ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ রূপ নিচ্ছে অর্থনৈতিক যুদ্ধে!


প্রকাশ: 28/02/2022


Thumbnail

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধটি শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক যুদ্ধে মোড় নিতে যাচ্ছে। আর এরইমধ্যে যুদ্ধের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্ব বাণিজ্যে। দ্বিগুণ বেড়ে গেছে জ্বালানি তেলের দাম। আগুন ধরেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে। প্রভাব পড়ছে স্বর্ণের বাজারে। হু হু করে পতনের হচ্ছে বিশ্বের রাঘব-বোয়াল শেয়ারবাজারে। করোনা পরিস্থিতির পর বিশ্ব অর্থনীতি যখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর ঠিক তখনি পুতিন যেনো দুঃস্বপ্নের মত হাজির ময়দানে। এ যেনো স্নিগ্ধ জোছনা ভরা সুন্দর রাতে হুট করে আমাবস্যার কালো অন্ধকার। আর এই অন্ধকারই ঘিরে রেখেছে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিকে।   
 
ইইউয়ের সাথে একটি আগ্রাসী অর্থনৈতিক চুক্তি থেকে বের হয়ে এসে যখন ইউক্রেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ইয়ানোকোভিচ রাশিয়ার সাথে নতুন চুক্তি করেন তখন থেকেই জ্বলতে শুরু করে দেশটি। সেই রেশে ক্ষমতাচ্যুত হন পুতিনপন্থী ইয়ানোকোভিচ। তার বদলে রাশিয়া দখল করে নেয় ক্রিমিয়া। ক্রিমিয়া দখলকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্বের চোখে এক ভিলেনে রূপ নেন পুতিন। শুরু হয় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। তবে সব ধরণের নিষেধাজ্ঞা এত দিন খুব ভালোভাবে সামলে এসেছিলেন তিনি। ইউরোপের সাথে রাশিয়ার তেল-গ্যাস বাণিজ্যতেও এর কোন প্রকার প্রভাব পড়েনি। ইউক্রেন যাতে রাশিয়ার তেল-গ্যাস বাণিজ্যতে কোন প্রকার বাঁধার কারণ না হয় তার জন্য বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে সরাসরি রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত নির্মাণ করা হয় নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপ লাইন। সব কিছুই ভালোই চলছিলো রাশিয়ার সাথে বিশ্ব অর্থনীতিরও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধ সাধলেন পুতিন নিজেই। 

ইউক্রেন আক্রমণের পঞ্চম দিন আজ। এর মাঝে রাশিয়ার উপর একের পর এক আগ্রাসী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান সহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রধান চারটি ব্যাঙ্কের উপর আরোপ করেছে নিষেধাজ্ঞা। পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবরোধে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ আটকে যেতে পারে রাশিয়ার। এর মধ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যাংক শেরব্যাংকের নামও রয়েছে। রাশিয়াকে আর্থিক লেনদেনের আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ। এর ফলে রাশিয়ান রুবলের দরপতন ঘটতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সুইফটের নিষেধাজ্ঞা জারি হলে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে অন্য দেশগুলো আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আর্থিক লেনদেন করতে পারবে না। তখন দ্বিপক্ষীয় লেনদেনে যেতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ। এতে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহজনিত সংকটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামেও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

ড. সালেহউদ্দিন বলেন, তুরস্ক কৃষ্ণসাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রপথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে ইংলিশ চ্যানেলে একটি রাশিয়ান জাহাজ আটক করেছে ফ্রান্স। জাহাজ চলাচল করতে না পারলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানিসহ খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে।

তিনি বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের খাদ্যপণ্যের ওপর নির্ভরশীল ইউরোপ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের গম আমদানির প্রধান উৎসস্থল যুদ্ধরত দেশ দুটি। ফলে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব শুধু ইউরোপ নয়, এটি এশিয়া থেকে দূরপ্রাচ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে।

যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে সোনার বাজারে। আন্তর্জাতিক বাজারে বৃহস্পতিবার সোনার দাম আউন্সপ্রতি (২৮ দশমিক ৪ গ্রাম) ২ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৯৬৮ ডলারে বিক্রি হয়েছে। যদিও পরদিন শুক্রবার স্পট মার্কেটে সোনার দাম প্রতি আউন্স ১ হাজার ৯০৯ ডলারে নেমে আসে। সাপ্তাহিক ছুটির পর আজ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও সোনার দর কোথায় যায় সেটিই এখন দেখার বিষয়।

বিশ্ব বাজারে তেল রপ্তানিকারক বড় খেলোয়াড়দের মাঝে রাশিয়া অন্যতম। দেশটির ইউক্রেন আগ্রাসনের ঘোষণার সাথে সাথেই এর প্রভাব যেই বস্তুটির উপর পড়েছে সেটি হচ্ছে তেল। বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিয়ে শুরু হয়েছে অস্থিরতা। যুদ্ধের পাঁচ দিনে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম উঠে সর্বোচ্চ ১০৫ ডলারে। যদিও গতকালের হিসেবে তা উঠা নামা করছিলো ছিল ৯৮ থেকে ১০২ ডলারের কাছাকাছি। ২০১৪ সালের পর গত সাত বছরে ১০৫ ডলার তেলের দাম ছিলো সর্বোচ্চ রেকর্ড। 

তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশ্ব বাজারে বেড়ে গেছে অন্যান্য নিত্য ভোগ্যপণ্যের দামও। সরবরাহে বিঘ্ন ঘটার কারণে এমনিতেই করোনা মহামারীর শুরু থেকেই ঊর্ধ্বমুখী ছিল সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম। রাশিয়ার হামলার পর আরেক দফা বেড়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই ভোগ্যপণ্যর দাম। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবর, ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রতি টন ক্রুড পাম অয়েলের দাম ১ হাজার ২৬৭ ডলার থেকে বেড়ে ২৫ ফেব্রুয়ারি ১ হাজার ৩৪৪ ডলারে উঠে যায়। স্পট মার্কেটে টনপ্রতি দাম ছিল আরও বেশি- ১ হাজার ৩৯০ ডলার।

পাম অয়েলের সাথে বেড়েছে গমের দাম। গমের দাম নিয়ে এমনিতেই বিশ্ব বাজার সব সময় থাকে অস্থিরতার মাঝে। যুদ্ধ শুরু আগে তেমনি গমের দাম ছিলো আকাশচুম্বী। পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসনের পর খাদ্যপণ্যটির দাম আরেক দফায় বৃদ্ধি পাওয়া জোর শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা। মানভেদে টনপ্রতি গমের দাম এরই মধ্যে ৪০০ ডলার থেকে বেড়ে ৫০০ ডলারে পৌঁছেছে। কানাডা থেকে আমদানি করা গমের দাম টনপ্রতি ৫০৫ ডলারে উঠেছে। ভারতীয় গমের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। এর ফলে আমদানিনির্ভর বাংলাদেশেও গমের দাম আরেক দফা বাড়তে পারে।

তেল ও গ্যাস একে অপরের সাথে যেনো ভাই-ভাইয়ের সম্পর্ক। এক জনের দাম বৃদ্ধিতে অন্য জনের বাজার যে স্থির থাকবে তা কখনোই সম্ভব নয়। আর তার জেরে প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজারেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। যুদ্ধ দির্ঘায়িত হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়া, আজারবাইজান ও কাজাখিস্তানের অপরিশোধিত তেলের ওপর নির্ভরশীল। এসব দেশ থেকে পরিশোধিত তেল জাহাজে করে কৃষ্ণসাগরের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিমে যায়। পশ্চিমে অবস্থিত দেশগুলো তাদের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে অপরিশোধিত তেলের জাহাজের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া এ অঞ্চলটি তার বন্দরগুলো থেকে বছরে কয়েক মিলিয়ন টন শস্য ও উদ্ভিজ্জ তেল সরবরাহ করে। ফলে কৃষ্ণসাগরে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটলে এটি শুধু ইউরোপ নয়, সারা বিশ্বেই জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করবে। আর এর সবচেয়ে বড় ভোগান্তির শিকার হবে এশিয়ার মানুষ।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭