ইনসাইড থট

মানুষের জীবন, সংগঠিত আদর্শ ও শেখ হাসিনা


প্রকাশ: 18/02/2022


Thumbnail

সমাজ বাস্তবতায় আমরা প্রতিনিয়ত যেসব পরিস্থিতির সামনে পড়ি সেসবের মোকাবেলায় সবচেয়ে বড়ো জটিলতা উপস্থিত হয় যখন নিজেকে মূল্যায়ন করি এই ভেবে যে, জীবন চক্রের ঘটনাপ্রবাহে সমাজ উন্নয়নে আমার ভূমিকা কি! আমরা বুঝতে পারিনা আমরা সমাজের জন্যে দেশের জন্যে কি করেছি। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত বা দক্ষিণের দেশগুলোয় একজন ব্যাক্তিকে মূল্যায়ন করা হয় তার পরিবারের জন্যে অবদান কি তা দিয়ে কারণ সামাজিক সম্পর্কের বাইরেও মানুষের সাথে মানুষের জৈবিক বা রক্তের সম্পর্ক একটি পারিবারিক দায় তৈরি করে। ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিকাশের সাথে সাথে মানুষ সামষ্টিক কৌশল ত্যাগ করেনি, শুধু বাইরের চিন্তা নিজের ও ঘরের স্বার্থের মধ্যে টেনে এনেছে। সমাজ ইতিহাসে এর বিবরণ স্বাক্ষ্য আছে, কেমন করে পুঁজিবাদ ও পুঁজিতন্ত্র মানুষকে ব্যাক্তি জগতে একঘরে করে রাখতে সাহায্য করেছে। সামষ্টিক উন্নয়ন তিরোহিত হতে হতে এখন ফিকশন আর বিকৃতি চর্চা ছাড়া মানব মেধায় কল্যাণ চিন্তা বলে তেমন কিছু নেই। যা আছে তা পুঁজি নিয়ন্ত্রণ করে, বাজারে সি এস আর (কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি) বলে এরকম একটা সামাজিক দায় পুঁজিবাদ তৈরি করে দিয়েছে। স্বার্থ ছাড়া কেউ এখন কল্যাণের চিন্তা করে না।

আমি-আপনি এখন যে বাস্তবতায় বাংলাদেশে বাস করছি আমাদের দায় কি? যদি মোটা দাগে দেশ ও নিজেকে বা পরিবারকে আলাদা করে নেই, কোন কিছুই কি দেশের বাইরে পড়ে? তাহলে যাই-ই ভাবি না কেন নিজেদের দেশটা সামনে এনে নিতে দোষ কি? এটা কোন অগ্রাধিকারের বিষয় নয়। আমাদের সন্তান জন্মগ্রহণের পরেই দেশের নাগরিক হয়ে যায়, সেখানে আমাদের দায় সাংবিধানিক, রাষ্ট্র কিছু দায় নিয়েছে ও পরিবারকে কিছু দায় দিয়ে রাষ্ট্র সে সম্পর্ককে আনুপূর্বিক পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু উল্টোদিকের দায়িত্ব সম্পর্কে একমাত্র পরিবারই সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব পালন করছে যার সব সুবিধা শেষমেশ রাষ্ট্র নিয়ে নিচ্ছে। একসময় পরিবারের সাথে আমাদের সম্পর্ক হয়ে উঠে আবেগ-অনুভূতির।

কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা পরিবারের মধ্যে রেখে যে শিক্ষা দিচ্ছি তাতে সন্তানের ও একইসাথে যে কিনা দেশের নাগরিক তার দায় ও দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে কতোখানি সচেতন করে দিচ্ছি। এখানে একটি বিতর্ক আছে এইরকম যে, তার দায়িত্ব পরিবারের চেয়ে সমাজের কোন অংশে কম নয় কিন্তু আমরা বিতর্কের সময় আলোচ্য বিষয়কে একটি সরল বিন্দুতে ফেলতে চাইনা যে সবগুলো পরিবার মিলেই সমাজ। সুতরাং যা শুরু হবে পরিবারে তার প্রতিফলন ঘটবে সমাজে, যা একসময় ভারতবর্ষে সামষ্টিক কল্যাণচিন্তার জন্ম দিয়েছিল, আজও অনেক ক্ষেত্রে সমাজ পরিচালিত হয় সেসব সামষ্টিক রূপরেখা দিয়েই, কিন্তু একটি পর্যায়ে এসে রাজনৈতিক কৌশল ও পুঁজিবাদের আগ্রাসী বিস্তরণ আমাদের সেই মূল্যবোধের সমাজ প্রায় গুটিয়ে নিতে বাধ্য করেছে।

আইনেস্টাইনের তত্ত্ব ভালো করে না বুঝেই আমরা ধরে নিয়েছি ‘বাস্তবতা একটি ইলিউশন”, এটা সময়ের সূত্রে প্রাসঙ্গিক কিন্তু আমরা যে সামাজিক বাস্তবতার কথা বলছি তা রূপান্তরশীল ও ক্রম বিবর্তনের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে। যদি ধর্মের কথাও বলি, এর ইতিহাস সমর্থন করে যে, কোন প্রচারক কখনও মানুষকে ‘অধর্মের’ কোন চর্চায় উৎসাহিত করেননি। ধর্মে মানুষকে সকল সৃষ্টির সেরা বলা হয়েছে কিন্তু এই দুনিয়ার সবচেয়ে অধর্মের কাজগুলো হয়েছে ধর্মকে পুঁজি করে। অথচ ধর্ম ইতিহাসের অংশ এমনকি ধর্ম গ্রন্থগুলোও ধর্মের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসকেই বিবৃত করেছে। সে ইতিহাস মানুষের ও মঙ্গলের, কল্যাণের চিন্তায় ইহলোক ও পরলোকের জন্যে দায় ও বর্তমান বাস্তবতার দায়িত্ব সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করেছে। কিন্তু কাজের কাজ কি কিছু হয়েছে?

সভ্যতার যে নিজের তৈরি একটি সঙ্কটের বিভ্রম আছে রবীন্দ্রনাথ নিজেও তা থেকে মুক্ত ছিলেন না, মেনে নিয়ে তাঁর আশিতম জন্মদিনে লিখেছিলেন, “পূর্বতম দিগন্তে যে জীবন আরম্ভ হয়েছিল তার দৃশ্য অপর প্রান্ত থেকে নিঃসক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি এবং অনুভব করতে পারছি যে, আমার জীবনের এবং সমস্ত দেশের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে, সেই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে গভীর দুঃখের কারণ আছে”। রবীন্দ্রনাথের এই দৃষ্টিভঙ্গি তিনি নিজেই যাকে বলছেন ‘নিঃসক্ত’ সে বিবেচনায় একটি মহৎ উপলব্ধি আছে কিন্তু যে ‘দুঃখের কারণ’ আছে তিনি বলেছেন আমরা তার অনুসন্ধান করিনি। রবীন্দ্রনাথের দেশ বাংলাদেশও, সেই দেশ যখন দুঃখিনী হল তখন তাঁর রক্ত নিঃশেষ করে ব্রিটিশ রাজন্য ভারতবর্ষ ত্যাগের সব কাজ গুছিয়ে ফেলেছে, কিন্তু এদেশের মানুষের তিতিক্ষার প্রতিদান হয়েছে বিভক্তি। তা শুধু দুই দেশের নয়, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক হয়েছে অবিশ্বাস্য দ্বন্দ্বের, সংস্কৃতির মধ্যে এসেছে ধর্মের বাহুল্য, পরিবার ও সমাজ বিভক্ত হয়েছে কৌণিক দ্বন্দ্বে – ফলে খুব সহজেই আমরা তাকে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্য বলে দায়মুক্তি চেয়েছি। কিন্তু এতে কি আমাদের শেষ রক্ষা হয়েছে?

রবীন্দ্রনাথের পরে বঙ্গবন্ধুই এই আন্দোলিত ‘দুঃখের কারণ’ চিহ্নিত করতে পেরে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নেমেছিলেন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমাদের অধিকার স্বপ্নকে স্বীয়-অধীনস্ত করেনি বলেই তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে মিথ্যা পাকিস্তানের স্বপ্নকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি একটি বিবৃতি দেন যা ইত্তেহাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ১৩ অগাস্ট ১৯৪৮ সালে। ১৪ আগাস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস (আজাদী দিবস হিসেবে পরিচিত)-কে বঙ্গবন্ধু ‘সংকল্প দিবস’ হিসেবে পালনের আহবান জানিয়ে ওই বিবৃতিতে বলেন, “১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট আমরা যে ‘আজাদী’ লাভ করিয়াছি, সেটা যে গণ আজাদী নয়, তা গত একটি বছরে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে.........বস্তুতঃ গণ-আজাদীর পরিবেশ সৃষ্টি না করিয়া আজাদী উৎসব করিতে যাওয়া এবং বন্যাক্লিষ্ট, দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মরণোন্মুখ জনগণকে সেই উৎসবে শরীক হইতে বলা নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কিছু নয়। এই প্রহসনে আত্মপ্রতারিত ‘নেতারাই’ সন্তুষ্ট থাকিতে পারেন, জনগণ- বিশেষ করিয়া সচেতন ছাত্র ও যুব-সমাজ উহা দ্বারা বিভ্রান্ত হইবে না। তারা ‘আজাদী দিবস’ অবশ্যই পালন করিবে, কিন্তু সেটা উৎসবের দিন হিসাবে নয়, উৎপীড়নের নিগঢ় ছিন্ন করার সংকল্প নেওয়ার দিবস হিসাবে পালন করিবে” (সূত্রঃ সিক্রেট ডক্যুমেন্টস অব ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দ্যা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রথম পার্ট ১৯৪৮-১৯৫০, পৃষ্ঠা ৪৪-৪৫)।

বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্ন দর্শনের জন্ম হয়েছিল তাঁর পরিবার থেকেই। তিনি যদি সে শিক্ষা না পেতেন তাহলে তখনকার ফরিদপুরের এক অজ পাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়া থেকে কোলকাতা পর্যন্ত যেয়ে তরুণ বয়সে সব নেতাদের মধ্যমণি হতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে জানা যায় তাঁর পরিবার, বিশেষ করে পিতার যে অপরিসীম স্নেহ তিনি লাভ করেছিলেন ত্যাগের আন্দোলনের জন্যে সেখানেও আবেগের সাথে ছিল প্রত্যয় ও উৎসাহ। নানারকম প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার যে অদম্য শক্তি বঙ্গবন্ধুর ছিল তা বাংলার চিরন্তন সংগ্রামের প্রতীক বৈশিষ্ট্য, অনেকটা সুলতানের আঁকা বাঙালী কৃষকের বাহুবলের শক্তি যার মূর্ত প্রতীক ছিলেন মুক্তিকামী আদর্শ চেতনার বঙ্গবন্ধু। রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের যে সঙ্কট হতাশা তা থেকে জাতীয় মুক্তির অবদান এই বাংলাদেশেই ঘটাতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু তার বাঙ্গালী মনুষ্যত্বের কল্যাণ চিন্তা থেকে। সে কল্যাণ চিন্তাই আমাদের ধর্ম, আমাদের বিশ্বাস ও স্বপ্ন। আমরা কিছুতেই তা থেকে আলাদা হয়ে পুঁজির কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারিনা। তাহলে আমাদের সব অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।

রাষ্ট্রের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক তা নাগরিক অধিকারের ও কর্তব্যের। কিন্তু পরিবার ও সমাজের সাথে মানুষের সম্পর্ক সদস্যের অধিকার, কর্তব্য ও একইসাথে আবেগের। যে কেউ যদি ভালো করে মিলিয়ে দেখেন, খুঁজে পাবেন এই সব একসাথে ধারণ করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, যার আদর্শ চিন্তা সম্পূর্ণ মানবিক। পুরো বাংলাদেশ এখন তাঁর পরিবার। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন তাঁকে দেশের আপামর মানুষের হৃদয়ে ঠাই দিয়েছিল কারণ তিনি ছিলেন হাজার বছরের একমাত্র বাংগালী যিনি মানুষের মনের আকাঙ্ক্ষার ভাষা বুঝতে পেরেছিলেন। সময় দুঃখিনী বাংলার মুখে হাসি ফুটাবার অবকাশ তাঁকে দেয়নি বটে কিন্তু এর সফল উত্তরাধিকার হিসেবে সে আদর্শ সংগঠিত করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারের সদস্য হয়ে পৌঁছে গেছেন। গত একশো বছরের ন্যূনতম হিসেবেও এরকম একজন সুতোর শাড়ি পড়া বাঙালী নারী আমরা পাইনি যিনি এদেশের সংস্কৃতি ও রাজনীতির এমন মেল-বন্ধন ঘটাতে পেরেছেন দেশের ও মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্যে, কোন বিশেষ মতাদর্শ বিস্তারের জন্যে নয়। হয়তো ভবিষ্যতে কোন একদিন এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা হবে কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস মানুষের এক জীবনে দেশের জন্যে সব কল্যাণ শেষ করে যেতে না পারলেও শেখ হাসিনা সেসবের আয়োজন করেছেন, কল্যাণসূত্র গেঁথে দিয়ে যাচ্ছেন, সমেত সমাজ গঠনের বাস্তব দিক-নির্দেশনা রেখে যাচ্ছেন - সেদিনের ইতিহাস বিশ্লষকগণ এসব কেমন করে সম্ভব হয়েছিল জেনে বিস্মিত হবেন।                    

রেজা সেলিম, পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প
e-mail: rezasalimag@gmail.com


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭