ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

পুতিনকে ঘিরে আফ্রিকান নেতাদের অবস্থানে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের শঙ্কা


প্রকাশ: 29/03/2022


Thumbnail

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র পৃথিবী কার্যত দুটি অঞ্চলে ভাগ হয়ে পড়ে। একটি অঞ্চল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক পশ্চিমা বিশ্ব অন্যটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিশ্ব সুপার পাওয়ার হওয়ার লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রর লড়াই মানব সভ্যতাকে বেশ অনেকবারই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিলো। যদিও ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে যাওয়ার পর গত ৩০ বছর ধরে এককভাবে বিশ্ব শাসন করে আসছিলো যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে রূপান্তরিত বর্তমান রাশিয়ার বিশ্ব মানচিত্রে তেমন কোনো প্রভাব এত বছর তেমনভাবে পরিলক্ষিত না হলেও, পুতিনের হাত ধরে যেনো দিন দিন আবারো সেই পুরনো গৌরবে ফিরতে শুরু করেছে রাশিয়া। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়াকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের মাঝে ফাটলের সুর যেমন লক্ষ্য করা গেছে তেমনি এই যুদ্ধে আফ্রিকান দেশগুলোর রাশিয়ার সমর্থনকে ঘিরে নতুন করে বিশ্ব মানচিত্রে স্নায়ুযুদ্ধের অশনি মেঘও যেনো দানাবাধতে শুরু করেছে। 

ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ অভিযান শুরুর পর জাতিসংঘে উত্থাপিত নিন্দা প্রস্তাবে এটি আরো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশের সরকারের পক্ষ থেকে ইউক্রেন অভিযানের সমর্থন পেয়েছেন পুতিন। এমনকি জাতিসংঘের উত্থাপিত নিন্দা প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত এবং নিন্দাও জানায়নি অনেক আফ্রিকান দেশ। 

জাতিসংঘের উত্থাপিত নিন্দা প্রস্তাবে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় সাধারণ পরিষদের ১৪১টি সদস্য দেশ, বিপক্ষে অবস্থান নেয় পাঁচটি দেশ। জাতিসংঘে তোলা ওই প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল ৩৫টি দেশ। এই ৩৫ দেশের মাঝে আছে দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে, তানজানিয়া, উগান্ডা, সেনেগাল, মোজাম্বিক, মালি, আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মাদাগাস্কার, নামিবিয়া, কঙ্গোসহ ১৭টি দেশই আফ্রিকার। যেখানে আফ্রিকার মোট দেশ ৫৪টি। আফ্রিকান এই দেশগুলোর এমন অবস্থান হতাশ করেছে ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের। 

ছোট একটা উদাহরণ সামনে আনা যাক। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার মাত্র ১২ ঘন্টার মাঝে আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী এবং উন্নত দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী শহর প্রিটোরিয়ায় একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন একদল বেসামরিক ও সামরিক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা। এসব কর্মকর্তারা রুশ একটি জাতীয় দিবস উদযাপনে যোগ দিয়েছিলেন। যেই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিলো দক্ষিণ আফ্রিকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ইলিয়া রোগাচেভ এবং এই অনুষ্ঠানে অতিথিদের তালিকায় ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানসহ গণ্যমান্য সব ব্যক্তিরা। হয়তো অনুষ্ঠানটি কার্যক্রম বা আয়োজনের সময় আগেই নির্ধারণ ছিলো কিন্তু অনুষ্ঠানটি যখন শুরু হচ্ছিলো তখন ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেন অভিযান শুরু করে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানটিতে যোগ দানে কারো মাঝেও কোন দ্বিধাবোধ ছিলোনা। 

আফ্রিকার দেশগুলোর এমন অবস্থানে অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বেশ শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে হওয়া স্নায়ুযুদ্ধর আবহ যেনো রাশিয়াকে আফ্রিকান দেশগুলোর সমর্থন নতুন করে নিয়ে আসছে। আফ্রিকান দেশগুলো নতুন করে নতুন সময়ে নতুন মেরুকরণের মাঝে পড়ে যাওয়ার ভেতর রয়েছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় দেশগুলোর এই অবস্থান এতটাই ব্যতিক্রম যে, স্নায়ু যুদ্ধপরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থা ও মূল্যবোধের প্রতি এসব দেশের প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

আফ্রিকান দেশগুলো থেকে ইউক্রেন অভিযান নিয়ে রাশিয়া কোন প্রকার সমালোচনার মুখেও পড়েনি। বরং দেশগুলো এই যুদ্ধ বন্ধে সংলাপের উপরই বেশি জোর আরোপ করেছেন। উল্টো আফ্রিকার কোন কোন দেশ এই যুদ্ধের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে দোষারোপ করে এই সংকটে তাদের ‘দ্বিমুখী আচরণের’ নিন্দা জানিয়েছে। 

আন্তর্জাতিক অনেক বিশ্লেষকের মতে, আফ্রিকান দেশগুলোর রাশিয়ার প্রতি এমন সমর্থন কোন অবাক করার বিষয় নয়। বরং এটা কথা উঠতে পারে তাদের বর্তমানে এত প্রকাশ্যভাবে সমর্থন জানানোর বিষয়টি। মহাদেশটির অনেক দেশেই রাশিয়া সমর্থিত সরকার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া ঔপনিবেশিক আমল থেকেই অনেক আফ্রিকার দেশকে স্বাধীন হতে অর্থ, অস্ত্র ও বুদ্ধি দিয়ে সহযোগিতাও করেছে মস্কো। এর ফলে আফ্রিকান দেশগুলোতে এমনিতেই মস্কোর প্রতি সমর্থন লক্ষ্য করা যায়। 

রাশিয়া আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে তার পুরনো সম্পর্ককে আরো মজবুত করার দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকবার রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভকে আফ্রিকা সফর করতে দেখা গেছে। এছাড়া দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি রাশিয়া নানা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তুলে ধরছে এবং আফ্রিকান নেতাদেরকে তাদের কাজের সমর্থন যুগিয়ে আসছে মস্কো। দেশটির এই প্রভাব বিস্তারের ফলও লক্ষ্য করা গেছে আফ্রিকার বেশ কিছ দেশে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও মালির মতো কয়েকটি দেশ থেকে উল্লেখ করার মতো ফলও এসেছে। 

তাছাড়া এসব দেশের পাশাপাশি রাশিয়ার খুব কাছে চলে এসেছে সুদান। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে ক্রমাগত চাপের মাঝে দেশটিকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে গেছে মস্কো। এর ফলও পেতে শুরু করেছে দেশটি। সুদান তার পূর্ব উপকূলের একটি বন্দর রাশিয়াকে ২৫ বছরের জন্য ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে চুক্তি করেছে। এছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবের বিপক্ষে যে পাঁচটি দেশ ভোট দিয়েছিলো তার একটি ইরিত্রিয়ার কর্মকর্তাদের সাথেও বেশ গাঢ সম্পর্ক রয়েছে মস্কোর। 

ইতিহাস বলে, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পশ্চিমাবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জোরালো মনোভাব রয়েছে। আর এই মনোভাবই প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়রা। 

আফ্রিকায় নিজেদের প্রভাব বিস্তারে রাশিয়া অস্ত্র ব্যবসাকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে। অস্ত্রর সাথে সাথে আফ্রিকার খাদ্য সমস্যা সমাধানে কৃষিকেও খুব ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে মস্কো। এই অঞ্চলের জন্য স্বল্প মূল্য অস্ত্র ও কৃষি ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। এছাড়া এই অঞ্চলের খনি ব্যবসাতেও বিনিয়োগ করছে তারা। যার ফল সরূপ আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলো ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অস্ত্র আমদানি করেছে। 

উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বয়ে যাওয়া ‘আরব বসন্তের’ ঢেউ আফ্রিকান শাসকদের পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আরো বেশি সতর্ক হওয়ার বিষয়ে সুযোগ দিয়েছে। আর যেটিকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে রাশিয়া। আফ্রিকান দেশগুলোতে এখনো ঔপনিবেশিক দেশগুলোর স্বেচ্ছাচার তাদের পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আরো বেশি দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। রাশিয়া সেই ফাঁকা জায়গাটুকুই যেনো পূরণ করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ববাসীকে আরো একবার যুক্তরাষ্ট্রর পাশাপাশি রাশিয়ার কূটনৈতিক বিজয় দেখারো সুযোগ করে দিলো। যা এককথায় পুতিনের বিজয়ই বলা চলে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭