ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

ফিনল্যান্ড-সুইডেনকে কেনো ন্যাটো জোটে দেখতে চায় না তুরস্ক?


প্রকাশ: 17/05/2022


Thumbnail

ন্যাটোর সচিবালয় থেকেও পরিষ্কার বলা হয়েছে উত্তর ইউরোপের দুটি দেশ- যাদের একটির (ফিনল্যান্ড) সাথে রাশিয়ার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে- সদস্যপদের জন্য আবেদন করলে যত দ্রুত সম্ভব তা অনুমোদনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

উত্তর ইউরোপের দুটি দেশ ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রেক্ষাপটে তারা পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে ঢোকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু দেশ দুটির এই সিদ্ধান্তে তুরস্ক বাগড়া দিতে পারে বলে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

ন্যাটো জোটে নতুন কোনও দেশকে সদস্য হিসেবে নিতে হলে জোটের ৩০ সদস্য দেশের সবাইকে একমত হতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি সদস্য দেশের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।

কিন্তু যে দেশটির সেনাবাহিনী জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম- সেই তুরস্ক স্পষ্টভাবে বলে চলেছে ন্যাটোতে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডকে নেওয়ার প্রশ্নে তাদের চরম অস্বস্তি রয়েছে। এ উদ্যোগে বাধা দেবে আঙ্কারা।

এমনকি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান  এক সংবাদ সম্মেলেনে বলেছেন, তুরস্ককে রাজি করাতে নিজ নিজ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আঙ্কারা পাঠানোর কথা জানিয়েছে ফিনল্যান্ড–সুইডেন। এর প্রয়োজন নেই। তাঁদের সফরের ফলে দেশ দুটির ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে অবস্থান পরিবর্তন করবে না তুরস্ক।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইস্তাম্বুলে সাংবাদিকদের বলেন, তুরস্ক চায় না ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন ন্যাটো জোটের সদস্য হোক। তিনি বলেন, “সুইডেন বা ফিনল্যান্ডকে নিয়ে যা হচ্ছে তা আমরা দেখছি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের মনোভাব ইতিবাচক নয়।”

এরদোয়ান সেসময় গ্রিসের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ১৯৫২ সালে ন্যাটোতে গ্রিসের সদস্যপদ সমর্থন করে তুরস্ক ভুল করেছিল যে ভুল তিনি আর করতে চান না। তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে বৈরিতা বহুদিনের এবং ন্যাটো সদস্য হয়েও তারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করেছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের ব্যাপারে তুরস্কের আপত্তি?

বিশ্লেষকরা বলছেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এই দুই দেশের ব্যাপারে তুরস্কের বহুদিনের অভিযোগ যে তারা তুরস্কের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী পিকেকেকে সমর্থন যোগায়, গোষ্ঠীর নেতা-কর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়।

এরদোয়ান বা তার মন্ত্রীরা অবশ্য তাদের উষ্মা চেপে রাখেননি। এরদোয়ান তার স্বভাবসুলভ চাঁছাছোলা ভাষায় বলেন, “সবচেয়ে বড় কথা, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এই দেশগুলো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সরাইখানা, ... তাদের সমর্থন করা সম্ভব নয়।”

সন্ত্রাসী সংগঠন বলতে তিনি যে পিকেকে এবং সিরিয়ায় তাদের শাখা বলে পরিচিত কুর্দি মিলিশিয়া গোষ্ঠী ওয়াইপিজিকে বুঝিয়েছেন- তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।



সুইডেনের ব্যাপারে তুরস্ক বিশেষভাবে ক্ষ্যাপা। কারণ সুইডেন প্রকাশ্যে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে কুর্দি মিলিশিয়া ওয়াইপিজিকে সমর্থন দিয়েছে। এ কারণে গত বছর এপ্রিলে আঙ্কারায় সুইডিশ রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল।

সুইডেনে পার্লামেন্টে এখন ছয়জন এমপি রয়েছেন যারা জাতিগত কুর্দি এবং তারা কুর্দি ইস্যুতে সোচ্চার।

তবে আমেরিকা এবং ন্যাটো জোটের অনেক সদস্য এখনও মনে করছে না যে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সদস্যপদের প্রশ্নে তুরস্ক শেষ পর্যন্ত ভেটো দেবে।

ফিনল্যান্ড–সুইডেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও। তিনি বলেছেন, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যুক্ত হওয়া রাশিয়ার জন্য নিরাপত্তাজনিত হুমকি বয়ে আনবে না। তবে পশ্চিমা দেশগুলোকে সতর্ক করে পুতিন বলেন, প্রতিবেশী দেশে অস্ত্র ও সেনা মোতায়েন করলে তার পরিণতি ভোগ করতে হবে। এর আগেও তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ন্যাটোতে যোগ দিলে ফিনল্যান্ড বড় ‘ভুল করবে’।

রাশিয়ার সঙ্গে ফিনল্যান্ডের ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। তবে ৫৫ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে নিয়োগপ্রাপ্ত সেনার সংখ্যা মাত্র ১৩ হাজার। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দুটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে দেশটির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চলা এসব লড়াইয়ে ফিনল্যান্ড অনেক ভূমি হারিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা ভোলেনি দেশটির মানুষ। তাই সোভিয়েত উত্তরসূরি রাশিয়া তাদের দেশে হামলা চালাতে পারে, এ আশঙ্কায় ভুগছে ফিনল্যান্ডের বেশির ভাগ মানুষ। এ জন্য ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে সম্মতি রয়েছে তাদের।

একই আশঙ্কা থেকে সুইডেনও ন্যাটোয় যুক্ত হতে চায়। গত সোমবার রাজধানী স্টকহোমে এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়ে ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডালেনা অ্যান্ডারসন। তিনি বলেন, তাঁর দেশ ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার আবেদন করবে। সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এক যুগ থেকে আরেকটি যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।’

দরকষাকষির সুযোগ তুরস্কের?

তুরস্ক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিশ্লেষক শুক্রবার তার এক বিশ্লেষণে লিখেছেন, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে আঙ্কারা সমরাস্ত্র ক্রয় করা নিয়ে আমেরিকার সাথে দরকষাকষি করতে চাইছে।

“আমি মনে করি এরদোয়ান আমেরিকার কাছ থেকে আধুনিক ফাইটার জেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় নিয়ে দরকষাকষির একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন,” লিখেছেন টিম অ্যাশ যিনি বর্তমানে ব্লু বে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্ট্রাটেজিস্ট হিসেবে কাজ করছেন।

“কিন্তু এরদোয়ানের এই অবস্থান পশ্চিমা দেশের রাজধানীগুলোতে ভালো চোখে দেখা হবে না। এটিকে দেখা হবে পশ্চিমা জোট থেকে তুরস্কের দূরে সরে যাওয়ার আরেকটি অধ্যায় হিসেবে।”

তুরস্ক ইউক্রেনের কাছে সামরিক ড্রোন বিক্রি করেছে, কিন্তু রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তারা মানেনি। এখনও রুশ বিনিয়োগ এবং পর্যটক তুরস্কে আসছে যা নিয়ে অনেক পশ্চিমা দেশ নাখোশ।

হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জেন সাকি শুক্রবার বলেন, বাইডেন প্রশাসন সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের প্রশ্নে তুরস্কের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছে।

ন্যাটো মহাসচিব ইয়েন্স স্টলটেনবার্গ রবিবার বলেছেন, “তুরস্ক পরিষ্কার করেছে যে সদস্যপদে বাধা তৈরি তাদের উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং আমি নিশ্চিত যে তুরস্ক যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তা নিয়ে বোঝাপড়া সম্ভব।”


সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী মাগডালেনা এন্ডারসন এবং ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন

সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শিগগিরই একটি সরকারি প্রতিনিধিদল আঙ্কারায় যাবে। তবে তিনি বলেন, ন্যাটোর বড় এবং প্রভাবশালী সব দেশ সুইডেনের সদস্যপদের পক্ষে এবং সেসব দেশের সাথে ‘সুসম্পর্ক রাখা তুরস্কের প্রয়োজন’।

যুদ্ধবিমান এবং ক্ষেপণান্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় নিয়ে আমেরিকার সাথে তুরস্কের দীর্ঘদিন ধরে একটি টানাপড়েন চলছে।

তবে অস্ত্র ছাড়াও এই সুযোগে পিকেকের প্রতি সমর্থন কমানো নিয়ে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায়ের সুযোগ হয়তো তুরস্ক ছাড়তে চাইবে না।

বার্লিনে শনিবার ন্যাটো মন্ত্রীদের বৈঠকের আগে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসগলু সাংবাদিকদের বলেন, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড ‘প্রকাশ্যে পিকেকে এবং ওয়াইপিজির সাথে সম্পর্ক রাখছে এবং সমর্থন দিচ্ছে যারা তুরস্কে হামলা করছে এবং তুর্কি সৈন্য এবং তুর্কি জনসাধারণকে হত্যা করছে’।

তিনি বলেন, “তুরস্কের জনগণের বিশাল অংশ এ দেশগুলোর ন্যাটো সদস্যপদের বিরোধিতা করছে...সুতরাং ন্যাটো জোটের অন্যান্য মিত্র এবং এই দুই দেশের সাথে আমাদের আলোচনা দরকার।” সূত্র: বিবিসি 


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭