ইনসাইড থট

খাবারের পুষ্টিমান বিবেচনায় খাদ্যাভাস পরিবর্তন সময়ের দাবি


প্রকাশ: 14/04/2022


Thumbnail

আজ পহেলা বৈশাখ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। বাঙালি সাংস্কৃতির প্রথা অনুযায়ী এই দিনে পান্তা-ইলিশ খাওয়া একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। পান্তা-ইলিশ বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্লেটভরা পানিভাত, সাথে ভাঁজা ইলিশ মাছ, কাঁচা পেঁয়াজ, পোড়া শুকনো মরিচ বা কাঁচা মরিচ, আলু ভর্তা, ডাল ভর্তা জাতীয় খাবার। সব আইটেম মিলিয়ে পরিমাণ তুলনা করলেও ভাতের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে থাকে। 

আমাদের সমাজে দৈনন্দিন খাবার গ্রহণকালে প্রথমেই ভাত পরিবেশন করা হয়। প্লেটে ভাতের পরিমাণ তুলনামূলক বেশিই থাকে। পরবর্তীতে মাছ/মাংস/সবজি নেওয়া হয় যাহা পরিমানে ভাতের তুলনায়  অনেক কম হয়।

জাপানে অধ্যয়নকালে দুপুরের খাবারের সময় ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী একসাথে একই টেবিলে নিজ নিজ খাবারের পাত্র নিয়ে বসতাম। এতে সবার খাবারের পরিমাণ ও ধরন দেখা যেত, মাঝে মধ্যে স্বাদগ্রহণের জন্য আংশিক খাবার বিনিময় হতো। জাপানীরা একাধিক ধরনের খাবার ছোট ছোট পাত্রে পৃথক পৃথক করে আনতো। পরিমাণে সবচেয়ে বেশি থাকতো সবুজ সালাদ এবং সবজি। লক্ষণীয় ছিল, জাপানীদের প্রধান খাদ্য ভাত হলেও, তাদের ভাতের পরিমাণ থাকতো সবচেয়ে কম। পরিমাণ এত অল্প থাকতো যে আমার একজনের ভাতের পরিমাণ ওদের ৪-৫ জনের ভাতের সমান থাকতো। একদিন বিভাগীয় প্রধান Professor Murata হাস্যরস করে বললেন, ‘মিঃ হোসেন, তোমার তরকারি ও সালাদের পাত্র ছোট, ভাতের পাত্র সবচেয়ে বড়’। আমি লজ্জা কাটিয়ে ওঠার জন্য জবাবে বলেছিলাম, ‘ভাত আমাদের প্রধান খাবার’। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ‘জাপানীদেরও প্রধান খাদ্য ভাত’। যদিও ঐ লজ্জা কাটাতে পরবর্তী ৪ বছর চেষ্টা করে দৈনন্দিনের খাবারে ভাতের পরিমাণ কমিয়ে এনেছিলাম। যা এখনও বহাল রাখার চেষ্টা করছি, দেহের ওজন কমানোর ক্ষেত্রে সুফলও পেয়েছি। কিন্তু বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে এই চেষ্টা বিফল হয়ে যায়।

একবার জাপানে এক অভিজাত হোটেলে টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের দেয়া একটি মধ্যাহ্নভোজে জাপানী, বাঙালি মিলে জনা পঞ্চাশেক হবে মেহমান ছিল। যথারীতি খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। ‘এপিটাইজার’ পরিবেশন শেষে প্রতিজনের সামনে একটি বড় প্লেটে মেইন ডিশ পরিবেশন করা হয়েছে। প্লেটের রয়েছে বড় এক টুকরো Smoked Red Salmon, সাথে সমপরিমাণ Potato mesh, কয়েকটি সিদ্ধ Baby carrot, Baby corn,  Mushroom, কচি মটরশুঁটি। সাথে পানীয় হিসেবে রয়েছে পছন্দমত Black coffee, Green tea, black tea। বিপত্তি বাঁধলো খাবারের শেষ পর্যায়ে যখন মিষ্টান্ন (Dessert) পরিবেশন করা হলো। একজন বাঙালি গণ্যমান্য ব্যক্তি দাড়িয়ে ওয়েটারকে (জাপানীজ ভাষায়) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা আমাদের ভাত দিবা না?‘ উল্লেখ্য ঐ ভদ্রলোক দীর্ঘদিন যাবত জাপানীজ স্ত্রীসহ জাপানে বসবাস করছেন। তা সত্বেও দুপুরের খাবারে মাছ-ভাতের পরিবর্তে মাছ-আলুভর্তা (Potato mesh-Smoked fish) মেনে নিতে পারেনি।

বিভিন্ন দেশের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস বিভিন্ন ধরনের। খাদ্যের তালিকায় বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মেন্যু রয়েছে। যেমন- বাংলাদেশ, ভারতের বাঙ্গালিরা মাছ-মাংস-সবজি জাতীয় খাবার পছন্দ করে। আরবীয়রা রুটি-তন্দুরী-মাংস-ডাল জাতীয় খাবার পছন্দ করে। পশ্চিমাদের আবার ভিন্ন ধরনের খাবার পছন্দ যাকে ‘ওয়েষ্টার্ন ফুড‘ বলে। কোন কোন মানুষ খাবারের ধরণ পছন্দ করে, খাদ্যাভ্যাসের ভিত্তিতে বা কোন খাবার কতটুকু মুখরোচক হবে। আবার অনেকেই খাবারের আইটেম নির্ধারণ করেন পুষ্টিমানের ভিত্তিতে, সুস্থ থাকার জন্য কোন সুস্বাদু খাবার গ্রহণ করলে কতটুকু ক্যালরি পাওয়া যাবে। আমাদের অনেকেই ভাত খেতে এত ভালোবাসেন যে, সম্ভব হলে তিন বেলাই ভাত খান। অনেকে আবার ভাত খেতে একেবারেই ভালোবাসেন না বলে রুটিকেই প্রধান খাবার হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। আবার যুগের পরিবর্তনে আমরা দেখছি, এখন বাঙালির খাবারের অভ্যাসও বদলে গিয়েছে। টিনেজাররা অনলাইনে ফাস্টফুড বা ওয়েস্টার্ন ফুডে ঝুঁকে পরছে।

দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের খাবারের মেন্যু তৈরী হয়েছে নিজ নিজ দেশে উৎপাদিত খাদ্যের উপকরণের উপর। নদীমাতৃক বাংলাদেশে খাল-বিল-নদীনালায় মাছ পাওয়া যায়। বর্তমানে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। কিন্তু মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ উপায়ে ব্যাপকহারে মাছের চাষ হওয়ায় বাংলাদেশে মিঠাপানির মাছ উৎপাদন বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদৌলতে প্রাপ্ত ডিজিটাল বাংলাদেশের ইন্টারনেট সুবিধায় সারা বিশ্বে গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে আমরা অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের পুষ্টিমান সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়েছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকা দেখেছি। জাপানে শিশুদের স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বিভিন্ন ফলমূল-শাকসবজিসহ বিভিন্ন ধরনের খাবারের ছবি দিয়ে পুষ্টিমান সম্পর্কে লেখা থাকে। ঐ ছবির খাবারটির কতটা পরিমাণে কি পরিমান ক্যালরি রয়েছে তাও পড়ানো হয়। ফলে ঐ জাপানী শিশুটি জীবনের প্রথমভাগেই শিখে নিয়েছে সুস্থতার সাথে বেড়ে উঠার জন্য কি পরিমাণ ক্যালরি প্রয়োজন, কোন খাবার কি পরিমাণ গ্রহণ করলে প্রয়োজনীয় ক্যালরি পূরণ হবে। একইভাবে পূর্ণবয়ষ্করা জানেন সুস্থতার সাথে বেঁচে থাকতে কি পরিমাণ ক্যালরি প্রয়োজন। সেই ক্যালরি হিসাব করে দৈনন্দিনের খাবার গ্রহণ করেন। বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট বা খাবারের দোকানে খাবারের Replica সাজানো থাকে বা Menu chart এ প্রতিটি খাবারে ক্যালরি লেখা থাকে। এতে গ্রাহকরা আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে ক্যালরি হিসাব করে পছন্দের খাবার গ্রহণ করেন। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক সময়ে সঠিক নির্দেশনায় কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। খাদ্যশস্য উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশেষ করে কার্বহাইড্রেট জাতীয় খাবার ‘গোলআলু‘ উৎপাদনে বাংলাদেশ সারপ্লাস। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে দেশের চাহিদা পূরণে আলু চাষ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এককালে মুন্সীগঞ্জে ব‍্যাপক আলু চাষ হতো। ছোট বেলায় বাবা-মায়ের সাথে ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চ করে চাঁদপুরের পাশ দিয়ে পৈতৃক নিবাস মাদারীপুর যাওয়ার পথে মুন্সীগঞ্জে আলু মজুদ করার জন্য অসংখ্য কোল্ডষ্টোরেজ দেখা যেত। বর্তমানে দেশে আলুর চাহিদা পূরণে মুন্সীগঞ্জের আলু চাষীরা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আলু চাষ করছে। উত্তরবঙ্গের মাঠে মাঠে কোল্ডষ্টোরেজ গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত আলু আভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত আলু বিভিন্ন দেশে রপ্তানী হচ্ছে। গবেষণায় পাওয়া গেছে, ১০০ গ্রাম চাউলে রয়েছে ১২৯ ক্যালরি, কার্বোহাইড্রেট ১০%, সোডিয়াম ১৬%, ০% ভিটামিন সি,  ০১% ডায়েটারী ফাইবার রয়েছে। পাশাপাশি ১০০ গ্রাম গোলআলুতে রয়েছে ৩১৩ ক্যালরি, ৬% আমিষ, কার্বোহাইড্রেট ৭%, সোডিয়াম ৩%, ৪৭% ভিটামিন সি, ২১% নাইয়সিন । এছাড়া আলুতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ডায়েটারী ফাইবার (৯%), পটাশিয়াম রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন এর কর্মরত বিশিষ্ট আলু গবেষক ডঃ রেজাউল করিম আলুর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের অধিক উৎপাদনশীল আলুর জাত উদ্ভাবন করেছেন। তিনি বলেন, ‘চাউলের তুলনায় আলুতে অধিক পরিমাণ ডায়েটারী ফাইবার (৯%) থাকার কারণে আলু থেকে গ্লুকোজ খুবই ধীরগতিতে মানবদেহে প্রবেশ করে। ফলে মানবদেহে ইনসুলিন নিঃসরণ প্রক্রিয়াও খুবই ধীর গতিতে হয়। ফলে ডায়বেটিক রোগীর প্রয়োজনীয়  কার্বোহাইড্রেট সরবরাহের জন্য আলু উত্তম খাবার’। 

এছাড়া ঢাকা মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন শহর-উপশহর এলাকায় ফার্স্ট ফুড বেশ জনপ্রিয় খাবারে পরিনত হয়েছে। এসকল খাবারের অনেকগুলো  আলু থেকে তৈরী। বাংলাদেশে আলুর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যার তুলনায় অপেক্ষাকৃত আয়তনে ছোট আকারের বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণে দেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও বিভিন্ন ক্রাইসিস মোকাবেলায় চাল, গম, ভুট্টা আমদানি করা হয়। খাদ্য অধিদফতরের এই মাসের (১১-৪-২০২২) হিসাব অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে ৯,৫৮,৩১৫ মেট্রিক টন চাল ৩২,৮৪,৯৮০ মেট্রিক টন গম আমদানি করা হয়েছে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে। উল্লেখ্য যে, বিশ্ববাজারে বিভিন্ন দেশে ভাল চাল-গম পাওয়া গেলেও পরিবহন খরচ বিবেচনা করে তুলনামূলক কম খরচে ভাল গম পাওয়ার জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের গম বিবেচনা করা হয়। কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেনের মাঝে চলমান যুদ্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেনের গম আমদানি করা কষ্টকর হবে। যদিও রাশিয়া বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বড় সহযোগিতা দানকারী দেশ। তথাপি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে কখন কোন বিপদ চলে আসে বলাতো যায় না। পরিস্থিতি মোকাবেলায় চাল বা গম এর উপর চাপ কমাতে ‘ওয়েস্টার্ন ফুড’ এর আলুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার যেমন ফ্রেন্স ফ্রাই, পটেটো চিপস্ , ওয়েজেস, মেস্ট পটেটো ইত্যাদি আমাদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা  ছাড়াও দৈনন্দিন খাবারে সবজির পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। আমাদের দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি আটার রুটির পাশাপাশি আলুর রুটি গ্রহণ করা যেতে পারে। জাপানের সেই অভিজাত হোটেলে পরিবেশিত Smoked Fish-potato mesh এর পরিবর্তে ভাতের সাথে আলুর ভর্তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়িয়ে এবং সিদ্ধ Baby carrot-Baby corn-Mushroom এর সাথে ভাজা মাছ যোগ করে ‘Rice- Fish-Potato mesh' নামকরণ দিয়ে খাবারে আলুর ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। ফলে যে কোন সংকট মোকাবেলা সহজতর হবে, খাদ্য আমদানি এড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, অধিক পরিমাণ ভাত গ্রহণে দৈহিক ওজন বৃদ্ধির কারণে স্বাস্থগত জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা কম হবে। সময় ও অবস্থা বিবেচনায় খাদ্যাভাস পরিবর্তন জরুরি।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭