ইনসাইড থট

সাম্প্রদায়িকতার বিষে সবাই নীল হবো একদিন!


প্রকাশ: 09/04/2022


Thumbnail

হিজাব পরার কারণে ছাত্রীদের প্রহার করেছেন বলে মিথ্যে অভিযোগ তুলে যারা নওগাঁর স্কুল শিক্ষিকা আমোদিনী পালের বিরূদ্ধে অপপ্রচার করছেন, তাদের মুখোশ উন্মোচন করা জরুরী। শুরুতে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সফল হলেও এখন আমরা প্রকৃত ঘটনাটা জানতে পারছি। ওইদিন আসলে স্কুল ড্রেস না পরার কারণে কিছু ছাত্র এবং ছাত্রীকে শিক্ষক বদিউল সাহেব এবং আমোদিনী পাল নামমাত্র শাসন করেন। এই শাসণের ধরণ, মাত্রা বা ঔচিত্য নিয়ে আমরা কোন কথা বলি নি। বরং আমরা এটাকে সাম্প্রদায়িকতার মিশেল দিয়ে মিথ্যের মোড়কে ঢেকে পরিবেশন করলাম। অথচ মূল ঘটনার সাথে হিজাব পরা না পরার আদৌ কোন সম্পর্ক নাই।

এবার নেপথ্যের ঘটনা একটু জানার চেষ্টা করি। ওই স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক অচিরেই অবসরে যাবেন। আমোদিনী পালের নতুন প্রধান শিক্ষক (হেড মাস্টার) হবার কথা। কিন্তু বর্তমান প্রধান শিক্ষক চান, তার নিজের অনুসারী অন্য আরেকজন শিক্ষক প্রধান শিক্ষক হন। বর্তমান প্রধান শিক্ষকের বিরূদ্ধে দুর্নীতিরও  কিছু অভিযোগ আছে। আমোদিনী পাল দায়িত্ব পেলে সেসব ফাঁস হয়ে যাবার একটা ঝুঁকি আছে। সুতরাং আমোদিনী পালকে ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশের অধুনা ভীষণ জনপ্রিয় এবং সফল ‘সাম্প্রদায়িকতার কার্ড’ খেলা হলো। শোনা যায়, এর সাথে স্কুল ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীরাও জড়িত। এর সাথে সরকারদলীয় কেউ জড়িত আছে কি না সেটাও অনুসন্ধানের দাবি রাখে।

সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে ফেসবুক ল্যান্ডের অধিবাসীরা আমোদিনী পালের বিরূদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন। সিদ্দিক নামের এক অপরিচিত অভিনেতা নামের কুলাঙ্গার ‘কেন এখন পুরুষ জাতি এখন হিজাব পরে প্রতিবাদ জানাচ্ছে না’ এই মর্মে বিলাপ শুরু করে দিয়েছেন। চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে আমার এক স্নেহভাজন অনুজ চিকিৎসক ফেসবুক মেসেঞ্জারে একটি ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়ে আমোদিনী পালের এই হিজাববিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরূদ্ধে আমার মতামত জানতে চেয়েছেন।

যেহেতু আমার বয়স হয়েছে, চুলে পাক ধরেছে, বয়সের সাথে সাথে অভিজ্ঞতাও হয়েছে কিছু, তাই কোনকিছু শোনামাত্রই সাধ্যমত সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই আমি ঝাপিয়ে পড়ি না। বরং দুয়েকদিন অপেক্ষা করে সত্যটা জানার চেষ্টা করি। 

এখন অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগ। এখানে যে কোন গুজবের আয়ু সর্বোচ্চ তিনদিন। তারপরই জোকের মুখে লবন পড়ার মত গুজবও নেতিয়ে পড়ে। অতীতে দেখেছি এরকম পরিস্থিতিতে এই দু-তিনদিনেই দেশের নানা স্থানে একটা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধানোর অপচেষ্টা করা হয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে ঠেকানোর জন্য আমোদিনী পালের বিরূদ্ধে এই ঘটনা সুপরিকল্পিতভাবে ঘটানো হলেও তার অপব্যবহার করতে ফেসবুকের ছাগুগোষ্ঠী তাৎক্ষণিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর চিলে কান নিয়েছে বলে নিজের কানে হাত না দিয়েই যারা চিলের পেছনে দৌড়ায়, ফেসবুকে এরকম নিরীহ নির্বোধের সংখ্যাও কয়েক মিলিয়ন। 

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। একান্ন বছর বয়সী এই দেশটাকে কমপক্ষে একত্রিশ বছর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তি শাসন করেছে। রাষ্ট্রের বুকে প্রোথিত তাদের এই সাম্প্রদায়িক বীজ সময়ের সাথে সাথে বেড়ে আজ ফুলে-ফলে শোভিত। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে গত এক যুগেরও অধিক সময় একটানা শাসন করছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষের শক্তি। আজ তাই এই প্রশ্ন করা যেতেই পারে, সাম্প্রদায়িকতার বৃক্ষ নিধনে বর্তমানের ক্ষমতাসীন এই রাজনৈতিক শক্তি কতটা সফল? সাফল্য-ব্যর্থতা নিরূপন করার আগে আরো জানতে ইচ্ছে করে, সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করতে বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটি তৃণমূল পর্যায়ে কতটা সক্রিয়? গত এক যুগ ধরে এটা কি তাদের রাজনীতিতে অগ্রাধিকার তালিকায় আছে? নাকি একেকটা ঘটনা ঘটার পরে তাদের দৌড়ঝাপ বেড়ে যায়?

সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গে বাংলাদেশটাকে মাঝেমধ্যেই খুব অদ্ভুত লাগে। এই দেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই অসাম্প্রদায়িক। বর্তমানের দিকেও তাকিয়ে দেখি, অনেক মানুষই ব্যক্তিজীবনে ধর্মের নিয়মিত অনুশীলন করেন না। শুক্রবারে জুমার নামাজে মসজিদ উপচে পড়া ভীড় থাকলেও অন্য ওয়াক্তে তেমন ভীড় দেখা যায় না। অথচ ধর্ম নিয়ে সত্য-মিথ্যা কেউ কিছু বললেই আমাদের ঈমানি দণ্ড দাঁড়িয়ে যায়। সারা পৃথিবীতে বড় বড় ধর্মীয় উৎসবের সময় বাজার মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রেখে সবাইকে উৎসবে সামিল করার প্রচেষ্টা যেখানে বিরাজমান, সেখানে রমজান এলেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা জনগণের পকেট কাটতে তৎপর হয়ে ওঠে। কে কোথায় ধর্ম নিয়ে কী বললো, তাতে যতটা সোচ্চার হই তার একশোভাগের একভাগ প্রতিক্রিয়াও আমরা আশেপাশের ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ- লুটেরাদের প্রতি দেখাই না। বরং টাকার গরমে অনেক অসৎ ব্যক্তিই আমাদের সমাজে মহান সেজে বসে আছে। এইসব তথাকথিতদের পদলেহনকারীর সংখ্যাও সমাজে কম নয়। এরকম একটি কপট সময়ে আমরা বসবাস করছি। আমাদের মগজে বসত গেড়েছে সাম্প্রদায়িকতা। এভাবে চলতে থাকলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবো। 

বাংলাদেশের স্থপতি, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করতেন। আমাদের যে সব নেতারা আজকাল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলতে বলতে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, তারা কি জানেন যে আদর্শ কেবল মুখের কথায় প্রতিষ্ঠিত হয় না। আদর্শ প্রতিষ্ঠায় দেশব্যাপী একদল নিবেদিত নেতা-কর্মীর নেতৃত্বে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করতে হয়। তারা কি তাদের সেই রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করছেন? বঙ্গবন্ধু কন্যা, বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতাদের উপর আস্থা রেখে যে রাজনৈতিক দায়িত্ব অর্পন করেছেন, তাদের তা নিষ্ঠার সাথে পালন করা উচিত। নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। কাজটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে একদিন সাম্প্রদায়িকতার বিষে আমরা সবাই নীল হয়ে যাবো।

লেখক: বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭