ইনসাইড বাংলাদেশ

এনআরবিসি কমার্শিয়াল ব্যাংকে হরিলুট

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 12/12/2017


Thumbnail

নতুন প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকে নতুন চেয়ারম্যান হলেন মস্কো প্রবাসী উদ্যোক্তা তমাল এস পারভেজ। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ব্যাংকের এমডিকে অপসারিত করে। নতুন পরিচালনা পর্ষদ কতটা দক্ষতার সঙ্গে এই ব্যাংক চালাবে, এখন তা দেখার বিষয়। তবে এই ব্যাংকটিকে একাই ‘ঝুঁকিগ্রস্ত’ ব্যাংকে পরিণত করেছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান শহীদুল আহসান।

তিনি এনআরবিসি বা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের একজন গ্রাহকমাত্র। ব্যাংক পরিচালনার পাশাপাশি শহীদুল আহসান পুরো এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনায় প্রভাব বিস্তার করেছেন দীর্ঘদিন। 

এনআরবিসি ব্যাংকের ওপর করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়, এনআরবিসি ব্যাংক আইন না মেনে শহীদুল আহসানকে ঋণ দিয়েছে, আইন লঙ্ঘন করে বেনামি শেয়ার কিনেছেন শহীদুল আহসান এবং অবৈধভাবে তিনি ব্যাংকটির পর্ষদ সভায়ও অংশ নিয়েছেন।

শহীদুল আহসানের কার্যকলাপগুলোকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রয়োজনীয় সহায়ক জামানত ছাড়াই তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট দুটি প্রতিষ্ঠানকে এনআরবিসি ৩০১ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যা ব্যাংকটির মূলধনের ৫৬ শতাংশ। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘একক গ্রাহকের ঋণসীমা’ নীতির লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তার বেনামি শেয়ার বাজেয়াপ্ত হওয়ার যোগ্য।

আওয়ামী লীগ সরকার সর্বশেষ যে নয়টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়, এনআরবিসি ব্যাংক তারই একটি। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল এ ব্যাংকের ইচ্ছাপত্র (এলওআই) দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ফরাসত আলীর নামে। তবে প্রতিষ্ঠাকালে ব্যাংকটিতে ২০ পরিচালকের নাম থাকলেও নানা কৌশলে ৫ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছিলো।

তারা হলেন- জার্মানিপ্রবাসী প্রকৌশলী আবু মোহাম্মদ তুষার ইকবাল রহমান, কানাডায় একটি কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট ফিরোজ হায়দার খান, ফিনল্যান্ডে একটি কোম্পানির সিইও তমাল এস এম পারভেজ, রাশিয়ায় তিনটি কোম্পানির অন্যতমমালিক রফিকুল ইসলাম মিয়া আরজু এবং যুক্তরাজ্যে তিনটি কোম্পানির এমডি মোহাম্মদ আদনান ইমাম।

শহীদুল আহসানের ব্যবসায়িক গ্রুপের নাম আহসান গ্রুপ (এজি)। এনআরবিসি ব্যাংক এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এজি এগ্রোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি সত্ত্বেও ১৮৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকিগ্রস্ত করেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। একাধিক ব্যাংক থেকে আগেও বিপুল অঙ্কের ঋণ নেওয়া আছে এজি এগ্রোর।

ঋণের বিপরীতে এজি এগ্রো যে কিস্তি দিয়ে যাচ্ছে, তার উৎস নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। কারণ, কিস্তির অর্থ এসেছে এনআরবিসি ব্যাংকের উত্তরা শাখার গৃহনির্মাণ ঋণগ্রহীতা আজিজ চৌধুরী, তার পুত্র সালাউদ্দিন চৌধুরী ও তারেক চৌধুরী এবং এ পরিবারেরই মালিকানাধীন স্টাইলিশ গার্মেন্টসের ঋণ হিসাব থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সন্দেহ, এজি এগ্রো কিস্তি দিচ্ছে বিভিন্ন নামে নেওয়া তারই ঋণের অর্থ থেকে।

এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালক কামরুন নাহারের বিকল্প পরিচালক এ কে এম শফিকুল ইসলাম এবং এ বি এম আবদুল মান্নানের বিকল্প পরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক। বিকল্প দুইপরিচালকই এজির পরিচালক ও উপদেষ্টা। নিয়ম লঙ্ঘন করে তাদের উপস্থিতিতেই এজি এগ্রোর ঋণ অনুমোদন করে পর্ষদ।

আহসান গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বেগমগঞ্জ ফিড মিলকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১১৮ কোটি টাকা ঋণ দেয় ব্যাংকটির নোয়াখালীর চন্দ্রগঞ্জ শাখা। বাংলাদেশ ব্যাংক দেখেছে, ঋণ আবেদনপত্রেসিল, স্বাক্ষর ও তারিখ নেই। ঋণ দিতে শাখা সুপারিশও করেনি।

এ নিয়ে ব্যাংকের তৎকালীন বিকল্প পরিচালক এ এম সাইদুর রহমান এক চিঠিতে এনআরবিসি ব্যাংককে জানিয়েছিলেন, ‘নোয়াখালীর এক প্রত্যন্ত এলাকায় জমির যে মূল্য দেখানো হয়েছে, তা শুধু অতি মূল্যায়ন নয়, একে অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।’

বেগমগঞ্জ ফিডকে এজির স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বলে স্বীকার করতে চান না শহীদুল আহসান। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এজি এগ্রো ও বেগমগঞ্জ ফিডের ঠিকানা একই অর্থাৎ ৭৬, মহাখালী।বেগমগঞ্জ ফিডের নামে নেওয়া ঋণের ছদ্মাবরণে সুবিধাভোগী হচ্ছে এজি এগ্রো। শহীদুল আহসানের ভাই শফিকুল আহসান ও মিরাজুল আহসান বেগমগঞ্জ ফিডের পরিচালক। দুই প্রতিষ্ঠানই একে অন্যের হিসাবে বিপুল অর্থ স্থানান্তর করেছে।

আবার এজির মালিকানাধীন মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ওয়েবসাইটে বেগমগঞ্জ ফিডকে এজির সহযোগী প্রতিষ্ঠান দেখানো হয়েছে। মেরিডিয়ান ফাইন্যান্সে এজির মনোনীত পরিচালক শফিকুল আহসান। তিনি বেগমগঞ্জ ফিডের এমডি ছিলেন। ঋণ অনুমোদনের পরই ২০১৬ সালের ১৫ডিসেম্বর শফিকুল আহসানকে এমডি পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এনআরবিসি ব্যাংকে শহীদুল আহসানের বেনামি শেয়ারও রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কামরুন নাহার, এ বি এম আবদুল মান্নান ও আমির হোসেন—এনআরবিসি ব্যাংকে এতিন পরিচালকের বিনিয়োগের টাকা এসেছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে। এ শাখায় তাঁদের নামে সঞ্চয়ী ও ফরেন কারেন্সি (এফসি) হিসাব খোলা হয় তাদের অনুপস্থিতিতে।

দেশের নয়টি ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দেশ ছেড়েছেন চট্টগ্রামের দুই ভাই মিজানুর রহমান শাহীন ও মজিবুর রহমান মিলন। মিজানুর রহমান শাহীনের স্ত্রী কামরুন নাহার নিজেও একজন ঋণখেলাপি। তাদের কাছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকেরই পাওনা ৩০০ কোটি টাকা। অথচ খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন রেখে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৫(৬)(ঊ) ধারার লঙ্ঘন করে কামরুননাহার এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালক হন।

কামরুন নাহার ২০০৯ সালের পর থেকে দেশে ছিলেন না। কানাডা থেকে দেশে এসেছেন তিনি গত মাসে। দেশে না থাকলেও কামরুন নাহারের সই জাল করে আটটি পর্ষদ বৈঠকে তিনি এবং এ বি এমআবদুল মান্নান উপস্থিত ছিলেন বলে দেখানো হয়। আবার কামরুন নাহারের পক্ষে ২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এনআরবিসি ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) অংশ নেন শহীদুল আহসান।

কামরুন নাহার এবং এ বি এম আবদুল মান্নানের ২০১৫ সালের লভ্যাংশের অর্থ ২০১৬ সালের ২ মে তাদের সঞ্চয়ী হিসাবে জমা হয়। একই দিন দুজনের টাকা তুলে নেন এজির কর্মকর্তা ওমর ফারুক।

কামরুন নাহারের অংশ শহীদুল আহসানের ব্যক্তিগত হিসাবে এবং এ বি এম আবদুল মান্নানের অংশ এজির আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রিন প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্টের হিসাবে জমা দেন। দুই দিনপরই কামরুন নাহারের হিসাব থেকে আসা টাকা তুলে নেন শহীদুল আহসান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের
প্রতিবেদন মতে, ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত এনআরবিসি ব্যাংকের পর্ষদ সভায় কামরুন নাহারের অনুপস্থিতিতে তার শেয়ার হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। তার এক সপ্তাহ আগে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ফরাসত আলীর কাছে কামরুন নাহারের নামে একটি আবেদন আসে, যাতে দুবাইপ্রবাসী ব্যবসায়ী মো. হারুনের নামে কামরুন নাহারের শেয়ার হস্তান্তরের কথা বলা হয়।
আবেদনে মো. হারুনের ঠিকানা দেওয়া হয় মহাখালীর আহসান টাওয়ার। ফরাসত আলী পর্ষদ সচিবের কাছে এই আবেদনের উৎস জানতে চেয়েও জবাব পাননি। তবে এনআরবিসি ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এটা ভুয়া আবেদন।

কামরুন নাহারের ব্যক্তিগত ইমেইল ঠিকানা থেকে ফরাসত আলীর কাছে ২০১৬ সালের ৪ ও ৫ অক্টোবর পাঠানো একাধিক ইমেইল বার্তা পরীক্ষা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কামরুন নাহার এসব বার্তায় তাঁর সশরীরে উপস্থিতি অথবা কানাডার বাংলাদেশ হাইকমিশনের লিখিত নিশ্চয়তা ছাড়া শেয়ার হস্তান্তর না করার আবেদন জানান।

মো. হারুনের নামে কামরুন নাহারের শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদুল আহসান বলেন, ‘মো. হারুন দুবাইয়ের এক ভদ্রলোক। তার শেয়ার কেনার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছিল। মনে হয় কামরুন নাহারকে দিয়ে কেউ অভিযোগ করিয়েছে।’

টিভি চ্যানেলে তিন কোটি টাকা
এনআরবিসি ব্যাংক থেকে পাওয়া কাগজপত্রে দেখা গেছে, ঢাকা বাংলা মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনস চ্যানেলের (ডিবিসি) আয়ের অন্যতম জোগানদাতা শহীদুল আহসান। চ্যানেলটির এমডি তিনিএবং এর স্টেশনও আহসান টাওয়ারে।

চ্যানেলটির সঙ্গে বছরে ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা বিজ্ঞাপন দেওয়ার চুক্তি করেছে এনআরবিসি ব্যাংক। বিজ্ঞাপন বাবদ প্রতি মাসে ব্যাংকটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করবে। এর সঙ্গে থাকবে ১৫শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও অন্যান্য খরচ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বিজ্ঞাপন চলছে।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ডিবিসির চেয়ারম্যান। আর ডিবিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ মনজুরুল ইসলাম—যিনি এনআরবিসি ব্যাংকেরও পরিচালক। বিজ্ঞাপন চেয়ে গত ৪ ডিসেম্বর ডিবিসি আবেদন করলে ব্যাংকের পর্ষদ দুই দিন পরই তা অনুমোদন করে দেয়।


বাংলা ইনসাইডার/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭