কালার ইনসাইড

জাতীয় নির্বাচনকেও হার মানিয়েছে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন


প্রকাশ: 03/02/2022


Thumbnail

নানা আলোচনা-সমালোচোনা, অভিযোগের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে শিল্পী সমিতির ২০২২-২৪ মেয়াদের দ্বিবার্ষিক নির্বাচন সম্পূর্ণ হয়েছ। আবারের নির্সবাচনে সভাপতি পদে জিতেছেন বরেণ্য অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন ও সাধারণ সম্পাদক পদে জিতেছেন চিত্রনায়ক জায়েদ খান। নির্বাচন শেষ হলেও যেনো এর রেশ করেই গেছে। 
 
তৃতীয়বারের মত সাধারণ সম্পাদক পদে জয়লাভ করা নায়ক জায়েদ খানকে নিয়ে যেনো আলোচনা-সমালোচনা থামছেই না। প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য আসছে সামনে। সব কিছু মিলিয়ে যেনো জাতীয় নির্বাচনেকেও হার মানাচ্ছে এবারের চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন। 
 
নির্বাচন আর বিতর্ক যেন একই সূত্রে গাঁথা। হোক জাতীয় নির্বাচন বা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। সর্বত্রই হিংসা আর কাদা ছোড়াছুড়ি। সর্বশেষ ভোটকেন্দ্রিক এই বিতর্ক দেখা গেল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনেও। যার প্রমাণ মিলে নেট দুনিয়া কিংবা বিএফডিসিতে চোখ রাখলেই। 

নির্বাচনে আলোচনার শুরুটা হয় ধাক্কা দিয়ে। চিত্রনায়ক ইমন অভিযোগ করেন শাহেন শাহ নামের এক বহিরাগত তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দিয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাহেন শাহ বহিরাগত না। তিনিও একজন চিত্রনায়ক। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি।



ধাক্কা প্রসঙ্গে সেই সময় শাহেন শাহ নিউজজিকে জানান, এফডিসিতে বহিরাগতদের আনাগোনায় অনিচ্ছাকৃত ঘটনাটি ঘটেছে। এর বাইরে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু ঘটেনি। তার একদিন পর ঘটনাটি চাপা পরে যায়। এরপর আলোচানায় আসে চিত্রনায়ক রিয়াজের কান্নার ভিডিও চিত্র। তবে সেই কান্না ঘিরেও বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়। এ প্রসঙ্গে মনোয়ার হোসেন ডিপজল ও জায়েদ খান যৌথভাবে বলেন, রিয়াজের কান্না ‘মায়াকান্না’। যাদের জন্য তিনি কান্না করেছেন তাদের সদস্যপদ স্থগিত হয় তারই স্বাক্ষরে। তিনি যাচাই বাছাই কমিটির অন্যতম একজন ছিলেন।

নির্বাচনের দুই দিন আগে দীর্ঘ দেড় বছরের আড়াল ভেঙে একটি ভিডিও বার্তায় দেখা দেন তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী নন্দিত চিত্রনায়িকা সাদিকা পারভীন পপি। ভিডিওতে তিনি জানান, শিল্পী সমিতির বিদায়ী কমিটির নেতৃত্ব কর্তৃক একাধিকবার অপমানিত হয়েছেন তিনি। এ কথা জানাতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে কেঁদে ফেলেন পপি। বিশেষ করে তার অভিযোগের তীর ছিল তার সাবেক প্রেমিক জায়েদ খানের বিরুদ্ধে।

পপি বলেন, আমি তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি সেরা অভিনেত্রী হিসেবে। সেই আমাকেও শিল্পী সমিতির একটা লোকের নানা খারাপ কাজে সমর্থন না দেয়ায় সদস্যপদ বাতিল করার চিঠি দেয়া হয়। আমার মতো একজন শিল্পীর জন্য এটা অনেক বড় অপমান। এসময় শিল্পী সমিতিকে নোংরা ব্যক্তিদের হাত থেকে উদ্ধার করার আহ্বান জানিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন ও নিপুণ প্যানেলের জন্য ভোট চান পপি।



একটি ভিডিওতে অভিযোগ জানিয়ে পপি বলেন, আমার বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে ছিলেন জায়েদ খান! একটা পিস্তল কেনার জন্য আমার কাছে টাকা ধার নিয়েছিল ৷ সেই টাকা দিয়ে সে পিস্তল কিনেছে। আমি একটা জায়গায় শুটিং করছিলাম, শুটিংয়ে গিয়ে সে বলল একটা কথা আছে, জরুরি কথা। শুটিং শেষ করে গাড়িতে বসলাম। সে হঠাৎ করেই আমার কানের পাশ দিয়ে ধম ধম করে গুলি ফোটালো। ভয় পেয়ে গেলাম খুব, আমি তো এসব দেখে অভ্যস্ত না। একটু পর নাকি সেই পিস্তলের নল পপির বুকে ঠেকিয়ে দেন জায়েদ খান, এমন অভিযোগ করেন পপি। তবে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন পপির এক সময়ের প্রেমিক জায়েদ খান।

এরপর ইলিয়াস কাঞ্চন-নিপুণ প্যানেলের ‘নোট দিয়ে ভোট কেনার দিন শেষ’ গান নিয়ে ব্যাপাক সমালোচনা হয়। এ নিয়ে বেশকিছু সিনিয়র-জুনিয়র শিল্পী প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিংবদন্তি অভিনেত্রী আনোয়ারা বলেন, শিল্পীরা ভালোবাসা চায়, টাকা নয়। তাদের এমন গান আমার ভালো লাগেনি।



শুক্রবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুরের দিকে ভোটারদের টাকা দেয়ার অভিযোগ ওঠে জায়েদ খানের বিরুদ্ধে। নিপুণের এমন অভিযোগে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার পীরজাদা শহীদুল হারুন। তবে তিনি জানান, এমন অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

নানা অভিযোগ এলেও শেষ পর্যন্ত তৃতীয়বারের মতো শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয় জায়েদ খানই। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে ১৩ ভোটে জায়েদ খানের কাছে হেরে যায় নিপুণ। শনিবার (২৯ জানুয়ারি) পুনরায় ভোট গণনা চেয়ে আপলি করলেও সেখানেও নিপুণের পরাজয় হয়। 

নির্বাচনের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, মুনমুন ও জায়েদ খান কথা বলছেন। সেই ভিডিও ঘিরে গুঞ্জন উঠেছে জায়েদ মুনমুনকে টাকা দিয়েছে। এমন একটি ভিডিও ক্লিপ নেটদুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। তবে নিপুণের অভিযোগ ভিত্তিহীন জানান, মুনমুন ও জায়েদ খান। এমন অভিযোগ শিল্পী সমাজকে অপমানিত করা হয়েছে বলে দাবি করেন এক সময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা মুনমুন।

অন্যদিকে, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে এফডিসিতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি চলচ্চিত্রের ১৭টি সংগঠনের সদস্যদের। এ বিষয়টিকে অপমানজনক দাবি করে তিন দফা দাবিতে লাগাতার কর্মবিরতির ডাক দেয় ১৭ সংগঠন। চলছে তাদের আন্দোলন। তার অংশ হিসেবে রোববার (৩০ জানুয়ারি) এফডিসির এমডি নুজহাত ইয়াসমিনের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। 

এছাড়া, নির্বাচন কমিশনার পীরজাদা শহীদুল হারুনকে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ১৮ সংগঠন। তাকে নাটকে না নেয়ারও দাবি করেন তারা। তবে এফডিসির এমডি দাবি করেন—তিনি নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেছেন। এখানে তার কোনো হাত নেই। তারপরও আন্দোলন চলছে সমান গতিতে।



আপিল ভোটের রায়ে সন্তুষ্টি জানালেও পরের দিন প্রেসক্লাবে শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে রোববার (৩০ জানুয়ারি) বিকালে প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন নিপুণ। ভোটে কারচুপির অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে ভোট, প্রার্থীকে অশালীন প্রস্তাবসহ বেশকিছু অভিযোগ জানান তিনি। এমনকি নির্বাচনের অতিরিক্ত প্রশাসন মোতায়েন নিয়ে তার অভিযোগ জানান। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে করেছেন থানায় জিডি এবং শিল্পী সমিতির ভোট বাতিল চেয়ে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন চান সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হয়ে জায়েদ খানের কাছে হেরে যাওয়া নিপুণ।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনার পীরজাদা হারুন ভোটের দিন সকালে আমার কাছে ২টি চুমু চেয়েছিলেন। সেখানে আমাদের প্যানেলের জেসমিন ছিল। তাকে থাপড়ানো উচিত। তাকে সিনেমা নাটকে কোনোদিন না নেয়া উচিত। 

নিপুণ আরও বলেন, জায়েদ খান, এফডিসির এমডি, আর নির্বাচন কমিশনার পীরজদা হারুন একটা গ্যাং। তারা সবাই মিলে জায়েদ খানকে জিতিয়ে দিয়েছে। তারা টাকা দিয়ে ভোট কিনেছে ভিডিওতে সেটা দেখা গেছে। যেখানে নায়িকা মুনমুনকেও জড়ানো হয়। 

সেখানে জায়েদ খানের ব্যক্তিগত কিছু চ্যাটের স্ক্রিনশট দেখানো হয়। তবে এ প্রসঙ্গে জায়েদ খানের ভাষ্য, স্ক্রিনশট সুপারভাবে এডিট করা। আর তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা ভিত্তিহীন বানোয়াট। একটি ভিডিও ও স্ক্রিনশট প্রকাশের ঘটনায় অভিনেত্রী নিপুণ আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবেন বলে জানালেন নবনির্বাচিত এই সাধারণ সম্পাদক।

এদিকে নায়িকা মুনমুন বলেন, নির্বাচনের দিন যখন এফডিসিতে যাই আমার সঙ্গে প্রথম দেখা শাহানূর ও তারপর জেসমিনের। তারা উভয়েই আমার কাছে ভোট চায়। আমি তাদের বলি, চিন্তা না করার জন্য। এরপর দেখা হয় চিত্রনায়ক জায়েদের সঙ্গে। সে এগিয়ে এসে আমার হাতটি ধরে। আর তাদের প্যানেলের পোস্টারটি ধরিয়ে দেয়। আপনারা দেখবেন, তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি অপর হাতে ব্যাগ খুলে কিছু একটা রেখেছিলাম। ওটা ছিল আমার কালো মাস্ক, টাকা নয়।’ সবাইকে তিনি মাস্ক দেখান।
 
তিনি আরও বলেন, ‘২০০৯ সালে আমি নির্বাচন করেছি, ইসিতে। আমাদের মধ্যে কখনোই টাকার বিষয়টি আসেনি। আমি খুবই দুঃখিত যে, ইউটিউব ব্যবসায়ীরা কয়টা টাকা কামাতে আমাদের সম্মান শেষ করে দিচ্ছেন। আর ইউটিউবারদের মতো ব্যবসায়ীদের কথা নিপুণ কেন বিশ্বাস করবে?’ 

এই নায়িকা আরও বলেন, নিপুণ তুমি আমাদের শিল্পীদের ছোট করছো। আর সেই শিল্পীদের নেত্রী তুমি কিভাবে হতে চাও?

যতই দিন যাচ্ছে নির্বাচনকে ঘিরে আলোচনা যেনো বেড়েই চলছে। সম্প্রতি  সদ্য নির্বাচিত চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানের বিরুদ্ধে ভোট কেনার অভিযোগ এনে সেই ফল বাতিলের জন্য আপিল বিভাগের কাছে আবেদন জানান নিপুণ। এ ছাড়া কার্যকরী পরিষদের সদস্য চুন্নুর পদটিও বাতিলের আবেদন করেছিলেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় হয়ে বুধবার আপিল বিভাগের কাছে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা এসেছে।

জায়েদ ও চুন্নুর প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান সোহানুর রহমান সোহানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন নিপুণ। সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে শিল্পী সমিতির নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান ও কার্যনির্বাহী সদস্য চুন্নুর প্রার্থিতা বাতিলের দিকনির্দেশনা চেয়েছেন সোহানুর রহমান। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর দেওয়া এক চিঠিতে এই দিকনির্দেশনা চেয়েছেন তিনি।

নির্বাচন ঘিরে এমন নানা রকমের কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত এক সময়ের শুটিংয়ে ব্যস্ত থাকা বিএফডিসি। বর্তমানে কাজ কমে গেলেও নিজেদের মধ্যে রেষারেষি ও পালটা-পালটি অভিযোগে যেন ক্রমেই দিগুণ হচ্ছে। অভিযোগ, পালটা অভিযোগে—এসব নিয়েই মুখর চলচ্চিত্রাঙ্গন।

এসব পালটা-পালটি অভিযোগ ও কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। সবাই এক হয়ে কাজ করলে আবারও ফিরে পাওয়া বাংলা সিনেমার সোনালি অতীত এমনটাই মনে করছেন তারা।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭