ইনসাইড থট

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে লাইসেন্সবিহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক ও ফিটনেসবিহীন এবং নিবন্ধন ছাড়া বাহন নিয়ন্ত্রণ হওয়া প্রয়োজন


প্রকাশ: 17/02/2022


Thumbnail

কক্সবাজারের, চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের হাসিনাপাড়ায় মৃত ডা. সুরেশ চন্দ্র সুশীলের বাড়ির উঠানে মৃত পাঁচ ভাই অনুপম সুশীল, নিরুপম সুশীল, দীপক সুশীল, চম্পক সুশীল ও স্মরণ সুশীলের মৃতদেহ সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, এ এক করুণ দৃশ্য। পিকআপ চাপায় নিহত পাঁচ বাবাকে  শেষ বিদায় জানিয়েছে তাদের অবুঝ শিশু সন্তানরা। শেষ বিদায় অনুষ্ঠানটি হয়ে উঠেছিল হৃদয়বিদারক। বাবা ডা. সুরেশ চন্দ্র সুশীলের শ্রাদ্ধের আয়োজন করতে গিয়ে একসঙ্গে পাঁচ ভাইয়ের প্রাণ গেছে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায়। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তারা সড়কের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় একটি পিকআপ তাদের চাপা দিয়ে চলে যায়।

বেশ কয়েকবছর পূর্বে আমিও একই ধরনের সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিলাম। যদিও শারীরিকভাবে আমি অক্ষত ছিলাম, কিন্তু আমার বাহনটির বাম পার্শ্ব চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিল। দুর্ঘটনাস্থল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (তৎকালীন হোটেল শেরাটন) এর মোড় অতিক্রম করে বাংলামোটরের দিকে ফুটওভার ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা। আমি বাংলামোটর মোড়ের দিকে যাচ্ছিলাম। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম একটি বাস আমার বাহনের বাম পার্শ্বের দরজা দুটোসহ অন্যান্য অংশে ঘষা দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্য একটি ছোট গাড়ীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। এরই মাঝে আরও দ্রুতবেগে একটি ‘ল্যান্ড ক্রুজার‘ গাড়ী ডান দিক থেকে এসে বাসটির গতিরোধ করে দাঁড়ালো। যাত্রাবাড়ী টু গাবতলি টাউন সার্ভিস বাসটি ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ীটিকে ধাক্কা দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে থেমে গেল। চারিদিক থেকে সাধারণ মানুষ জড়ো হতে শুরু করলো। আমরা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা বাসটির চালককে ধরার জন্য বাসের ভিতর ঢুকতেই চালক জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। সড়কদ্বীপের কাঁটাতারের বেড়া টপকিয়ে টিএন্ডটি অফিসের সামনে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে গেল। চালকের অবয়ব দেখে মনে হলো কিশোর বয়সের চালকটি নিশ্চয়ই লাইসেন্স বিহীন বা হেলপার। ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ীর আরোহীদের মারফত জানলাম, বাসটি শাহবাগ চত্বরে ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে পালানোর চেষ্টা করছিল।

আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, ছোটখাটো আকারের ঐ কিশোরটি আরোহীসহ বিশাল সাইজের গাড়ীসহ রাজপথ দাপিয়ে বেড়িয়েছে। দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানোর কারণে চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। 

চট্টগ্রামের মহাসড়ক এবং আঞ্চলিক সড়কগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ চাঁদের (পুরাতন জিপ) গাড়ি। সড়কে চলাচলের জন্য এ গাড়িগুলোর কোনো রুট পারমিট নেই। চালকদেরও নেই লাইসেন্স। তারপরও জেলাজুড়েই অবাধে চলাচল করছে অবৈধ গাড়িগুলো। এর মধ্যেই গত ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির হাইদচকিয়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির দুই ছাত্রীর মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। ট্রাফিক পুলিশের তাড়া খেয়ে ধানবাহী চাঁদের গাড়ি উল্টে এই দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।

আমার এলাকার শ্রমিক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। মটরবাইক যোগে গুলিস্তান যাওয়ার পথে দোলাইপাড় চৌরাস্তা এলাকায় নিজ সংগঠনের একজন কর্মীর সাক্ষাৎ পেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কুশলাদি বিনিময়কালে ‘লেগুনা‘ (লাইসেন্স বিহীন অটোমোবাইল) এসে ডান পার্শ্ব দিক থেকে ধাক্কা দিল। মিজানের ডান পায়ের হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত লম্বা হাড়টি ভেঙ্গে গেল। চারিদিক থেকে লোক জড়ো হতে লাগলো। ‘লেগুনা‘ চালককে ধরা হলো। ১০-১২ বছরের কিশোর। ক্ষুধার তাড়নায় বা শখের বসবর্তী হয়ে বা মূল চালকের অনুপস্থিতিতে চালকের আসনে বসে যে ঘটনা ঘটিয়েছে, ফলে মিজানের যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, এজন্য দায়ী কে?

কদমতলী থানা মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি কোহিনুর বেগম নিজ এলাকা জুরাইনের গলির ভিতরে রিক্সাযোগে বাড়ী ফিরছিলেন। পিছন থেকে একটি ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক রিক্সাটিকে ধাক্কা দিলে রিক্সার আরোহী কোহিনুর বেগম সামনে পরে গেলেন। ষাটের উপরে বয়সে ভারী শরীর নিয়ে পড়ে যাওয়াতে একটু বেশিই ব্যথা পেয়েছে। চারদিক থেকে লোক জড়ো হলো। সকলেই উনাকে চিনেন, ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। এক্স-রে রিপোর্টে দেখা গেল, দুই হাত, কোমড়, পাঁজর সহ শরীরের বিভিন্ন অংশে বেশ কয়েকটি হাড় ভেঙ্গে গেছে। দুই হাত-পা দিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে  কোন কিছু করতে পারছেন না, দাড়াতে পারছেন না। হাত পায়ে কয়েকটি স্টিলের পাত দিয়ে হাত ও পায়ের হাড় সোজা করে প্লাস্টার করে এক মাসের জন্য বিছানায় শুয়ে থাকতে ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেন। ঐ ইজিবাইক এর চালকের আসনে বসেছিল ১২-১৩ বছরের এক কিশোর। এই দুর্ঘটনাটি কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে? কোহিনূর বেগম কি সুস্থ হয়ে আবার স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবেন?

পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন থেকে তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারীকালে ২০২১ সালে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত এবং ৯ হাজার ৩৯ জন আহত হন। ২০২০ সালের  তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মহামারির কারণে এ বছরে অফিস-আদালত, দোকানপাট বন্ধ ছিল। ফলে করোনা মহামারিকালে সড়ক দুর্ঘটনা কম হওয়ার কথা, কিন্তু উল্টো এ সময় বেশি ঘটেছে। লকডাউনে গণপরিবহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকার পরও এ বছর দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, প্রাইভেট কারের তুলনায় অটোরিকশা, ইজিবাইক ও থ্রি-হুইলারের দুর্ঘটনার তিনগুণ বেশি। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

১। কম বেতনে লাইন্সেস বিহীন চালক নিয়োগের প্রবণতা
২। মালিকরা বেশি মুনাফার লোভে দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা প্রবর্তন
৩। মালিকদের পাওনা মিটিয়ে বেশি আয়ের লোভে চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর প্রবণতা
৪। কিশোর বয়সের চালক বা হেলপার দিয়ে গাড়ী চালানো
৫। বিরতি ছাড়া দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানোর ফলে চালকের ক্লান্তি আসা।
৬। মহাসড়কে মোটরসাইকেল, অটোইজিবাইক ও ব্যাটারি চালিত তিন চাকার গাড়ি বৃদ্ধি, 
৭। একই রাস্তায় বৈধ ও অবৈধ এবং দ্রুত ও শ্লথ যানবাহন  চলাচল

অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনার কারণে, ঘর থেকে বেরিয়ে সড়কে নামলে সুস্থভাবে গন্তব্যে পৌঁছাতে বা বাড়ি ফিরতে পারবো কি না উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হয়। দুর্ঘটনারোধে সড়ককে নিরাপদ করতে মহাসড়কে মোটরসাইকেল, অটোইজিবাইক ও ব্যাটারি চালিত তিন চাকার গাড়ির নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে লাইসেন্স বিহীন চালক বা কিশোর বয়সের চালক দিয়ে গাড়ি বা ইজিবাইক ড্রাইভ করা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরী।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭