ইনসাইড থট

হারিছ চৌধুরীর নীরব মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন!


প্রকাশ: 18/01/2022


Thumbnail

চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে দোর্দণ্ড প্রতাপশালীদের একজন ছিলেন আবদুল হারিছ চৌধুরী। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হলেও খালেদা জিয়া তাকে তার বিশেষ সহকারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। আর ফিরে তাকাতে হয় নি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হন। তিনি এতটাই ক্ষমতাধর ছিলেন যে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজ বাড়িতে ডাকঘর, স্কুল, পুলিশ ক্যাম্প ও ব্যাংকের শাখা বসিয়েছিলেন। সেখানে গড়ে তুলছিলেন ব্যক্তিগত মিনি চিড়িয়াখানা। আয়ের বৈধ কোনো উৎস না থাকলেও রাতারাতি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যান হারিছ চৌধুরী। তার কানাইঘাটের বাড়িকে বলা হতো সিলেটের ‘হাওয়া ভবন’।  ১/১১ এর পট পরিবর্তনের পর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ঝটিকা অভিযান শুরু হলে আত্মগোপনে চলে যান হারিছ চৌধুরী। আড়ালে চলে গেলেও গণমাধ্যমে একের পর এক তার দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। সম্প্রতি জানা গেল তিনি তিন মাস আগে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেছেন। 

হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর সংবাদটি অবিশ্বাস্য মনে হলেও হারিছ চৌধুরীর কন্যা ও লন্ডন বিএনপির শীর্ষ নেতারা খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। প্রমাণ হয়েছে - ইন্টারপোলের রেড নোটিশে থাকা কেউ চাইলে আত্মগোপনে থাকতে পারে। তিনি কবে, কিভাবে দেশ ছাড়লেন, কোথায় ছিলেন, কি করেছেন, কবে ও কিভাবে দেশে এলেন - এমন অনেক প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু এ রহস্যকে ছাড়িয়ে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে -  বিএনপির গুম দাবি করা ব্যক্তিদের সন্ধানও কি একদিন এভাবে পাওয়া যাবে?


২০১৫ সালের ১০ মার্চ ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন  বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। দু'মাস পর ১১ মে মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে 'উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরাফেরা' করার সময় তাকে আটক করে শিলং পুলিশ। তার নামে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা হয়। বলা হয়েছিল, গোয়েন্দা পরিচয়ে তাকে তার উত্তরার বাসা থেকে তুলে একটি প্রাইভেট কারে শিলং নেওয়া হয়েছে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে নিয়ে ছেড়ে দেয়ার দাবি হাস্যকর ও অবাস্তব একটি বিষয়। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হারিছ চৌধুরী ছিলেন আলোচিত/সমালোচিত একজন ব্যক্তি। বিএনপির শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও তখনকার পাওয়ার হাউস হিসেবে পরিচিত  "হাওয়া ভবন" - উভয় স্থানেই অবাধ বিচরণ ছিল তার। এছাড়া মোসাদ্দেক আলী ফালুর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় যৌথ ব্যবসা রয়েছে বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়। হারিছের বিরুদ্ধে ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও শাহএএমএস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা রয়েছে। এছাড়া দুদকের দুর্নীতি মামলা ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তার যথাক্রমে তিন ও সাতবছরের জেল ও দশ লাখ টাকা জরিমানা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছেন আদালত। ২০১৮ সালে ইন্টারপোলে তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ ইস্যু হয়। কিন্তু তিনি সফলভাবেই গা ঢাকা দিয়ে থাকতে সক্ষম হন। 

জানা যায়, ২০০৭ সালে ২৯ জানুয়ারি সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতের করিমগঞ্জে পাড়ি জমান হারিছ চৌধুরী। সেখান থেকে পাকিস্তান হয়ে ইরানে তার ভাই আবদুল মুকিত চৌধুরীর কাছে যান। ইরানে থেকে তিনি যুক্তরাজ্যে যান এবং যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা নেন বলেও গণমাধ্যমের সূত্রে জানা যায়। এর আগে যুদ্ধাপরাধী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ভারত হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া বিদেশে এসাইলামের জন্য পিনাকী ভট্টাচার্য নামের এক ইউটিউবার নাটক করে মিয়ানমার হয়ে ফ্রান্সে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। তাই ধারণা করা অস্বাভাবিক নয় যে - ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তে চোরাচালানে জড়িত কোনো সিন্ডিকেট হয়তো তাদেরকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে।

খবরে জানা যায়, নিখোঁজের ৯ বছর পর বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীকে নিয়ে মন্তব্য করে দলের বিরাগভাজন হয়েছিলেন বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস। তিনি ইলিয়াস আলীর ‘গুমের’ পেছনে দলের ভেতরে থাকা কয়েকজন নেতাকে দায়ী করেন। 
 
গুম অবশ্যই নিন্দনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত একটি বিষয়। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতেও যে গুম নাটক হতে পারে তার নজির রয়েছে। ছাত্র অধিকার পরিষদ নেতা তারেককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেই সংগঠনের নেতাকর্মীরাই আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করে লুকিয়ে থাকার তথ্য ফাঁস করে। বিএনপির পক্ষ থেকে গত ১২ বছরে প্রায় ছয়শ নেতাকর্মীকে গুম করার অভিযোগ তোলা হয়েছে। কিন্তু তথ্য পাওয়া যায় ৮৭ জনের। এদের মধ্যে কতজন ব্যক্তিগত কোন্দলের শিকার, কতজন স্বেচ্ছায় গা ঢাকা দিয়ে আছে - কে জানে! যেমন: একজন কাপড় বিক্রেতাকে কোনো রাজনৈতিক দল কেন প্রতিপক্ষ করবে - তার বিশ্বাসযোগ্য জবাব খুঁজে পাই নি। ব্যক্তিগত কোন্দলকে রাজনৈতিক মেরুকরণ করে পরোক্ষভাবে বিচারের পথ বন্ধ করা হয়েছে কিনা তাও বিবেচনার দাবি রাখে। তবে যেহেতু গুম ইস্যুতে সরকারকে টার্গেট করে প্রচারণা চলে আসছে, তাই সরকারের উচিত এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে জনগণকে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করা এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরা ।

লেখক: রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭