মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের রেশ কাটতে না কাটতেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। তারা বলেছে যে, মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে বাংলাদেশের কোন ব্যবস্থা গ্রহণের ইচ্ছাই নেই। এই প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এর আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই প্রতিবেদনটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, এখন গুম নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলার একটা কৌশল প্রকাশ্য রূপ ধারণ করেছে। দেশে সুশীল সমাজের একটি অংশ এবং বিদেশে লবিস্ট, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে গুমের বিষয়টিকে সামনে এনে সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, এমন একটি প্রচারণা এখন দৃশ্যমান। এই প্রচারণার মূল লক্ষ্য হলো, সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং আগামী নির্বাচনে আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করা। বিশেষ করে বিএনপি এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দল যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছে সেই দাবিটিকে সামনে আনার জন্যই গুম নাটক সাজানো হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয় ইত্যাদি প্রচার করতে পারলে আগামী নির্বাচনে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হতে পারে। ইতিমধ্যে এরকম একটি দাবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের কাছে দেয়া হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
যখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুম নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে তখন বাংলাদেশেও সুশীল সমাজ নিয়ন্ত্রিত একটি দৈনিকে গুম ব্যক্তিদের বাড়ি যাচ্ছে পুলিশ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে তাদের স্বজনদের জেরা ও চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে, কাউকে কাউকে থানায় ডেকে পাঠানো এবং ক্ষেত্র বিশেষে সাদা কাগজে সই দিতে চাপ দেওয়ার অভিযোগও তুলেছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। আর এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই ‘মায়ের ডাক’ ও আইন সালিশ কেন্দ্র পৃথক পৃথক বিবৃতি দিয়েছে।
লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচারিত হয় সেই ঘটনাগুলো উৎসভূমি হলো বাংলাদেশই। প্রথমে সুশীল সমাজ নিয়ন্ত্রিত জাতীয় একটি বাংলা এবং ইংরেজি দৈনিকে এ সংক্রান্ত খবরগুলো প্রকাশিত হয়। এর পরপরই এই প্রতিবেদনের আলোকে দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিবৃতি দেয় এবং এই বিবৃতির পরপরই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন সেটি লুফে নেয় এবং সেটি বিভিন্ন দেশের প্রদান করে।
বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে ৮৭ জন গুম হয়েছে, এই ৮৭ জন্যের একটি তালিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সরকারের কাছে দিয়েছে। কিন্তু সরকারের কোন কোন মহলের অদক্ষতা, দায়িত্বহীনতা এবং অনাগ্রহের কারণে এর জবাব দেওয়া হয়নি। এর মাত্র ৭ জনকে জবাব দেওয়া হয়েছে। এখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুম হওয়া ব্যক্তিদের সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য তাঁদের বাড়িতে যাচ্ছেন এবং এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করার কাজটা করছেন যেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই সংক্রান্ত সঠিক তথ্য দেয়া হয়। বাংলাদেশে যাদেরকে গুম বলা হচ্ছে তারা আসলে নিখোঁজ এবং বিভিন্ন কারণেই মানুষ নিখোঁজ হয়। শুধু বাংলাদেশে নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছিল। বাংলাদেশের কোন ব্যক্তি নিখোঁজ হলে তাকে গুম বলে প্রচারিত করা একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই নিখোঁজ ব্যক্তিরা নানা কারণে নিখোঁজ হন।
বাংলাদেশে মোটদাগে পাঁচটি কারণে মানুষ নিখোঁজ হন। প্রথমত, দায়-দেনা পরিশোধে অক্ষমতার কারণে আত্মগোপন করেন এবং নিখোঁজ হন। দ্বিতীয়ত, প্রতিপক্ষের মামলা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এড়ানোর জন্য নিখোঁজ হন। তৃতীয়ত, জঙ্গিবাদ বা কোন সংগঠনে যোগদানের জন্য নিখোঁজ হন। চতুর্থত, অভিবাসী হওয়ার জন্য নিখোঁজ হন। পঞ্চমত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তারা আটক হন। কিন্তু যেকোনো নিখোঁজই গুম বলে প্রচারের যে প্রবণতায় সে প্রবণতা বাংলাদেশের ওপর একটি চাপ সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন, তথ্য অধিকার কমিশন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না বলেই পরিস্থিতি ক্রমশ নেতিবাচক হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত এবং সঙ্ঘবদ্ধ প্রচারণা। দেশের একটি গোষ্ঠী এই প্রচারণার মূল নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।