ইনসাইড থট

নারায়ণগঞ্জের এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণ


প্রকাশ: 14/01/2022


Thumbnail

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের খাস কামাল কাটি গ্রামের আনুমানিক ৭-৮ বছরের ডানপিটে কিশোর মোঃ মেজবাহুল হক বাচ্চু সাহেবের স্মৃতিচারণ। 

‘‘২৬ মার্চ এর কালো রাতে ঢাকা আক্রান্ত যখন হইল, তারপরের দিন থেকেই আমাদের গ্রামের সামনের রাস্তা দিয়া  নারী-পুরুষ-শিশু ঢাকা থেকে বের হয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে যাইতেছিল। আমরা তখন ঐ অসহায় মানুষদের হেল্প করার জন্য মুরব্বীদের নির্দেশে রাস্তার পাশে পানির কলস, মুড়ি নিয়ে বসে থাকতাম তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য, ডাইকা ডাইকা খাওয়াইতাম। আবার অনেক সময় তাদের সাথে থাকা লাগেজ, ব্যাগ ইত্যাদি মাথায় করে নিয়া যাইয়া গুদারাঘাট অর্থাৎ আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে নিয়ে গিয়ে আসতাম। বেশ কয়েকদিন এভাবে কাজ করেছি। 

তারপর মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হইল। সেসময় একটু ডানপিটে ছিলাম। আমরা কিছু ছেলেপেলে এক সাথে হয়ে কলাগাছের ছোট চারা দিয়ে কেটে রাইফেল বানাইয়া (ক্ষেতের) উচা আইল সামনে রেখে পজিশন নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে এগুলো করতাম। 

মুক্তিযোদ্ধাদ্বারা তখন আমাদের গ্রামের সামনের ঐ রাস্তা দিয়েই যাইতেন। আমরা তখন তাদের রাইফেল, গুলির বাতিল অনেক সময় তাদের সাথে থাকা ব্যাগ ও বিভিন্ন মালসামানা আমরা মাথায় করে এগিয়ে দিয়ে আসতাম অনেক দূর পর্যন্ত।

আজকে আমাদের পূর্বাচল উপশহর হইতাছে। এই পূর্বাচল উপশহরটি ছিল একটি ব্যাকওয়ার্ড জায়গা, টেক টিলা জংগল। এই উপশহরের মাঝখানে একটা জায়গা ছিল, বলতো ‘ধামচির গজারী গড়‘। এখানে বিশাল বড় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা যেখানেই যাইতেন, এই গড়ে চলে আসতেন। আমরা তাদের জিনিসপত্র আগাইয়া দিয়া যাইতাম। 

আমাদের বাড়ির সামনে দিয়া শাতলশীতলক্ষ্যা নদী বইয়া গেছে। অনেক সময় আমি দেখেছি মুক্তিযোদ্ধারা নদী পার হইয়া, সাতরাইয়া পার হইয়া এই পারে চলে আসতো। পাক হানাদার আমাদের এই পারের চেয়ে ঐ পারেই অর্থাৎ ডাঙ্গা বাজার, আতলাপুর বাজার, ঐ সমস্ত এলাকায়ই তারা আসতো, হানা দিতে। আর সব সময়তো এই শীতলক্ষ্যা নদী দিয়া তারা গানবোট দিয়া তারা চইলা যাইতে। যাইহোক মুক্তিযোদ্ধাদের ...... অনেক সময় আগাইয়া দিতাম। আর আমার আব্বার সাথে থেকে গ্রাম থেকে চাল, ডাউল, মরিচ, পিয়াজ এইগুলি উঠাইতো আমার আব্বা ও সাথে থাকা লোকজন। আমি সাথে যাইতাম। মরিচের ব্যাগটাতো হালকা, মরিচের ব্যাগটা আমার কাছে দিত। প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি যাইয়া এগুলি উঠাইতাম। উঠাইয়া আমার আব্বা ও অন্য লোকজন তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে দিয়া আসতো। 

আমার হৃদয় বিচারক স্মৃতি আজও মনে পড়ে। আমার এক মামা, আমার মা‘র আপন মামাতো ভাই, দুইটা ভাই। ছোট বেলাযই তাদের বাপ মারা যায়। আমার নানি তাদেরকে লালনপালন করে। ৭১‘এ একজনের বয়স ২৪ বছর, আরেকজনের বয়স ২২ বছর। একজনের নাম আব্দুস সালাম, আরেকজনের নাম আব্দুল আজিজ। দুই ভাইই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আমার নানীকে না বলে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। তখন ছোট মামা, আজি মামা, দীর্ঘ দিন মা‘কে দেখে না। তখন নদী পার হইয়া, নৌকা দিয়া নদী পার হইয়া মায়েরে দেখার জন্য আসছিল, প্রায় ৭ মাস পর। নদীর পারটা ছিল খাড়া। নৌকা থেকে নাইমা নদীর পাড়ের উপরে উঠছে, তখন দেখে আর্মি, আর্মির সামনে পরে। এটা ছিল কালীগঞ্জে। আমার পার্শ্ববর্তী থানা কালীগঞ্জ। তখন সেনাবাহিনীর লোকজনদের দেখাইয়া দেয় রাজাকারেরা। এইডাই আব্দুল আজিজ মুক্তিযোদ্ধা। সেনাবাহিনী ধইরা নিয়া যায়। আমার নানি পিছনে পিছনে পশ্চিমা সেনাদের পায়ে ধরছে, বাবা ডাকছে। সৈন্যরা লাথ্থি দিয়া ফালাইয়া দিছে। তাই আমার মামা বলতেছিল, ‘মা, কুত্তাদের পায়ে ধরিস না‘। ঐ যে আমার মামাকে নিয়া গেল আর পাওয়া যায় নাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কালীগঞ্জ থানা থেকে তার জামাকাপড় গুলি পাওয়া গেল।

তারপর আরেক আত্মীয়, ফুফাতো বোনের জামাই, দুলাভাইও মুক্তিযোদ্ধা ছিল। উনার বাড়ী ছিল ডাঙ্গা, ডাঙ্গা বাজারের সাথে। ডাঙ্গা বাজার যখন আক্রান্ত হইল, পশ্চিমা সেনাবাহিনী ডাঙ্গা বাজারে আগুন দিল। অনেক বড় বাজার ছিল। পলাশ থানার ডাঙ্গা বাজার। আগুন দিল। তখন আমার দুলাভাইসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়ে দুরের থেকে আইলো, আইসা, ধান ক্ষেতের মধ্যে পজিশন নিয়া বইসা গেলো যে, পশ্চিমা সেনাবাহিনীরা যখন নদীর পাড়ে আসবে, বাজার থেকে নদীর পাড়ে আসবে স্পিড বোট বা লঞ্চে উঠার জন্য, তখন গুলি করবে। কিন্তু সেনাবাহিনীর লোকজন তাদের লঞ্চে না উঠে পিছনের দিক থেকে, ধান ক্ষেতে যারা আশ্রয় নিয়েছিল, ধান ক্ষেতের মধ্যে ব্রাশ ফায়ার মেরে তাদের হত্যা করেছিল। অনেক লোক মারা গেছিল। 

আমরা অনেক সময় দেখতাম নদীর মধ্যে একসাথে দুইটা বা চারটা লাশ বাঁধা, ফুইলা ভাইসা ভাইসা যাইতাছে। আর আমাদের সামনে দিয়া যে শীতলক্ষ্যা নদী ...চইলা গেছে, সেই পলাশ, কাপাসিয়া হইয়া ময়মনসিংহের টোক‘এ যাইয়া মিলছে ব্রক্ষ্মপুত্রের সাথে। এই শীতলক্ষ্যা নদী দিয়া গানবোটে প্রত্যেক দিন যাইতো, আমার বাড়ীর সামনে আইসা ফাঁকা গুলি করতো। সেগুলো স্মৃতিতে আজও ভাইসা উঠে। এবং এগুলি মনে হইলে গর্ববোধ করি যে , কিছু হইলেও সেই স্বাধীনতার জন্য অল্প বয়সে করতে পারছি‘‘।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭