ইনসাইড আর্টিকেল

নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ই কি ধর্ষণ বাড়ার কারণ?


প্রকাশ: 10/04/2022


Thumbnail

বাংলাদেশে সামাজিক চিত্র অনুযায়ী 'ধর্ষণ' এখন আর নতুন কোনো শব্দ না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী যেন নিত্যকার বিষয় এই ধর্ষণ। কিন্তু কেন দিনের পর দিন এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে তা মূল চিন্তার বিষয়। সকল বয়সী নারীদের জন্যই যেন এখন নিরাপত্তাই প্রধান উদ্বেগের কারণ। 

সাধারণত কোনো নারীর সাথে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাকে ধর্ষণ বলা হয়। দেশের সার্বিক শিক্ষার হার বাড়ছে, উন্নয়ন হচ্ছে, ততই যেন নৈতিক মূল্যবোধ এর অবক্ষয় হচ্ছে মানুষের অভ্যন্তরে। কিছু সমীক্ষাতে উঠে এসেছে, শিক্ষার হার বাড়লেও মানুষের মানবিক চিন্তা চেতনার জায়গাগুলো সঠিকভাবে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠছে না। তাছাড়া রয়েছে 'ভিক্টিম ব্ল্যামিং' কালচার আর সঠিক আইনি ব্যবস্থায় গাফিলতি। যে কারণে এই ধরণের অন্যায় প্রসারিত হচ্ছে এবং এর সংখ্যা বেড়ে চলেছে দিনের পর।  

দেশে রিপোর্ট দায়ের হওয়া মামলা সমূহের সবটুকু আমজনতা অবদি পৌঁছায় না। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে দায়েরকৃত অভিযোগের বাইরে প্রায় মোট ধর্ষণ ঘটনার ২৫ শতাংশ পৌঁছায়ই না। নানা সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক চাপে অনেকে আইনি সাহায্য নেওয়া থেকে পিছিয়ে আসেন। 

"লোকে কি বলবে?" এই ভয় একুশ শতকে এসেও মানুষের মধ্যে কাজ করে। বড় থেকে বড় অপরাধও এই লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধের কারণে বিনা বিচারেই চাপা পড়ে যায়। বহু আগে থেকেই সমাজের এই রীতি চলে আসছে যেখানে ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারকেই একঘরে করে দেওয়া হয়। বর্তমানে এ অবস্থা যে পরিবর্তন হয়েছে তা কিন্তু নয়। সমাজের মানুষের কাছে ভুক্তভোগীরা যেন আজও প্রধান আসামী। 

কিছু শ্রেণীর মানুষ এখনো বিশ্বাস করেন, নারীর পোশাক, পেশা, জীবনযাত্রার ধরণ ইত্যাদি ধর্ষণের কারণ। অর্থাৎ, তথাকথিত জীবন আচরণের বাইরে যদি কেউ নিজস্ব জীবনমানের সূচক দাঁড় করায় তাহলে তা আজও বেশি ভালো চোখে দেখা হয় না। পোশাক, পরিবেশ, পেশা ইত্যাদিকে আজও দাবী করা হয় নারী ধর্ষণের কারণ হিসবে। আবার, কিছু শ্রেণীর মানুষ ভাবেন, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া নারীদের সাথে ঘটা নানা অন্যায়ের প্রধান কারণ। এই সমস্ত চিন্তা চেতনা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতির মুখোমুখি  অনেক মানুষ, ভুক্তভোগী কিংবা ভুক্তভোগীর পরিবাররা হতে চান না। সেক্ষেত্রে, পুরো বিষয় চাপিয়ে যাওয়া যেন তাদের কাছে বেঁচে যাওয়ার পন্থা হিসেবে দাঁড়ায়।

কেবল নৈতিক মূল্যবোধ এর উপর দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া গেলে বিষয়টা সহজই হতো, তবে কেন ধর্ষণ হয় এবং এর সংখ্যা বাড়ছে তা চিন্তা করতে গেলে আমাদের সামনে অনেকগুলো কারণই উঠে আসে। প্রথমত শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা। বয়ঃসন্ধি একজন মানুষের জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বেশিরভাগ বিদ্যালয় সমূহে বয়ঃসন্ধি সংক্রান্ত কোনো রকম যৌন শিক্ষা দেওয়া হয় না।  ছেলে মেয়েরা কৌতূহল মিটাতে ইন্টারেনেটের যে ধরণের সাইটে প্রবেশ করে তাতে তাদের যৌন শিক্ষা তো হয়ই না বরং মন মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পরে। পারিবারিক শিক্ষা এবং চারপাশের পরিস্থিতি ইত্যাদি নানা কিছুও দায়ী একজন মানুষের অসুস্থ যৌন চিন্তা তৈরি করার। 

সাইকোলজিক্যাল দিক থেকে অনেকে বলে থাকেন, অসুস্থ পরিবেশ, অসুস্থ শিক্ষা,  ট্রমাটিক ইন্সিডেন্ট সহ আরো বিরূপ কারণের ফলে নানা ধরণের মানসিক বিকারগ্রস্ততা থেকেও একজন মানুষ ধর্ষকে রূপান্তর হতে পারে। কিন্তু দেশে সে সমস্ত সম্ভাবনা কে আমলে না নিয়ে প্রায়ই দেখা যায় কেবল ভুক্তভোগীর দিকে নজরপাত দেওয়া হয়। 

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইন ২০০৩ সেকশন ৯ অনুসারে ধর্ষণের শাস্তি হলো কোনো নারী বা সন্তানের সাথে ধর্ষণকারী কঠোর কারাদণ্ড এবং জরিমানা দিয়ে শাস্তি দিতে হবে। যেকোনো মহিলা বা সন্তানকে ধর্ষণের পর মৃত্যু বা আঘাত করার চেষ্টা করলে, তাকে কঠোর কারাদণ্ড এবং জরিমানা দিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। ধর্ষণের বর্ণনা যথাযথভাবে দিয়ে দোষ স্বীকার করলে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে, যা কমে ৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে, কিন্তু এর কম মেয়াদ নয় এবং জরিমানাও হতে পারে। আবার, ৩৭৬ ধারা দন্ডবিধি অধীন অনুসারে ধর্ষণের শাস্তি হলো, যদি কেউ ধর্ষণ করে, তার অবশ্যই শাস্তি হবে যা দশ বছরের কারাদণ্ডের সমান হতে পারে এবং জরিমানাও করা হবে যদি না ধর্ষিত নারী তার নিজের স্ত্রী হয় এবং তার বয়স ১২ বছরের বেশী হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই সকল আইন এবং বিচার ব্যবস্থা নিয়ে মানুষ তেমন জ্ঞান রাখে না। বিচার কার্যকর হলে হয়ত এই নিয়ম এবং শাস্তি সম্পর্কে মানুষের আরো ধারণা জন্মাতো। 

বিশ্বের "রেইপ স্যাটিস্টিক" ক্রমানুসারে বাংলাদেশের অবস্থান খুব একটা নিচে নয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে এক হাজার ৬২৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৩ জনকে। আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১৪ জন। আর মামলা হয়েছে এক হাজার ১৪৪টি। এই সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার দাবি বিচারহীনতা এবং যথাযথ শিক্ষা না থাকার কারণে মানুষের বিকৃত যৌন চাহিদা এবং মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় যা পরবর্তীতে এমন ঘৃণীত অপরাধে রূপ নেই। 

এই অবস্থা থেকে মুক্তি বা এই অবস্থা থেকে উত্তরণ রাতারাতি সম্ভব না। যদি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় যেমন, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্করণ, বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তবে দেশের সামগ্রিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা রাখা যায়। 


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭