ইনসাইড থট

জলাভূমি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা


প্রকাশ: 02/02/2022


Thumbnail

আজ ২ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক জলাভূমি দিবস। নদী,  হ্রদ, পুকুর ইত্যাদির অবনতিশীল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের এদিনে ইরানের রামসার শহরে জলাভূমি কনভেনশন গৃহীত হয় এবং জলাভূমি রক্ষার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দিনটি স্মরণে রাখতে জাতিসংঘের আয়োজনে ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছর দিনটি বিশ্ব জলাভূমি দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০২১ সালের ৩০ আগষ্ট গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে এ বছর প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক জলাভূমি দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হল পৃথিবীর জন্য জলাভূমির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। 

জলাভূমি বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য, স্থানীয় ও আঞ্চলিক তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, মিঠাপানির আধার, ভূগর্ভস্থ পানি পুনর্ভরাট, কার্বন আধার, জলবায়ুর অভিঘাত প্রশমন ও অভিযোজন, জীবিকার উৎস, অর্থনীতি ইত্যাদিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। জলাভূমি সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহারে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরতে ২০২২ সালের এ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মানুষ ও প্রকৃতির জন্য জলাভূমি কার্যক্রম’ (Wetlands Action for People and Nature)। জাতিসংঘের তথ্যমতে অষ্টাদশ শতক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় ৮৫ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। বনভূমির চেয়ে তিনগুণ হারে জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। জার্নাল নেচার জিওসায়েন্সের ২০২১ সালের  ৮ মার্চের সম্পাদকীয়তে বিগত ৫০ বছরে পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৫ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে যাওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। দ্রুত হারিয়ে যাওয়া থেকে জলাভূমি রক্ষা, সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে এখনই সচেষ্ট হওয়া জরুরি।

জলাভূমি জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। এটি বিপন্ন এবং বিরল প্রজাতির পাখি এবং প্রাণী, গাছপালা এবং কীঠপতঙ্গের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান সরবরাহ করে। জলাভূমি বিভিন্ন প্রাণী এবং শীতকালীন পাখির আশ্রয়স্থল। রামসার কনভেনশন অনুসারে একটি জলাভূমিকে এমন একটি জায়গা হিসাবে বিবেচনা করা হয় যেখানে বছরের আট মাস পানি থাকে। জলাভূমি শুধুমাত্র পানি ধরে রাখার কাজেই গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি পালন করে না বরং বন্যার অতিরিক্ত পানি ধরে রাখার মাধ্যমে বন্যার ঝুঁকি কমায়। পানি প্রবাহ এবং পানি সংরক্ষণ জলাভূমি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই জলাভূমিকে পৃথিবীর কিডনি বলা হয়। জলাভূমি পৃথিবীতে জীবন টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। তাই আমাদেরকে নিজেদের স্বার্থেই জলাভূমিকে বাঁচিয়ে রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের জলাভূমিকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা প্লাবন ভূমি সংশ্লিষ্ট জলাভূমি, ভূগাঠনিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট জলাভূমি, উপকূলীয় এলাকার জলাভূমি এবং মানবসৃষ্ট জলাভূমি। আমাদের বিভিন্ন কর্মকান্ড যেমন- পানি উত্তোলন, নদী শাসন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণ, ভূমি ব্যবহারে পরিবর্তন, কৃষি সম্প্রসারণ, বন নিধন, অনিয়ন্ত্রিত পাথর ও বালু উত্তোলন, মাটি ও পানি দূষণ ইত্যাদি কারণে জলাভূমির পরিবর্তন হয়েছে এবং পরিবর্তন প্রক্রিয়া চলমান। জলাভূমি এলাকায় বিগত কয়েক দশকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে গড়ে উঠেছে মানব বসতি, পর্যটন শিল্প। এতে ধানের উৎপাদন, মাছ চাষ, সড়ক যোগাযোগের উন্নতিতে আর্থসামাজিক উন্নতির পাশাপাশি জলাভূমির পরিমাণ কমেছে, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি হয়েছে, জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তি বা হ্রাস বা হুমকিতে পড়েছে, কোথাও কোথাও  জীবন-জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

সুন্দরবন সংকুচিত হওয়া, টাঙ্গুয়ার হাওর ও সেন্টমার্টিন দ্বীপে বর্ধিত হারে পর্যটকের আগমন এবং তাদের অনেকের অবিবেচনাসুলভ কর্মকান্ডের ফলে মাটি ও পানি দূষিত এবং জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন অতি দ্রুত গতিতে জলাভূমিগুলোয় পরিবর্তন আনছে। যা মানুষের জীবন-জীবিকা ও জীববৈচিত্র্যের উপর বড় মাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে।  

জলাভূমি আমাদের পানি সম্পদ বিশুদ্ধ ও ভূগর্ভস্থ জলাধার পুনর্ভরাট করে এবং কোটি কোটি মানুষের মাছ ও ভাতের যোগান দেয়। জলাভূমি বন্যা ও খরার বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে এবং আমাদের উপকূল রক্ষা করে। জলাভূমি  জীববৈচিএ্য এবং কার্বনের আধার হিসেবে কাজ করে। অনেক বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বাসস্থান এই জলাভূমি। খাদ্য উৎপাদন, সেচ, পর্যটন, বিনোদন, কর্মসংস্থান ও জীবিকা, পানি নিরাপত্তার জন্য জলাভূমি অত্যন্ত গুরুত্বর্পর্ণ। জলাভ’মি মানুষ তথা জীবজগৎ ও প্রকৃতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বাস্তুতন্ত্র।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীনালা, খালবিল, হাওর, বাওড়সহ বহু জলাভূমি এ দেশকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে। দেশের মোট আয়তনের প্রায় ৫০ ভাগ কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। জলাভূমি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য, খাদ্য, কৃষি, মৎস্য, পানি দূষণরোধ, পশু খাদ্য, ঔষধি গাছ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সাইক্লোন থেকে রক্ষা, পলি ধারণ, নৌচলাচল ও যোগাযোগ, পর্যটন ও বিনোদন, প্রতিবেশ, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। কাজেই আমাদের অস্তিত্বের সাথে জলাভূমি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। 

এ দেশের প্রাকৃতিক স্বাদু মাছের প্রধান উৎস হলো হাওর অঞ্চল। জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে এ দেশে সবচেয়ে সমৃদ্ধ হলো হাওর অঞ্চল ও সুন্দরবন। এছাড়া বিভিন্ন বিল বিশেষ করে আড়িয়ল বিল ও চলন বিল এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। সুন্দরবন শুধুমাত্র জীববৈচিত্র্যেই সমৃদ্ধ নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে ঝড়, জলোচ্ছাস, সাইক্লোনের হাত থেকে এ দেশকে বাঁচানোর এক অতন্দ্রপ্রহরী। ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট (রামসার কনভেনশন কর্তৃক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জলাভূমি) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

কৃষি, বসবাসের জন্য বাড়িঘর তৈরি, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও শিল্প-কারখানা তৈরির প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জলাভূমি ধ্বংস করা হয়েছে এবং হচ্ছে। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দয্য আর জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ টাঙ্গুয়ার হাওরকে ২০০০ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সুনামগঞ্জ জেলার এ হাওরে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। এছাড়াও প্রতিবছর শীতকালে প্রায় ২০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে।  

আমাদের জীবন জীবিকার প্রয়োজনেই জলাভূমির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ কিন্তু সম্পদের অতিরিক্ত আহরণ, পরিবেশ দূষণ, জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, জলাভূমির গুরুত্বকে খাটো করে দেখা ও অনুধাবনে ব্যর্থতাসহ নানা কারণে এ দেশের জলাভূমিগুলোর প্রায় প্রতিটিই কমবেশি বিপদের সম্মুখীন। হারিয়ে গেছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ নানা উদ্ভিদ ও প্রাণী। বহু জীব বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। অনেকের আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে গেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর সুন্দরবন, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, মারজাত বাওড়, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু, গুলশান লেকসহ ১২টি এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী এসব এলাকায় মাটি,পানি ও বায়ু দূষণকারী শিল্প স্থাপন, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোন প্রকার কার্যাবলী, ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট/ পরিবর্তন করতে পারে এমন সকল কাজ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে আইন অনুযায়ী পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা সংরক্ষণে তেমন কোনো কার্যক্রম দৃশ্যমান  নেই।

জীববেচিত্র্য সংরক্ষণসহ হাওরাঞ্চলের উন্নয়নে সরকার ২০ বছর (২০১২-২০৩২ সাল) মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ণ করেছে। কিন্তু মাস্টারপ্ল্যানের বাস্তবায়ন অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে। যার গতি বাড়ানো খুবই জরুরী। আয়তনে ছোট হলেও বাংলাদেশে রয়েছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য।  জীববৈচিত্র্যসহ কৃষি, মৎস্য, পর্যটনের জন্য টেকসই জলাভূমি ব্যবস্থাপনার কেনো বিকল্প নেই।

ভূপ্রাকৃতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে জলাভূমির অবক্ষয় বা হ্রাস বা বিলুপ্তি আমাদের দেশের আয়ত্তে নেই বললেই চলে। সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিত কর্মকান্ড পরিচালনার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব সহনীয় পর্যায়ে রেখে জলাভূমির টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। জলাভূমির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং আন্তরিকতার সাথে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। অপরিকল্পিত ব্যবহার ও দূষণরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭