ইনসাইড থট

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ ও বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ


প্রকাশ: 27/01/2022


Thumbnail

স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে সরাসরি শোনানোর জন্য ‘শ্যামপুর-কদমতলী সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাব’ ১৪ জানুয়ারি, ২০২২ শ্যামপুর মডেল স্কুল এন্ড কলেজের সভাকক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘স্মৃতিচারণ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। মোট ৫৪জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সরাসরি স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে আরও কয়েকজন আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। তনমধ্যে দুটি আলোচনা এখানে উদ্ধৃত করছি। 

নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের খাস কামালকাটি গ্রামের অধিবাসী সাবেক ইপিআর  সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ উদ্দিন। তিনি স্বাধীনতার পর রক্ষীবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে রক্ষীবাহিনীর চাকুরী ছেড়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন। এরই মাঝে উনার স্ত্রী মারা যান। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, স্বাধীন বাংলাদেশে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা দু’কন্যা ও এক পুত্রসন্তান নিয়ে কর্মহীন জীবনযাপন করতে থাকেন। অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটতে থাকে। এক পর্যায়ে বিভিন্ন স্কুলের সামনে মুড়ির মোয়া, চকলেট, চানাচুরের প্যাকেট ইত্যাদি বাচ্চাদের খাবার বিক্রি করতে শুরু করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ উদ্দিন সাহেব অত্যন্ত পরহেজগার লোক ছিলেন। গ্রামের বিত্তশালীরা সাধ্যমত সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তিনি বলতেন, "আমি গরীব ঘরের ছেলে ছিলাম। দেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমি আমার পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছি‘। মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহ করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করতেন। একদিন ঢাকা পুরাতন বিমানবন্দরের কাছে একটি মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করে মসজিদেই শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। একটু তন্দ্রা এসে যায়। এই ফাঁকে সাথে থাকা ব্যাগটা খোয়া যায়। ব্যাগে ছিল মুক্তিযুদ্ধের কাগজপত্র, জেনারেল ওসমানীর চিঠি, রক্ষীবাহিনীতে চাকুরীর কাগজপত্র ইত্যাদি। সবকিছুই শেষ, মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহ করতে পারলোনা। তারপর দীর্ঘদিন তিনি মনমরা হয়ে থাকতেন। টাকার অভাবে ঢাকা গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাগজপত্র ঠিকও করতে পারেন না, ভাতাদিও উঠাতে পারে না, এমনকি রক্ষীবাহিনীর চাকুরীর সুবিধাদিও সংগ্রহ করতে পারেন না। টুকিটাকি যা আয় হয় তা দিয়ে নিজ হাতে রান্না করে ছেলেমেয়েদের খাওয়াতেন। এভাবেই অত্যন্ত দুঃখকষ্ট, অর্থকষ্ট অযত্নে অবহেলায় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবনযাপন করতেন। একদা নীরবে ইহলোক ত্যাগ করেন। 
আব্দুল মোতালেব নামে আরেক  মুক্তিযোদ্ধার কাহিনী উঠে আসে রূপগঞ্জের খাসকামালকাটি গ্রামের অধিবাসী মেজবাউল হক বাচ্চু সাহেবের আলোচনায়।

বাচ্চু সাহেবের নিজ গ্রাম খাসকামালকাটি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাপ্তাহিক হাট বসে। এই গ্রামের লোকজন নিয়মিত ঐ হাটে সওদা করে। ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে হবে, মাটিতে ছালা বিছায়ে বসে ঝাঁকায় করে হলুদ মরিচ পিয়াজ রসুন বিক্রি করতেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতালেব। যা বেচাকেনা হতো তা দিয়েই খুবই কষ্টে অনাহারে অর্ধাহারে জীবন যাপন করতেন। হঠাৎ একদিন উধাও। কোন খোঁজ নাই। প্রায় ৪-৫ মাস পর গ্রামে ফিরে এসে বাজারের একই স্থানে দাঁড়িয়ে মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে কাঁদছেন। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল খেয়ে পরে ভালই আছেন। সবার মনেই প্রশ্ন,  কান্না করছে কেন? তিনি বলছিলেন, ‘আমি ভাল আছি। ভাল বেতন পাই। ভাল খাবার খেতে পাই। কিন্তু তারপরও আমি কেন কাঁদছি? আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমি যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছি। দেশ স্বাধীন করেছি। সেই স্বাধীন দেশে আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে পেটের তাগিদে রাজাকার মাওলানা মান্নানের বাড়িতে দারোয়ানের চাকুরী করি। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে রাজাকার এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। এটাই আমার দুঃখ। সেই দুঃখে আমার বুক ফেটে কান্না আসছে’।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট কালো রাতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুদের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কতিপয় উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তার হাতে শাহাদাতবরণ করার পর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যাকাশে নেমে এসেছিল অন্ধকার। তাঁদের প্রতি শুরু হয়েছিল অবজ্ঞা আর অবহেলা। মুক্তিযোদ্ধারা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে ‘বীর’ শব্দ ব্যবহার বাধ্যতামূলক, মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি, চিকিৎসা সুবিধাসহ নানাবিধ কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। তনমধ্যে উল্লেখযোগ্য:

১। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পারিবারিক জীবনে আর্থিক সচ্ছলতার জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয় কর্মসূচির আওতায় জনপ্রতি মাসিক ১২,০০০/- টাকা হারে ১,৯২,৯৯৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
২। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনযাপন সুন্দর ও আনন্দময় করার লক্ষ্যে ২০২০-২১ অর্থ বছরে জনপ্রতি ১০,০০০/- টাকা করে ২টি উৎসব ভাতা, জনপ্রতি ২০০০/- টাকা হারে বাংলা নববর্ষ ভাতা ও জনপ্রতি ৫,০০০/- টাকা হারে বিজয় দিবস ভাতা ১,২০,৫২৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে প্রদান করা হয়েছে।

জুরাইন কবরস্থানে মৃত বীরমুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বিনা খরচে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এছাড়া বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস সহ বিভিন্ন দিবসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ নেন, কুশলাদি বিনিময় করেন।

দেশমাতৃকা শত্রুমুক্ত করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা স্বাধীনতা অর্জনে জীবন উৎসর্গকারী সেই বীর সেনানীদের সুন্দর সচ্ছল জীবনযাপন নিশ্চিত করেছেন।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭