ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবার কি সমাপ্তির পথে?


প্রকাশ: 12/05/2022


Thumbnail

অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত শ্রীলঙ্কায় চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রী মাহেন্দ্রা রাজাপাকসের পদত্যাগের পর এবার আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের জন্য কঠোর আন্দোলন শুরু করেছে। গোতাবায়ার পদত্যাগের দাবীতে অনড় আন্দোলনকারীরা কারফিউ উপেক্ষা করে দেশটির বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। যা দেশটির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে আরও সংকটময় করে তুলছে। 

দীর্ঘ দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছে রাজাপাকসে পরিবার। পরিবারের বড় কর্তা মাহেন্দ্রা রাজাপাকসে এত দিন ক্ষমতা সামলে আসলেও আন্দোলনের মুখে ঠিক এভাবে হুট করে তাকে যে প্রস্থান করতে হবে তা কেও ঘুনাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেননি। অন্যদিকে ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসা ছোট ভাই গোতাবায়া ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে থাকলেও হুট করে বড় ভাইয়ের প্রস্থানে অনেকটাই একাকী হয়ে পড়েছেন। 

বছরের পর বছর ধরে অসীম দুর্নীতি আর মিথ্যা আশ্বাসে দেশটির ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা রাজাপাকসে পরিবারের কোনো সদস্যকেই আর শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে দেখতে চান না দেশটির সাধারণ জনগণ এবং রাজনীতিবিদরা। এমনকি রাজাপাকসে পরিবারের সদস্য এবং তার দলীয় এমপিদের উপরও ক্ষুব্ধ দেশটির জনগণ। 


চিত্র: পুলিশের বাধায় বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারী

মাহেন্দ্রা রাজাপাকসে ক্ষমতা ছাড়ার পরপরই গোতাবায়াকে ক্ষমতা ছাড়তে চাপ দেওয়া শুরু করে বিরোধী দলগুলোও। গোতাবায়া নতুন করে নিরপেক্ষ প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ গঠন করার আশ্বাস দিলেও তাতে কর্ণপাত করতে ইচ্ছুক নয় রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে দেশটির আমজনতা।
 
আন্দোলন শুরু হওয়ার পর রাজাপাকসে পরিবারের জন্য প্রথম বড় ধাক্কা হয়ে আসে সব মন্ত্রী এবং দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হলেও কেও বেশি দিন টিকতে পারেনি। এমন অবস্থায় গোতাবায়া ও তার ভাই মাহেন্দ্রা ছাড়া তাদের আশেপাশে নিজের বলে কিছুই ছিলো না। শুরুতে মাহেন্দ্রা পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে একের পর এক অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপে শেষ পর্যন্ত চলতি সপ্তাহের সোমবার হুট করেই নিজের পদত্যাগের ঘোষণা করেন মাহেন্দ্রা। তার পদত্যাগের পর বিক্ষোভকারীরা তার সরকারি বাসভবন ‘টেম্পল ট্রি’র উপর চড়াও হয়। শেষ পর্যন্ত  সেনাবাহিনীর তাকে তার সরকারি বাসভবন থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তবে সেই রাতেই রাজাপাকসে পরিবারের পৈর্তৃক বাড়িতে হামলা চালিয়ে সেটিতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। 


চিত্র: আন্দোলনকারীদের দেওয়া আগুনে জ্বলছে রাজাপাকসে পরিবারের পৈতৃক বাড়ি 

দিন যতই পার হচ্ছে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের টিকে থাকা অনেকটাই মুশকিল হয়ে পড়ছে। তার সবচেয়ে বড় কারণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। প্রধান বিরোধীদলগুলো রাজাপাকসে পরিবারের এমন পরিস্থিতিতে পূর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় দেশটির অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়েছে।  

এই পরিস্থিতিতে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল বিরাসিংহে সতর্ক করে বলেছেন, আগামী দুই দিনের মধ্যে নতুন সরকার গঠন না করা গেলে দেশের অর্থনীতি একেবারে ধসে পড়বে। সংকট কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ছাড়া সে আলোচনা এগোবে না। রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে এসব সমস্যা যদি দ্রুত সমাধান না হয় তবে পদত্যাগ করবেন তিনি। 

গভর্নরের এমন সতর্কতার ঢের কারণও রয়েছে। দেশটির হাতে দিন দিন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েই চলেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে মোট রিজার্ভের অর্থ দিয়ে টেনে টুনে সপ্তাহখানেকের বেশি আমদানিপ্রক্রিয়া চালানো সম্ভব হবে না দেশটির জন্য। 

গভর্নরের কথা যেনো শুকনো কাঠে ঘি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো কাজে দিয়েছে বিরোধী শিবিরগুলোতে। এই পরিস্থিতিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গোতাবায়া রাজাপকসের প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়ার দাবি জানিয়েছে শ্রীলঙ্কার প্রধান বিরোধী দল সমাজি জনা বালাভেগায়া (এসজেবি)। দলটির নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা বলেন, শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে বের করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে তাঁরা রাজি আছেন। তবে এর জন্য চারটি শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথম শর্তই হচ্ছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগ করতে হবে।


চিত্র: বিব্রত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে 

এদিকে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে কলম্বোয় প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বাইরে বিক্ষোভ চলছে। সেখানে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারীরা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করেন। তারা জানান, ‘আমরা চাই না রাজাপকসে পরিবারের কেউ সরকারে থাকুক।’


চিত্র: নিত্যপ্রয়োজনীয় তেল সংগ্রহে নাগরিকদের লম্বা লাইন 

শ্রীলঙ্কার অহিংস আন্দোলন দিন দিন আরো সহিংস হয়ে উঠছে। ন্যায্য মূল্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য, বিদ্যুৎ, পানি আর চিকিৎসার দাবি। প্রয়োজনীয় আমদানি পণ্য প্রাপ্যতার দাবীতে শুরু হওয়া আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকার দলীয় উগ্রতায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এখন পর্যন্ত এই আন্দোলনে সহিংসতায় একজন এমপি সহ নয়জন নিহত হয়েছেন। সোমবার রাতে আন্দোলন নতুন মাত্রা যোগ পেলে দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে সরকার। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। মানুষ ঘর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসছে কারফিউ উপেক্ষা করে। মাঝে গুজন ছড়ায় সরকার বিক্ষোভকারিদের দেখা মাত্র সেনা বাহিনীকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে। তবে এরপর মঙ্গলবার রাতেও সড়কে বিক্ষোভ করেছেন কলম্বোর অনেক তরুণ। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবিতে সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান তাঁরা। যদিও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে তা অস্বীকার করা হয়। তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয় সরাসরি গুলি নয়, জানমাল নষ্ট, লুট কিংবা উগ্র সহিংসতা দেখলে তাদের ফাঁকা গুলি চালিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে বুধবার পুলিশকে জানমাল রক্ষায় গুলি চালানোর ক্ষমতা দিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার।


চিত্র: গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পাহারায় দেশটির সেনাবাহিনী 

পরিস্থিতি সামাল দিতে গোতাবায়া জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া এক ভাষণে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নতুন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। সেই সাথে তিনি আরও বলেন, এই সরকারের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। তারা দেশের জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে। এই ঘোষণার পরেও বিক্ষোভকারীরা তাঁদের অবস্থানে অনড় রয়েছে। 

সীমাহীন দুর্নীতি আর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মাধ্যমে শ্রীলঙ্কাতে রাজাপাকসে পরিবার যে প্রায় দীর্ঘ দুই দশক ক্ষমতা ধরে রেখেছিলো তা আজ খড়ের ঘরের মতই বাতাসে উড়ে যেতে বসেছে। নিজের সবগুলো ভাইকে ক্ষমতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত করেও আজ জনতার রোষানলে নিজ বাসভবনে পর্যন্ত থাকার অবস্থায় নেই মাহেন্দ্রারর। পরিস্থিতি যেভাবে মোড় নিচ্ছে হয়তো রাষ্ট্রপতির চেয়ার খানাও ছাড়তে বাধ্য হবেন গোতাবায়া। আর তাই যদি হয় তবে এটাই হতে পারে রাজাপাকসে পরিবারের শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে শেষ অধ্যায়। এখন ভবিষ্যৎই বলে দেবে রাজাপাকসে পরিবারের ভাগ্য কোন দিকে গড়ায়?


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭