ইনসাইড টক

‘ইংরেজি অবশ্যই আমরা শিখবো, কিন্তু বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়’


প্রকাশ: 21/02/2022


Thumbnail

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেছেন, ৫২ সালে আমাদের যে ভাষা আন্দোলনটি হয়, ওটি কিন্তু মাতৃভাষার জন্য ছিল না। কেননা মাতৃভাষায় কথা বলতে তো কেউ নিষেধ করেনি। এটি হয়েছিল রাষ্ট্রভাষাকে বাংলা করতে হবে। ওপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকরা যখন বললো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে, তখন সমস্যাটি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের সবাই উর্দুতে কথা বলতো না। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের মতো এলাকাগুলোতেও কেউ উর্দুতে কথা বলতো না। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সব মিলিয়ে পাঁচ শতাংশ মানুষও উর্দুতে কথা বলতো না এবং তারা ছিল প্রধানত ভারত থেকে আগত মুসলিম। তাদেরকে পাকিস্তানে ‘মুজাহির’ বলা হতো। তাদের দাবি ছিল রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এটি আমাদের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে দেয়। আমরা তার প্রতিবাদ করি। এর ফলশ্রুতিতে আমাদের প্রথম উপলব্ধি হয় যে, এই পাকিস্তানের মাধ্যমে আমাদের কোনো স্বার্থরক্ষা হবে না। অর্থাৎ পাকিস্তান দ্বারা আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়া সম্ভব হবে না। বাঙ্গালিত্বের বিকাশ ঘটবে না। আমাদের স্বাধীনতার মূল টার্নিং পয়েন্ট ছিল ভাষা আন্দোলন। এর পরবর্তীতে ধাপে ধাপে আমারা অন্যান্য আন্দোলন করে স্বাধীনতা পেয়েছি। 

৫২ এর ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন মাধ্যমের প্রচলনসহ নানা বিষয়ে বাংলা ইনসাইডার এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এসব কথা বলেছেন। পাঠকদের জন্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলা ইনসাইডার এর নিজস্ব প্রতিবেদক অলিউল ইসলাম।

ড. মীজানুর রহমান বলেন, কিন্তু দেশ যখন স্বাধীন হয়ে গেলো, তখন কিন্তু ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিটি আপনা-আপনি মিইয়ে গেলো। যেহেতু সাংবিধানিকভাবে বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে, তার কারণে।  কিন্তু সমস্যাটি হলো আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হলেও এখানে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার ব্যাপারটি আমরা করতে পারিনি। আমাদের শিক্ষার যে বাহন, শিক্ষার যে মাধ্যম, এটির কিন্তু বিচিত্র ধরণ। প্রথমত হচ্ছে আমাদের একটি বিশাল অংশ লক্ষ লক্ষ ছাত্র কওমিসহ বিভিন্ন মাদ্রাসায় পড়ে। আবার অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। কেউ কেউ বলে এটি এখন চার লক্ষ ছাড়িয়েছে। বা সংখ্যাটি আরও বেশিও হতে পারে। আবার বাংলা মাধ্যমেও ইংরেজি ভার্সন নামে কোর্স চলছে। এই যে একটি মিশ্র শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের হয়ে গেলো, মানে বুনিয়াদি অবস্থায় প্রাথমিক থেকে এই  যে বিভাজন শুরু হয়ে গেলো, আমার মনে হয়, এটি একটি বড় গলদ।

তিনি বলেন, এই অবস্থা আজ থেকে ‍শুরু হয়নি। যখন ইংরেজরা এই দেশ শাসন করে, তারা এই দেশের শিক্ষার জন্য তেমন কিছু কিন্তু করেনি। কিন্তু তারপরও ১৮৫৪ সালে আমাদের পলাশী যুদ্ধেরও ১০০ বছর পরে ‘উড কমিশন’ এর প্রস্তাবে ইংরেজরা বলে গিয়েছিল এই দেশে শিক্ষার বাহন বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ে, তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষায় হওয়া দরকার। অর্থাৎ যে অঞ্চলের যে মাতৃভাষা, ওটাই হবে শিক্ষার মাধ্যম। কিন্তু আমরা সেটি করতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের উচ্চ শিক্ষায় বাংলা ভাষার প্রয়োগে একটি যা-তা অবস্থা বিরাজ করছে। আমরা উচ্চ শিক্ষায় যে ধরণের বই, পাঠ্যপুস্তক অনুবাদ করার দরকার ছিল, সেগুলো আমরা করতে পারিনি। যার জন্য উচ্চ শিক্ষাটা রয়ে গেলো ভিন্ন ভাষার ভাষার দখলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রকৌশল,মেডিকেল থেকে আরাম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত উচ্চ শিক্ষায় যে ধরণের বই আমাদের দরকার ছিল, পাঠ্যপুস্তক দরকার ছিল, অনুবাদ দরকার ছিল, সেগুলো আমরা করতে পারিনি। 

ড. মীজানুর রহমান বলেন, উচ্চ আদালতে রায় লেখার জন্য সাংবিধানিকভাবে বাধ্যবাধকতা থাকার পরও কোর্টে বোধহয় একটি মামলা করে রায় নিয়েছে যে রায় ইংরেজিতেও লেখা যাবে। মূলত বাংলায় লেখার কথা, তার সাথে ইংরেজিতেও লেখা যাবে। কোর্টের ওই রায়কে হাতিয়ার করে এখন রায় ইংরেজিতে লেখে, পারলে বাংলায়ও দুই-একজনে লেখে। এরকম একটি অবস্থায় চলে গেছে আমাদের কোর্ট-কাচারি থেকে আরাম্ভ করে সবকিছু। এমনকি আমাদের সাধারণ মানুষের জন্য যে ব্যাংক, তার চেক বইগুলোও ইংরেজিতে লেখা। সব বিল ইংরেজিতে হয়ে যাচ্ছে। এসবের কারণ হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলাকে অবহেলা করা এবং চতুর্মুখী শিক্ষা ব্যবস্থা। পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষায় মাতৃভাষায় পাঠ্যবইয়ের স্বল্পতার কারণেও আমরা সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। 

তিনি বলেন, আমাদের আইনের বই, বিজ্ঞানের বই অথবা প্রকৌশলের বইগুলো আমরা বাংলায় করলাম না। বাংলায় না করার ফল হলো এখন ডাক্তারের কাছে রোগী গেলে তার প্রেসক্রিপশন লেখা হয় ইংরেজিতে। রোগী পড়তেও পারে না, কিন্তু তার প্রেসক্রিপশন ইংরেজিতে লেখা। যে রোগী বাংলা পড়তে পারে না, তার এক্সরে রিপোর্ট দেওয়া হয় ইংরেজিতে। আমার মনে হয় এগুলো আমরা ইচ্ছে করেই করছি না। কারণ এগুলো তেমন কোনো কাজ না। ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে ওধুষের নাম লিখে দিনে কয়বার খাইবেন, খালি পেটে খাইবেন নাকি ভরা পেটে খাইবেন, একথাগুলো বাংলায় লেখা যায়। দুই চারজন ডাক্তার লেখেও। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এরকম সবগুলো সেক্টরেই চলছে। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, জাতীয়ভাবে এটিকে এখন দেখা উচিত, চিন্তা করা উচিত। 

তিনি আরও বলেন, ইংরেজি অবশ্যই আমরা শিখবো, কিন্তু বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি জানা লাগবে। প্রযুক্তির ভাষাও এখন ইংরেজি। কিন্তু মাতৃভাষাকে অবহেলা করে কোনো জাতি পৃথিবীতে কোনো সময় উন্নতি লাভ করতে পারেনি। এটি জার্মান বলেন, ফরাসী বলেন, জাপান বলেন, চিন বলেন, কোরিয়া বলেন, প্রত্যেক দেশ কিন্তু তার শিশুদের মাতৃভাষায় পড়াশোনা করিয়ে আজ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে। এটি কেন আমরা করতে পারছি না, আমাদের কোথায় কোথায় গাফিলতি আছে, তা সনাক্ত করা দরকার। আমাদের নতুন করে শুরু করতে হবে। এখন থেকে আমরা যদি শুরু করি আগামী ১০ বছরে আমরা একটি পর্যায়ে উন্নীত হতে পারবো বলে আমি মনে করি। আমাদের উচ্চ শিক্ষার শিক্ষকরা প্রত্যেকে যদি একটি করেও বই অনুবাদ করে, তাহলেও কিন্তু অনেক বই হবে। বাংলাদেশে একসময় মার্কেটিং বিভাগের জন্য বাংলা ভাষায় লেখা কোনো বই ছিল না। আমিই প্রথম ১৯৯০ সালের দিকে বাংলায় বই লিখি। আমি লেখার পরে এখন অবশ্য আরও অনেকেই মার্কেটিং এর উপর লিখেছে। বর্তমানে মার্কেটিং বিভাগের একজন শিক্ষার্থী চাইলেই বাংলা ভাষায় তার কোর্স সম্পন্ন করতে পারে। সেজন্য প্রত্যেকটি বিষয়ে মাতৃভাষায় পড়ার উপযোগী বই লেখা দরকার, অনুবাদ দরকার, পৃষ্টপোষকতা দরকার। কেন জানি আমাদের শিক্ষকরা এসবে এগিয়ে আসছেন না। তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্র কর্তৃকও প্রণোদনা থাকতে হবে। বাংলা একাডেমিকেও পৃষ্টপোষকতা করতে হবে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭