ইনসাইড বাংলাদেশ

স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনে কতটা সহায়ক হবে নতুন আইন?


প্রকাশ: 30/01/2022


Thumbnail

দেশের রাজনৈতিক সচেতন মহলে এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় নির্বাচন কমিশন আইন। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে এই আইন। এই আইনের অধীনেই গঠিত হবে নতুন নির্বাচন কমিশন এবং এই কমিশনই আগামী জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করবে। নতুন নির্বাচন কমিশন আইন অনুমোদিত হওয়ার পরপরই এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা রকম বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, সুশীল সমাজও আইনটি নিয়ে দ্বিধা বিভিক্ত এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকেই খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছেন না। তারা বলছেন, এই আইন দিয়ে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের বদলে সরকারের অনুগত একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে৷

সব ঠিকঠাক থাকলে ২০২৩ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি নতুন কমিশনকে দায়িত্ব নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা এবং সেটি গঠন করার দায়িত্ব একান্তভাবে রাষ্ট্রপতির। সব সময় রাষ্ট্রপতিই এই কমিশন এককভাবে গঠন করেছেন। কিন্তু এবার মোটামুটি সবগুলো দলই নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে সংবিধান মোতাবেক আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছিল। পাশাপাশি সুধীজনরাও আইন প্রণয়নের বিষয়ে তাগিদ দিচ্ছিলো। রাজনৈতিক দল ও সুধীজনদের দাবির প্রেক্ষিতে গত ১৭ জানুয়ারি মন্ত্রীপরিষদের বৈঠকে নতুন নির্বাচন কমিশন আইন প্রথম অনুমোদিত হয় এবং গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আইনটি পাস হয়। আইনটি পাসের আগে ১২ জন সংসদ সদস্য বিতর্কে অংশ নেন৷ এ সময় বিএনপির সংসদ সদস্যরা আইনটির সমালোচনা করেছেন এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি তুলেন৷ বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ এ সময় বলেন, অবশ্যই নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে৷ বিগত দুইটি নির্বাচন কমিশন জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে৷ অন্যদিকে বিএনপির সাংসদদের এমন সমালোচনার জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘ওনারা তালগাছ চান৷ তালগাছটা নিজেদের না হওয়া পর্যন্ত তারা কিছুই মানেন না’৷

শুধু বিরোধী রাজনৈতিক মহল নয়, সুধীজনের মধ্যেও এই আইন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত বদিউল আলম মজুমদার, অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার শামসুল হুদাসহ অনেকেই এই আইনের সমালোচনা করেছেন। আবার উল্টো দিকে ড. সেলিম মাহমুদ, প্রফেসর আবদুল মান্নানসহ অনেকেই আইনটি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। 

ইসি গঠন আইন নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, আমি মনে করি সব নির্বাচন কমিশনই সুষ্ঠু, যদি না তারা নির্বাচনের সময়, আগে বা পরে কোনো দলের পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করে। নির্বাচন কমিশন গঠনে যদি আইন নাও থাকে, তাহলেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। অনেক দেশেই এ সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। কিন্তু ওইসব দেশে নির্বাচন ঠিকই সুষ্ঠু হয়। আমাদের সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে যতটুকু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেসব ক্ষমতা ভারতের নির্বাচন কমিশনও পায় না। এখন নির্বাচন কমিশনকে যতটুকু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তারা যদি সেটি প্রযোগ করে তাহলে যে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হতে বাধ্য এবং সম্ভব। একটি নির্বাচন শুধু নির্বাচন কমিশন ও তার আইনের উপরই নির্ভর করে না। এটি অনেকটাই নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর আকাঙ্খার উপর বিশেষ করে যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়। পাশাপাশি এখানে প্রশাসনের সহযোগিতাও একটি বড় অনুসঙ্গ। কমিশনের আইন হলেই যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, আর না হলে হবে না, এমনটা হয় না। এর আগে আমাদের যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, আইন ছাড়াই হয়েছে। তাহলে আমাদের সব নির্বাচন কি খারাপ ছিল? প্রশ্নবিদ্ধ ছিল? তা তো না।

আইনটি বিশ্লেষণ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, পুরনো পন্থায় তো আর নতুন গন্তব্যে যাওয়া যাবে না। যে আইনটি করা হয়েছে, তার মাধ্যমে পুরনো প্রজ্ঞাপনকে আইনের মোড়কে সংসদে পাস করা হয়েছে। এর মাধ্যমে যেই নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে, এটি নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে কিংবা স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের নিয়ে হবে না। এই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার কোনো কিছুই নেই। যার ফলে এই আইনের মাধ্যমে নূরুল হুদার মতো ব্যক্তিরাই নিয়োগ পাবেন। এটি আমাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। পাশাপাশি আইন যাই থাকুক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ নির্বাচনকালীন সরকার যদি নিরপেক্ষ না হয় তাহলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তিনি।

একই বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আইনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে সবকিছু দেখে শুনে খসড়া করে দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম যে, এই এই আদলে আইনটি হলে ভালো হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় থাকবে। আমরাও জানবো কাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, কেন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই আইনে তো স্বচ্ছতার কোনো জায়গা-ই রাখা হয়নি। এখন তো আইন-ই পাস হয়ে গেছে। এখন আর কথা বলে লাভ নেই। রকিব ও হুদা কমিশন স্বচ্ছ নির্বাচন করতে না পারায় জনগণের আস্থা হারিয়ে ছিল কিন্তু এখন কমিশন গঠন করার আগেই জনগণ মনে করছে অনুগত কমিশন হবে৷ তার ভাষায়, ‘এখন যেটা হয়েছে তা হলো, আগামী নির্বাচনে কাঙ্খিত ফলাফল নিশ্চিতকরণ আইন৷’

তবে ড. শাহদীন মালিক এবং ড. বদিউল আলম মজুমদারের বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক এবং আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ।  ইসি গঠনে নতুন আইনের বিষয়ে ড. সেলিম মাহমুদ বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এমনকি পাশের দেশ ভারতেও এরকম কোনো আইন নেই। ফলে এই আইন দেশের গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রাখবে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭২ সালেই এই আইন প্রণয়নের কথা সংবিধানে সংযোজন করেছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন, গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের বিকল্প নেই। এ জন্যই তিনি সংবিধানে আইনের বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছিলেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে যে এই আইনটি গঠিত হয়েছে, এটিই একটি বিরাট ঘটনা। এর আগে কোনো সরকারই এই আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়নি।

আইনটি নিয়ে সুশীল সমাজের নেতিবাচক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ড. সেলিম মাহমুদ বলেছেন, যারা এই আইন নিয়ে নেতিবাচক কথা বলছে বিশেষ করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এক প্রকারের অসুস্থ। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এরা চিন্তা চেতনায় প্রচণ্ড আওয়ামী বিরোধী লোক, দেশবিরোধী লোক। এতবছর তারাই আইনের কথা বলে আসছিলো। ২০১১ সালে এই আইন নিয়ে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো, বর্তমান আইনেও তা বলবৎ আছে। সুজন, শাহদীন মালিকরা যেসমস্ত প্রস্তাব দিয়েছে, তাদের প্রস্তাবের আলোকেই এই আইন গঠিত হয়েছে। ফলে তারা একটি রাজনৈতিক পক্ষ নিয়ে এ মন্তব্যগুলো করছে বলে মনে করেন তিনি।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭