ইনসাইড থট

গুলশান হামলা: লক্ষ্য ছিল সামাজিক হিংসার বিস্তার ঘটানো

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 05/12/2017


Thumbnail

চলতি ডিসেম্বরেই হলি আর্টিসান মামলার চার্জশিট দেয়া হবে। এমনটা জানিয়েছে পুলিশ। মামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িতরা কেউ জীবিত নেই। ঘটনাস্থলেই তাঁদের মৃত্যু হয়ছে। তবে ঘটনার পরিকল্পনা ও সহযোগিতায় যারা ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের অনেকে পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে মারা গেছেন। এ মুহূর্তে চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। কে বা কারা এর আসল মদদদাতা, তা জানতে আগ্রহী সাধারণ মানুষ।

গত বছরের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় জঙ্গিরা। হামলায় দেশি-বিদেশি ২০ জনসহ দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। নিহতদের মধ্যে নয়জন ইতালির, সাতজন জাপানি ও একজন ভারতের নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশি। নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন- ডিএমপি গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন। ওই রাতেই ইসলামিক স্টেট (আইএস) হামলার দায় স্বীকার করে।

ঘটনার দেড় বছর পর চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে। এটি এমন এক ঘটনা যা বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। যে বাংলাদেশ আমরা আবহমান কাল থেকে দেখে আসছি, যে বাংলাদেশের জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি, ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, সেই বাংলাদেশে অনেক রক্ত ঝরেছে ঠিক, কিন্তু এই গুলশান হামলা ছিল সব ঘটনার চেয়ে আলাদা।

এই উদার বাংলাদেশকে বারবার সাম্প্রদায়িক করার চেষ্টা করেছে রাজনীতি, যার চূড়ান্ত আঘাত ছিল হলি আর্টিজানে হামলা। উদ্দেশ্য ছিল, এদেশকে পাকিস্তানের দর্শনে ছেয়ে ফেলা। হামলাকারীরা মারা গেলেও সফল হয়েছেন অন্যভাবে। সেই হামলার পর সমাজ যেন আরও বিভাজিত ও কলুসিত হয়েছে। ধর্মীয় রাজনীতির বিষে আক্রান্ত সমাজ।

গুলশান হামলার পর জঙ্গি ও সন্ত্রাসি খতমে বড় সাফল্য দেখিয়েছে আমাদের আইনশৃংখলা বাহিনী। কোথায় জাতীয় ঐক্য দেখবো আমরা, তা নয়, বরং এই সাফ্যলকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেছে আমাদের এখানে সদা ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসী সরকার বিরোধী রাজনীতি। বিরোধিতার প্রচলিত ছকের বাইরে গিয়ে রাজনীতি করতে না শেখায় আমাদের রাজনীতিকরা দেশের ভেতরেই নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিনাশকারী শক্তিগুলির মাঝে নিজেদের ঠিকানা খুঁজছে। কোন সন্দেহ নেই, সেই সন্ত্রাসীরা কারো না কারো মদদে এই কাজ করেছে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক যে সহিংস রাজনীতি এই বাংলাদেশ অতীতে দেখেছে তার সঙ্গে বর্তমানের পার্থক্য অনেক। স্বাধীনতা বিরোধী জামাত-শিবির চক্রের রাজনীতি সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি মানুষের কাছে। তাই এবার নতুন কৌশল - অরাজনৈতিক শক্তির নামে হেফাজতে ইসলাম নামে এক অন্ধকারের শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে, যা আজ প্রগতির বাংলাদেশের প্রধান অন্তরায়।

যারা স্বাধীনতার চেতনার পক্ষে রাজনীতি করেন, এখন তাঁদের এক জায়গায় আসা প্রয়োজন, তাঁদের মূল্যায়ন করা দরকার, নতুন এই সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি রণনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানে প্রচলিত ধারার রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তন কি করে সূচিত হবে তা নিয়ে।

বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহুত্ববাদী। কিন্তু ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি তা নয়। সংকীর্ণ ধর্মীয় আধিপত্য আসলে সমাজকে অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তারের ষড়যন্ত্র। ধর্ম দিয়ে ভাবনা জগতে সংকীর্ণতা প্রবেশ করিয়ে দেয়া- ‘আমরা’ আর ‘ওরা’। এটাই সাম্প্রদায়িকতা। চিরাচরিত রাজনীতির পালাবদল ঘটে স্বাভাবিকভাবে। একদল জেতে, আরেক দল হারে। শাসক দলের বিরুদ্ধে বিরোধীরা আন্দোলনে মুখর হতো, সে আন্দোলনে সংঘর্ষ হতো। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর, এই বিচারকাজ ঠেকাতে যে সহিংসতা দেখেছে মানুষ, দিনের পর দিন পেট্রল বোমা দিয়ে মানুষ ও তার সম্পদ পুড়িয়ে দেয়া, তার নজির পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এই জঙ্গি আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এখনকার সংস্কৃতি বিরোধি রাজনীতি, যে রাজনীতি ভাড়া করা আধা-বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে সুচতুরভাবে সামাজিক হিংসার বিস্তার ঘটানো। ধারাবাহিক হিংসাশ্রয়ী এই রাজনীতিই গুলশান হামলার পর বাংলাদেশের সামনে নতুন রাজনীতি যাদের ফাঁদে পা দিয়েছে সাধারণ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক গোষ্ঠী।

গুলশান হামলার অন্যতম লক্ষ্য রাজনৈতিক সহিংসতা আমদানির পাশাপাশি শিল্প ও বাণিজ্যকে বিদায় জানানো। তাঁরা চেয়েছিলেন, প্রগতির পথ, উন্নয়নের পথ যেন থেমে যায়। তাইতো হয়েছিল কিছুটা। একের পর এক আঘাত এসেছিল ব্যবসা বাণিজ্যে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আবার জোর কদমে চলেছে উন্নয়নের চাকা। এতো রক্ত, হিংসা আর আগুনের পরও সাত শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি, মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন।

এ কথা সত্য, যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে সংঘাত ও হিংসা পুরোপুরি দূর করা যায় না। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়, এসব নানা ভাবে সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব দ্বন্দ্ব নিরসন করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে চলতে হয় বহুপাক্ষিক পথে। কোন গোষ্ঠী, ধর্মীয় বা অন্যকোন সংখ্যাতত্বের জোরে যেন নিরঙ্কুশ সুবিধা ভোগ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। যারা বারবার ধর্মীয় সংখ্যার আধিক্য দিয়ে সব সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর চাপাতে চায়, রাষ্ট্র থেকে আদায় করতে চায়, তাদের সেই মনোভাবের মধ্যেই আছে সহিংসতার সবথেকে বড় সম্ভাবনাময় উৎস।

গুলশান হামলার পর এটাই চ্যালেঞ্জ বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সামনে। দুর্ভাগ্যজনক যে, এই ক্ষুদ্র মানসিকতার গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে বাকি সবাইও ধারণ করতে চায় সেই ক্ষুদ্র পরিচয়। ফলে বুঝে না বুঝে, ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীও সহিংসতা ও ঘৃণাকে রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলছে। বিপদটা এখানেই।

ধর্মীয় সংকীর্ণতায় মুক্তি নেই বাংলাদেশের। বাংলাদেশের মুক্তি অসাম্প্রদায়িক পথে। সহিংসতার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতেই হবে আমাদের। ‘যাকে তাঁকে যখন তখন মুরতাদ, নাস্তিক যারা বলে তারা দেশ বিরোধী’, এই মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে সবার আগে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে এটাই হোক নতুন অঙ্গীকার। বাংলাদেশকে সব মানুষের বাসযোগ্য করতে ইচ্ছে জাগতে হবে মনে। আফগানিস্তান, সিরিয়া, পাকিস্তানের পথে দেশকে যারা নিয়ে যেতে চায় তাঁদের সঙ্গে আর রাজনীতি নয়, এটাই হোক প্রত্যয়। উদার ও সহনশীল মনোভাবসম্পন্ন মানুষের আবাসভূমি হিসেবে বাংলাদেশের যে সুনাম ও মর্যাদা ছিল, জঙ্গিদের অপতৎপরতার কারণে তার অনেকটাই ম্লান হয়েছে। দেশ থেকে জঙ্গিবাদ ও তাদের দোসর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠিকে নির্মূলে মানুষের ঐক্য আজ সময়ের দাবি। ধ্বংস, খুন ও বিশৃংখলার মাধ্যমে যারা ধর্ম কায়েমের চেষ্টা করছে, সমাজকে কলুসিত করছেন সে পথ আদতে ইসলামের পথ নয়, সে কথাও জোরের সঙ্গে বলার সময় এখন, এই বদলে যাওয়া বাংলাদেশে।

দুই কারণে হলি আর্টিসানে এই হামলা হয়েছিল। প্রথমত, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দৃষ্টি আর্কষণ এবং দ্বিতীয়ত সরকারকে বিপদগ্রস্ত করা। সরকারকে বিপদে ফেললে কারা লাভবান হয়? আমার মনে হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশোধ নিতেই এই হামলা হয়েছে। জাতি অপেক্ষায় আছে এই মামলার পরিণতি দেখার জন্য।


বাংলা ইনসাইডার/টিবি



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭