ইনসাইড থট

ছুটি চাওয়া কি ডাক্তারদের অপরাধ?


প্রকাশ: 28/02/2022


Thumbnail

ছুটি চাওয়াতে একজন চিকিৎসককে কারণ দর্শানোর নোটিস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলাম। ঘাবড়ানোর কারণটা সঙ্গত বটে। কারণ আমিও ছুটি চেয়েছি। তবে পার্থক্যটা হলো ডা. নাসের নামের ওই চিকিৎসক ছুটি চেয়েছেন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। আমি চেয়েছি আমার কর্মস্থল ব্রুনাই এর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। পার্থক্য আরো আছে। বাংলাদেশের বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে ছুটি চাইতে কোন বাধা নেই। তবে আমার এখানে ছুটি নিতে বাধা আছে। কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এদেশের জনসংখ্যার প্রতি ১৬ জনে একজন বর্তমানে কোভিড আক্রান্ত। দু'সপ্তাহ যাবত সবার ছুটি হিমাগারে রাখা হয়েছে। যারা ছুটিতে আছেন তাদেরকে অনতিবিলম্বে যোগদান করতে বলে হয়েছে । এমন পরিস্থিতিতে আমার জরুরি ছুটির আবেদন।

ডা. নাসেরের সাথে আরেকটি জায়গায় বড় পার্থক্য রয়েছে। ডা নাসেরকে যেদিন (১৭ ফেব্রুয়ারি) কারণ দর্শানো হয় সেদিন দেশে কোভিড আক্রান্তের  গ্রাফ একেবারেই নিচের দিকে। তার চারদিন পরে তো সব ধরণের বিধি নিষেধ উঠিয়েই নেয়া হলো। পক্ষান্তরে, তাঁর কারণ দর্শানোর নোটিস যেদিন (২২ ফেব্রুয়ারি) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজরে আসে, সেদিন ব্রুনাইতে আক্রান্তের সংখ্যা গত দু বছরের ভেতর সর্বোচ্চ। তাই না ঘাবড়িয়ে উপায় কি বলুন ! পরদিন আরো ঘাবড়ে গেলাম । কারণ সেদিন রোগীর সংখ্যা আগের দিনের থেকেও বেশি। আমার আবেদনপত্রটি তখন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কক্ষে। এর পরদিন আমার ছুটির অনুমোদন হলো।  অর্থাৎ গত দুবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী পাবার দিন মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি আমার ছুটির অনুমোদন দিলেন।

ডা. নাসেরকে ছুটি না দিয়ে তাঁর ছুটি চাওয়াকে 'হতাশাব্যঞ্জক ও দায়িত্বহীনতা' বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। কারণ দেশে নাকি তখন সংকটময় অবস্থা।  কোভিড ১৯ এর সংক্রমণ নাকি তখন প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেটি ডাহা মিথ্যা কথা।  বস্তুত ১৭ ফেব্রুয়ারী যখন কারণ দর্শানো নোটিস দেয়া হয়, তখন বাংলাদেশে সংক্রমণ গ্রাফ নিম্নমুখী। পক্ষান্তরে, আমাকে কেন ছুটি দেয়া হল, তার ব্যাখ্যা মন্ত্রণালয় দেয়নি, দেয়ার প্রয়োজন নেই। তবে ধরে নেয়া যায়, গত দুবছর ধরে আমি এদেশে সম্মুখ যোদ্ধা। এর ভেতর কখনো ছুটি নেই নি। গত আড়াই বছর কর্মস্থলের বাইরে যাইনি। এখন জরুরি প্রয়োজন, তাই যেতে চাই। কি জন্য জরুরি প্রয়োজন তার কোন প্রমান জমা দেয়া লাগেনি । আবেদনে উল্লেখ করেছি, এটাই যথেষ্ট।

কথায় কথায় শুনি চিকিৎসা একটি মানবিক পেশা। যদিও ২৭ বছরের পেশাগত জীবনে স্বীকৃত কোন অমানবিক পেশা কোথাও খুঁজে পাইনি।  সবই মানবিক পেশা।  বলতে পারেন, চিকিৎসা একটি 'অতি মানবিক' পেশা। তবে এই 'অতি মানবিক' পেশাজীবিরা, মানে স্বাস্থ্যকর্মীরা তো আর যন্ত্রমানব নয়।  তাদেরও চিত্ত আছে, সে চিত্তে বিনোদনেরও প্রয়োজন আছে। কখনো কি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, চলতি অতিমারীতে স্বাস্থ্যকর্মীদের মনের কি অবস্থা ? সীমিত সাধ্যের মধ্যে প্রতিনিয়ত রোগীদের যন্ত্রনা, স্বাসকষ্ট, বেঁচে থাকার আকুতি, মৃত্যু- এগুলো স্বাস্থ্যকর্মীদের মনে কি রেখাপাত করে সেটা অধিদপ্তরে বা সচিবালয়ে বসে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

কোভিড ১৯ এর ফলে স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক অবস্থা নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে ২০২০ সালে একটি গবেষণা হয়েছে। শতকরা ৭৪ ভাগ স্বাস্থ্যকর্মী সেখানে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, শতকরা ৬৫ ভাগ বিষন্নতা ও অনিদ্রায় ভুগছেন, শতকরা ৫৭ ভাগ রয়েছেন অন্যান্য মানসিক কষ্টে। উক্ত গবেষণায় আরো দেখা গেছে, ডা নাসেরের মত যারা কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে কাজ করেন, তাদের মধ্যে এসব মানসিক বিকারগ্রস্থতার পরিমান বেশি। এবার দৃষ্টি দেয়া যাক, গত বছর প্রকাশিত দক্ষিণ ভারতের একটি গবেষণার দিকে। ৫ শ ৪৪ জন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পরিচালিত এই সমীক্ষায় শতকরা ২১ ভাগ  বিষন্নতা, শতকরা ৭ ভাগ  উদ্বেগ এবং শতকরা ১৪ ভাগের অন্যান্য মানসিক কষ্ট ছিল। এ গবেষণায় দেখা গেছে, ডা নাসেরের মত যারা ফ্রন্টলাইন কর্মী, সরাসরি কোভিড রোগী নিয়ে কাজ করেন, তাদের বিষন্নতায় ভোগার ঝুঁকি শতকরা ৮৪ ভাগ বেশি।

স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মধ্যে বিষন্নতা এবং চাপ কমাতে বা দূর করতে উচ্চতর স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মানসিক এবং সামাজিক সমর্থন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক কারণ হিসেবে এসব গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এখানে উল্টোটা হচ্ছে। মানসিক এবং সামাজিক সমর্থন তো দূরের কথা, তাঁদের কর্মকান্ডে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মধ্যে বিষন্নতা, চাপ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের অতি মহামারিজনিত মানসিক সমস্যা হচ্ছে উপেক্ষিত। স্বাস্থ্যসেবা যদি সত্যিই অতি মানবিক পেশা হয়ে থাকে, তবে এসব স্বাস্থ্যকর্মীদের যারা পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদেরও অতি মানবিক না হোক, নিদেনপক্ষে মানবিক হওয়া প্রয়োজন। যারাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তাদেরকে নিয়োগ বা বদলির পূর্বে মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা প্রয়োজন। যাঁরা মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন তাঁদেরকেই 'অতি মানবিক' পেশাজীবিদের তদারকি ও নিয়ন্ত্রনের দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন। তাতে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে কাজের স্পৃহা বাড়বে, কমবে মানসিক যন্ত্রনা। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, চিকিৎসকদের প্রতি মানবিকতা তো দূরের কথা, বর্তমানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেন চিকিৎসকদের টর্চার সেলে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থার আশু পরিবর্তন দরকার।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭