ইনসাইড থট

মহাসড়কের ঘাতক ‘খড় কুটা’র যাবজ্জীবন কারাবাস চাই


প্রকাশ: 15/05/2022


Thumbnail

১৯৯৫ সাল। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। স্বপ্না (ছদ্মনাম) ইন্টার্নি করতো বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে। এক সকালে সে শুনলো সে নিঃস্ব, এতিম। তাঁর বাবা মা ফিরছিলো যশোর থেকে ঢাকা। সাথে একমাত্র ভাই। মাগুরার কাছে কারটি দুর্ঘটনা কবলিত হয়। বাবা মা ঘটনাস্থলে নিহত। ভাই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, পিজি হাসপাতালে। পরদিন লাশ এলো তাঁদের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের স্বরূপকাটিতে। স্পষ্ট মনে আছে, হরতাল ছিল সেদিন। যানবাহন বন্ধ। একটি ওষুধ কোম্পানি বরিশাল থেকে শুভানুধ্যায়ীদের জন্যে কিছু মোটর সাইকেল এর ব্যবস্থা করেছিল। আমি ছিলাম সে দলে। গিয়েছিলাম জানাজায়। এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনায় গ্রামবাসী স্তম্ভিত, শোক বিহ্বল। সেদিন জেনেছিলাম, প্রাইভেট কারটি যেখানে দুর্ঘটনা কবলিত হয় সেখানে পাট বিছানো ছিল। গ্রামবাসী ওই দুর্ঘটনার জন্য রাস্তায় বিছানো পাটকেই দুষছিল।

ঘটনাটি ২৭ বছর আগের। গত তিন দশকে ক্ষমতায় অনেকবার অদল বদল হয়েছে। একবার এ দল, আরেকবার ও দল। পালা বদলের এ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। গত তেরো বছরে দেশ অনেক এগিয়েছে। দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু সড়কে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের মিছিল এখনো কমেনি। শুধু বিয়োগান্তক এ কাহিনীগুলোতে কিছু পাত্র পাত্রীর পরিবর্তন। দিনক্ষণের পরিবর্তন। দুর্ঘটনার কারণের মধ্যে কোন অমিল নেই। ১৯৯৫ এর স্থলে ২০২২। বিএনপির জায়গায় আওয়ামী লীগ। স্বপ্নার জায়গায় শর্মিলা। কিন্তু মিল একটাই, রাস্তায় কিছু একটা শুকাতে দেয়া হয়েছে। হয়তো পাটের জায়গায় ধান, শুধু এটুকুই পরিবর্তন। পর্দার পেছনের লোকগুলো একই। যারা ধান বা পাট শুকাতে দিচ্ছে তারা মহাসড়ক সংলগ্ন গ্রামবাসী, কৃষক । নির্দ্বিধায়, নির্বিঘ্নে তারা এ কুকর্মটি করে যাচ্ছে। প্রকান্তরে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করছে।

বলছিলাম, শর্মিলার কথা। শর্মী নামেই সবাই জানে। ৯৫ সালের স্বপ্নার মতই সে মেডিকেল পড়ুয়া। সপ্তাহখানেক পরে তার এম বি বি এস ফাইনাল পরীক্ষা। দাদি অসুস্থ। বাসায় সবাই গোপালগঞ্জ যাচ্ছে তাঁকে দেখতে। সবাই মানে বাবা ডা. বাসুদেব সাহা, মা আর ছোট ভাই। পরীক্ষার জন্য সে ঢাকায় থেকে গেলো। সবাই সকালে ঢাকার বাসা থেকে গন্তব্যে বেরিয়ে গেলো। তখনো তার সব ছিল। দুপুর গড়াতেই সে জানলো, সে নিঃস্ব, এতিম; স্বপ্নার মতই। পরিবারের সবাই এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। সে দুর্ঘটনায় তিন দম্পতিসহ প্রায় দশ জন নিহত হয়। গত শনিবার গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানায় এক চতুর্মুখি সড়ক দুর্ঘটনাটি ঘটে। শর্মিলার বাবা আমার সহকর্মী। একই বিষয়ের সতীর্থ আমরা। দূরদেশে বসে দুর্ঘটনার সাথে সাথে করুণ মৃত্যুর খবরটি জেনে যাই সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে, প্রায় সাথে সাথে। ফেসবুক জুড়ে আহাজারি। সহকর্মী হবার সুবাদে চোখ ছিল ফেসবুকে। পল্লব সাহা নামে এক জুনিয়র চিকিৎসকের একটি পোস্ট পেলাম সেখানে। তিনি লিখেছেন, "এক্সিডেন্ট হওয়া বাসের প্রায় ৫০ গজ পেছনে ছিল আমাদের বাসটা। একচুয়ালি আমাদের বাসটা কাউন্টারে স্লো করার পরেই এক্সিডেন্ট হওয়া বাসটা ওভারটেক করে, তার দু মিনিট পরেই এক্সিডেন্ট। বাসের গতি অতটাও বেশি ছিল না, দুই লেনের রাস্তার মাঝ বরাবর ছিল।" পল্লব আরো জানান, দুর্ঘটনায় জড়িত চার গাড়িই হার্ড ব্রেক করছিল। কিন্তু একটার ব্রেকও কাজ করে নাই, কারণ হল রাস্তায় ধান মাড়াই ৷ এই ধান মাড়াই এর জন্যই এক্সিডেন্টের সময় দুইটা গাড়ি মুখোমুখি ছিল কারণ দুই পাশেই ধান রাখা ৷" যারা দুর্ঘটনার স্থিরচিত্র দেখেছেন, তারা খেয়াল করবেন, চূর্ণ বিচূর্ণ হওয়া কারটির নিচে ধানের বিচালীর স্তূপ, খড় কুটা।

মহাসড়কে ধান পাট, এমনকি সেদ্ধ ধান শুকানোর এ চিত্র সারা দেশে বিদ্যমান। উত্তরবঙ্গে বেশি, দক্ষিণ বঙ্গে একটু কম। এ চিত্র সর্বকালে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি -সব আমলে। কেউ কিছু বলে না। সমস্যার সমাধানও করে না, উদ্যোগও নেয় না। গ্রামবাসীদেরও সমস্যা রয়েছে। আসলে কৃষকরা ধান পাট দ্রুত শুকানোর জন্য এটি করে। পিচের রাস্তার উপরিভাগ সূর্যের তাপ শোষণ করে, যা ধান পাট দ্রুত শুকায়। ভেজা মৌসুমে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা চায় সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে এগুলো দ্রুত শুকাতে। যারা শুকাতে দেয় তাদেরকে কিছু বললে তারা বলে রাস্তা কি কারো বাপের? রাস্তার মালিক সরকার। যারা রাস্তায় ধান পাট শুকাতে দিয়ে মানুষ খুন করে তাদেরকে কোন সরকার কোনোকালেই বিচারের আওতায় আনে না। তাই তাদের কাছে বিচার চেয়ে লাভ নেই। আমি শুধু ওই ঘাতক ‘খড় কুটা’র যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চাই। সরকার চাইলে এগুলোকে যাবজ্জীবন কারাবাসের ব্যবস্থা করতে পারে। মহাসড়কের পাশে ফুটপাথের আদলে ‘খড় কুটা পথ’ নির্মাণ করে সেখানে ধান পাট শুকানোর ব্যবস্থা করতে পারে। যাতে কৃষকদের আর মহাসড়কে না উঠতে হয়। দ্বিতীয় বিকল্প হিসাবে গ্রামের ঈদগাহ, মসজিদ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোন স্থানে ধান পাট শুকানোর মত বিকল্প ব্যবস্থা চিন্তা করা যায়। এভাবেই মহাসড়কের উপর অবস্থানরত ঘাতক ‘খড় কুটা’দের যাবজ্জীবন কারাবাসের ব্যবস্থা করা যায়। ধান পাট খড় কুটা গুলোকে ‘খড় কুটা পথে’ বন্দি করে রাখা যায়!


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭