ইনসাইড থট

দুধ উৎপাদনে ভারতের উত্থান এবং বাংলাদেশের অভিযাত্রা (তৃতীয় পর্ব)


প্রকাশ: 20/02/2022


Thumbnail

৬। পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনাঃ 
ভারতের দুগ্ধখাতকে একটি প্রাণবন্ত ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপে রূপান্তরিত করার জন্য অপারেশন ফ্লাড সেদেশে একটি শক্তিশালী ভিত্তি রচিত করেছিল। দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বনেতৃত্ব দেয়ার জন্য ভারতের পথকে প্রশস্ত করেছিল অপারেশন ফ্লাড। অতঃপর ভারতের ডেইরী শিল্পের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল অপারেশন ফ্লাডের অঅওতায় তৈরী নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে একে আরও শক্তিশারী করা। ভারতের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ডেইরী সেক্টরকে দুগ্ধ সমবায় আন্দোলনের সর্বোচ্চ সম্ভাবনায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ৪টি মূল ক্ষেত্রে নজর নিবন্ধ করে, যথাঃ সমবায় ব্যবসা জোরদার করা; উৎপাদন বৃদ্ধি করা, গুণমান নিশ্চিত করা এবং একটি জাতীয় নেটওয়ার্ক তৈরী করা। এনডিডিবি দেশের সকল খামারীর উপকারের দিকে লক্ষ্য করে প্রেক্ষিত পরিকল্পনাটি সহজ করেছিল এবং উহা বাস্তবায়নের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা ও প্রয়োজন ভিত্তিক অর্থ সরবরাহ করেছিল। 

৭। ন্যাশনাল ডেইরী প্লান-১ (এনডিপি-১)
জাতীয় দুগ্ধ পরিকল্পনা-১ বা প্রথম পর্ব ২০১১-২০১২ থেকে ২০১৮-১৯ মেয়াদের জন্য ভারতের একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) ঋৃণ হিসেবে ১৫ হাজার ৮৪৪ কোটি রুপি; ভারত সরকার ১৬৬ কোটি রুপিসহ মোট ২২৪২ কোটি রুপি বিনিয়োগ করার মাধ্যমে এনডিপি-১ বাস্তবায়ন হয়েছে। ভারতের ১৮টি বড় দুধ উৎপাদনকারী রাজ্য যথাঃ অন্ধ্র প্রদেশ, বিহার, গুজরাট, হরিয়ানা, কর্ণাটক, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, তেলেংগানা, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, তামলিনাডু, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবংগ, উত্তরাখন্ড, ঝাড়খন্ড এবং ছত্রিশগড়ে ; অর্থাৎ যে রাজ্যগুলো গড়ে ভারতের ৯০% দুধ উৎপাদন করে, এমন রাজ্যগুলোকে এনডিপি-১ এর আওতায় বিনিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। 

৮। ডেইরী প্রোসেসিং ও অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলঃ  
ভারতে ডেইরী শিল্পের বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠান অপারেশন ফ্লাডের সময় অর্থাৎ ১৯৯৬ সাল বা তার পূর্বে প্রতিষ্ঠা করা। ইতোমধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ২০১৭ সালে ভারত সরকার ১০ হাজার ৮৮১ কোটি রুপির ডেইরী প্রোসেসিং ও অবকাঠামো উন্নয়ন ফান্ড গঠন করে ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ মেয়াদের জন্য। অতঃপর ২০২০ সালে ভারতের কেবিনেট কমিটি ফর ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স এই মেয়াদ ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে।

৯। ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর ডেইরী ডেভেলপমেন্টঃ 
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৩০০ কোটি রুপির কেন্দ্রীয় স্কীম চালু করেছে ডেইরী সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বিনিয়োগ প্রদানের জন্য। এরূপ বাজেটের আওতায় সম্ভাব্যতা যাচাইপূর্বক শুধমাত্র উত্তর প্রদেশ ও বিহার রাজ্যের জন্য ২০২১-২২ থেকে ২০২৫-২৬ মেয়াদে ভারত সরকার ও জাইকার সহায়তায় ১৫৬৮.২৮ কোটি রূপির ‘ডেইরীং থ্রো কোঅপারেটিভস- কি টু সাসটেইনেবল লাইভলুহুড’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। 

ভারতে ডেইরী উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ ও তৎপরতা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রকৃতিগতভাবেই ভালো মানের মহিষের জাত যেমনঃ মুরাহ; নিলি-রাভি; মেহসানা; জাফরাবাদি, বান্নী এবং গাভীর ক্ষেত্রে বিখ্যাত গীর; রথী, লাল সিন্ধী, শাহীওয়াল, শেওতাকাপিলা ইত্যাদি মানসম্মত উচ্চ উৎপাদনশীল জাত ভারতকে শক্তিশালী অবস্থানে যেতে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে।

খ) বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ খাতের ক্রমবিকাশঃ
লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ফ্রিজার ও লন্ডন কোর্ট অফ ডিরেক্টরের উদ্যোগে ১৭৭৫ সালে বৃটিশ সামরিক অশ্বারোহী বাহিনীতে ঘোড়া সরবরাহের উদ্দেশ্যে ভারতে পোষা ঘোড়ার খামার স্থাপিত হয়। প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই এতদঞ্চলে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রাণিসম্পদ সেবার শুরু। এরও প্রায় শতাধিক বছর পরে ১৮৯৩ সালে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ সিভিল ভেটেরিনারি ডিপার্টমেন্ট যাত্রা শুরু করে। 

পাক ভারত স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত প্রাণিসম্পদের উৎপাদন সম্পর্কিত ‘পশুপালন বিভাগ’ কৃষি অধিদপ্তরের সাথে সম্পৃক্ত থেকে পরিচালিত হতো। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পরে উক্ত পশুপালন বিভাগের সদর দপ্তর কুমিল্লা জেলা শহরের ক্ষেত্রী বিল্ডিং এ স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ৩১ অক্টোবর ১৯৪৮ ইং তারিখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বেসমারিক পশুপালন বিভাগকে নতুনভাবে পূনর্গঠিত করে বেসামারিক ভেটেরিনারি সার্ভিস অন্তর্ভূক্ত করা হয়। পূনর্গঠিত পশুপালন বিভাগের নামকরণ করা হয় Directorate of Animal Husbandry.

১৯৬০ সালে পশুপালন বিভাগ আবার পূনর্গঠিত করে এর সদর দপ্তর কুমিল্লা থেকে ঢাকার নিমতলীস্থ ‘সাইন্স ভিলা’-তে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় পশুপালন বিভাগের অবকাঠামোগত সংস্কার ও পেশাগত সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি ও ভেটেরিনারি সার্ভিসের মান উন্নয়ন এবং লোকবল বৃদ্ধি ইত্যাদি ব্যাপারে সার্বিকভাবে পরিবর্তন আনা হয়। এই পূনর্গঠনের ফলে পশুপালন বিভাগের নতুন নামকরণ হয় Directorate of Livestock Services. এ সময়ে নবগঠিত পশুপালন অধিদপ্তরের বিভাগীয় পর্যায় থেকে শুরু করে থানা পর্যন্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বিভাগীয় ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তাগণ ১ম শ্রেণীর গেজেটড পদমর্যাদাসহ পূর্ব পাকিস্তান হায়ার লাইভস্টক সার্ভিসেস (EPHLS) অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্য দিকে জেলা ও সমপর্যায়ে কর্মকর্তাগণ ২য় শ্রেণীর পদমর্যাদায় পূর্ব পাকিস্তান এ্যানিমেল হাজবেন্ড্রী সার্ভিসের (EPAHS)  অন্তর্ভূক্ত ছিল। পশুপালন অধিদপ্তরের পূণর্বিন্যাসের ফলে থানাতে ০২ জন কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করা হয়। ০১ জন থানা সহকারী পশুপালন কর্মকর্তা, যার মুল কাজ ছিল পশুপাখির সার্বিক উন্নয়ন এবং অন্যজন থানা সহকারী ভেটেরিনারি সার্জন, যিনি পশুপাখির চিকিৎসা ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের দায়িত্বে থাকতেন। পরবর্তীকালে ১৯৬৪ সালে সদর দপ্তর ঢাকার নিমতলীস্থ ‘সাইন্স ভিলা’ হতে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৬ সালের জুন মাসের পূর্বে শুধুমাত্র মহকুমা তদুর্ধ্ব পদগুলোতে সংক্ষিপ্ত ০৩ মাসের পিজিটি সমাপ্তির উপর পদোন্নতি প্রাপ্ত ডিপ্লোমাধারী এবং ডিগ্রীধারী কর্মকর্তাদের নিয়োগের বিধান চালু করা হয়, যে সার্ভিসে পশুপালন ও পশু চিকিৎসা উভয় ডিসিপ্লিনের গ্রাজুয়েটগণ কর্মরত থাকতেন। এই সময়ে মহকুমা ও থানা পর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তাগণ সাব অর্ডিনেট লাইভস্টক সার্ভিসের (আপার) অন্তর্গত ছিল। অন্যদিকে ডিপ্লোমাধারী কর্মকর্তাগণ পূর্বের ন্যায় নিম্নতর এ্যানিমেল হাজবেন্ড্রী সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত থাকে। ১৯৬৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে মহকুমা ও থানা পর্যায়ে নিয়োজিত সকল ডিগ্রীধারী কর্মকর্তাদের পদ ২য় শ্রেণীর গেজেটেড পদ মর্যাদায় উন্নীত করা হয়। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সদর দপ্তরটি পূনরায় ১০৫/১০৬ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় এবং তৎপরবর্তীতে আলাউদ্দিন রোডে স্থানান্তরিত হয়। পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে মহকুমা ও থানা পর্যায় পর্যন্ত নিয়োজিত ডিগ্রীধারী কর্মকর্তাদের পদ ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে ১ম শ্রেণীর মর্যাদায় উন্নীত করা হয়। ১৯৮৩-৮৪ অর্থ বছরে সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কার সাধন করা হয়। এতে মহকুমাগুলিকে জেলায় রূপান্তর করা হয়। থানাগুলিকে জন প্রতিনিধির (চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ) অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ফলশ্রুতিতে অন্যান্য বিভাগের মত তৎকালিন পশুপালন বিভাগের থানা পর্যায়ের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী উপজেলা পরিষদে প্রেষণে নিয়োজিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক পূনর্বিন্যাস ও সংস্কার কমিটির (এনাম কমিটি) রিপোর্টের ভিত্তিতে পশুপালন অধিদপ্তরের প্রশাসনিক পূনর্বিন্যাস করা হয় এবং এর ফলে (ক) অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন), (খ) অতিরিক্ত পরিচালক (সম্প্রসারণ), (গ) অতিরিক্ত পরিচালক (উৎপাদন), (ঘ) অতিরিক্ত পরিচালক (গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন) পদ সৃষ্টি হয়। এই সময়ে সদর দপ্তরটি সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে ফার্মগেটে অবস্থিত কৃষি খামার সড়কে অধিদপ্তরের জন্য নবনির্মিত নিজস্ব ভবনে স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে পশুপালন অধিদপ্তরের নাম পরিবর্তন করে পশুসম্পদ অধিদপ্তর করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯২-৯৩ সালে জনাব মান্নান কমিটির সুপারিশে পরিচালক পদটি মহাপরিচালক, অতিরিক্ত পরিচালকের পদগুলো পরিচালক পদে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৯৫ সালে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের পদ উন্নীত করাসহ পরস্পর বদলীযোগ্য ১৯১টি জেলা ও সমপর্যায় ও পরবর্তীতে ৪৭টি উপ-পরিচালক ও সমপর্যায়ের পদ হতে ১৩টি পদকে উচ্চতর বেতন স্কেলে উন্নীত করা হয়। এভাবে কালের পরিক্রমায় ২০১১ সালে পশুসম্পদ অধিদপ্তর ‘প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর’ নামে নবযাত্রা শুরু করে। অতঃপর সুদীর্ঘ প্রয়াস ও নিরলস পরিশ্রমের ফলস্বরূপ ২০২১ সালে সর্বশেষ জনবলকাঠামো পায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। এই জনবল কাঠামোয় পরিচালক পদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং সকল প্রশাসনিক বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের অধিকর্তাগণ পরিচালক (৩য় গ্রেড) পদে উন্নীত হোন এবং একই সাথে ৫ম গ্রেড পদসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা হয়। 

আগামীকাল চতুর্থ পর্ব প্রকাশিত হবে...


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭