ইনসাইড থট

মারণঘাতী রোগ থ্যালাসেমিয়া: প্রতিরোধই যেখানে একমাত্র ভরসা


প্রকাশ: 08/05/2022


Thumbnail

৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। মারণঘাতী রোগ থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর এ দিবস পালন করা হয়। থ্যালাসেমিয়া একটি জন্মগত উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া রক্তের রোগ। শরীরে থ্যালাসেমিয়ার ভ্যারিয়েন্ট বা ত্রুটিযুক্ত জিন (Gene) থাকলে হিমোগ্লোবিন কম উৎপন্ন হয়। হিমোগ্লোবিন হচ্ছে একটি আয়রণ সমৃদ্ধ প্রোটিন যা রক্তের লোহিত কণিকার (RBC) সাথে দেহকাষে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। হিমোগ্লোবিনের দুটি অংশ থাকে একটা হলো হিম, অন্যটা হলো গ্লোবিন। হিমের উপস্থিতিতে গ্লোবিন জিন প্রতিলিপি তৈরি শুরু করে। এখানে দুটি জিন-চেইন দায়িত্ব পালন করে থাকে। এরা হচ্ছে- আলফা-গ্লোবিন চেইন ও বিটা-গ্লোবিন চেইন। যে দুটো গ্লোবিন চেইন একত্রে হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য দায়ি থাকে, জেনেটিক মিউটিশানের কারণে এ দুটির জিনের কোন একটিতে ত্রুটি থাকলে সংশ্লিষ্ট শিশুর শরীরে থ্যালাসেমিয়ার রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। তখন আক্রান্ত শিশুর শরীরে হিমোগ্লোবিন কম উৎপন্ন হয় এবং লোহিত কণিকা উৎপাদনও ব্যাহত হয়, ফলে শিশু রক্ত শূণ্যতায় ভোগে এবং বাইরে থেকে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়।

থ্যালাসেমিয়া অর্থ ’রক্তের সমুদ্র’। গ্রিক শব্দ ‘Thalassa’ এবং ‘haima’ শব্দ থেকে থ্যালাসেমিয়ার ভ্যারিয়েন্ট/রোগের নামকরণ করা হয়েছে। ‘Thalassa’ অর্থ ‘সমুদ্র’ এবং ‘haima’ অর্থ ‘রক্ত’। রক্তের এ রোগ সর্বপ্রথম ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় শনাক্ত হয়েছিল বলেই এরূপ নামকরণ। এ রোগ মূলত এশিয়া ও আফ্রিকার ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকার রোগ। যে সব অঞ্চলে মহামারী আকারে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব হয়েছে, সে সব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জিনগত মিউটিশানের/পরিবর্তনের মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের জিনে ত্রুটির সৃষ্টি হয়েছে। উত্তরাধিকার হিসেবে এ জিনগত ত্রুটি প্রজন্মের পর প্রজন্মে অনুপ্রবেশ করেছে। পরবর্তীতে বিশ^ায়ন, মাইগ্রেশন ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে এটি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছে। তবে থ্যালাসেমিয়ার জিনগত ত্রুটি সংবলিত মানুষের সংখ্যা এখনও এশিয়া ও আফ্রিকায় বেশি। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় তিন লক্ষ বিশ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়ার জিনগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, এর মধ্যে ৮০%-এর জন্ম উন্নয়নশীল দেশে।

হিমোগ্লোবিনের উপাদান আলফা-গ্লোবিন ও বিটা-গ্লোবিনের জিনগত ত্রুটির শ্রেণির ভিত্তিতে থ্যালাসেমিয়া রোগকে ০২টি নামে অভিহিত করা হয়। এরা হচ্ছেÑ আলফা-থ্যালাসেমিয়া ও বিটা-থ্যালাসেমিয়া। আলফা-গ্লোবিনের ০২টি জিন এবং বিটা-গ্লোবিনের ০২টি জিন মিলে সংশ্লিষ্ট জিনের চেইন তৈরি করে এবং হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন হয়। মোট কয়টি জিনে ত্রুটি আছে, তার ওপর সংশ্লিষ্ট শিশু থ্যালাসেমিয়ার বাহক বা রোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়। একটি শিশুর ভ্রƒণ সৃষ্টির সময় পিতা ও মাতার উভয়ের দুটি করে আলফা-গ্লোবিন জিন মিলিত হয়। এ চারটি আলফা-জিনের একটিতে ত্রুটি থাকলে সংশ্লিষ্ট শিশু আলফা-থ্যালাসেমিয়ার নীরব বাহক (Carrier), দুটি জিনে ত্রুটি থাকলে বাহক, তিনটি জিনের ত্রুটি থাকলে হিমোগ্লোবিন এইচ নামে আলফা-থ্যালাসেমিয়ার একটি ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত বলে গণ্য করা হয়। আর চারটি আলফা-গ্লোবিন জিনের ত্রুটি থাকলে শিশু আলফা-থ্যালাসেমিয়া মেজর নামে ভয়াবহ মারণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগে আক্রান্ত শিশু মৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। কেউ জীবিত অবস্থায় জন্ম নিলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মারা যায়। আলফা-থ্যালাসেমিয়ার নীরব বাহক ও বাহক শ্রেণির মানুষের জীবন-যাপনে কোন অসুবিধা হয় না। কারো মাঝে মধ্যে রক্ত স্বল্পতা দেখা দিলে রক্ত পরিসঞ্চালন করার প্রয়োজন হয়। আলফা-হিমোগ্লোবিন এইচ আক্রান্ত শিশুর শরীরে নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হয়। সে ক্ষেত্রে ঘন ঘন রক্ত পরিসঞ্চালনের কারণে রোগীর লিভার, প্লিহা, প্যানক্রিয়াস ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অতিরিক্ত আয়রণ জমা হয়। অতিরিক্ত আয়রণ শরীরের এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট করে এবং লক্ষণ ভেদে চিকিৎসা, অতিরিক্ত আয়রণ মুক্ত করা (iron chelation) বা অস্ত্রোপচার করা হয়।

হেপোগ্লোবিনের বিটা-গ্লোবিন চেইনের একটি জিন ত্রুটি থাকলে বিটা-থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা বাহক (Carrier) এবং দুটি জিনে ত্রুটি থাকলে বিটা-থ্যালাসেমিয়া মেজর রোগে আক্রান্ত বলে গণ্য করা হয়। এছাড়াও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে হিমোগ্লোবিন- ‘ই’ নামের বিটা-থ্যালাসেমিয়ার জিনগত ত্রুটির অস্তিত্ব আছে। বিটা-থ্যালাসেমিয়া মাইনরের এক অংশের কোন লক্ষণ থাকে না, বা সামান্য রক্তস্বল্পতা থাকে। আর এক অংশের মধ্যম পর্যায়ে থেকে মারাত্মক রক্তস্বল্পতা থাকে। তাদের নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিটা-থ্যালাসেমিয়া মেজর হিসেবে চিহ্নিত শিশুদের মারাত্মক পর্যায়ের রক্তস্বল্পতা শিশু বয়স থেকেই দেখা দেয়। বয়স যতো বাড়তে থাকে, তাদের মুখম-লের হাড়ের বিকৃতি, মারাত্মক রক্তস্বল্পতা, শারীরিক বৃদ্ধি কম হওয়া, ফ্যাকাসে ত্বক, প্লিহা ও লিভার বড় হওয়া ইত্যাদি নানা উপসর্গ বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন ছাড়া এদের যেমন বাঁচানো যায় না, আবার ঘন ঘন রক্ত পরিসঞ্চালনের কারণে এদের লিভার, হার্ট, প্লিহা এবং প্যানক্রিয়াসসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও এন্ড্রোক্রিন গ্লান্ডে আয়রণ জমা হয়। এ অতিরিক্ত আয়রণ শরীর থেকে বের করার জন্য (iron chelation) নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আয়রণ জমা হওয়ার কারণে লিভার, প্লিহা এবং প্যানক্রিয়াস ইত্যাদি বড় হয়ে যায়- যা অস্ত্রোপচার করে কেটে ফেলতে হয়। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত একটি শিশুর পরিবারই জানে, এ রোগে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা, স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং মানসিক অশান্তি কতোটা ভয়াবহ ও দুর্বিষহ। এরূপ চিকিৎসার পরেও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের গড় আয়ু অনেক কম থাকে। কারণ অধিকাংশ শিশু প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পায় না এবং একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে অস্থিমজ্জা/স্টেম সেল প্রতিস্থাপন, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সেখানেও মৃত্যুর হার খুব একটা কম নয়।
 
সাধারণভাবে ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকার দেশসমূহ থ্যালাসেমিয়া বেল্ট হিসেবে পরিচিত। ভারত, পাকিস্তান, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের এ থ্যালাসেমিয়া বেল্টে বাংলাদেশ অবস্থিত। থ্যালাসেমিয়া বেল্টের দেশসমূহের মধ্যে মালদ্বীপে সবচেয়ে থ্যালাসেমিয়ার ভ্যারিয়েন্ট বেশি (১৮%)। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর ৫.২% (৩৬ কোটির বেশি) মানুষ থ্যালাসেমিয়ার কোন ভ্যারিয়েন্ট বহন করে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কি পরিমাণ থ্যালাসেমিয়ার ভ্যারিয়েন্ট আছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ৩% বিটা-থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা বাহক এবং ৪% বিটা-থ্যালাসেমিয়ার হিমোগ্লেবিন-ই ভ্যারিয়েন্ট আছে। স্কুলের ছাত্র/ছাত্রীদের মধ্যে পরিচালিত সীমিত একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, ৪.১% শিশু বিটা-থ্যালাসেমিয়া মাইনর এবং ৬.১% শিশু বিটা-থ্যালাসেমিয়ার হিমোগ্লেবিন-ই ভ্যারিয়েন্ট বহন করে। যা ভবিষ্যতে থ্যালাসেমিয়ার একটি ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের আগাম চিত্র উপস্থাপন করে।

জিনগত ত্রুটি হিসেবে থ্যালাসেমিয়ার কোন ভ্যারিয়েন্ট পিতা-মাতার থেকে জন্মলগ্নে উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। কাজেই অনুপ্রবেশের মাধ্যম শুধুমাত্র বিয়ে এবং সন্তান জন্মদান। একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহকের সাথে অপর একজন বাহক নয়, এমন একজনের বিয়ে হলে ৫০% সন্তান থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু থ্যালাসেমিয়া মেজর বা খারাপ পর্যায়ের কোন ভ্যারিয়েন্টের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু পিতা-মাতা উভয়ই যদি থ্যালাসেমিয়ার ভ্যারিয়েন্ট বহন করে, তবে সুস্থ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা ২৫% এবং বাহক হওয়ার আশঙ্কা ৫০% এবং প্রাণঘাতী থ্যালাসেমিয়া মেজর হওয়ার আশঙ্কা ২৫%। যেহেতু অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ছাড়া থ্যালাসেমিয়া মেজরসহ কোন থ্যালাসেমিয়া ভ্যারিয়েন্ট নিরাময়ের কোন চিকিৎসা নেই, কাজেই এ রোগ প্রতিরোধে থ্যালাসেমিয়ার ভ্যারিয়েন্ট বহনকরী দুজনের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করার কোন বিকল্পও নেই।

হিমোগ্লোবিন ইলেকটোপোরেসিস নামক পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে থ্যালাসেমিয়ার ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করা যায়। বিয়ের আগে বর-কনের এ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে ইরান, তুরস্ক, গ্রিসসহ কিছু দেশ থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্মহার প্রায় শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনেছে। সৌদি আরব, লেবানন, তিউনিশিয়া, বাহরাইন, কাতার, ইউনাইটেড আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপসহ অনেক দেশ বিয়ের আগে বর-কনের রক্ত পরীক্ষা করার নিয়ম চালু করেছে। আমাদেরও এ বিষয়ে নীরব থাকার সুযোগ নেই। ‘বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নিন’Ñএরূপ নামের একটি নাটক বেশ আগে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। নাটকটি দেখা হয়নি, তাই এর মূল বক্তব্য কি ছিল জানি না। তবে থ্যালাসেমিয়া রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শুধু নাটক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন সীমাবদ্ধ থাকার সুযোগ নেই। বিয়ের আগে বর-কনের থ্যালাসেমিয়ার ভ্যারিয়েন্ট আছে কি-না, তা এখন বাধ্যতামূলক পরীক্ষা ও ভ্যারিয়েন্ট বহনকরী দুজনের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করাই জরুরি। না হলে ভবিষ্যতে থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবার রাস্তা আরও প্রশস্ত হবে।

লেখক: ড. মিহির কান্তি মজুমদার, সাবেক সচিব।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭