এডিটর’স মাইন্ড

অর্জন বিসর্জন যাচ্ছে হাটে-মাঠে


প্রকাশ: 29/04/2022


Thumbnail

মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) ৩৩ হাজার পরিবারকে আনন্দে ভাসালেন শেখ হাসিনা। গৃহহীন পরিবারগুলোকে ঘর দিলেন। ঘর পাওয়া মানুষদের আবেগ-উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নের জন্য যুদ্ধরত একটি দেশ 'থাকবে না কেউ গৃহহীন'-এর মতো একটি সাহসী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে; এটি অসাধারণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষের শুরুতে গৃহহীনদের ঘর দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তিনি শুধু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হননি; সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও করেছেন।

শুধু আশ্রয়ণ নয়; গত ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে এই সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি বিরাট অংশজুড়ে আছে প্রান্তিক মানুষ। উন্নয়নের সুফল যেন দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পায় সে বিষয়ে নজর রাখা হচ্ছে খুব সচেতনভাবে। এ কারণেই পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের মতো মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি আমার বাড়ি আমার খামার, কমিউনিটি ক্লিনিক, আশ্রয়ণের মতো মানবিক কর্মসূচি এগিয়ে নিচ্ছে সরকার। দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নেওয়া হয়েছে নানা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী। বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকল্পে সব মানুষের কথা ভাবা হয়েছে। কিন্তু এই যে বিপুল উন্নয়ন; সেই উন্নয়নের ফসল কি সরকার ঘরে তুলতে পারছে?

অনেকেই বলেন, গত ১৩ বছরে এই সরকার যা উন্নয়ন করেছে, তা অভাবনীয়। এই উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে এমনিতেই জনগণের উচিত এ সরকারের পাশে থাকা। আগামী নির্বাচনে এত উন্নয়নের পর ভোট চাওয়ার দরকার কী- এমন প্রশ্নও করছেন কেউ কেউ। অস্বীকার করার উপায় নেই- সরকারের অর্জন অনেক। কিন্তু এই অর্জন অনুপাতে কি সরকার জনগণের হৃদয় জয় করতে পেরেছে? এই প্রশ্নটি এখন বড় করে উঠছে। শুধু উন্নয়ন দিয়ে কি জনপ্রিয়তা বাড়ানো যায়? কিংবা উন্নয়ন দিয়েই কি জনগণের মন জয় করা যায়? আস্থা অর্জন করা যায়? আপন হওয়া যায়? অনেক জনপ্রিয় নেতা ছিলেন, যারা এলাকায় বড় কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেননি। কিন্তু মানুষকে ভালোবেসেছেন। মানুষের ভালোবাসা দিয়েই তারা বারবার জিতেছেন। আবার অনেকে এলাকায় বিপুল উন্নয়ন করেও জনগণের ভালোবাসা অর্জন করতে পারেননি। ছোটখাটো ঘটনায় বড় অর্জনগুলোর বিসর্জন ঘটে।

বর্তমান সরকারের অনেক প্রাপ্তি, অনেক অর্জন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু ঘটনার কারণে যেন এসব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। সরকারের ভালো কাজের চেয়ে কিছু মন্দ কাজের চর্চা বেশি হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ আর নিউমার্কেট এলাকায় তাণ্ডব নিয়ে বিভিন্ন মহলের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। জনগণ এই ঘটনাগুলোতে হতাশ, বিব্রত, ক্ষুুব্ধ।

কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠের ঘটনাই ধরা যাক। এই মাঠ থাকবে, না এখানে পুলিশের থানা হবে- আমি সে বিতর্কে যাব না। মাঠ নিয়ে এলাকাবাসীর আন্দোলন যৌক্তিক কিনা- সেটি বিশ্নেষণ করাও আমার মতো নগণ্য ব্যক্তির কাজ নয়। আমার প্রশ্ন- ভয়, আতঙ্ক অন্যত্র। একজন নারী মাঠ দখলের কারণে প্রতিবাদ করেছেন। মাঠে দাঁড়িয়ে ফেসবুকে লাইভ করেছেন। এ জন্য পুলিশ তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে থানায়। শুধু রত্না নয়; তার কিশোর সন্তানকেও উঠিয়ে নিয়ে থানার গারদে পোরা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে গ্রেপ্তার করে থানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখতে পারে? রত্না বা তার সন্তান যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করবে পুলিশ। মামলা করে তাকে আটক করবে; কোর্টে চালান দেবে। কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া, মামলা ছাড়া পুলিশ কি যাকে খুশি উঠিয়ে আটকে রাখতে পারে?

এটি একটি ভয়ংকর প্রবণতা। কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া পুলিশ যদি যাকে খুশি এভাবে উঠিয়ে নিয়ে আসে; তাহলে তো এই রাষ্ট্র হয়ে যাবে পুলিশি রাষ্ট্র। এমনিতেই গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশ আছে আন্তর্জাতিক চাপে। সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে বোঝানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করছে- এতে তাদের কোনো হাত নেই। কিন্তু কলাবাগানের একজন পুলিশ কর্মকর্তা একাই দেখিয়ে দিলেন তার কী ক্ষমতা।

এখন পশ্চিমা দেশগুলো তো বিশ্বাস করতেই পারে- এভাবে যদি প্রকাশ্যে পুলিশ কাউকে উঠিয়ে নিয়ে থানায় আটকে রাখতে পারে, তাহলে অপ্রকাশ্যে অনেক কিছুই করতে পারে। এই ঘটনা ঘটানো হলো প্রধানমন্ত্রী আশ্রয়হীনদের ঘর দেওয়ার দু'দিন আগে। তাহলে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারের অর্জন কি মাঠের ঘটনায় ম্লান হলো না? যে সরকার ঘরহীন মানুষের জন্য ঘর দেয়; সেই সরকার কীভাবে শিশুদের খেলার মাঠ কেড়ে নেয়? যে সরকার নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে রোল মডেল; সেই সরকারের এক সিকি পুলিশ কর্মকর্তা একজন নারীকে কীভাবে ১৩ ঘণ্টা আটকে রাখে?

দ্বিতীয় ঘটনারও কেন্দ্রীয় চরিত্র পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিউমার্কেটে ছোট ঘটনা, যা ১৮ এপ্রিল রাতেই সমাধান করা যেত। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর হেলমেট বাহিনীর কারণে নিউমার্কেটের ঘটনা জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করাচ্ছে। নাগরিক হিসেবে আমরা নিরাপত্তাহীন এবং আতঙ্কিত বোধ করছি। বিভিন্ন টেলিভিশনের ভিডিও ফুটেজে দেখা গেল, পুলিশ কখনও ছাত্রদের প্রতি অত্যন্ত মারমুখী; কখনও পুলিশ নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দু'পক্ষ ফ্রি স্টাইলে মারামারি করছে, পুলিশ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডবে দুটি তাজা প্রাণ চলে গেল। পুলিশ পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকল। কেন? নিউমার্কেটের ঘটনা সরকারের বড় অর্জনের ওপর কি এতটুকু কালিমা ফেলেনি? ফেলেছে। জনগণ একটি সরকারের কাছে কী চায়? নিরাপত্তা, শান্তি, সম্পদের হেফাজত। নিউমার্কেটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় যে তাণ্ডব ঘটেছে, তাতে কি সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে?

গত কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছি, সরকারের ভেতর একটা মহল বেপরোয়া। কোনো কিছু কেয়ার করে না। টিপ পরার কারণে পুলিশ একজন নারীকে হেনস্তা করে। বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে অকারণে ১৯ দিন জেল খাটতে হয়। অথচ এসব রাষ্ট্রের নীতি বাস্তবায়নজনিত ঘটনা নয়। এসব ঘটনা সরকারের কোনো নীতিনির্ধারক ব্যক্তির দ্বারাও সংঘটিত নয়। সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য এই ঘটনা সরকারি নির্দেশে ঘটানো হয়নি। ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন। কিছু ব্যক্তির দায়িত্বহীনতার কারণে এসব ঘটছে। কিন্তু এসব ঘটনা সরকারের সব অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মানবিক বাংলাদেশের ছবিটা ধূসর হয়ে যাচ্ছে। হাটে-মাঠের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো মানুষের অশান্তি সৃষ্টি করছে। অর্জন বিসর্জন যাচ্ছে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে- এরা কারা? কার সাহসে একজন পুলিশ সদস্য আইনকে থোড়াই কেয়ার করার সাহস পায়? কারা হেলমেট বাহিনীকে মাঠে নামায়? আর সরকার এসব দায় কেনই বা কাঁধে নেয়? এই বোঝা সরকারের কাঁধ থেকে নামাতে হবে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
সূত্র: সমকাল।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭