সম্প্রতি নানা ইস্যুতে বেশ উত্তপ্ত চাঁদপুর আওয়ামী লীগের রাজনীতি। পৌর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া-না পাওয়া, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে স্থানীয় নেতাদের কোন্দল এখন প্রকাশ্যে। স্পষ্টত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে দলীয় কার্যক্রম, মিছিল-মিটিং করছেন স্থানীয় নেতারা। আর এর ফলে তৃণমূল কর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা। নেতারা দলে কোনো কোন্দল নেই বললেও তাদের মধ্যে স্পষ্ট কোন্দল ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখছেন অনেকেই।
বিভক্তির শুরু চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদের পৌর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া থেকে। চাঁদপুরের সাবেক এ পৌর মেয়র এবার মনোনয়ন না পাওয়ায় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় দেখা যায়নি তাকে। এমনকি নির্বাচিত মেয়রের শপথ অনুষ্ঠানেও দেখা যায়নি নাসির উদ্দিন আহমেদকে। আর তার বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম পাটোয়ারি। অভিযোগ আছে, দু’জনই বিভিন্ন কর্মসূচির জন্য স্থানীয় কর্মীরা ফোন দিলে, তাদের ফোনকল রিসিভ করেন না। কখনো-সখনো কথা বললেও খারাপ আচরণ করেন। তাদের কারণে কখন কোন ঝামেলায় পড়ে যান, এ নিয়েও ভয়ে থাকেন স্থানীয় কর্মীরা। যদিও বছরখানেক আগে এ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে, তবুও এ দুজনের দাপটে জেলার অন্যান্য নেতারা বহুদিন ধরেই দলে কোণঠাসা।
দলে চলমান এ বিভক্তির মধ্যেই সম্প্রতি চাঁদপুরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগে কিছু ব্যক্তির যোগসাজশে জমি অধিগ্রহণে অনিয়ম হয় বলে লিখিত অভিযোগ করেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ। চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে জমি ক্রয়ের সময় অস্বাভাবিক মূল্য দেখানো হয় বলে ভূমি মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন তিনি। আর এই অভিযোগের তীর ছোড়া হয়েছে শিক্ষামন্ত্রীর পরিবারের দিকে। অভিযোগে বলা হয়, শিক্ষামন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনরাই এ সমস্ত জমি ক্রয়-বিক্রয় করেছে। বিষয়টিকে অপপ্রচার হিসেবেই দেখছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ। যেহেতু যেকোন জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জমির মূল্য নির্ধারণ করেন জেলা প্রশাসক বা ডিসট্রিক্ট কালেক্টর, সেহেতু এখানে জমির মালিকের জমির মূল্য নির্ধারণ করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে জমির অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণে শিক্ষামন্ত্রী কিংবা তার পরিবারের কোনো হাত নেই এবং বিষয়টিকে অপপ্রচার বলেই মনে করছেন চাঁদপুরবাসী।
শিক্ষামন্ত্রীও বলেছেন যে, এই ভূমিগ্রহণ বা অধিগ্রহণের সঙ্গে তিনি বা তার পরিবারের কেউ জড়িত নেই। এ অপপ্রচারের প্রতিবাদে গত ২৬ জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন ধরণের প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছে চাঁদপুরে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার সকালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ চাঁদপুর জেলা শাখা ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ পৃথকভাবে বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন চাঁদপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি রণজিৎ রায় চৌধুরী। এটি সঞ্চালনা করেন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ চাঁদপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক স্যাইয়েদুল ইসলাম। মানবন্ধনে বক্তারা বলেন, চাঁদপুরের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে গভীর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। কেউ যদি দুর্নীতি করেন, তাহলে তার অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত।
কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে চলমান অপপ্রচার রুখতে আওয়ামী লীগসহ সমগ্র চাঁদপুরবাসীর জোটবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানোকে সহজভাবে নিচ্ছে না জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকসহ একটি স্বার্থন্বেষী মহল। তারা জেলা আওয়ামী লীগের পদ ব্যবহার করে শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষ নিয়ে যারা যারা প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন, তাদেরকে বিভিন্নভাবে শাসাচ্ছেন। সাধারণ নেতা-কর্মী, যারা শিক্ষামন্ত্রীকে ভালোবাসেন, নেতা মানেন, শ্রদ্ধা করেন তাদের প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে। তাও আবার গোপনে নয়, একেবারে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে। বিবৃতিতে কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তাদের সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আওয়ামী লীগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আওয়ামী লীগ সভাপতির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ওয়ান-ইলেভেনের সময় মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনার পক্ষে এবং মাইনাস ফর্মুলার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ডা. দীপু মনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন এবং ২০১৪ সালে তিনি কোন মন্ত্রিত্ব পাননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তাকে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। ফলে রাজনীতিতে তার এই উত্থানের জন্যই তাকে স্থানীয় অপরাজনীতির শিকার হতে হচ্ছে কিনা এ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কেন না, চাঁদপুরের আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি দীর্ঘদিনের এবং দীপু মনির নির্বাচনী এলাকায় একটি প্রবল প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাকে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে। আর তারাই কি এই জমি অধিগ্রহণ নিয়ে একটি নাটক সাজিয়ে দীপু মনির ইমেজ নষ্টের চেষ্টা করছেন কিনা, এ প্রশ্নটির উত্তর খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।