এডিটর’স মাইন্ড

টিসিবির লাইনে বিবর্ণ মানুষের সানি লিওন দর্শন


প্রকাশ: 16/03/2022


Thumbnail

কান পাতলেই শুনি- বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল- উন্নয়নের যে উৎসব হচ্ছে, তা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই উন্নয়নের সঙ্গে বাড়ছে বৈষম্য। বাঙালির অস্তিত্বের শক্তি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমেই যেন নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। একদিকে কিছু মানুষ বিত্ত-বৈভবে গা ভাসাচ্ছে। অথৈ অর্থে দিশেহারা। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে কিছু মানুষের পিঠ যেন দেয়ালে ঠেকে গেছে। দিশেহারা মানুষের একটা চিত্র পাওয়া যায় টিসিবির ট্রাকের সামনে। এই লাইন প্রতিদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

টিসিবির ট্রাক থেকে সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ ইত্যাদি নেওয়ার জন্য আগে নিম্ন আয়ের মানুষ দাঁড়াত। এখন দাঁড়াচ্ছে মধ্যবিত্তরা। মধ্যবিত্ত বাঙালি আত্মসম্মানকে খুব গুরুত্ব দেয়। এটাই তাদের সবচেয়ে বড় অহঙ্কার। হাজারো কষ্টেও তারা প্রকাশ্যে নিজের দৈন্য উন্মোচন করে না। টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়ানো কোনো কোনো মধ্যবিত্তের জন্য মর্যাদা হারানোর মতোই ভয়ংকর। কিন্ত আত্মসম্মানের মাথা খেয়ে অভাবের জন্য তারা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাজারে জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বহু আগেই বাজার মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এমনকি ভালো আয়-রোজগার করা মানুষও এখন হাতে টান অনুভব করছে ভালোভাবেই। মাসে যারা লাখ টাকা উপার্জন করে, তাদেরও এখন ধার-কর্জ করতে হয় সংসার চালাতে। দিশেহারা মানুষের অস্বস্তি ক্ষোভে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু এই সমাজেরই কিছু মানুষ দ্রব্যমূল্যের খবর রাখে না। সয়াবিন তেলের লিটারপ্রতি দাম যদি এক হাজার টাকাও হয়, তবু তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এদের সামান্য হাঁচি-কাশি হলেই বিদেশে যায়। ঈদ, পালা-পর্বণে এদের বিদেশে প্রমোদ বিহারে যেতে হয়। এদের দেশের চেয়ে বিদেশে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ বেশি। এদের প্রায় সবারই কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নিদেন পক্ষে দুবাইতে বাড়ি ও সম্পদ রয়েছে। এদের পুত্র-কন্যাদের বিয়ের অনুষ্ঠান দেখে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালীরাও অবাক হয়ে যায়।

ইদানীং অভিজাত এলাকায় অসম্ভব এসব ধনী মানুষের বিয়ের অনুষ্ঠানে নতুন ধরনের ফ্যাশন চালু হয়েছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে এরা বিদেশ থেকে (সুনির্দিষ্ট করে বললে ভারত থেকে) নামিদামি নায়িকা-গায়িকা নিয়ে আসে। এদের এনে জৌলুস না বাড়ালে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানই যেন পানসে হয়ে যায়। ধনীরা তাদের বিত্ত যেভাবে ইচ্ছা ওড়াতে পারে। এ নিয়ে আমাদের ঈর্ষা হতে পারে, কিন্তু তাতে বিত্তশালীদের কী যায় আসে! কিন্তু কিছু মানুষের হাতে ইদানীং যেন আলাদিনের চেরাগ এসেছে। তাদের টাকা উপার্জনের জন্য কোনো পরিশ্রম করতে হয় না। তাদের বীভৎস বিত্তের উৎস কী, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতে পারে।

সম্প্রতি আটক হওয়া ফরিদপুরের বাবরের কথাই ধরা যাক। এক সময় তিনি মুরগির ব্যবসা করতেন। সেখান থেকে তার বিস্ময়কর উত্থান। কানাডায় বাড়ি বানিয়েছেন। দুই হাজার কোটিরও বেশি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে সিআইডি অভিযোগ করেছে। বাবরের আগেও ফরিদপুরে বরকত-রুবেলের হাজার কোটি টাকা পাচারের কাহিনি শুনেছি। আলাদিনের চেরাগ ছাড়া এত টাকার মালিক হওয়া কীভাবে সম্ভব? শুধু বাবর, রুবেল, বরকত নয়; এ রকম বহু মানুষের হাতে এখন হাজার কোটি টাকা। এই টাকার বেশিরভাগই এরা বিদেশে পাচার করে; কিছুটা দেশে ফুর্তি করে ওড়ায়। এদের মানুষের জন্য না আছে কোনো ভালোবাসা; না আছে দেশের জন্য ভাবনা। এ রকম হঠাৎ বনে যাওয়া বড়লোকরা এখন জাতির জন্য এক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এরা দেশের আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। এদের কুৎসিত রুচিবোধ সংস্কৃতির জন্যও এক বড় হুমকি।

আমরা পাপিয়ার পাঁচতারকা হোটেলের বিকৃত বিলাস দেখেছি। হেলেনা জাহাঙ্গীরের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার খবরও দেখেছি। এবার দেখলাম সানি লিওনের ঢাকা দর্শন। ক'দিন আগে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গণমাধ্যমকে বললেন, ভারতীয় অভিনেত্রী সানি লিওনের ভিসা বাতিল করা হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী এটাও বললেন, তিনি পরিচয় গোপন করে ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিট নিয়েছেন। ওমা, দু'দিন পরই দেখলাম- সানি লিওন ঢাকায়! বিশেষ বিমান বা চার্টার্ড বিমানে তিনি ঢাকায় উড়ে এসেছেন। এর পর জানলাম, সানি লিওন ঢাকা এসেছেন বিয়ের দাওয়াতে। একজন উঠতি ধনাঢ্য ব্যক্তি যেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করেই ঢাকায় নিয়ে এসেছেন সানি লিওনকে।

সানি লিওনের ব্যাপারে আমার কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। পর্নো স্টার থেকে তিনি হিন্দি ছবির নায়িকা হয়েছেন। তিনি রাজধানী ঢাকা আসবেন; না কোনো মফস্বল শহরে যাবেন- এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমি বিস্মিত, হতবাক দুটি কারণে। প্রথমত, সানি লিওনের যদি ভিসা বাতিলই হবে; তথ্যমন্ত্রী যদি তার ঢাকায় আসার ব্যাপারে আপত্তিই জানাবেন, তাহলে তিনি ঢাকায় এলেন কীভাবে? তার মানে কি এই যে, যারা তাকে এনেছেন তারা মন্ত্রী এবং সরকারের চেয়েও ক্ষমতাবান? তাহলে রাতারাতি টাকার খনি পাওয়া ব্যক্তিরা এখন সরকারকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে? দ্বিতীয়ত, বিয়ের দাওয়াত খেতে বা বিয়ের অনুষ্ঠানে সানি লিওনকে এনে আভিজাত্যের কী প্রকাশ দেখাতে চায় ওই ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। তারা কি প্রমাণ করতে চায়- তাদের টাকা খরচের জায়গা নেই? দেশে যখন দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের ত্রাহি অবস্থা, তখন সানি লিওনকে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসাটা কি এক ধরনের পরিহাস নয়?

এ দেশে কিছু মানুষ যেমন হঠাৎ ধনী হচ্ছে; তেমনি তাদের রুচি, মানবিক মূল্যবোধও লোপ পাচ্ছে। এই ঘটনা তারই প্রমাণ। টিসিবির দীর্ঘ লাইনে যখন মানুষের ফ্যাকাসে, বিবর্ণ মুখ; তখন সানি লিওনের উদ্দাম হাসি, বিয়ের উৎসব যেন এক অমানবিক বৈষম্যের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সারাজীবন স্বপ্ন দেখেছিলেন শোষণ, বঞ্চনা এবং বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের।

উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু বৈষম্য বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। বৈষম্যের এই দেশে উন্নয়নগুলো যেন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। এমন বাংলাদেশ কি চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, আমাদের শহীদরা?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭