চেন্নাই থেকে দু'দিন পরেই সোজা কলকাতায়। এয়ার ইন্ডিয়ার অভ্যন্তরীন ফ্লাইট ছিল এটা। রাত আটটায় অবতরণ করি। নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস এয়ারপোর্ট থেকে শহরের দিকে আসতে চোখে পড়লো অনেকগুলো নতুন ফ্লাইওভার। সর্বশেষ ২০১৫ সালে সপরিবারে এসেছিলাম। এবার কলকাতাকে বেশ গোছানো ও পরিবর্তিত মনে হল। শহরের দিকে যেতে যেতে দু'পাশের জনজীবনের স্বস্তি ও পরিচ্ছন্নতা নজরকাড়ে। আমি আর মামুন পুরনো কলকাতার মারকুইস স্ট্রিটের একটা মাঝারি মানের হোটেলে গিয়ে উঠি। পায়ে হেঁটে নিউমার্কেট, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করর্পোরেশ, বিখ্যাত গ্র্যান্ড হোটেলসহ যে দিকে মন চায় যাওয়া যাবে। পা বাড়ালেই হোটেল রেস্তোরাঁর কোনো অভাব নেই। ভাত, বিরিয়ানি, রুটি,পরোটা ডালমাখানি, ফলমূল সবই নাগালে। আলোকোজ্জ্বল ও জনাকীর্ণ রোড। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখ, মারোয়ারী কারা নেই এ ঐতিহাসিক শহরে? শত শত বছরের পুরনো নগরী কলকাতার মাটিতে এবার পা রাখতেই মনে একটি অদৃশ্য শিহরণ জাগে। ভেতর থেকে সাড়া আসে এ যে আমাদেরই জনপদ। চল্লিশ পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত এখানে আমাদের পূর্বপুরুষ, আত্মীয় স্বজন অনেকেই ছিলেন, তাদের রকমারি ব্যবসা-বাণিজ্য কতকিছুই না ছিল। বিশেষ করে মা'র মুখে আমার নানাদের জৌলুশপূর্ণ কত গল্প শুনেছি। এমনকি আমার জন্মের সময় অবধি কলকাতার সাবেক মুসাফির হিসেবে নানাজি ধূতি পরিহিত হয়ে ঘোড়া চালিয়ে আমাকে দেখতে এসেছিলেন। সুদীর্ঘ কাল তাঁরা এ স্বপ্নের শহরে বসবাস করে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিকও হয়েছিলেন। মূলতঃ অভিশপ্ত দেশ ভাগই তাঁদেরকে গ্রামে বসিয়ে কর্মহীন ভদ্রলোকে পরিণত করেছিল। পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে গিয়ে মধ্য ষাটের দশকেই তাঁরা ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে নেমে এসে খানিকটা দারিদ্র্যের সাথে বসবাস করছিলেন।
২) কলকাতা একটি মেগা মেট্রোসিটি। কোটি কোটি মানুষের বসবাস। প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষের বাস। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী হলেও কলকাতা বৃটিশদের নজরে পড়ে সর্বপ্রথম। শহরতলীর সুতানটির কাছে একদিন ইস্ট- ইন্ডিয়া কোম্পানি মোগলদের দ্বারস্থ হয়েছিল, তারা কেবল সামান্য একটু জায়গায় ব্যবসার অনুমতি নিয়েছিল। পরবর্তীতে এদের মানদণ্ড কিভাবে রাজদণ্ডে পরিণত হয়েছিল তা এখন ইতিহাস। কলকাতা প্রাচীন বন্দর, ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির শহর, দিল্লি, মুম্বাইয়ের পর তৃতীয় জনসংখ্যারও শহর এটি। শত শত স্ট্রিট, লেন, রোড, বাজার, পার্কের শহর। প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ নামই আজোবধি বৃটিশ কর্মকর্তা, বড়লাট বা তৎকালীন পরিচিত আধিকারিকদের নামে রয়ে গেছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের নাম, শিক্ষাবিদের নাম, আত্মাহুতি দেয়া বিপ্লবীদের নামও কম নয়। পুরনো বাস, ট্রাম ত্রিহুইলার, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, টানা সবই একরাস্তায়। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক অপূর্ব নিদর্শন শহর কলকাতা। মানুষের সংগ্রামী জীবন, শ্রেনী বৈষম্য, বাঁচার আকুতি ও প্রতিযোগিতা সর্বত্র বিদ্যমান।
৩) আমি যেহেতু ঘোরাঘুরির লক্ষে আছি, সব ধরনের অভিজ্ঞতা নিতে হবে। রোববার সরকারি ছুটির দিন। তবুও বেরোলাম। সঙ্গে অশোক নগরের ভোলানাথ সাহা। ভোলা মামুনের বন্ধু। আমরা হাঁটছি , রাস্তা ক্রস করে এপার-ওপার যাচ্ছি। বাম পাশে দেখি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজ। বলাবাহুল্য, বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা মৌলানা আজাদ স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী। ভেতরে গেলাম, কিছু ছাত্র ছাত্রী ও শিক্ষক আছেন। বেকার হোস্টেলের লোকেশন জানার চেষ্টা করি। এটা আসলে সাবেক ইসলামিয়া কলেজ। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চল্লিশের দশকের মাঝামাঝিতে এখানকার ছাত্র ছিলেন। চলে গেলাম বেকার হোস্টেলের গেইটে। লেখা আছে ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত। জানা যায়, আবাসন সমস্যা নিয়ে সেসময় কলকাতার মুসলিম ছাত্রদের প্রবল আন্দোলনের ফলে তৎকালীন লেঃ গভর্নর এ্যাডওয়ার্ড নরম্যান বেকার এ হোস্টেল নির্মাণ করেন। তবে আজ বন্ধ বলে কর্তব্যরত কর্মচারি আমাকে প্রবেশ করতে দেয়নি। বরং পরদিন আসতে পরামর্শ দিলেন। ঘন্টার চুক্তিতে একটি রিকশা নিলাম। তরুণ চালক। আজ কোথাও তার বাধা নেই। সোজা চলেছে সে। হঠাৎ দেখি জায়গাটার নাম বউ বাজার। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নামটি বহুবার পড়েছি। এগিয়ে যাচ্ছি এই তো কলেজ স্ট্রিট, ডানে বাঁয়ে বিখ্যাত দুই প্রতিষ্টান। কফি হাউস আর প্রেসিডেন্সী কলেজ। কোনটায় আগে যাব, কফি হাউসেই ঢুকে যাই, একটু বসি এবং ফটো তুলি। উভয় ফ্লোরে তরুণ তরুণীদের জমজমাট আড্ডা চলছে। নেমে প্রেসিডেন্সী কলেজের তোরণে। এখানেও বন্ধ বলে ঢুকতে বারণ। ছবি তুললাম, ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলেজ। এখন লেখা আছে প্রেসিডেন্সী ইউনিভার্সিটি। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে কয়েকজন দারোয়ান। ভেতরে যাওয়া নিষেধ, বলে, ক্যামেরা আছে। ভোলানাথ এবার মিষ্টি খাওয়াবে। 'ভীম চন্দ্র নাগ' এর মিষ্টি এটা নাকি কলকাতার সেরা রসগোল্লা। খেলাম এবং ছবি তুললাম। ঠিকানা ৫, নির্মল চন্দ্র স্ট্রিট কলকাতা ৭০০০১২। কলেজ স্ট্রিটের একপ্রান্তে গিয়ে বাংলাদেশের বইয়ের দোকান 'পাঠক সমাবেশ' খোঁজে বের করার চেষ্টা করি। কিন্তু পাই নি। তবে আদি মোহন কান্জিলাল বস্রালয় ঠিকই পেয়েছি।
৪) ফিরে এসে গ্র্যান্ড হোটেলের লবিতে বসি। খানিকটা জিরিয়ে নেয়া এবং শীতল হওয়া। কি করা যাবে ছুটির ফাঁদে পড়েছি। বৃটিশদের প্রিয় হোটেল এটি। হোটেলের অবকাঠামো ও নির্মাণশৈলী আজো পর্যটকদের দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করে। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি মহানায়ক উত্তম কুমারও এ হোটেলের ভক্ত ছিলেন। লবিতে বসে শাহজাহান হোটেলের খোঁজ নিই। এ প্রজন্ম বলতে পারে না। তবু জানলাম, হোটেলটি এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কথা সাহিত্যেক শংকর এর উপন্যাস চৌরঙ্গী'র চলচ্চিত্রায়ন হয় শাহজাহান হোটেলকে কেন্দ্র করে। এতেও উত্তম কুমার। এবারই প্রথম দেখার জন্য গ্র্যান্ড হোটেলের অভ্যন্তরে ও দোতলায় যাই। বিদেশি শ্বেতাঙ্গ বা ইউরোপীয়ান গেস্টও একেবারে কম নয়। এবার হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরে আসি।
৬) সন্ধ্যার আগে বিজু'র কলকাতার প্রতিনিধি আবদুল রশীদ আসেন আমার হোটেলে। তিনি কলকাতার মানুষ। স্হানীয় চেনা জানা মানুষ। আমাকে বলেন, কোথায় যাবেন স্যার? কোথায় আবার চলুন হাঁটি। ট্রামে চড়ার খুব শখ আমার। যদিও কবি জীবনানন্দ দাশ এতে দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। তিনি চেষ্টা করেও পারেন নি কারণ ছুটির দিনে ট্রামও তেমন চলছে না। তাই ট্যাক্সি নিয়ে শিয়ালদহ রেলস্টেশন। রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর লেখায় শিয়ালদহ এসেছে বারবার। কতক্ষণ আনমনে ঘুরাফেরা করি। প্ল্যাটফর্ম সংখ্যা গুনে দেখি। বের হয়ে বলি চলুন হাওড়া স্টেশনে। বেচারা না বলতে পারেন নি। পাবলিক বাসে চড়ে বসি দু'জন। মানুষ উঠছে মানুষ নামছে। কন্ডাকটর টিকিট দিচ্ছে। মিনিট পঁচিশের মধ্যে পুরনো রবীন্দ্র ব্রীজ পার হয়ে পৌঁছে যাই । হাওড়া স্টেশনেও আমার একই কাজ, উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটি। তখন আমার মাথায় শুধু একটাই ভাবনা, এগুলোই অখণ্ড বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাওড়া থেকে বিদ্যাসাগর ব্রীজ হয়ে ফিরে আসি। হোটেলে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে যায়।
৬) আজ পঁচিশ বৈশাখ। বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ কবি ও ঋষিতুল্য মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ১৬২তম জন্মদিন। কলকাতায় বৃষ্টি আর বৃষ্টি। বাইরে বের হওয়ার উপায় পাচ্ছি না। হোটেল মার্কের নিচতলা বৃষ্টির জলে ভেসে যাচ্ছে। এটি খুব পুরনো হোটেল। তবু বাণিজ্যিক কারণে বাসযোগ্য করে রাখা হয়েছে। ভাবছি, চাকরির রেশটুকু তো এখনো আছে। বর্ণ গন্ধ একদম ফুরিয়ে যায়নি। আমাদের মিশন অফিসের একটু সহযোগিতা বা অনুকম্পা পেতে ক্ষতি কী? ফোন দিই ডেপুটি হাইকে। তাঁকে চিনি না তবে জানি। তিনি বাংলা-ভাষার অন্যতম প্রধান কথাশিল্পী 'চিলেকোঠার সেপাই'র লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পুত্র আন্দালিব ইলিয়াস। মনে পড়ে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সাপ্তাহিক সন্ধানীতে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল 'চিলেকোঠার সেপাই'। আমার পরিচয় পেয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্হা নিল সে। ঘন্টাখানিক বাদে গাড়ি আসে। সবকিছু সঙ্গে নিয়ে সোজা রবীন্দ্র সরণী হয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি। বৃষ্টিস্নাত জন্মদিনের অনুষ্ঠান। মঞ্চের সাজসজ্জার ওপর বৈশাখী জলের স্পর্শ। আলোচনা পর্ব তখন শেষ। শত শত মানুষের কোলাহল। ভেতরে বাহিরে ঘুরে দেখছি, আগেও এসেছি তবে এত পরখ করে দেখি নি। বাড়ির পেছনটায়ও গেলাম, ভবনগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। সামনের অংশে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণ। এক ঘন্টার মত সময় থাকি, যদিও ফটো তোলার জন্য মাঝেমধ্যে কাউকে অনুরোধ করতে হয়েছে। স্মরণীয় হলো, তাঁর জন্মদিনে তাঁরই জন্মভিটায়।
৭) ঠাকুর বাড়ি হতে বেকার হোস্টেলে যাব। গতকাল বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্যটি দেখার অনুমতি পাই নি। আজ মিস করা যাবে না কারণ সন্ধ্যায় আমাকে কলকাতা ছাড়তে হবে। মেঘলা আকাশ, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি লেগেই আছে। ট্রাফিক যানজট থাকলেও অসহনীয় বলা যাবেনা। তবে এটা ২২শে শ্রাবণ হলে মেনে নেয়া যেত। গাড়ি চলছে ধীর গতিতে, তথাপি চিন্তামুক্ত আমি। আমার হাতে অনেকটা সময়। চলে এসেছি বেকার হোস্টেলের নিচে। একই গার্ড আমাকে চিনতে পেরেছে। বললো, আপনার জন্য হাই কমিশন থেকে বলেছেন, চলুন তৃতীয় তলায়। তিন তলার শেষ প্রান্তের ২৪ নম্বর কক্ষটিতে বঙ্গবন্ধু থাকতেন। তাঁর কক্ষটির সামনেই আবক্ষ ভাস্কর্য স্হাপন করা হয়েছে। জাতির পিতার স্মৃতিস্মারক চিহ্ন দেখে ভীষণ ভালো লেগেছে। সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি ২০১১ সালে উন্মোচন করেন।
৮) এবার বিমানবন্দরের পথে। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ছোট্ট মাটির পেয়ালার এক কাপ চা খেলাম। পরিমাণে এত কম আমাদের এক কাপের একতৃতীয়াংশ হবে। চালককে বললাম, একটা ভালো শপিংমলে নিয়ে যাও। আমার কোনো কেনাকাটা নেই। চাহিদাও নেই। তবে মাত্র ১৬ মাস বয়সী আমার প্রিয়তমা তো বাদ যেতে পারে না। চালক বললো, সামনেই 'কোয়েস্টমল' এখানকার বড় অভিজাত মার্কেট। তবে প্রবেশ করতেই মন খারাপ হয়ে গেল, ২০১৫ সালে সস্ত্রীক এ মলে এসেছিলাম। ২০২০ সালের জুনে সে করোনায় পৃথিবী ছেড়ে যায়। এক্সেলেটরে পা রাখতেই আমার বিষন্ন হৃদয় হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। ধপাস করে ওঠে ভেতরটা। সে এক্সেলেটর ব্যবহার করতে পারত না। তাঁকে সিঁড়ি দিয়ে উঠাতে হয়েছিল। এ নিয়ে বাচ্চাদের মজা করার কথাও মনে পড়ছিল। এ সবই যেন নিয়তি। খুব কম সময়ের মধ্যে দুটো জামা নিই এবং শপিংমল ত্যাগ করি। দমদমের পথে পথে উড়ালসেতু হওয়ায় বেশি সময় লাগেনি। সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টা হবে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে আগরতলা যাচ্ছি।
চলবে...