ইনসাইড থট

ওরা নাকি টিকা নেয়নি!


প্রকাশ: 04/02/2022


Thumbnail

গতকাল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণে যারা মারা গেছেন তাদের ৭০% শতাংশের বেশি টিকা নেননি। মনে হচ্ছে পরোক্ষভাবে তারা বলছে ওনারা সময় মত টিকা নিলে বা ওনাদের সময় মত টিকা দেয়া হলে আমরা কিছু জীবন বাঁচাতে পারতাম। যদিও সংক্রমণের এই ৪র্থ তরঙ্গে মৃত্যু গত কয়েকদিন ধরে ৩০ বা তার উপরে, হয়ত এর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে, তবুও প্রতিটি মৃত্যু শুধুমাত্র একটি সংখ্যা বা পরিসংখ্যান নয়, তবে তারা কারও মা বা বাবা, বা ছেলে বা মেয়ে, স্বামী বা স্ত্রী, বা কোনও আত্মীয়। তাই প্রতিটি মৃত্যু একটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা এবং আমাদের অবশ্যই সব সময় অনুসন্ধান/বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যে আমরা কি কিছু সেই জীবনগুলিকে বাঁচাতে পারতাম, আমরা কি অন্য কোন ভাবে তা সম্ভব করতে পারতাম? যেমন তারা পরোক্ষভাবে বলছে টিকা দিয়ে কিছু জীবন বাঁচানো যেত। আমরা জানি কোভিডের কারণে বিশ্বে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। গতকাল (২রা ফেব্রুয়ারি) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৯৯৯ এবং যুক্তরাজ্যে ৫৩৪ জন কোভিডের কারণে মারা গেছে। বিভিন্ন দেশে এই জীবন হারানোর কারণ শুধুই কি তারা টিকা নেয়নি তার কারণে কিংবা কিছুটা আমাদের ব্যর্থতা এবং নেতৃত্বের অভাবের কারণে? তাই আমাদের কি বলা উচিত যে যারা মারা গেছে, তাদের বেশিরভাগই মারা গেছে শুধু তারা টিকা নেয়নি তার কারণে? বরং আমাদের উচিত অনুসন্ধান করে কেন তারা টিকা নেয়নি বা নিতে পারেনি বা অন্যান্য কারণে টিকা দেওয়া হয়নি তা জানার চেষ্টা করা। কোভিড টিকাদানে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো করছে, তাই কাউকে দোষারোপ করার জন্য নয় বরং আমরা কীভাবে আমাদের টিকাদান কর্মসূচিকে আরও উন্নত করতে পারি তা খুঁজে বের করার জন্য এই অনুসন্ধান করা উচিত। আমরা সবসময় অতিরিক্ত প্রচেষ্টার সাথে আরও ভাল করতে পারি। কিছু মৃত্যুর ঘটনা ঠেকানো যাবে না বা যায় না, এমনকি সমস্ত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ধনী দেশগুলোতেও তা সম্ভব না। তাই সব ব্যবস্থা সত্ত্বেও কিছু মৃত্যু ঘটবে। তবে আমাদের অবশ্যই আত্মতুষ্ট হওয়া উচিত নয় এবং এই অসম্ভাব্যতাকে এড়াতে, অন্যকে বা অন্যকিছুকে দোষারোপ না করে আমাদের উচিত, প্রতিটি মৃত্যু থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন বাঁচাতে আমাদের প্রচেষ্টাকে আরও কিভাবে উন্নত করা যায় তার যথাসাধ্য চেষ্টা করা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বাংলাদেশ সরকার, হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা সততার সাথে তাদের প্রচেষ্টা নিবেদন করছে। তাদের আমি সম্মান করি আর আন্তরিক সালাম জানাই।

আমার অতীতের নিবন্ধে আমি গৃহকর্মীদের দুর্দশা উল্লেখ করেছিলাম। লিখছিলাম, হয়ত সাধারণ আমলাতান্ত্রিক কারণে বা অকার্যকর, অবাস্তব কৌশল যা মাঠের বাস্তবতাকে বিবেচনা করে না, তার কারণে অনেক গৃহকর্মী হয়তো কোভিড ভ্যাকসিন নিতে পারছেন না বা তাদের টিকা দেওয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশে এখন ১২ বছরের বেশি বয়সী যে কোনও ব্যক্তিকে কোভিড টিকা সরবরাহ করা হচ্ছে। তারা তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং/অথবা জন্ম সনদপত্র সহ ওয়েব-ভিত্তিক অ্যাপ ব্যবহার করে নিজেদের নিবন্ধন করার পর টিকা নিতে পারছেন। টিকা পাওয়া সহজ করার জন্য, স্বাস্থ্য মন্ত্রী আরও জানিয়েছে যে লোকেরা কেবল তাদের জন্ম সনদপত্র নিয়ে টিকা কেন্দ্রে আসতে পারে এবং টিকা নিতে পারবে। খুব ভাল প্রচেষ্টা এবং তা প্রশংসা করা আবশ্যক। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলাদেশে কতজনের জন্ম সনদ নেই, তাই তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রও থাকতে পারে না। আমার কাছে সর্বশেষ তথ্য অনুসারে (যদি ভুল হয়, আমাকে সংশোধন করবেন) বাংলাদেশের প্রায় ৬০% মানুষ তাদের জন্ম নিবন্ধন করেছে এবং তারা তাদের জন্ম সনদপত্র পেয়েছে বা তাদের আছে। ৪০% এর জন্ম সনদপত্র নেই। আমরা কি জানি সেই দুর্ভাগা গোষ্ঠী (অর্থনৈতিক এবং লিঙ্গ) কোনটি যাদের জন্ম সনদপত্র নেই? আমি আমার জন্ম সনদপত্র পাওয়ার গল্প বিস্তারিত লিখব অন্য একদিন। যখন আমি নেদারল্যান্ডে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, তখন তারা বাংলাদেশ রেজিস্ট্রি থেকে আমার প্রকৃত জন্ম সনদপত্র দাখিল করতে বলেছিল, যা আমার কাছে কোনদিন ছিল না। আমার ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট বা আমার বাংলাদেশ পাসপোর্টে যা লেখা আছে তা তারা গ্রহণ করতে রাজী হয়নি। সুতরাং, আমাকে ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে রেজিস্ট্রি অফিসে আমার জন্ম নিবন্ধন করতে হয়েছিল।
 
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO), বাংলাদেশ ফ্রি ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (BFTUC) এবং Uxfam এর মতে, বাংলাদেশে প্রায় ১.৬৯ মিলিয়ন (১৬লাখ ৯০ হাজার) গৃহকর্মী রয়েছে যাদের বয়স ১৫ বছরের বেশি। আরও ৪২০,০০০ হাজার ১৫ বছর বয়সের নীচের মেয়ে বা ছেলে গৃহকর্মী রয়েছে। সকল গৃহকর্মীর ৮৩%ই নারী। তাদের মধ্যে কত শতাংশের জন্ম সনদ আছে তা জানার চেষ্টা করেছি, যে পরিসংখ্যান আমি খুঁজে পাইনি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তারা একটি অপরিহার্য কর্মী হিসাবে বিবেচিত হতে পারে এবং কোভিড মহামারী গতিশীলতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দল হতে পারে। আমরা কি জানি সেই ১৬ লাখ ৯০ হাজার গৃহকর্মী, যাদের ১৫ বছর বা তার বেশী বয়স, যাদের ৮৩% নারী, তাদের মধ্যে কতজনকে এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে বা হয়নি? ১৫ বছরের নিচের ৪২০,০০০ গৃহকর্মীরা কি টিকা পাচ্ছেন? অবশ্যই অনেকেই টিকা পেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের বর্তমান টিকা নীতির কারণে তারা নিবন্ধন করতে পারেননি বা নিয়োগকর্তা তাদের টিকা পাওয়ার জন্য সাহায্য করেননি বা তাদের জন্ম সনদপত্র নেই তার কারণে। কোভিড-১৯-এর কারণে মানুষের এই দলের যদি কেউ মারা যায়, তবে তারা কি শুধু একটি সংখ্যা বা পরিসংখ্যান হয়ে যাবে এই বলে যে তারা ভ্যাকসিন নেয়নি। সমাজ তাদের সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? তাদের পরীক্ষা করার কি সুযোগ রয়েছে, সংক্রমিত হয়ার পর বিচ্ছিন্নতা পালন করার কারণে, তাদের আয় বা বেতন হ্রাস বন্ধ করার বা তাদের ভোগান্তি এবং মৃত্যু কমাতে আমরা কি পদক্ষেপ নিয়েছি? সমাজ কি এই হতভাগাদের কথা ভাবছে? আমি জানি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে টিকা দিচ্ছে। কেন আমরা সেইসব গৃহকর্মীকে জন্মসনদ ছাড়া টিকা নেওয়ার অনুমতি দিতে পারি না, যাদের জন্ম সনদপত্র নেই তাদের নিয়োগকর্তার মাধ্যম নিবন্ধিত হয়ে কেন টিকা নেওয়ার পদ্ধতি চালু করা যাবে না? গর্বের সাথে বলতে পারি, বাংলাদেশে আমরা উদ্ভাবনী ধারণা তৈরিতে অনেক ভাল, তবে কেন আমরা প্রধানত মহিলাদের এই হতভাগ্য গোষ্ঠীর টিকা দেওয়ার একটি উদ্ভাবনী উপায় খুঁজে পাচ্ছি না বা চেষ্টা করছি না! আমাদের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এবং অন্যান্য শহরগুলোতেও, অনেক গ্রামীণ এবং উপকূলীয় মহিলা এবং মেয়েরা নিজেদের এবং তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তাদের কাছে উপলব্ধ কয়েকটি বিকল্পের মধ্যে একটি হিসাবে গৃহকর্মে ঝুঁকছে। তারা বেশিরভাগ বস্তিতে বসবাস করে। সহজেই তারা সংক্রামিত হতে পারে এবং অজান্তে তাদের নিজের পরিবারের লোকজনকে বা তারা যে বাড়িতে কাজ করেন সেখানে সংক্রামিত হতে বা ছড়াতে পারে। তারা দরিদ্র হতে পারে, কিন্তু সংবিধান তাদের জন্ম সনদপত্র সহ বা ছাড়াই স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার দিয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশে এখন কোভিড ভ্যাকসিনের কোনও অভাব নেই। আমি সত্যিই চাইবো মন্ত্রণালয় এই মানুষ গুলো যেন কোভিড টিকা পেতে পারে তা জরুরীভাবে বিবেচনা করবে (আমাকে ক্ষমা করবেন, যদি তাদের টিকা প্রদান ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে থাকে, তাহলে)।

আরেকটি সমস্যা, আমি পড়লাম স্বাস্থ্য মন্ত্রী বিলাপ করছে যে লোকেরা বুস্টার ডোজ দেওয়ার জন্য নাকি এগিয়ে আসছে না। কিন্তু কেন তারা আসছে না তার কারণ গুলোকি আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি এবং যা করলে তারা তাদের বুস্টার পেতে আমরা কি সেই ভাবে পদক্ষেপ নিয়েছি? দুঃখজনক কিন্তু সত্য হল যে বাংলাদেশে মানুষের জীবন এবং জীবিকা সংরক্ষণের জন্য আমাদের কেবল মাএ মাস্ক পড়া আর টিকা ছাড়া আর অন্যকোন কার্যকরী উপায় নেই।

সুখবর, সংক্রমণের হার কমছে। গত ১৪ দিনে বেশি সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়ার কারণে আজকাল মৃত্যুর হার যদিও একটু বেশির দিকে (এখনও এটি গত বছরের জুলাই/আগস্টে ডেল্টার কারণে মৃত্যুর সংখ্যার এক দশমাংশ)। আমি মনে করি শীঘ্রই মৃতের সংখ্যাও কমতে শুরু করবে। আমি আরও মনে করি এবং আশা করি বাংলাদেশ কোভিডের ৪র্থ তরঙ্গ হয়ত তার শিখরে পৌঁছেছে। ধীরে ধীরে কিন্তু স্থিরভাবে কোভিড পরিস্থিতি আরও উন্নত হবে। ডেনমার্ক এবং অন্যান্য অনেক দেশ সমস্ত বিধিনিষেধ তুলে নিচ্ছে। বাংলাদেশ সঠিক কারণে (যদিও সবকিছুই এর সঠিক এবং জোরদার বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করে) কিছু বিধিনিষেধ আরও ২ সপ্তাহ বাড়িয়েছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক যে, আমার মনে হয় আতঙ্কে, স্কুলগুলি বন্ধ করা হয়েছে এবং আরও দুই সপ্তাহের জন্য তা বাড়ানো হয়েছে। আমি মনে করি না যে এটি শিক্ষার্থী বা তাদের পরিবার বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করেছে বা করবে। আমি আশা করি আমরা এই সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাবগুলি বিবেচনা করছি। আমি আশাবাদী এবং আস্থাশীল সরকার মাঠের বাস্তবতার ভিত্তিতে তাদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

ওমিক্রন এবং এর বৈকল্পিক চাচাতো ভাইয়ের রূপ BA.2 এখনও ন্যূনতম দুর্ভোগ এবং মৃত্যুর সাথে ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু আমরা হয়তো মহামারীর শেষ দেখতে পাচ্ছি। তবে কোন ভুল করবেন না, এটি এখনও শেষ হয়নি। COVID-19 একটি স্থানীয় রোগ হিসাবে আমাদের সাথে কিছু সময়ের জন্য থাকবে এবং আমাদের প্রতি বছর বুস্টার ডোজ দেওয়ার এবং পাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, ইতিহাস বলবে, সীমিত সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর সুষম কৌশল বাস্তবায়ন করেছে। আমি মনে করি এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭