ইনসাইড থট

দুধ উৎপাদনে ভারতের উত্থান এবং বাংলাদেশের অভিযাত্রা (দ্বিতীয় পর্ব)


প্রকাশ: 19/02/2022


Thumbnail

সমবায় মডেল পরিচালনাঃ
এক পর্যায়ে বহু সমবায় সমিতি গঠন করল আমূল। এই সমবায় সমিতিগুলির দিনে দুইবার গ্রামের খামারীদের নিকট থেকে দুধ সংগ্রহ করছিল। দুধে ফ্যাটযুক্ত পরিমাণ অনুসারে খামারীদের মূল্য প্রদান করা হচ্ছিল। এজন্য ফ্যাট মাপার যন্ত্র, প্রাথমিক পরীক্ষা, খামারীদের সচেতন করা ইত্যাদি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। একই দিনে দুধভর্তি সকল ক্যান দুধ চিলার ইউনিটে স্থানান্তর করা হচ্ছিল এবং সেখানে কয়েক ঘন্টার জন্য স্টোরেজ করে, অতঃপর পাস্তুরাইজেশন, কুলিং ও প্যাকেজিং ইউনিটে নেয়া হচ্ছিল। সেখান থেকে প্রথমে পাইকারী সরবরাহকারী এবং পরবর্তীতে খুচরা বিক্রেতাদের এবং এই দুই স্তরের বিপণন চ্যানেল অনুসরণ করে ভোক্তা গ্রাহকদের নিকট দুধ পৌছে যেত। এই সাপ্লাই চ্যানেলটি ড. কুরিয়েন এবং মি: ত্রিভূবনদাস প্যাটেল ডিজাইন করেছিলেন। এর ফলশ্রুতিতে সমবায় ব্যবস্থার উন্নতি অব্যহত ছিল এবং ১৯৬০ এর শেষের দিকে আমূল গুজরাটে সাফল্যের গল্পে পরিণত হয়েছিল।  


৪। অপারেশন ফ্লাডঃ ভারতীয় শ্বেত বিপ্লবঃ
১৯৬৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল আমূলের আওতায় দুগ্ধবতী গাভীর ফিডিং পদ্ধতির নতুন প্রযুক্তি উদ্বোধনের জন্য। দিন শেষে তার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আনন্দে পৌঁছে সমবায়ী খামারীদের সাফল্য জানার জন্য থেকে গিয়েছিলেন এবং ড. কুরিয়েনের সাথে সকল সমবায় পরিদর্শন করেছিলেন। আমূলের খামারীদের সাথে দুধের আদ্যপান্ত নিয়ে করা শূটিং দেখে এবং খামারীদের সাথে মতবিনমিয় করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিতে ড. কুরিয়েনের ভূমিকা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। দিল্লীতে ফিরে লালবাহাদুর শাস্ত্রী ড. কুরিয়েনকে তার ডেইরী মডেল বা আনন্দ প্যাটার্নটি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে বলেন। সম্মিলিত চেষ্টার ফলস্বরূপ ১৯৬৫ সালে গুজরাটে ভারতের জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড (এনডিডিবি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ড. কুরিয়েন এনডিডিবির দায়িত্ব নেন এবং আনন্দ প্যাটার্ন ভারতে অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে দেন এবং এই সম্প্রসারণের ফলে সারাদেশে দুধের সরবরাহ দ্রুত বাড়ছিল। আজ ভারত পাশের দেশ শ্রীলংকার মতই দুধের সবচেয়ে বড় আমদানীকারক দেশে পরিণত হতে পারত, যদি সেই সময় ভারত সরকার এনডিডিবি প্রতিষ্ঠা না করত এবং পর্যাপ্ত পদক্ষেপ না নিত। প্রতিষ্ঠা লগ্নে এনডিডিবি সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছিল দুধের বিপ্লব ঘটাতে অর্থ সংস্থান নিয়ে। এই অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য এনডিডিবি বিনা শর্তে অনুদান প্রদানের জন্য বিশ্বব্যাংক অনুরোধ করার চেষ্টা করেছিল। ১৯৬৯ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ভারতে আসেন। ড. কুরিয়েন তাকে বলেছিলেন “আমাকে টাকা দিন এবং ভুলে যান”। কিছুদিন পর বিশ্বব্যাংক এনডিডিবিকে ঋণ অনুমোদন দেয়। এই সহায়তা একটি অপারেশনের অংশ ছিল, যা পরবর্তীতে ‘অপারেশন ফ্লাড’ নামে পরিচিতি পায়। এই অর্থ দিয়েই আনন্দ প্যাটার্ন সম্প্রসারণ করা হয় এবং ভারতজুড়ে প্রায় এক লক্ষ সমবায় ৫০ লক্ষ খামারীকে প্রোডিউসার গ্রুপভূক্ত করে সমবায়ে যুক্ত করা হয়েছিল। একই সাথে গুডো দুধ তৈরী, দুগ্ধপণ্য বহুমূখীকরণ, পশুপুষ্টি, পশুস্বাস্থ্য এবং রোগ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে গুজরাট সমবায় দুধ বিপণন ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা পায়। ভারতের পাশাপাশি বিদেশওে আমূল পণ্য ব্রান্ড হিসেবে বিক্রি করার জন্য আমূলের অধিনে একটি পৃথক বিপণন ইউনিট সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ, আমূল বর্তমানে দেড়কোটি ডেইরী খামারীকে সারাদেশে প্রায় ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ২৪৬টি দুগ্ধ সমবায় সমিতি কার্যকর হয়েছে এবং ভারত আজ বিশ্বে বৃহত্তম দুধ উৎপাদনকারী দেশের মর্যাদায় আসীন হয়েছে। অপারেশন ফ্লাডের মূল ভিত্তি ছিল (ক) সমবায় ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, ইনপুট ও পরিষেবা সরবরাহের দ্বারা দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি বা দুধের বন্যা; (খ) গ্রামীণ খামারীর আয় বৃদ্ধি এবং (গ) দুধের গ্রাহক বা ভোক্তাদের জন্য যুক্তিসংগত মূল্য। অপারেশন ফ্লাড তিনটি দফায় কার্যকর করা হয়েছিলঃ

(ক) প্রথম পর্যায়ঃ ১৯৭০-১৯৮০ সাল এই দশকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর মাধ্যমে তৎকালীন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে পাওয়া গুড়ো দুধ ও মাখনের তেল বিক্রি করে এনডিডিবিকে বা দেশের ডেইরী সেক্টরকে অর্থায়ন করা হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে অপারেশন ফ্লাড ভারতের ৪টি প্রধান মহানগরী দিল্লী, মুম্বাই, কলিকাতা ও চেন্নাইয়ের গ্রাহকদের সাথে ভারতের ১৮টি মিল্ক হাবকে যুক্ত করা হয়েছিল।  

(খ) দ্বিতীয় পর্যায়ঃ ১৯৮১-১৯৮৫ মেয়াদে মিল্ক হাব ১৮ থেকে ১৩৬টিতে উন্নীত করা হয়েছিল এবং ২৯০টি নগরীর বাজারে দুধের আউটলেট স্থাপন করা হয়েছিল। এসময়ে একই সাথে গুড়োদুধের উৎপাদন বছরে ২২ হাজার টন থেকে ১৯৮৮ সালে প্রায়  ১ লক্ষ ৪০ হাজার টন হয়েছিল এবং এই উন্নয়নের পিছনে বিশ্বব্যাংকের ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিনিয়োগ ছিল চোখে পড়ার মত।

(গ) তৃতীয় পর্যায়ঃ ১৯৮৫-১৯৯৬ মেয়াদে দুগ্ধ সমবায়গুলির ক্রমবর্ধমান উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাজারজাতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সম্প্রসারণ ও জোরদারে সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সমবায়ের সদস্যদের শিক্ষার পাশাপাশি সহযোগী সদস্যদের ভেটেরিনারি ও প্রাথমিক চিকিৎসা স্বাস্থ্য পরিষেবা, পশুখাদ্য, কৃত্রিম প্রজনন ইত্যাদি বিষয়ে জাগরণ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই সময়ে মহিলাদের জন্য পৃথক সমবায় উদ্যোগকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। আরও গুরুত্ব দেয়া শুরু হয়েছিল স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে এবং প্রোটিন ফিড ও ইউরিয়া মোলসেস ব্লক এবং বাইপাস প্রোটিন নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রম। ফলে অবদানও রেখেছিল অনেক।

৫। আনন্দ প্যাটার্নঃ 
সমবায় প্রচেষ্টার মাধ্যমে খামারীদের বেশী লাভ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং মিল্ক হাইজিন/ফার্ম হাইজিন বৃদ্ধিই হলো আনন্দ প্যাটার্নের বৈশিষ্ট। আনন্দ প্যাটার্ন আসলে পেশাদার পরিচালনার মাধ্যমে সমবায় ভিত্তিতে দুধ সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ, বাজারজাতকরণ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদিকেই উৎসাহিত করে। আনন্দ প্যাটার্ন সফল হয়েছিল কারণ ইহা খামারীদের সমবায় খামারীদের নির্বাচিত খামারী কর্তৃক পরিচালিত হয় এবং নির্বাচিতগণ সকল খামারীর নিকট দায়বদ্ধ থাকে। এক্ষেত্রে গ্রাম সমবায়, দুধ ও গবাদিপশু, জেলা ও রাজ্য সমবায় এবং জাতীয় বিপণন সকল ক্ষেত্রে খামারীদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ও তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। আনন্দ প্যাটার্ন সমবায়কে ভোক্তার সাথে সংযুক্ত করে। আনন্দ প্যাটার্নের ৩টি স্তর। যথাঃ

(ক) গ্রাম সোসাইটিঃ আনন্দ প্যাটার্ন গ্রামের দুগ্ধ সমবায় সমিতির (ডিসিএস) মাধ্যমে দুধ উৎপাদনকারী খামারীদের সংগঠিত করে। যেকোন খামারী ১টি শেয়ার কিনে কিংবা সেখানে দুধ বিক্রি করে সমিতির সদস্য হতে পারে। প্রতিটি ডিসিএস এর জন্য ১টি দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র থাকে যেখানে খামারীগণ প্রতিদিন দুধ প্রদান করেন, মিল্ক ফ্যাট ও সলিড নট ফ্যাট/এসএনএফের ভিত্তিতে দুধের মান ও দাম নির্ধারিত হয়। প্রতিবছর শেষে ডিসিএসের লাভের ১টি অংশ খামারীদের সারা বছর দেয়া দুধের পরিমানের উপর ভিত্তি করে পৃষ্ঠপোষকতা বোনাস প্রদান করা হয়।

(খ) জেলা ইউনিয়নঃ একটি জেলা সমবায় দুধ উৎপাদনকারী ইউনিয়ন, দুগ্ধ সমবায় সমিতিগুলির মালিকানাধীন। এই জেলা ইউনিয়ন সমস্ত সমিতির দুধ কিনে নেয় এবং প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাত করে। বেশীরভাগ জেলা ইউনিয়ন ডিসিএসগুলির সদস্যদের জন্য বিভিন্ন ধরণের ইনপুট এবং পরিষেবা সরবরাহ করে।

(গ) রাজ্য ফেডারেশনঃ একটি রাজ্যের বা প্রদেশের সকল জেলা ইউনিয়ন একটি রাজ্য ফেডারেশন গঠন করে। এই রাজ্য ফেডারেশন ইউনিয়নগুলোর তরল দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য বিপণনের জন্য দায়ী থাকে। কিছু কিছু রাজ্য ফেডারেশন পশুখাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ এবং ইউনিয়ন কার্যক্রমকে সহায়তা করে থাকে।

আগামীকাল তৃতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে...


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭