ইনসাইড থট

জন্মদিনের মর্মগাঁথা


প্রকাশ: 30/03/2022


Thumbnail

আজ থেকে ৬৩ বছর আগের এইদিনে (৩০ মার্চ) বৃহত্তর কুমিল্লার এক পাড়াগাঁয়ে আমার জন্ম। ত্রিপুরা সীমান্ত সংলগ্ন ব্রাহ্মণপাড়া আমার পৈতৃক নিবাস হলেও আমার গর্ভধারিণী মা আর সব মায়ের মতোই তাঁর পিত্রালয় বাঞ্ছারামপুরে মায়ের কাছে যেতে মনস্থ করেন ও চৈত্র মাসের এই নিদাঘ দুপুরে তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম দেন। আমার পিতা সরকারী চাকুরীসূত্রে চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন ও দশ দিন পরে রোজার ঈদ হবে বিধায় ছুটির জটিলতার জন্যে আমার জন্মের ৯দিন পরে প্রথম আমার মুখ দেখার ও কোলে নেবার সুযোগ পেয়েছিলেন।

আমার শৈশব ও বাল্যকাল কেটেছে চট্টগ্রামে। ১৯৭৭ সালে ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসি। সেই থেকে আমি বাবা-মায়ের কোলছাড়া। একটা সংসার হয়েছে কিন্তু বিষয়-বুদ্ধির অভাবে আজও আমার নিজের কোন ঘর হয়নি। বাবা-মায়ের আদলে ক্ষমা-অনন্ত নামের দুইজন অসাধারণ ছেলে-মেয়ে পেয়েছি কিন্তু ভালো করে কিছু বুঝবার আগেই দেখলাম ওদেরও সংসার হয়ে গেছে। ওদের কাছেও আমরা বাবা-মা নেই। আমার স্ত্রী রেবেকা, ছেলে-মেয়ে দুটোও তার বুকের কাছে নেই। আমার বাবা আমাদের ছেড়ে গেছেন ১৩ বছর, মা ধুকে ধুকে বেঁচে আছেন যেন চলে যাবার অপেক্ষা। কী হলো তাহলে? এটাই জীবন? জীবন চক্রের এই নিয়ম মেনে নিতে পারা কতো কঠিন সংবেদনশীল বাঙালী মাত্রই জানেন। দেখলাম মানুষ যা পায় সবই হারায়, কিছুই এক সময় আর তার নিজের থাকে না। 

পেশাগত জীবনে যে অমূল্য সম্পদ পেয়েছি তা হলো নিজের দেশটাকে ভালো করে দেখতে পারা। ১৯৮৯ থেকে ‘৯৫ সাল পর্যন্ত ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে গ্রাম গবেষণায় বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া এমন কোন জেলা নেই যেখানে যাইনি। প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি, থেকেছি, অগণিত সাধারণ মানুষের সাথে মিশেছি। উদ্দেশ্য- বেসরকারি উদ্যোগে আর্থ-সামাজিক ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ, সাথে সরকারী সমন্বয় মিলিয়ে দেখা, এই নিয়ে ছ’বছরে মোট ১৮টি গবেষণা পুস্তক সিরিজ আকারে প্রকাশ হয়েছে। সেসব প্রকাশনা উন্নয়ন সাংবাদিকতার মডেল হলেও সেই ‘অনুভব’ সিরিজ আমাকে নিয়ে গেছে অভিজ্ঞতার এক নির্মোহ আদর্শ নির্মাণের দিকে, সে হলো- ‘মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা’ বুঝতে শেখা।

এই পেশাগত কাজই দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় ৪০টির মতো দেশে আমাকে নিয়ে গেছে, কোথাও লেখাপড়া বা কোথাও কাজ করেছি, নানা রকম মানুষ নানা সংস্কৃতির সাথে পরিচয় ঘটেছে, অভিজ্ঞতার ঝুলিও বড় হয়েছে কিন্তু এখন মনে হয় এই পরিব্রাজকের জীবন কি আমার আকাঙ্ক্ষায় কখনও ছিল? এ-ও জীবনচক্রের কাজ, মানুষকে একটি নিয়তির দিকে ক্রমাগত ঠেলে দেয়া!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের সাবসিডিয়ারি ক্লাসে প্রফেসর নাজমুল করিম স্যারের কাছে শিখেছিলাম সমাজের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে না শিখলে কাজের কাজ কিছু শেখা হবে না। সারা জীবন পদে পদে সে চিন্তার মর্ম অনুধাবনের চেষ্টাই করেছি। নব্বই দশকের শেষে এসে দুনিয়াজুড়ে যখন ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ সঙ্কোচনের আন্দোলন জোরদার হলো তাতে সামিল হয়ে আমার মনে বিশ্বাস দৃঢ় হলো তথ্য-প্রযুক্তি যদি উন্নয়ন ধারায় সম্পৃক্ত না হয় আর এর ফলে পরিবর্তনটা যদি আমরা বুঝতে না পারি তাহলে ভুল হবে। সে মতের নিরীক্ষায় জন্ম হলো আমার ‘আমাদের গ্রাম- উন্নয়নের জন্যে তথ্য-প্রযুক্তি’ প্রকল্প ধারণার। রামপালের শ্রীফলতলা গ্রাম কেন্দ্র করে গত ২৫ বছর সে পর্যবেক্ষণের কাজ করেছি ও দেশে বিদেশে কর্মসূত্রে সে প্রয়োগ যাচাই করেছি। এই অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতায় তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে সবচেয়ে কঠিন কাজ, ক্যান্সারের চিকিৎসা ও দূর-নিরাময় পরামর্শ যুক্ত করতে সমর্থ হয়েছি যা এখন চিকিৎসা শিক্ষা শাস্ত্রে স্বীকৃত হয়েছে। বিদেশে একে বাংলাদেশের ‘আমাদের গ্রাম মডেল’ বলে উল্লেখ করা হয়। এখন আমি যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কাজ করি তারা আমাকে ‘রামপাল মডেলের জ্ঞান ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে একটি বই লিখতে বলছে। কিন্তু আমি কি সেরকম কিছু করতে চেয়েছিলাম?

২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর যুবলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর মেলায় আমন্ত্রণ পেয়ে আমাদের গ্রাম দূর-নিরীক্ষার ক্যান্সার কার্যক্রম উপস্থাপন করা হলো। সব কিছু দেখে প্রধান অতিথি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিভূতচিত্তে পরামর্শ দিলেন, গ্রামের মানুষের জন্যে ভালো মানের চিকিৎসা ও গবেষণা কেন্দ্র হওয়া দরকার, দেশে থাকো, চেষ্টা কর, আমরা সব সহযোগিতা দেবো। ১২ বছর হলো রামপালে একটি ক্যান্সার চিকিৎসা ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলতে জীবন উৎসর্গ করেছি। আমার কী সত্যিই এমন কিছু করবার কথা ছিল? আমরা বুঝতেই পারিনা জীবন কখন কী সিদ্ধান্ত নিজে থেকে নিয়ে নেয়, সেখানে মানুষের নিজের কোন হাত থাকে না।

আমার সৌভাগ্য আমি বঙ্গবন্ধুর দেশে একটি অখ্যাত বাঙালী পরিবারে জন্মেছি। গুগলের মতে, আমার কর্ম আমাকে দুনিয়ায় কিছুটা পরিচিত করেছে বটে কিন্তু ভেবে আনন্দ পাই আমি দুইজন মেধাবী সন্তানের পিতা। আমার ভাই-বোনেরা, যাদের আমি কোলে-পিঠে নিয়েছি তাদের জন্যে যখন বুকের মধ্যে হাহাকার করে তখন আমি আমার সন্তানদের মুখের দিকে তাকাই। যখন আমার মায়ের জন্যে বুক ভেঙ্গে আসে তখন আমি অন্য মায়েদের মুখের দিকে তাকাই। আমার নাতনী যখন বলে ‘নানা-ভাই, তুমি কোথায়?’ - তখন মনে হয় পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী কে আছে? নিয়তি যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি কি কখনও জানতে চেয়েছেন, আমি কোথায়, কেমন আছি? আমার নাতি যখন আধো বোলে আমাকে ‘দাদা’ বলে ডাকে তখন মনে হয় পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী কে আছে? কিন্তু এ কথাও তখন মনে হয় আমি যে দেশে জন্মে এই সুখ অর্জন করেছি সে দেশের জন্যে আমি কী করেছি? মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতি আমার মনে আছে অথচ আমার সামনে ’৭৫ সালের ঘটনা ঘটেছে। আমার চোখের সামনে বিকৃত ইতিহাসের চর্চা ঘটেছে, আমি কিছুই করতে পারিনি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে আমি সেসব পর্যবেক্ষণ করেছি মাত্র, পত্রিকার পাতায় সেসব নিয়ে কিছু কিছু লিখেছি, কিন্তু আরও কী করতে পারতাম যা আমি করিনি বা আমার করা উচিত ছিল? এসব চিন্তার দহনে আজ আমার মতো একজন মধ্যবিত্ত তার বিবেক দংশনের জন্মদিন অবলোকন করছে! 

রেজা সেলিম, পরিচালক, আমাদের গ্রাম প্রকল্প
e-Mail: rezasalimag@gmail.com


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭