লোকসাহিত্য সংগ্রাহক মনসুর উদ্দিনের জন্মবার্ষিকী

একটা জাতি বা সমাজের সার্বিক জীবনধারার বিচিত্র প্রকাশই সংস্কৃতি। আর এই সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি লোকজ জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি নিখুঁত চিত্র। যাতে জীবনের হাসি কান্না, গৌরব গাঁথা ও সুখ-দুঃখের বিচিত্র প্রকাশ পায় সাহিত্য হিসেবে। যাকে আমরা লোকসাহিত্য বলি।  লোক সাহিত্য নিয়ে যিনি গবেষণা করেন দিনি লোকবিজ্ঞানী। সে রকমই একজন লোকবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন।

আজ বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত, লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও লোকসাহিত্যবিশারদ মনসুর উদ্দিনের  জন্মদিন আজ। তিনি ১৯০৪ সালে পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার মুরারিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।  তার পিতার নাম জায়দার আলী এবং মাতার নাম জিউয়ারুন নেসা। 

লোকসাহিত্যি সংগ্রাহক ও গবেষক ১৯২১ সালে  কৃতিত্বের সাথে প্রবাশিকা পরিক্ষায় পাস করেন এবং ১৯২৬ সালে বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার্সে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে তিনি এমএ পাস করেন। এর আগে কোন মুসলিম প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয় নি। 

যখন তিনি দশম শ্রেণীতে পড়েন, তখন থেকে শুরু করেন লোক্সাহিত্যের কাজ। তাঁর লোকসাহিত্যের আত্মনিবেদন ঘটে প্রবাসী পত্রিকা পাঠে, যা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো এবং পত্রিকাটিতে রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত লালনের গান ছাপা হতো, যা  থেকে মনসুর উদ্দীন লালনের গান সংগ্রহের অনুপ্রেরণা পেতো। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলো এই লোকসাহিত্য সংগ্রাহক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন।

মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৩১ সালে এবং তাঁর কর্মজীবনের প্রথমেই তিনি সরকারি চাকরি করেন। স্কুল সাব ইনেস্পেক্টর ছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালে সরকারি মাসিক পত্রিকা মাহে নও এর সম্পাদক ছিলেন ছয় মাসের জন্য। বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনার পর চাকরি শেষ করেন ১৯৫৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রফেসর হিসেবে।

তাঁর প্রথম সংগ্রহ করা ছিলো একটি লালনের গান। তাঁর নিজ গ্রামের প্রেমদাস বৈরাগীর থেকে গানটি সংগ্রহ করেছিলেন। পরে গানটি তিনি পাঠিয়ে দেন প্রবাসে, যা ছাপা হয় ১৩৩০ সালের আশ্বিন সংখ্যায়। তাঁর মাধ্যমে আমরা পেয়েছি ত্রয়োদশ খণ্ডে হারামণির মতো লোকসংগীতের অমূল্য সংগ্রহ। এছাড়া তিনি লিখেছেন বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনার মতো তিন খণ্ডে বিভক্ত গবেষণাগ্রন্থ।

তাঁর রচিত গ্রন্থসংখ্যা ৪২টি। অমূল্য সব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেশে-বিদেশে পেয়েছেন অনন্য সব সম্মান, স্বীকৃতি, সংবর্ধনা, পদক। তাঁর ছিল হুঁকোবিলাস, জুতা ও ইংরেজিপ্রীতি। তিনি আসলে ছিলেন এক বিশ্ব মানব। বাউল-ফকিরদের সাথে তাঁর ছিল নিবিড় যোগাযোগ।

সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার এবং শিক্ষায় অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন।

লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও লোকসাহিত্যবিশারদ মুহম্মদ মনসুর চির নিদ্রায় যান  ১৯৮৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর।