ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ১ মাস পূর্তি


প্রকাশ: 24/03/2022


Thumbnail

মাত্রই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে ইউক্রেনে আকাশে। আড়মোড়া ভেঙ্গে হয়তো কেউ কেউ উঠেও পড়েছেন বিছানা ছেড়ে। আর আট-দশটা দিনের মতই সেই একই রুটিনে বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। কিন্তু বাসা থেকে এই বের হওয়া যে অনেক ইউক্রেনীয়র জন্য অনির্দিষ্টকালে পরিণত হবে কে বা ভেবেছিলো। ২৪শে ফেব্রুয়ারি সেই ভোরে ইউক্রেনের আকাশে শুধু যে সূর্যের আলোয় এসেছিলো তা নয়, সেই সাথে উড়ে এসেছিলো তপ্ত একরাশ গোলাও।

২০২২ সালের শুরু থেকেই রাশিয়ার সাথে ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের একপ্রকার জোর-কদমে টানাপোড়ন চলছিলো বলা চলে। যদিও এই সমস্যার গোঁড়া অনেক পুরনো। তবে নতুন বছরে তা যেন খুব বাজে ভাবে সবার সামনে ধরা দিতে শুরু করে। ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের আগ্রাসী সিদ্ধান্ত আর আমেরিকার টানা উস্কানি সত্ত্বেও অনেকেই ভেবেছিলেন পুতিন হয়তো ঠাণ্ডাই থাকবেন।

ন্যাটোর উস্কানির জবাবে স্বাভাবিক নিয়মে রাশিয়াও ইউক্রেন সীমান্তে ফেব্রুয়ারিতে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ সামরিক মহড়া। প্রায় দেড় লক্ষ্য সেনার এই মহড়াকে সবাই ন্যাটোকে ভয় দেখানোর একটি কৌশল মনে করলেও পুতিনের দাবার চাল যে ছিলো সবার অজানা। এমনকি রুশ বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই জানত না কি ঘটতে চলেছে। তবে সবাইকে চমকে দিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি মস্কো সময় ভোর ৬টায় ইউক্রেনে পূর্ণ দমে সামরিক অভিযানের ঘোষণা দেন ভ্লাদিমির পুতিন। তার ঘোষণার কয়েক মিনিটের মাঝেই ইউক্রেনের সেই মিষ্টি ভোর যেন মৃত্যু আতঙ্কতে রূপ নিলো। মুহুর্মুহু কামানের গোলা আর মিসাইলের আঘাতে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ও সীমান্ত লাগোয়া শহরগুলোর সামরিক ব্যারাক সমূহ।

পুতিনের এই অভিযানে শুরুতে কিছুটা সাফল্যর মুখও দেখতে পায় রুশ বাহিনী। অভিযানের দ্বিতীয় দিনই দখল হয় চেরনোবিল পারমাণবিক স্থাপনা। ওই দিনই রাজধানী কিয়েভের সীমান্তেও পৌঁছে যায় রুশ সেনারা। রাশিয়ার যুদ্ধের প্রাথমিক পরিকল্পনা দেখে বোঝা গিয়েছিলো যথা সম্ভব বেসামরিক প্রাণহানি এড়াতে চাইছিলেন পুতিন। আর তাইতো যুদ্ধের শুরুর সময় গুলোয় শুধু সামরিক স্থাপনাগুলোতেই রাশিয়ার মিসাইলের আঘাতের দেখা পাওয়া যায়। তবে দিন যত গড়িয়েছে রুশ বাহিনী যেন ততই খাঁদের কিনারায় পৌঁছেছে ইউক্রেনের শক্ত প্রতিরোধের সামনে। আর তাই তো যুদ্ধের শেষ এক সপ্তাহজুড়ে সামরিক স্থাপনা ছাড়াও মিসাইলের আঘাতে ধ্বংস হতে শুরু করেছে ইউক্রেনের বেসামরিক নানা স্থাপনা, গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে শহর।

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে জাতিসংঘের হিসেবে এখন পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এক কোটি মানুষ। এর মধ্যে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ৩৬ লাখ। রাশিয়ার অভিযানে প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো কিয়েভ দখল করে ইউক্রেনের বর্তমান সরকারে পতন। শুরুতে সেটা যত সহজ মনে হয়েছিলো বাস্তবে সেটি হয়নি রুশ বাহিনীর জন্য।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিমা বিশ্বের একের পর এক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ছে রাশিয়া। এখন পর্যন্ত নতুন করে প্রায় তিন হাজার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে দেশটির ওপর যা রাশিয়াকে সংখ্যার হিসেবে বিশ্বের সব থেকে বেশি নিষেধাজ্ঞা জর্জরিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। রাশিয়ার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের দেওয়া অবরোধের প্রধান টার্গেট ছিলো দেশটির অর্থনীতি ধ্বংস করা। আর এতে প্রাথমিকভাবে সফলও তারা। এরই মধ্যে অবরোধের চাপে ভুগতে শুরু করেছে রাশিয়ার অর্থনীতি। রুবেলের দামে পতন আর মুদ্রাস্ফীতি মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছে পুতিন সরকারের ওপর।

এতসব চাপের মাঝেও লক্ষ্য অর্জনে গতি আনতে বোমা বর্ষণকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে রুশ বাহিনী। আর তাইতো মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বোমাবর্ষণের ব্যাপকতা বেড়েছে। রুশ পদাতিক বাহিনী ও নৌবাহিনী ব্যাপক বোমা ফেলছে। কেননা ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধের মুখে স্থলপথে রুশ বাহিনীর অগ্রগতি থমকে আছে। রাজধানী কিয়েভ থেকে উত্তর–পশ্চিমে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছেন রুশ সেনারা, পূর্ব দিকে এই দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার।

রাশিয়ার অভিযান নিয়ে নতুন নতুন মন্তব্যও করে চলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার ভাষ্যমতে ‘ইউক্রেনে পুতিনের পিঠ ঠেকে গেছে।’ অন্যদিকে বাইডেনের সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জন কিরবির ভাষ্য, নৈতিক জোরই শুধু হারাতে বসেননি রুশ সেনারা, তাঁদের খাদ্য ও জ্বালানিতেও টান পড়েছে।

অন্যদিকে ফরাসি এক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার মতে, সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে। সঠিক নিশানায় হামলাও করতে পারছে না রুশ বাহিনী। তাঁর কথায়, এটা রাশিয়ার নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণনীতির সত্যিকারের ঘাটতি।

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ গতকাল বুধবার বলেন, ধ্বংসযজ্ঞ চালানো সত্ত্বেও পুতিনের অভিযান আটকা পড়েছে।

যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সমন্নয়হীনতায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে ব্যাপক আকারে। তবে কতসংখ্যক সেনা এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন, তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন। রুশ সেনাদের প্রাণহানির বিষয়ে একটা পরিসংখ্যান উপস্থাপনা করেছে পেন্টাগন। সংস্থাটির ধারণা, রুশ অভিযানের প্রথম মাসে প্রায় সাত হাজারের মতো রুশ সেনা নিহত হয়েছে।

তবে রুশ অভিযানে কি পরিমাণ ইউক্রেনীয় সেনা নিহত হয়েছে সে বিষয়ে ইউক্রেন সরকারের দেওয়া ভাষ্যর সাথে একমত নয় বিশেষজ্ঞরা। ইউক্রেনের সরকারের ভাষ্যমতে এখন পর্যন্ত রুশ অভিযানে প্রতিরোধে ১২ মার্চ পর্যন্ত তাদের ১ হাজার ৩০০ সেনা মারা গেছেন। অসমর্থিত সূত্র মতে এই সংখ্যাটি আরো কয়েকগুণ হতে পারে।

রাশিয়ার অভিযানে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বেশ ভালো রকমের সমর্থন পাচ্ছে দেশটির সাধারণ জনগণ থেকে। আর তাইতো সাধারণ জনগণের মনোবলে চিড় ধরাতে রুশ সেনারা আশপাশের লোকালয় অবরোধ করতে শুরু করেছে।

এই যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর মাঝে চরম আকারের সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে দেশটির সেনাবাহিনীর সাথে বিমানবাহিনীর সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ার মত। আর সেই কারণে সেনাবাহিনীর নানা অভিযানে রুশ বিমান বাহিনীর সহযোগিতার অভাব বেশ ভালোভাবে ভোগাচ্ছে রুশ বাহিনীকে।

ন্যাটোর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেছে, ‘রাশিয়ার পদাতিক বাহিনী যত বিপদে পড়ছে বিমানবাহিনী তত বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠছে এবং তারা যত্রতত্র তাদের ক্ষমতা ব্যবহার শুরু করেছে।’ এক্ষেত্রে কিছুটা স্থির দেখা গেছে নৌবাহিনীকে। দেশটির নৌসেনা ইউক্রেনের সাগর অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। নৌ বাহিনী একের পর এক দূর পাল্লার মিসাইল ছুঁড়ে সাহায্য করে চলেছে পদাতিক বাহিনীর অভিযানে।

শুরুতে যেভাবে ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চল রুশ বাহিনীর দখলে গেছে তা দখলে রাখা কিংবা আরো সামনে অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক প্রতিরোধে পড়েছ রুশ বাহিনী। গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মাঝে এখন পর্যন্ত শুধু মাত্র ইউক্রেনের দক্ষিণে অবস্থিত খেরসন দখল করতে সক্ষম হয়েছে রাশিয়া। এছাড়া যুদ্ধের শুরুতেই রাজধানী কিয়েভের মুখে পৌঁছে গেলেও শক্ত প্রতিরোধে রাজধানীর ভেতর এখন নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারেনি মস্কো। এছাড়া বন্দর নগরী মারিউপোল রুশ বাহিনী অবরুদ্ধ করে রাখলেও দখল নিতে সক্ষম হয়নি দেশটি। মিকোলাইভে নিয়মিত আকারে গোলা ও মিসাইল ছুড়ছে সেনাবাহিনী। উত্তরাঞ্চলীয় শহর খারকিভের দক্ষিণ ও পূর্ব দিক থেকে ঘেরাও করে শহরটিতে এগোনোর চেষ্টা চালাচ্ছে রুশ বাহিনী। দখল নিতে নিয়মিত বোমা হামলাও করছে তারা।

এত ঘটনা মাঝেও দুই দেশের মধ্য আলোচনাও শুরু হয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা এখন পর্যন্ত চারবার নিজেদের মাঝে বৈঠক করেছে। যদিও বৈঠকগুলো থেকে তেমন কিছুই অগ্রগতি হয়নি তবে এই বৈঠকের ফলে আলোচনার দোয়ার উন্মোচিত হয়েছে।

অন্যদিকে তুরস্কের সহযোগিতায় ইউক্রেন ও রাশিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বসে। তুরস্কে অনুষ্ঠিত হওয়া এই বৈঠকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুলেভ নিজেদের মাঝে যুদ্ধ বন্ধ বিষয়ে আলোচনা করেন। এই বৈঠকেও বলার মত তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি তবে দেশ দুটির মাঝে সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই বৈঠক যুদ্ধ বন্ধে বিশ্ববাসীর কাছে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখিয়েছে।

তবে যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে এখনো রাশিয়া ও ইউক্রেন একে অপরকে দোষারোপ করে চলেছে। রাশিয়ার ভাষ্য যুদ্ধ বন্ধে অবশ্যই ইউক্রেনকে দেওয়া রাশিয়ার প্রতিশ্রুতি গুলো পূর্ণ করতে হবে অন্যথায় অভিযান চলতে থাকবে। অন্যদিকে রাশিয়া আরো অভিযোগ করছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় ইউক্রেন রাশিয়ার দেওয়া শর্তগুলো পূরণ করছে না। তবে ইউক্রেন এই যুদ্ধে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে সরাসরি দায়ী করে চলেছে।

পশ্চিমা অনেক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না নেওয়া পর্যন্ত হয়তো ক্ষান্ত হবে না। তবে দেশটির এই অভিযানের ফলে যেমন আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির স্বীকার হয়েছে তেমনি এটি এখন দেশটির জন্য সম্মানের বিষয় হয়েও দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া যদি চলমান শান্তি প্রক্রিয়ায় অস্ত্রবিরতিতে রাজিও হয়, তবে তা হবে রুশ বাহিনীকে আবারো সুগঠিত করা এবং নিজেদের জন্য আরো বেশি সময় বের করা। কারণ রাশিয়া এই যুদ্ধে নিজেদের শক্তি ক্ষয়ের এক দুষ্ট চক্রে পতিত হয়েছে। এই চক্র কাটিয়ে উঠতে রাশিয়ার এখন একটা দম নেওয়ার জায়গা প্রয়োজন। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের পরের পর্ব হয়তো ইউক্রেনবাসীর জন্য আরো ভয়ের হয়ে উঠবে। রুশ বাহিনী নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে আরো বেশি বেসামরিক লক্ষে আঘাত হানবে তারা হয়তো তাদের যুদ্ধ কৌশলের ঘাটতি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ঢাকার চেষ্টা চালাবে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭