ণাঙ্গ প্রাণ নয় বলে জীবজগত ও উদ্ভিদ জগতের প্রচলিত বংশ বিস্তার পদ্ধতি অনুসরণে কোন ভাইরাস বংশবিস্তার করতে পারে না। সংশ্লিষ্ট প্রাণের দেহকোষে সংযুক্ত হয়ে দ্রুত গতিতে প্রতিলিপি তৈরী করেই বংশবিস্তার করে। আর প্রতিলিপি তৈরীর সময় প্রতিনিয়ত অবয়বে পরিবর্তন ঘটে ও ঘটায়। একে বলা হয় মিউটেশন। যেসব মিউটেশনে মুল ভাইরাসের আলাদা বৈশিষ্ট্য তৈরী হয় এবং বংশ বৃদ্ধি করে তাকে টিকে থাকতে সাহায্য করে, তাকে ঐ ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট বলা হয়। করোনা প্রজাতির বর্তমান সার্স কভ-২ ভাইরাসেরও মিউটেশন হয়েছে হাজার হাজার। কিন্তু টিকে থাকার ক্ষমতা থাকায় ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে নাম দেওয়া হয়েছে মাত্র ১২টির। ওমিক্রন এর মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন। সংক্রমণের তীব্রতার কারণে খুব দ্রুতই ওমিক্রন উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে নাম পেয়েছে। সংক্রমণ ক্ষমতা, তীব্রতা ও মারণঘাতী বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার বর্তমান প্রজাতির ৪টি ভ্যারিয়েন্টকে “উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট” ঘোষণা করেছে। এগুলো হচ্ছে বেটা (প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় সনাক্তকৃত), গামা (ব্রাজিলে সনাক্তকৃত), ডেল্টা (ভারতে সনাক্তকৃত) এবং ওমিক্রন (দক্ষিণ আফ্রিকায় সনাক্তকৃত)।

ওমিক্রনের গায়ের স্পাইক বা কাঁটায় মিউটেশন বা পরিবর্তনের সংখ্যা অনেক বেশি এবং এসব স্পাইকের প্রয়োজনে আঁকা বাঁকা হয়ে জীব দেহকোষে সংযুক্ত হয়ে সংক্রমণ করার ক্ষমতাও অনেক বেশি। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসতন্ত্রে প্রথম ২৪ ঘন্টায় ওমিক্রন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি বংশবিস্তার বা প্রতিলিপি তৈরী করতে পারে। দেহকোষে অনুপ্রবেশের পরে কোভিড-১৯ রোগ সৃষ্টিতে এ ভ্যারিয়েন্টের সুপ্তিকাল অনেক কম, গড়ে মাত্র ০৩ দিন। অর্থাৎ সংক্রমণের ৩ দিনের মধ্যে কোভিড রোগের উপসর্গ তৈরী করতে পারে। এ ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তির উপসর্গ অনেক কম। সর্দি, শুকনা কাশি, মাথা ব্যথা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে একটু গায়ে ব্যথা বা মাথা ধরা, যেগুলো সাধারণ সর্দি জ্বরেও হয়। কাজেই, গন্ধ না পাওয়া বা স্বাদ না পাওয়া- এসব ভিন্ন মাত্রার উপসর্গ নেই। লন্ডনের ইম্পোরিয়াল কলেজের গবেষকগণের মতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ওমিক্রনের পুন:সংক্রমণের ক্ষমতা ৫.৪ গুণ বেশি। সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি এবং এন্টিবডি এড়িয়ে পুন:সংক্রমণ ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি হওয়ায় ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে ঝড়ের গতিতে। নভেম্বর/২০২১ এর প্রথম দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রনের সংক্রমণ সনাক্ত হয়। ঝড়ের গতির সংক্রমণের কারণে সে দেশে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সংক্রমণের ২২% এবং ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সংক্রমণের ১০০% দখল করে। মাত্র এক মাসের মধ্যে মারণঘাতী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেশছাড়া।

উন্নত দেশসমূহেও ওমিক্রনের সংক্রমণ ঘটছে দ্রুত গতিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ ডিসেম্বর/২০২১ তারিখে প্রথম ওমিক্রন সংক্রমণ সনাক্ত হয়। সেই ডিসেম্বরের মধ্যেই ঐ দেশে ৫৯% সংক্রমণের জন্য দায়ী ওমিক্রন। ৪ জানুয়ারি (২০২২) তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫,১২,০০০ কোভিড রোগী সনাক্ত হয়েছে। এ মহামারিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি কোন দেশ নেই। কিন্তু একদিন ৫ লক্ষের বেশি আক্রান্তের ঘটনা সে দেশেও এ মহামারীকালে পূর্বে ঘটেনি। কিন্তু দ্রুত সংক্রমণ ক্ষমতা থাকায় ওমিক্রন সে ঘটনাই ঘটিয়েছে। ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানী, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ডেনমার্কসহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে ঝড়ের গতিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের এসব দেশে টিকা গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু তারা মোটেই ছাড় পায়নি। ছাড় পায়নি তরুণ প্রজন্মও। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের এ ঝড়ের গতির সংক্রমণে তাহলে আশার আলো কোথায়?

ওমিক্রন সংক্রমণের শুরুর দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ১০০% সংক্রমণ ওমিক্রনের দখলে। অত্যন্ত মারণঘাতী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সেখানে জায়গা হারিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে- ওমিক্রন কম মারণঘাতী এবং ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হবার সংখ্যা অনেক কম। এ গবেষণা প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে- ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মারাত্নক জটিলতায় ভোগার আশঙ্কা ৭০% এর কম। ডেল্টা ও অন্য ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীদের চেয়ে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা ৮০% কম বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। এ মারাত্নক সংক্রমণ ক্ষমতার দাপট নিয়ে ওমিক্রন আমাদের প্রায় দোড়গোড়ায়। ইতোমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলতে যাওয়া ক্রিকেটারের মাধ্যমে ওমিক্রন এ দেশে অনুপ্রবেশ করেছে। প্রতিবেশি দেশ ভারতে তান্ডব সৃষ্টি করে তৃতীয় ঢেউ সৃষ্টি করেছে। ভারতে একদিন সনাক্ত এক লক্ষের কাছাকাছি পৌঁছেছে। দিল্লীর স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে দিল্লীতে সংক্রমণের ৮৪% ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দখল করেছে। আমরাও ওমিক্রন সংক্রমণের একটা বড় ঢেউয়ের আতঙ্কে আছি।

এতসব আতঙ্কের মধ্যে আশার আলো হচ্ছে- ওমিক্রনের ঝড়ের গতির সংক্রমণের কারণে মারণঘাতী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টও অতি দ্রুত জায়গা হারাচ্ছে। ব্যাপক সংক্রমণের কারণে সংক্রমিত মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (Herd Immunity) তৈরী হচ্ছে। দেশে টিকা প্রদানের কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। ওমিক্রন আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এবং রোগের তীব্রতা সৃষ্টির আশঙ্কা অনেক কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ (ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেসন) করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী কয়েকটি ওষুধের অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশও এ ওষুধ উৎপাদন শুরু করেছে। ইতোমধ্যে এ বৈশ্বিক মহামারীর ০২ বছর পূর্ণ হয়েছে। দিগন্তে এটাই আশার আলো প্রজ্জ্বলিত করছে। কাজেই, এ বৈশ্বিক মহামারী সাধারণ সর্দি-জ্বরের মত কম মারণঘাতী আঞ্চলিক (endemic) রোগ হিসেবে রূপান্তরে খুব বেশি সময় হয়তো লাগবে না। কিন্তু ততদিনে নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার করা এবং বিদ্যমান সংক্রমণ প্রতিরোধী অন্যান্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। সর্বোপরি ভবিষ্যতের প্রয়োজনে আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিদ্যমান ব্যবস্থাকে আরো গতিশীল করার কথা বিবেচনায় আনতে হবে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭