ইনসাইড আর্টিকেল

ভাষার আন্দোলন: আমাদের সাহিত্য


প্রকাশ: 01/02/2022


Thumbnail

''আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি''। রক্তে রাঙানো এই ফেব্রুয়ারি মাস হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের মাস। শুরু হলো ছোট্ট সোনামণিদের মুখে অ,আ, ধ্বনিত্ব হওয়া গল্পের মাস। বাঙ্গালী জাতি পুরো মাস জুড়ে ভালোবাসা জানাবে ভাষা শহীদদের প্রতি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভাষার জন্য বাংলার মানুষেরা যে ত্যাগ বহন করেছে সেটি কখনো ভুলবার নয়। এই ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সাহিত্যের এক বিশাল ভাণ্ডার। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গান, কবিতা গল্পের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে নানাবিধ সাহিত্য। ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনাকে মর্মে ধারণ করে আমাদের সাহিত্যে লেগেছে নতুন হাওয়া। ভাষা আন্দোলনই আমাদের সাহিত্যিকদের সামনে তুলে ধরে জাতিসত্তার মূল পরিচয়, গন্তব্যের ঠিকানা। তাই সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের প্রতিফলন ছিলো একান্তই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত।

১৯৫২'র  ভাষা আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে-

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে দেয়া ভাষণে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ঘোষণা দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ওই নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেন। বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক, সচেতন জনগণও ওই নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে ছাত্রদের হাতকে শক্তিশালী করতে সমর্থন জানান। রুখে দেয়ার ঘোষণা দেন বাংলা ভাষা নস্যাতের সকল ষড়যন্ত্র। ফলে অমানুষিক নিপীড়ন শুরু হয় বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ওপর। শুরু হয় বাঙালি দমন ও নিধন প্রক্রিয়া। ভাষা রক্ষার দাবিতে সক্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়া ভাষিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে আসেন ঢাকার রাজপথে।

২১ ফেব্রুয়ারির ওই মিছিলে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার, সালাম। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। শাসকরা সঙ্গে সঙ্গেই ওই স্তম্ভ গুঁড়িয়ে দেয়। ক্রমে দ্রোহের এ আগুন সম্প্রসারিত হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান দেশের প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিকরা। আর এসব প্রতিবাদ প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে সাহিত্য।

তবে এই আন্দোলন শুরুর আগে অবরুদ্ধ ভাষা নিয়ে কবি আব্দুল আকিমের রচিত ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’ কবিতাটি মাতৃভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রচিত সার্থক কবিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে চট্টগ্রামে বসে মাহবুবুল আলম চৌধুরী ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে  ১২০ লাইনের- ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শিরোনামের কবিতা রচনা করেন।

১২০ লাইনের এই কবিতাটি একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য আত্মত্যাগকারী শহীদদের স্মরণে প্রথম এবং ভাষিক আগ্রাসনের ওপর লিখিত দ্বিতীয় কবিতা হিসেবে ধরা হয়। 

এরপর একই সময়ে  আলাউদ্দিন আল আজাদ রচিত ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো!’- ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ শিরোনামের এই কবিতাটিকে দ্বিতীয় এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার ভাঙার দিনে লুৎফুর রহমান জুলফিকার রচিত ৬৩ পঙক্তির দীর্ঘ কবিতাকে একুশের ওপর লিখিত তৃতীয় কবিতা হিসেবে ধরা হয়।

এছাড়াও দেশব্যাপী ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে কবিরাও লিখতে থাকেন তাদের অমর পঙক্তিমালা-

ভাষা আন্দোলন নিয়ে লিখিত আসাদ চৌধুরীর পঙক্তিমালা:
‘ফাগুন এলেই পাখি ডাকে
থেকে থেকেই ডাকে
তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো।
আমি যে তার নাম রেখেছি আশা
নাম দিয়েছি ভাষা, কত নামেই ‘তাকে’ ডাকি
মেটে না পিপাসা।’

শওকত ওসমানের‘মৌন নয়’গল্পটি ভাষা-আন্দোলন নিয়ে লেখা প্রথম একুশের গল্প। এই গল্পে  একুশে ফেব্রুয়ারির রূপক উপস্থাপন করেছে শওকত ওসমান। আন্দোলনে গণমানুষকে উজ্জীবিত করা- সাহসী করার শুদ্ধ উচ্চারণ এভাবেই উঠে আসে কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে-

ভাষা আন্দোলন নিয়ে আব্দুল লতিফের বিখ্যাত পংক্তিতটি , যা সকলের অন্তরের অন্তঃস্থলে এখনো গাঁথা রয়েছে।
‘ওরা আমার মুখের কথা
কাইরা নিতে চায়।
ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায়
আমার হাতে পায়।’ (আব্দুল লতিফ)

বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের একুশে ফেব্রুয়ারি অমর ও অবিনশ্বর। ভাষা-আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনে যেমন এনে দিয়েছে গৌরবের তাৎপর্য, তেমনি আমাদের শিল্প-সাহিত্যকে নতুন প্রাণের স্পন্দনে প্রভাবিত করেছে। তাই ভাষা-আন্দোলন ও বাঙলা সাহিত্য সমান মর্যাদায় বাঙালি জাতির ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭