ইনসাইড থট

মহান মে দিবসের ভাবনা


প্রকাশ: 01/05/2022


Thumbnail

শ্রমিকের স্বাধীনতায় একদা বিশ্বাসী রাশিয়ার যুদ্ধংদেহি আচরণে বিশ্বের তাবৎ দেশ আজ আতঙ্ক ও দিশেহারা গ্রহের বাসিন্দা। পৃথিবীর যে শতাধিক রাষ্ট্র খুব গুরুত্বের সঙ্গে মহান মে দিবস পালন করে তারাও আজ শঙ্কিত। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই দিনটিকে লেবার ডে বা ওয়ার্কার্স ডে হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। অসংখ্য দেশে এই দিনটিতে ছুটি থাকে। মে দিবস শ্রমিকদের দাবি আদায় করার সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জনের স্মৃতিকে সম্মান দেখানোর দিন। এদিন একজন শ্রমিক উন্নততর জীবনের স্বপ্ন দেখে। কারণ মে দিবস সমগ্র বিশ্বকে বৈষম্য ও শোষণমুক্ত একটি সমাজ উপহার দিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা শ্রমজীবী মানুষের জন্য অভিশাপ বয়ে এনেছে। যুদ্ধের অভিঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য উন্নত দেশগুলোতে কল্যাণকর ব্যবস্থায় সহযোগিতা করা সম্ভব। পক্ষান্তরে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সেই তুলনায় মেহনতি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যেমন, বাংলাদেশের ৫০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক শহরকেন্দ্রিক (যদিও এদেশের শ্রমিকদের মাত্র ১৫ শতাংশ শহুরে-শ্রমিক হিসেবে কাজ করে), এছাড়া আছে দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ এবং কৃষিখাতে জড়িত বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এসব স্বল্প আয়ের মানুষকে সংকট থেকে রক্ষা করা যেমন জরুরি তেমনি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য তাদের কাজে লাগানোও প্রয়োজন। তাছাড়া চিকিৎসা সেবাখাতে শ্রমজীবী নারী-পুরুষের চাহিদা করোনা সংকটে অনেক বেশি ছিল। চিকিৎসক-নার্সদের পাশাপাশি হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনার করোনা মোকাবেলায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে। অর্থাৎ সংকটময় মুহূর্তে চিকিৎসাসেবায় শ্রমজীবী মানুষের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এদিক থেকে এবারের মে দিবস আলাদা তাৎপর্য বহন করছে। এজন্য ২০২২ সালেরও স্লোগান হওয়া দরকার- ‘বাঁচলে শ্রমিক বাঁচবে দেশ’।   

২.
মহান মে দিবসের রক্তাক্ত ইতিহাস উনিশ শতকের অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা। ঘটনাটি আমেরিকার শিকাগো শহরের কিন্তু পর্যায়ক্রমে তার প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বব্যাপী প্রসারিত। ১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরে প্রায় ৪ লক্ষ শ্রমিক বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করত। ‘হে মার্কেটে’র শ্রমিকরা কাজের সময় ১৬ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা আর উপযুক্ত মজুরি আদায়ের দাবি নিয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। ১ মে থেকেই তারা তাদের সক্রিয় আন্দোলকে বাস্তবে রূপদান করা শুরু করে। শ্রমিকদের একঘেয়ে জীবন ও কল কারখানার দুর্বিষহ পরিবেশে প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করা ছিল অত্যাচারের সামিল। সপ্তাহজুড়ে কাজ করে শ্রমজীবীদের স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। অতি পরিশ্রমে শিশু ও নারী শ্রমিকরা দুর্বল ও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। স্বল্প বেতনের বিনিময়ে তখনকার মালিকশ্রেণি তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও অবসরের সময়টুকুও কেড়ে নিয়েছিল। দিনের পর দিন পরিশ্রম করে ভারবাহী পশুতে পরিণত হয়েছিল তারা। এজন্য দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার স্বীকৃতি দিতে হবে- এই স্লোগান নিয়ে লক্ষাধিক মেহনতি মানুষ একত্রিত হয়। শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে ১ মে থেকে কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং ঘোষণা করে যে তাদের দাবি মেনে না নেয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে। বহু সংখ্যক শ্রমিক একসাথে কর্মবিরতিতে অংশ নেওয়ায় মালিক শ্রেণি ভীত হয়ে পড়ে। ওই মালিক শ্রেণি শ্রমিক ও কর্মজীবীদের অতিরিক্ত কাজ করিয়ে বেশি মুনাফা লাভের চেষ্টা করত। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তার কথা ভাবত না।

৩ মে পুলিশের সাথে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয় এবং ৬ জন শ্রমিক এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। ৪ মে ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শ্রমিক-জনতা একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করে। মিছিল শেষে শ্রমিক নেতা ফিয়েলদেন শেষ বক্তব্য প্রদান করছিলেন। তখনও সে সময় পরিবেশ শান্ত ছিল। হঠাৎ প্রশাসনের নির্দেশে একদল পুলিশ এসে সমাবেশ ভেঙে দিতে বলে। তখন ফিয়েলদেন ও অন্যান্যদের সঙ্গে পুলিশের তর্ক-বিতর্ক চলার সময় মালিকশ্রেণির ইন্ধনে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। তাতে পুলিশসহ ৪ জন শ্রমিক মারা যায়। এ ঘটনার পর পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে এবং মারমুখী অনেক নেতাকে গ্রেফতার করে।

সেদিনের আন্দোলন সংঘটিত করা, জমায়েতে শ্রমিকদের নিয়ে আসা এবং পুলিশের নির্দেশ উপেক্ষা করে প্রতিবাদী সভার সমাবেশ করায় শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করে নিপীড়ন চালানো হয়। বোমায় পুলিশ নিহত হওয়া এবং ধর্মঘট সংঘটিত করার দায়ে অগাস্ট স্পাইস নামে এক শ্রমিক নেতাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। তার আগে জেলে একজন শ্রমিক আত্মহত্যা করে। ফাঁসির মঞ্চে আরোহিত ও নিপীড়নের শিকাররা বলে গিয়েছিল তাদের সেই নীরব প্রতিবাদই ভবিষ্যতে সারা বিশ্বে ধ্বনিত হবে। যে কণ্ঠস্বর সেদিন চাপা দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল তা একদিন খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে কথা বলবে। ইতিহাসের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ১৮৮৬ সালের মে মাসে শ্রমিক হত্যাকাণ্ড এবং তার প্রতিবাদে সমাবেশ ও সমাবেশে বোমা হামলা প্রভৃতি ঘটনার বিচার ও বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীতে পরবর্তী কয়েক দশক নিন্দার তপ্ত হাওয়া বয়ে যায়। ফলে ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আন্দোলকারীরা হত্যা-নির্যাতনের পরও তাদের দাবি নিয়ে প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিল। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭