ইনসাইড এডুকেশন

ভিসি নিয়ে যত বিতর্ক!


প্রকাশ: 22/01/2022


Thumbnail

ভাইস-চ্যান্সেলর (ভিসি) একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিভাবক। সর্বোচ্চ এই কর্তা যদি দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে আহমদ ছফা রচিত গাভী বিত্তান্তের ‘মিয়া মুহাম্মদ আবু জুনায়েদ’ হয়ে পড়েন, তখন স্বাভাবিক নিয়মে চলে না ওই বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তখন আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরদের নিয়ে চলেছে বিতর্ক। ভাইস-চ্যান্সেলরদের এইসব বিতর্কের ফলে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পিতৃতুল্য। বর্তমানে ভিসি অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ চলছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি)। উল্লেখযোগ্য বিতর্কিত কয়েকজন ভিসিকে নিয়েই আমাদের এই প্রতিবেদন।

১. বশেমুরবিপ্রবির সাবেক ভিসি খন্দকার নাসিরউদ্দিন: বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক এক শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়াসহ আরও কয়েকটি দাবি কর্তৃপক্ষ মেনে নিলেও নিয়োগে দুর্নীতি, ভর্তি দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. খন্দকার নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন তিনি।

২. বেরোবির সাবেক ভিসি কলিমুল্লাহ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে শুরু থেকেই নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ নিয়মিত ক্যাম্পাসে যেতেন না, অফিস করতে ঢাকা থেকে। তার বিরুদ্ধে নিজের লোকজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগও আছে। তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকরাও। ওই সময় উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে ৪০টিরও বেশি অভিযোগ ওঠে। এ অবস্থায় ইউজিসি অভিযোগগুলোর বিষয়ে তদন্তে নেমে সত্যতা পায় এবং ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ তখন সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন। এছাড়াও রাত ৩টায় শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস করিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। 

৩. রাবির সাবেক ভিসি ড. এম আব্দুস সোবহান: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহানকে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দুর্নীতির নানা অভিযোগে বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার পরিবর্তন করে নিজ মেয়ে ও জামাতাকে নিয়োগ, রাষ্ট্রপতিকে অসত্য তথ্য দিয়ে অবসরগ্রহণ, বিভিন্ন নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিসহ বিস্তর অভিযোগ মাথায় নিয়েই বিদায় নেন তিনি। মেয়াদের শেষ সময়ে এসেও বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স কমিটিতে অনিয়মের চেষ্টার অভিযোগে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা উপাচার্যের বাসভবন, প্রশাসনিক ভবন ও সিনেট ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়।

৪. জাবির ভিসি অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম: উন্নয়ন প্রকল্পে ছাত্রলীগকে দুই কোটি টাকা দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছিল উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে। যদিও তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ একপেশে ছিল এবং বিষয়টিকে প্রমাণ করা যায়নি। ফলে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করবেন না জানিয়ে উপাচার্য বলেছিলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্দেশ দিলে দায়িত্ব থেকে সরে যাবেন তিনি। সেই বিতর্ক কাটিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে বর্তমানে স্বপদে বহাল আছেন অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম।
 
৫. ঢাবির ভিসি ড. মো. আখতারুজ্জামান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নামেও আছে বিস্তর অভিযোগ। বিশেষ করে ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই তার কাছ থেকে ‘চিরকুটের মাধ্যমে’ ঢাবিতে ভর্তি হয়ে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেন ছাত্রলীগের ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান নেতা, এরকম একটি অভিযোগ ওঠেছিল। বিষয়টি গণমাধ্যমে আসলে আন্দোলন শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর পাশাপাশি ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্যানেল নির্বাচনেও উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। নীল দলের অভ্যন্তরে হওয়া ভোটের ফলাফল অনুযায়ী ভিসি প্যানেলে তিনজনের ক্রম ঠিক হওয়ার কথা থাকলেও তা মানেননি বর্তমান ভিসি। তিনি নিজের নাম সর্ব প্রথম দিয়েছেন। যদিও সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. মু. সামাদ সবার ওপরে থাকার কথা ছিল। এ নিয়ে নীল দলের শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল সেসময়। 

৬. চবির সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সাবেক ভিসি ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে তার অনুসারী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজনের পাশাপাশি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র এবং মামলার আসামিকেও নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি নিয়োগ বাণিজ্য, ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ হত্যার আসামিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং বঙ্গবন্ধু চেয়ার দখলসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি।
 
৭. ববি ভিসি অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক: বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক নিয়োগে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। এরপর ছাত্রদের কটূক্তি করে আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

৮. নোবিপ্রবি সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এম অহিদুজ্জামান: নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) সাবেক উপাচার্য এম অহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়ম করার অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়োগ স্থগিত রাখতে বললেও তা অমান্য করেই তার সময়ে বেশ কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর আগে, ২০১৬ সালে ইউজিসির একটি তদন্ত দল তদন্তে গেলে উপাচার্যপন্থী বলে পরিচিত কর্মকর্তা ও বহিরাগত যুবকদের মহড়ায় ভীত হয়ে তদন্ত দল ঢাকায় ফিরে আসতে হয়। যদিও এম. অহিদুজ্জামান আগে থেকেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।

৯. জবির সাবেক ভিসি মীজানুর রহমান: শিক্ষার্থীদের মেস ভাড়ার সংকট নিরসন প্রশ্নে বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) সাবেক উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান। এছাড়াও যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেও বিতর্কিত হয়েছিলেন তিনি। যদিও তিনি দুই মেয়াদে সফলতার সাথেই দায়িত্ব পালন করেছেন বলে মনে করেন অনেকেই।

১০. শাবিপ্রবি ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ: উপাচার্যদের বিতর্কের মিছিলে সর্বশেষ সংযোজন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ। হল প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনার সূত্র ধরে তার পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। অবশ্য শুধু হামলাই নয়, উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের বলে জানা যায়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের এখন একটাই দাবি, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগ। তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি, ক্যাম্পাসে কোনো অনুষ্ঠান করতে বাধা প্রদান, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কুমিল্লার লোকদের নিয়োগে প্রাধান্য, উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭