ইনসাইড থট

‘আশ্রয়ণ’ – সামাজিক ব্যবধান মোচনে শেখ হাসিনার আদর্শ চিন্তা


প্রকাশ: 22/04/2022


Thumbnail

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বই ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা’ ১৯৯৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় (ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫, আগামী প্রকাশনী)। এই বইয়ে সুচিন্তিত অনুধাবন থেকে দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে শেখ হাসিনা তাঁর দার্শনিক ভিত্তি উপস্থাপন করেন। বাঙালী জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে আসীন একজন সুকোমল হৃদয়ের অধিকারিণী যিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা, তিনি লিখেছেন, “মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, কর্তব্যবোধ, সহানুভূতি দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। স্বার্থপরতায় মানুষ অন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অনাহার, অবিচারের শিকার নিরীহ অসহায় মানুষ। তাদের কথা ভাববার সময় খুব কম মানুষেরই রয়েছে। সবাই ছুটছে, ছুটছে কিসের আশায় কোন মরীচিকার পিছনে? ছুটছে অর্থ, সম্পদ, বিলাসী সামগ্রীর পিছনে। মানুষ কি একবারও ভাবে একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে? মৃত্যু হচ্ছে সব থেকে বড় সত্য। কিন্তু মৃত্যুর পর সবই ফেলে যেতে হবে। ধন-দৌলত, অর্থ-সম্পদ কিছু নিয়ে যেতে পারবে না। তারপরও এই অন্ধের মতো ছোটাছুটি কেন?”

এই উপলব্ধি তিনি যখন লিপিবদ্ধ করেন তখনও তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হননি। যে রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে তিনি নিজের আদর্শ ও দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবার জন্যে চিন্তা করছিলেন তখন এই কল্যাণ দর্শনের উদ্বেগ তাঁর মনের মধ্যে তৈরি হয়েই ছিল। এই লেখা প্রকাশের প্রায় ২৬ বছর পরে, ২০২১ সালের ৯ই মে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের জমি দাতাদের মধ্যে প্লট বরাদ্দ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দেশে যারা বিত্তশালী তারা প্লট কেনেন। ভালো ভালো দৃষ্টিনন্দন বাড়িঘর বানান। যখন পূর্বাচল শুরু হলো, তখন আমি দেখেছি.. এমনকি গুলশান, বারিধারায় বিশাল বিশাল অট্টালিকাও যাদের, তাদেরও পূর্বাচলে একটা প্লট না থাকলে নাকি ইজ্জতই থাকে না। এই রকমও কিছু কিছু মানুষের মানসিকতা আমি দেখেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যাদের এত বিশাল বিশাল অট্টালিকা, বাড়িঘর ফ্ল্যাট সবই আছে, তাদের আরও লাগবে কেন? মরলে তো সবাইকে যেতে হবে সেই কবরে- মাত্র তিন হাত, সাড়ে তিন হাত জায়গায়। এই ধনসম্পদ কেউ সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। এই কথাটা মানুষ কেন ভুলে যায় আমি জানি না’। পূর্বাচলে যারা জমির মালিক ছিলেন তাদের মধ্যে সেদিন যারা প্লটের বরাদ্দ পেলেন, তাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কিন্তু যাদের সত্যিকার প্রাপ্য, আপনারা কিন্তু বঞ্চিত ছিলেন। কাজেই আমার সব সময় একটা প্রচেষ্টা ছিল যে কীভাবে আপনাদের বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি দেব। আপনারা জমি দিয়েছেন, অথচ আপনারা প্লট পাবেন না এটা হতে পারে না...আমি এইটুকু চাই- বাংলাদেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। যেইটুকু পারি, যেভাবে পারি একটা মানুষকে একটা ঘর, একটা মাথা গোজার ঠাঁই সেটা আমরা করে দেব এবং প্রত্যেকটা ঘরেই বিদ্যুৎ থাকবে, আলো জ্বলবে। প্রতিটি পরিবারেই শিক্ষিত মানুষ থাকবে, লেখাপড়া শিখবে”। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে পূর্বাচলে জাতির পিতার স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের একটা প্রকল্প অনুমোদনের প্রস্তাব এলেও তাতে সায় দেননি উল্লেখ করে তিনি সেদিন বলেন, ‘সেই ফাইলে আমি লিখে দিয়েছিলাম, এখানকার যারা আদিবাসী তারা প্লট পাবে। তারপর আমি এ প্রকল্পের অনুমোদন দেবো। তার আগে কোনও প্রকল্পের অনুমোদন দেবো না এবং কীভাবে প্লট বের করবে সেটা যেন মন্ত্রণালয় বা রাজউক খুঁজে বের করে। সেই নির্দেশনাটাই আমি দিয়েছি’।

শেখ হাসিনার এই আদর্শ কেতাবি নয়, তিনি তা বাস্তবে প্রমাণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হবার অনেক আগেই তিনি যা বিশ্বাস করতেন দায়িত্ব পাবার পরেও সে বিশ্বাসে একবিন্দু নড়চড় হয়নি। যে কোন গবেষক তাঁর নানা প্রকাশনা, বক্তব্য, সাক্ষাৎকার, ভিডিও বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতার তথ্য সংগ্রহ করে মিলিয়ে দেখলে এই সিদ্ধান্তের প্রমাণ পেতে পারেন। আমাদের উচিত তিনি বেঁচে থাকতে তাঁর নেতৃত্বের আদর্শ থেকে দার্শনিক অনুচিন্তাগুলো খুঁজে বের করে পরের প্রজন্মের জন্যে একটি আধুনিক কল্যাণ শিক্ষার দিক নির্দেশনার দায়িত্ব অনুভব করা।

‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প সে কল্যাণ চিন্তারই একটু অতুলনীয় সাক্ষ্য। ঘর বাড়ি হারিয়ে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকের স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে পড়া মানুষ ও তাদের পরিবারগুলো টেনে এনে আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করা কিন্তু ওই আদর্শ চিন্তার প্রতিফলন। ’৯৫ সালে তিনি লিখেছিলেন, “জানিনা কবে এদেশের মানুষের মুক্তি আসবে। দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসরত ৮৬ভাগ মানুষকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অনাচার, অবিচার থেকে মুক্ত করতে পারব। আমার লেখা বঞ্চিত মানুষগুলির জন্য, যদি তাদের জন্য কিছু করতে পারি। সমাজের অবহেলিত মানুষকে টেনে তোলার প্রচেষ্টা প্রতিনিয়ত করে যাব। নইলে বিবেক শান্তি পাবে না”।

বঙ্গবন্ধুর পরে এই দেশে এই ‘বিবেকের শান্তি’ খুঁজতে চেয়েছে কোন নেতৃত্ব? শেখ হাসিনা তাঁর ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা’ নিবন্ধেই লিখেছেন, “ব্যাগে সব সময় কিছু টাকা থাকে, কেউ হাত পাতলে যাতে ফিরে না যায়। বিবেকের তাড়নায় এটা করতে হয়। একটা অজানা অপরাধবোধ যেন কাজ করে। এই পৃথিবীতে জন্মেছি আমি, ওরাও জন্মেছে, মানুষ নামে খ্যাত আমরা যারা গাড়িতে চড়ি- ফুটপাতে বসবাসকারী ঐ কঙ্কালসার দেহধারী ওরাও মানুষ কিন্তু বিরাট একটা ব্যবধান”। এই ব্যবধান মোচনের ব্রতই শেখ হাসিনার সকল কর্মের প্রকৃত সত্য।

পূর্বাচল আলোচনায় আমরা ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি শেখ হাসিনা উপরের তলার মানুষের চেয়ে নীচের দিকের মানুষের জন্যেই মনোযোগ বেশী দিয়েছেন। নিজের পর্যবেক্ষণের কথা জানাতে লিখেছেন, সারাদিন পরিশ্রম করলে হাতে একজন দিনমজুর কত টাকা পান আর পাঁচ জনের একটি পরিবারের খাবার জোগাড় করতে কী প্রাণান্ত সংগ্রাম তাঁদের করতে হয়। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজের হিসেব কষে তিনি নিজেই অঙ্ক করে তাঁর সে নিবন্ধে দেখিয়েছেন আয়ের এই বৈষম্য বাস্তবতার জগতে কী পরিমাণ ব্যবধান তৈরি করে রেখেছে। আর তাতে তিনি নিজে তাঁর করণীয় খুঁজে পেয়েছেন।

শেখ হাসিনার যে আদর্শ চিন্তা দেশের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবধান কমাবার দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করেছে তাকে সম্মান জানাতে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নতুন ভাষা আয়ত্তে আনতে হবে। আমরা এখনও মনে করি ও বিশ্বাস করি তাঁর গন্তব্য বহুদূর বিস্তৃত, কারণ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে দেশ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর অসমাপ্ত উন্নয়ন সংগ্রামের ঝড় তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাকেই মোকাবেলা করতে হয়েছে। তাঁর প্রধান সংগ্রাম- ঘরহারা, কঙ্কালসার মানুষের অস্তিত্ব যেন এই দেশে না থাকে, সব মানুষ যেন দুই বেলা খাবার পায় ও হাসিমুখে সম্মানের সাথে জীবন কাটাতে পারে। খুঁজে পেতে আমরা দেখেছি ১০ লক্ষ মানুষের মতো হবে যারা নিত্য সংগ্রামী, ঘর পেয়েছে, ঠিকানা পেয়েছে ও বলছে ‘জীবন ফিরে পেয়েছে’ – এটা কোন আদর্শ চিন্তকের নেতৃত্ব ছাড়া কোনদিন সম্ভব হতো না। ইতিহাসের জন্যে সে বিশ্লেষণ ফেলে না রেখে আমাদের উচিত এখন থেকে সে আদর্শ বুঝতে চেষ্টা করা।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭