ইনসাইড থট

বঙ্গবন্ধুর কারা-সাহিত্য


প্রকাশ: 17/03/2022


Thumbnail

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা (২০১৭) ও আমার দেখা নয়া চীন (২০২০) তাঁর লেখকসত্তার অনন্য পরিচয়ে ভাস্বর। গ্রন্থ তিনটির বিষয়বস্তু পর্যালোচনায় দেখা যায় তাঁর সংগ্রাম, অধ্যবসায় ও আত্মত্যাগের মহিমা বর্তমান প্রজন্মের জন্যও অভিনব। তবে ত্রয়ী গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর কষ্টে যাপিত জেলজীবনের প্রতিচ্ছবি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কারাবন্দি জীবনের একাকিত্বের মুহূর্তগুলো ভরে তুলেছিলেন আত্মজীবনী লেখায় নিজেকে নিয়োজিত করে। যদিও তা সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। তিনি কারাগারে বসে রোজনামচাও লিখেছেন। তাঁর ত্রয়ী গ্রন্থ বাংলা কারাসাহিত্যের অন্যতম সংযোজন।

২.

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দি অবস্থায় লিখে গেছেন তাঁর কারাজীবন, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সর্বোপরি সর্বংসহা সহধর্মিণীর কথা, যিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সহায়ক শক্তি হিসেবে সকল দুঃসময়ে পাশে  ছিলেন। একইসঙ্গে লেখকের চীন, ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণের বর্ণনাও বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। এছাড়া আছে আত্মজীবনী লেখার প্রেক্ষাপট, লেখকের বংশ পরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, দেশবিভাগ পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণ এবং এসব বিষয়ে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা। কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ কালপর্বের কারাস্মৃতি স্থান পেয়েছে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কারাগারে তাঁর লেখা দুটি এক্সারসাইজ খাতা জব্দ করে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এবং পুলিশের বিশেষ শাখার সহায়তায় উদ্ধারকৃত একটি খাতার গ্রন্থরূপ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কারাগারের রোজনামচা। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের পর বারবার গ্রেফতার হন। ওই সময়ের বন্দিজীবনের দিনলিপি উঠে এসেছে বইটিতে। বঙ্গবন্ধু কারান্তরীণ থাকাকালীন প্রতিদিন ডায়েরি লেখা শুরু করেন। এজন্য কারাগারের রোজনামচায় জেলজীবনের অনুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। অর্থাৎ জেলখানায় সংঘটিত বিভিন্ন কথা ও কাজের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা সবিস্তারে উপস্থাপিত। কারা-জীবনে তিনি সীমাহীন নির্যাতন, কষ্ট, অপমান, অবহেলা সহ্য করেছিলেন। বন্দি থাকাকালীন তাঁর সংসার, সন্তান ও বেগম মুজিব কষ্ট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে দিন পার করেছেন। তবে তিনি দিনলিপি লেখার আগেই কারাগারের প্রচলিত শব্দগুলোর অর্থ ঘটনার মধ্যদিয়ে তুলে ধরেছেন। প্রতিটি দিনলিপির শেষে লেখকের নিঃসঙ্গতার নিদারুণ বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। জেল-জীবন, জেল-যন্ত্রণা, কয়েদিদের অজানা কথা, অপরাধীদের কথা, কেন তারা এই অপরাধ জগতে পা দিয়েছিল- সেসব বিষয় যেমন সন্নিবেশিত হয়েছে; ঠিক তেমনি তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কারাগারে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দুঃখ-দুর্দশা, গণমাধ্যমের অবস্থা, শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন, ৬ দফার আবেগকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রকৃতিপ্রেম, পিতৃ-মাতৃভক্তি, কারাগারে পাগলদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না দরদ দিয়ে তুলে ধরেছেন। কারাগারের রোজনামচা দিনলিপি হলেও; তিনি বিবৃত করেছেন ভাষা আন্দোলনের প্রারম্ভিক পর্যায়, কখনো বা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠা সেই মহৎ সংগ্রাম। বর্ণনা করেছেন সেই সময়কার সংগ্রামে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকার কথা। বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার সংস্পর্শে এসে একজন কুখ্যাত চোর কীভাবে জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন এনে আলোর পথে যাত্রা শুরু করে, সে সত্যও বইটিতে অভিব্যক্ত। জেলখানায় কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয় তাঁকে। তবুও তাঁর লেখায় কৌতুকবোধের অভাব হয়নি। তাই রোজনামচায় বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনের কষ্টের পাশাপাশি রসবোধের পরিচয়ও ব্যক্ত হয়েছে।

১৯৫২ সালের চীন ভ্রমণের কাহিনি আমার দেখা নয়াচীন। বঙ্গবন্ধু এটি রচনা করেছিলেন ১৯৫৪ সালে যখন কারাগারে। তাঁর লেখা খাতাটির ওপর গোয়েন্দা সংস্থার সেন্সর ও কারা-কর্তৃপক্ষের যে সিল দেয়া আছে তা থেকেই সময়কালটা জানা যায়। শেখ মুজিবের বয়স তখন ৩২ বছর। কারাগারে বসে লেখা বলে এটিও কারা-সাহিত্যের অন্যতম দৃষ্টান্ত। গ্রন্থটির সূচনায় জেলে থাকার কথা লিখেছেন তিনি- ‘১৯৫২ সালে জেল হতে বের হলাম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর। জেলে থাকতে ভাবতাম আর মাঝে মাঝে মওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, ‘যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও।’ অল্পদিনের মধ্যে তারা কত উন্নতি করেছে। চীন দেশের খবর আমাদের দেশে বেশি আসে না এবং আসতে দেওয়াও হয় না। তবুও যতটুকু পেতাম তাতেই মনে হতো যদি দেখতে পেতাম কেমন করে তারা দেশকে গড়েছে! ৭৩ পৃষ্ঠায় তিনি চীনের সেলুনওয়ালার পরিচয় জিজ্ঞাসার উত্তরে মনে মনে বলেছেন- ‘... মনে মনে বলি, আমার আবার পরিচয়? পথে পথে ঘুরে বেড়াই, বক্তৃতা করে বেড়াই। আর মাঝে মাঝে সরকারের দয়ায় জেলখানায় পড়ে খোদা ও রসুলের নাম নেবার সুযোগ পাই। এই তো আমার পরিচয়।’ প্রকাশিত গ্রন্থটির খাতা  পরিচিতি অংশে আছে- ‘তরুণ জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান এন্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স-এ পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নয়াচীন সফর করেন। সেই সময়ের স্মৃতিনির্ভর এ ভ্রমণকাহিনি ১৯৫৪ সালে কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালে তিনি রচনা করেন। ১৯৫৭ সালে পূর্ব-বাংলার শ্রমমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তান সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে তিনি আরো একবার চীন সফর করেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর গভীর ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় এ লেখায়। সদ্য বিপ্লবের পর গণচীনের শাসনব্যবস্থা ও মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে গভীর আগ্রহ ও ঔৎসুক্যের পরিচয় আছে এ লেখায়। মুক্ত মন ও তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখা ঘটনার প্রাঞ্জল বর্ণনায় এ রচনা খুবই আকর্ষণীয়। চীন, রাশিয়া বা আমেরিকার মূল্যায়নে তাঁর বোধের স্বচ্ছতা ও সত্যনিষ্ঠা আমাদের মুগ্ধ করে। তরুণ বয়সেই যে তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতায় রূপান্তরিত হচ্ছিলেন এ বই তাঁর উজ্জ্বল নিদর্শন। এ লেখার সঙ্গে প্রসঙ্গক্রমে নিজের দেশ ও মানুষের অবস্থার কথাও তিনি তীক্ষèভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি ও গভীর উপলব্ধি তাঁর রচনাকে সমৃদ্ধ করেছে।’

৩.

আমার দেখা নয়া চীনে জেলজীবনের প্রসঙ্গ আছে। জেল-জুলুমের পরও রাজনীতিতে নিজের আদর্শবাদিতা বজায় রেখেছিলেন সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অভিব্যক্তি-‘আমি ভাবলাম, লোকটা অন্ধ। আমরা রাজনীতি করি, আমাদের লোভ মোহ দিয়া ভোলানো সোজা না। তাহলে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগওয়ালারা তা পারতো। মনে করে ভাবলাম, ‘জেলে দিয়া, মিথ্যা মামলার আসামি বানিয়ে, ইউনিভার্সিটি থেকে বহিষ্কৃত করে নানা প্রকার অত্যাচার করেও আমাদের মতের পরিবর্তন করা যায় নাই।’ দেখা যায়, হংকং-এ থেকে কম্যুনিস্ট বিরোধী হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ, চীনের অনেক বড় বড় লোক কম্যুনিস্ট জুজুর ভয়ে হংকং-এ আশ্রয় নিয়েছে। তবে আস্তে আস্তে তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ছে। অনেকে আবার হুজুগে এসে বিপদে পড়েছে। এইভাবে, বহুলোক হংকংয়ে সামান্য জায়গায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। যা হোক, ফেরার পথেও দুইদিন হংকংয়ে ছিলাম, তাই হংকং পর্ব শেষ করে নয়াচীনে ঢুকবো। (পৃ ২৭)

নিরাপত্তা আইনে নিজের জেল খাটার ঘটনা স্মরণ করেছেন চীনকে দেখার ঘটনা বর্ণনা করার সময়- ‘আর হতভাগাদের ছেলেমেয়েরা কিছুদিন মহাজনের বাড়ি কাজ করে, কিছুদিন ভিক্ষা করে জীবন রক্ষা করে, তারপর একদিন গ্রাম ছেড়ে পেটের তাগিদে অন্য কোথাও চলে যায়। আর ফিরে আসে না। এই যাওয়াই শেষ যাওয়া হয়। বোধ হয়, প্রকৃতির কোলে চিরদিনের জন্য আশ্রয় নেয়। তাদের ছেলেমেয়েগুলি না খেয়ে থাকতে থাকতে একদিন ব্যারাম হয়ে মারা যায়। আমরা বলি অসুখ হয়ে মারা গেছে। কিন্তু না খেতে না খেতে যে ব্যারাম হয়, তারপর মারা যায়, একথা আমাদের দেশে বলে না। কারণ, সরকারের থেকে খবর নিলে জানা যায় যে, না খেয়ে মরে নাই, ব্যারাম হয়ে মারা গেছে। যদি কেউ না খেয়ে মরার খবর দেয় তবে তার কৈফিয়ত দিতে কাজ সারা হয়ে যায়। আর যদি কোনো খবরের কাগজে প্রকাশ পায়, তবে কাগজআলার কাগজটা দেশের নিরাপত্তার নামে বন্ধ করে দেওয়া হয়্ আর বেচারার আমার মতো নিরাপত্তা আইনে জেল খাটতে খাটতে জীবন শেষ হয়ে যায়।’ (পৃ ৯৩)

জেলে থাকার সময় সিপাহিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক সম্পর্ক ছিল তার দৃষ্টান্ত রয়েছে এ গ্রন্থে- তাহলেই গরিব কর্মচারীরা কোনোমতে বাঁচতে পারে। তাদের ছেলেমেয়েদের ফ্রি শিক্ষার বন্দোবস্ত করা উচিত এবং সাথে সাথে তাদের জন্য অল্প খরচে বাড়ির বন্দোবস্ত করে দেওয়া উচিত- যাতে তাদের বেশি ভাড়া দিয়ে বাড়ি ঠিক করতে না হয়। আমি যখন জেলে ছিলাম এক সিপাহি আমাকে বলেছিল যে, ‘৬০ টাকা বেতন, তার মধ্যে বাসা ভাড়া দিতে হয় ১৮ টাকা। কারণ যে সামান্য কয়েকটা সরকারি বাড়ি আছে তাহা অন্য সিপাহিদের দেওয়া হয়েছে। আমাকে দেওয়া হয় নাই। কারণ আমি বড় কর্তাদের দালালি করতে পারি নাই।আমি বললাম, তাদের যদি না দেওয়া হতো তাহলে তো তাদেরও আপনার মতো দশা হতো। তাই একই কথা। এটা সত্য কথা যে একদিনে হয় না, কিন্তু সুষ্ঠু কর্মপন্থা থাকা দরকার।’(পৃ ১০৩)

কয়েক বছর রাজবন্দি থাকার পর জেলের অভ্যন্তরে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত মানুষদের দেখতে পেয়েছেন। আর পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্নীতির ভয়ঙ্কও অবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন- ‘১৪ বৎসরে রাজনীতিতে আমার শিখবার ও দেখবার যথেষ্ট সুযোগ হয়েছে। পূর্বে শুনতাম, দারোগা পুলিশের মতো ঘুষ কেউ খায় না। তারপর শুনতাম, সিভিল সাপ্লাইয়ের মতো ঘুষ কেউ খায় না, তারপর শুনতাম কাস্টমস অফিসারদের মতো ঘুষ কেউ খায় না। আমি কয়েক বৎসর রাজবন্দি হিসেবে জেল খেটেছি, তাতে দেখেছি জেলখানার ঘুষের মতো বৈজ্ঞানিকভাবে ঘুষ বোধ হয় কোনো ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরা নিতে জানে না। কোনো দুর্নীতি দমন বিভাগের কর্মচারীর উপায় নাই যে সে ঘুষ ধরে! জেলখানা, পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট, কাস্টম্স, কোর্ট-কাচারি, সাব রেজিস্ট্রার অফিস, ইনকাম ট্যাক্স, কারো চেয়ে কেউ কম না, এই ধারণাই আমার শেষ পর্যন্ত হয়েছে। জাতির নৈতিক পরিবর্তন ছাড়া ও সুষ্ঠু কর্মপন্থা ছাড়া দেশ থেকে দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এই দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করা দরকার। নিরাপত্তা আইন যদি ব্যবহার করতে হয় তবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলে বোধ হয় জনসাধারণ এই নিরাপত্তা আইনের কোনো সমালোচনা করতো না। সকলের চেয়ে দুঃখের কথা হলো, অনেক দুর্নীতিপরায়ণ নেতা দেশে আছে যারা শাসকগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলাইয়া চোরাকারবার করে লক্ষ লক্ষ টাকা উপায় করে। যখন তাদের বিরুদ্ধে কোনো সৎ কর্মচারী মামলা দায়ের করতে চায় তখনই বড় বড় মন্ত্রীরা এই সমস্ত কর্মচারীদের বদলি করে মামলা ধামাচাপা দেয়।’(পৃ ১০৪)

৪.

বঙ্গবন্ধুকে সাড়ে নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার ঘরে বন্দি রাখা হয়েছিল। লায়ালপুর (বর্তমানে ফয়সালাবাদ) জেলের অপরিসর একটি কুঠুরিতে রাখা হয়েছিলো। তাঁর জগৎ বলতে সেখানে ছিল চার দেওয়াল, একটি জানালা ও একটি উঁচু বিছানা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর তাঁকে সরিয়ে নেয়া হয় কারাগার থেকে দূরে আরো দুর্গম জায়গায়। ২৪ ডিসেম্বর একটি হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির অদূরে শিহালা পুলিশ একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসক।

একাত্তরে পাকিস্তানের কারাভ্যন্তরে বন্দি ছিলেন ঠিকই; কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন জানতেন না তিনি কোন শহরে আছেন। কেবল জানতেন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাঁকে বন্দি করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে রেখেছে। কারাজগৎ জগৎ সম্পর্কে তাঁর ভালোভাবেই ধারণা ছিল, কেননা আগেও তিনি কারাবন্দি ছিলেন। তিনি কারাবাস সম্পর্কে প্রায়শই বলতেন যে, প্রথম দফার স্বল্পকালের কারাবাস ছাড়া তাঁকে কারাগারে বরাবর নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে আটক রাখা হয়েছিল। দৈহিকভাবে নির্যাতন করা না হলেও নানাভাবে মানসিক হয়রানি করা হয় তাঁকে।  কারা-কর্তৃপক্ষ প্রতি সপ্তাহে বন্দির আচার-আচরণ সম্পর্কে ইসলামাবাদে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাতো। এই রিপোর্টে উল্লেখ থাকতো তিনি কি খাবার খেয়েছেন, তিনি কেমন ঘুমিয়েছেন, সেলের মধ্যে এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়াল অবধি পায়চারি করেছেন কি করেননি। বন্দির কথাবার্তা সম্পর্কে জানতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খুব উৎসুক ছিলেন। অবশ্য বঙ্গবন্ধু সেলে প্রবেশকারী গার্ডদের সালামের প্রতি-উত্তর দেওয়া ছাড়া সবসময় নীরবই থাকতেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘকাল নিঃসঙ্গ এবং বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগাযোগ ছিল- ‘জনগণের সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়নি, এক মুহূর্তের জন্যও নয়।...যখন বিপদ আমাকে আচ্ছন্ন করতো, আমি বুঝতে পারতাম আমার জনগণ তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করছে। যখন আমার মনের দিগন্তে দেখা দিতো চকিত আশার ঝলকানি, আমি জানতাম তারা সেই দুর্ভোগ অতিক্রম করছে।... একে বলতে পারেন প্রজ্ঞা, টেলিপ্যাথি, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিংবা অন্য যা খুশি তাই। কিংবা সম্ভবত এটা এক ধরনের ঐশী প্রেরণা; আমি যেটা জানি তা হলো আমার মন বলছিল বিজয় আমাদের হবেই। এত বিপুল রক্তদান বৃথা যেতে পারে না। রক্ত সেই অতীব জরুরি তরল, বাঁচিয়ে রাখে জীবনকে এবং এমনি রক্তদান যে আদর্শের জন্য, সেই আদর্শকেও তা বাঁচিয়ে রাখবে।’ বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর পরিবার সম্পর্কে নানা পরস্পরবিরোধী খবর ছড়ানো হতো। বন্দি থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ নিম্নরূপ :

‘সেই সময়ে আমার সেলে যাঁরাই এসেছিলেন তাঁদেরই দেখাতো অনেক কম আস্থাবান ও সুস্থির। আটককারীর ঔদ্ধত্য তাঁদের মধ্যে তেমন প্রকাশ পেতো না। বরং কোনো অজানা দুশ্চিন্তা যেন তাঁদের পীড়িত করতো।...

... এটা আমার কাছে বেশ তাৎপর্যময় মনে হয়েছিল। তাঁদের নিরাপত্তা বিধানে কাজে লাগতে পারে এমন কোনো বিবৃতি আমার কাছ থেকে আদায়ের জন্য উপর্যুপরি প্রয়াস থেকে এর সমর্থন মিলেছিলো। আমি অনুভব করেছিলাম, তাদের নৈরাশ্যজনক অবস্থা সম্পর্কে ক্রমোপলব্ধির এটা একটা ইঙ্গিত। এর ফলে আমার মধ্যে প্রত্যয়ী মনোভাব জেগেছিল যে, আমার দেশে তাদের দিন ভালো যাচ্ছে না। আমি তাদের কথা মান্য করতে অস্বীকার করি। আমি কোনো কিছু বলতে, লিখতে বা সই করতে অস্বীকার করি।’

৫.

রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা সাহিত্যিকরা তাঁদের ব্যক্তিগত কারা-অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে রূপায়ণ করেছেন। কখনো তা লেখকের সমকালীন ইতিহাস ও যুগকে আলোকপাত করে স্মৃতিকথা কিংবা গদ্য রচনায় উপস্থাপিত; কখনো বা বাস্তবতা-নির্ভর কথাসাহিত্যের অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে একই রকমের কারাজগৎ বৈচিত্র্য ও অভিনবত্বে নানা বর্ণ ও প্রকৃতিতে স্বতন্ত্র মাত্রা লাভ করেছে। আসলে কারা-সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র রূপ হিসেবে স্বীকৃত। লেখক সাধারণ কয়েদির মতো জেলহাজতে বন্দি কিংবা গৃহে অন্তরীণ সে সময় তিনি যে দিনপঞ্জি, স্মৃতিকথা কিংবা সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনা করেছেন তাকে কারা-সাহিত্য বলা হয়। আবার জেলের বাইরে থেকে যে কোনো মুক্ত ব্যক্তিও কারাভ্যন্তরের ঘটনাবলি নিয়ে কারা-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির ‘কারাজীবনের অন্তরালের ঘটনা, জেলখানার রীতিনীতি, শাসনপ্রণালি, পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং সেখানকার অন্যান্য বন্দি ও কর্মচারীবৃন্দ’-এর সবকিছু উন্মোচিত হওয়া আবশ্যক। বলা যায় কারা-সাহিত্য কারাগারের ভেতরের চিত্র তুলে ধরে। তবে বন্দিশালা সবসময়ই লেখকের জন্য একটি সংকীর্ণ পরিসর। তাঁর স্বাধীনতা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও সমঝোতার সুযোগ সেখানে সংকুচিত। অবশ্য অবারিত তাঁর কল্পনার আঙিনা। অনেক লেখককে পাওয়া যায় যাঁরা বন্দি হওয়ার পূর্বেই লেখনি ধারণ করেছেন। বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম এঁদের অন্যতম। তবে তাঁর রাজবন্দীর জবানবন্দী ১৯২৩ সালের ৭ই জানুয়ারি কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বসে লেখা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতে নজরুলের মতো অসংখ্য কারাবন্দি তাঁদের জীবনাভিজ্ঞতা লিখে গেছেন। কেউ কেউ বন্দি জীবনের অভিজ্ঞতায় নির্যাতনের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। আবার স্বাধীন দেশেও বন্দিত্বের যন্ত্রণার কথা লেখা হয়েছে। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা (২০১৭) ও আমার দেখা নয়াচীন (২০২০) কারা-সাহিত্যের অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রথম গ্রন্থটি তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টিও কারাবাসের সময় লিখিত। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও বন্দি অবস্থায় করাচী নিয়ে যাবার প্রসঙ্গে এস. এ. করিম উল্লেখ করেছেন- ‘করাচী পৌঁছানোর পর বঙ্গবন্ধুকে লায়ালপুর বর্তমানে পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদ কারাগারে নেওয়া হয়। তাঁকে একটি অতি ক্ষুদ্র সেলে রাখা হয়- যেখান থেকে লোহার শিক দ্বারা বেষ্টিত ছোট্ট ফাঁকা জায়গা থেকে এই বিশ্বজগৎ প্রায় আবছা। প্রচণ্ড গরম অথচ কোনো বৈদ্যুতিক পাখা ছিলো না- পরবর্তী সময়ে একটি পুরোনো বৈদ্যুতিক পাখা লাগানো হলো- যা মূলত ঘরের গরমকে আরও ছড়িয়ে দেবার জন্যই। এছাড়াও আরও নানা রকমের অত্যাচার ছিলো সেখানে। বঙ্গবন্ধু এসব তোয়াক্কা করেননি, তবে বেদনাবোধ করেছেন বাংলাদেশের জন্য- যে বাংলাদেশটি তখন জন্ম নেবার জন্যে লড়ছে।’ কারা-সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো- ক) কারাসাহিত্যে সমকালীন দেশ ও কালের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। খ) সমাজের অপরাধী জনগোষ্ঠী কারাজগতের জীবন্ত অংশ তেমনি জেলপ্রশাসনের দুর্নীতি ও অত্যাচারী প্রশাসনও তার অঙ্গ। গ) কারাকাহিনিতে রাজনৈতিক চিন্তার বিবর্তনের ইতিহাস নেই; আছে রূপান্তর। ভারতের সন্ত্রাসবাদী স্বাধীনতাকামীদের আত্ম-উপলব্ধি, আত্মজিজ্ঞাসার প্রকাশ দেখা যায় অনেক রচনায়। ঘ) ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের অমানবিক নির্যাতন করা হতো। সিপাইরা প্রতিনিয়ত রাজবন্দিদের চরমতম অত্যাচারের জাল বিস্তার করত। ঙ) কারা গ্রন্থগুলি যে কোনো দেশের এবং কালের বিপ্লব আন্দোলনে এবং বিপ্লবী প্রেরণার ক্ষেত্রে স্থায়ী উপাদান হিসেবে ভাস্বর। চ) পৃথিবীতে যতদিন কারাগার এবং দ-ব্যবস্থা বর্তমান থাকবে ততদিনই কারাগারের অসামাজিক মানুষগুলিকে কেন্দ্র করে তাদের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, ইন্দ্রিয় পীড়ন এবং বিভীষিকাময় মানসিক অবস্থা সাহিত্যের উপাদান হয়ে উঠবে। ছ) পাশবিকতা ও বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রাণের মৃত্যুঞ্জয়ী কণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছে কোনো কোনো কারা-সাহিত্যে। জ) পৃথিবীর কোনো কোনো কারারুদ্ধ বিদগ্ধ সাহিত্যিক রাজা বা সরকারের কাছে মার্জনা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন যা ছিল দাসত্ব ও চাটুকারিতার সামিল এবং আত্মবিক্রিত মনোভাবের পরিচায়ক। ঝ) কারা-সাহিত্যে সমাজবিশ্লিষ্ট মানুষের নৈতিকতা অনেক গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে।

৬.

কারাসাহিত্যের বৈশিষ্ট্যানুযায়ী এবং অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়া চীন-এই তিনটি গ্রন্থ পর্যালোচনার পর আমরা বলতে পারি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারা-কাহিনিতে অবরুদ্ধ কারাপ্রাচীরে পিষ্ট মানবতা, কয়েদি জীবনের ব্যথা-বেদনার সঙ্গে তাদের সংকীর্ণতা, দলবাজি ও রাজনৈতিক মতান্তরে সৃষ্ট কলহ, শাসকদের স্বার্থবুদ্ধি ও আদর্শচ্যুতি; সর্বোপরি রাজবন্দির পরিবার ও সন্তানদের জন্য মর্মবেদনা প্রাধান্য পেয়েছে। সর্বোপরি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম-ইতিহাস উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।বঙ্গবন্ধুর ৩০৫৩ দিনের কারাজীবনের বিবরণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের ইতিহাসের কথাই বলবে।

(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস,  বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭