ইনসাইড থট

ভোজ্যতেলের সংকট নিরসনে অতিরিক্ত ব্যবহার কমানো, উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন


প্রকাশ: 19/05/2022


Thumbnail

সম্প্রতি ভোজ্যতেলের মনুষ্য সৃষ্ট কৃত্রিম সংকটে লংকাকান্ড ঘটে যাচ্ছে। এই উছিলায় হারিয়ে যাওয়া গণবিচ্ছিন্ন বিভিন্ন ধরনের সংগঠন শিয়ালের মত গর্তের মধ্য থেকে হুয়াক্কা হুয়া ডাক দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এই সংকটের মূল কারণ ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা। ভোজ্যতেলের ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। তথ্যমতে ভোজ্যতেল আমদানিতে বছরে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হচ্ছে। ভোজ্যতেল সংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শ অনুযায়ী ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে তেলবীজের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গবেষণা ও উৎপাদন বাড়ানোর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের 'তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি' প্রকল্পের জাতীয় কর্মশালায় উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে জন প্রতি তেল ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে। গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালে মাথাপিছু খাবার তেল ব্যবহারের পরিমাণ ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, খাবার তেলের ভোগ বেড়ে যাওয়া জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। কারণ তারা মনে করেন যে বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ পুষ্টিজনিত রোগে ভুগছে, তাই তাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভোজ্যতেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পুষ্টি চাহিদা পূরণে যেমন পর্যাপ্ত তেল দরকার, তেমনি যারা স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ কিংবা রক্তচাপের মতো সমস্যায় ভুগছেন তাদেরকে আবার চিকিৎসকের পরামর্শে মেপে মেপে তেল খেতে হবে। নিজের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বুঝে পরিমিত পরিমাণে তেল খাওয়া বেশ জরুরি। সেক্ষেত্রে দেহের চাহিদা যদি কম-বেশি থাকে, তাহলে তেল খাওয়ার পরিমাণও কম-বেশি হবে। এছাড়া ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে যাদের বয়স, দেহের ওজন বুঝে তাদের তেল গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে।

এখন প্রশ্ন, কী ধরণের তেল খাচ্ছেন এবং সেটা কী পরিমাণে খাচ্ছেন? তেলে সাধারণত স্যাচুরেটেড, মনো-আনস্যাচুরেটেড ও পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, যেগুলো আমাদের রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রার তারতম্য ঘটায়।

স্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তের এলডিএল (খারাপ) কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়, যা আমাদের হৃদরোগের ঝুঁকিতে ফেলে। যে তেল বা চর্বি প্রাণী থেকে আসে যেমন গরু, খাসির চর্বি, ঘি, মাখন, ডালডা ইত্যাদি প্রাণীজ ফ্যাট। এগুলোকে স্যাচ্যুরেটেড ফ্যাটও বলা হয়। এই সকল তেল পরিহার করা উচিত। আবার পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তের এইচডিএল (ভালো) কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়, যা উপকারি। গাছ, ফুল বা শস্য থেকে যে তেল আসে সেটা উদ্ভিজ্জ তেল, একে পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটও বলা হয়। যে তেলে পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের মাত্রা বেশি, সেগুলোই ব্যবহার নিরাপদ।

বাংলাদেশের বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ তেলের মধ্যে রয়েছে সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, ক্যানোলা তেল, জলপাই তেল, রাইস ব্র্যান তেল, সূর্যমুখী তেল, ভুট্টার তেল ইত্যাদি।

যে তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ৩৫ শতাংশের নিচে এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ৫০ শতাংশের ওপরে সেই তেল দৈনিক ব্যবহারের জন্য ভালো।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তেলের স্মোক পয়েন্ট (অর্থাৎ যে তাপমাত্রায় তেল পুড়ে ফ্যাটগুলো ভেঙে  আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এলডিহাইড তৈরি করে)। তাই রান্নার পদ্ধতির ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। যেমন—অলিভ অয়েলে পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকলেও এর স্মোক পয়েন্ট অনেক কম হওয়ায় ভাজাপোড়ার জন্য এই তেল ঠিক নয়। তবে সালাদ ড্রেসিং এবং অল্প আঁচের রান্নার জন্য ভালো। আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে খাবার রান্না করা হয় তাতে বেশি স্মোক পয়েন্ট (১৭৭ থেকে ২৩২ ডিগ্রি) সম্পন্ন তেলই উপযুক্ত। 

বর্তমানে আমরা রান্নায় সবচে বেশি ব্যবহার করি সয়াবিন তেল। কারণ এটি উদ্ভিজ্জ তেল। তবে তথ্যমতে সয়াবিন তেল অতিরিক্ত সেবনে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এই তেল অ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্টস হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সয়াবিন তেল ডায়াবেটিস, স্থূলতা, স্নায়ুজনিত বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া চাহিদার কারনেই সয়াবিন তেল বেশি আমদানি করা হয়। আমরা যেন এর বিকল্প ভাবতেই পারি না। কেউ কেউ সরিষার তেলে রান্না করলেও তার সংখ্যা খুবই কম। এদিকে লাফিয়ে বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম। আমদানি নির্ভরতা কমাতে এবং সুস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে সয়াবিন তেলের ব্যবহার কমানো উচিত এবং সয়াবিন তেলের বিকল্প ভাবা উচিত। চাহিদা পূরণে দেশীয় তেলবীজ উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন।

যে সকল তেল, যা সয়াবিন তেলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়, যেগুলো স্বাস্থ্যকরও বটে। তন্মধ্যে, সরিষার তেল, সূর্যমুখী তেল, জলপাই তেল, বাদাম তেল, তিল তেল, ভেন্না তেল, তিসি তেল, রাইসব্রান তেল, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তবে সয়াবিন তেলের সহজলভ্য বিকল্প হলো সরিষার তেল। এতে মাত্র ৭ শতাংশ স্যাচুরেটেড ফ্যাট রয়েছে। সরিষার তেলে মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ প্রায় ৬০ শতাংশ। ফলে আমাদের শরীরের কোলেস্টেরলের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমে, কারন সরিষার তেলে রয়েছে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। সুস্বাস্থ্যের জন্য যা বেশ উপকারি। একসময় গ্রাম বাংলার একমাত্র ভোজ্যতেল ছিল সরিষার তেল। শুধু খাওয়ার জন্যই নয় চুল ও ত্বকের যত্নেও সরিষা তেল উপকারী। এর ওষুধি গুণের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সরিষা তেলের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ইদানিং সরিষার উৎপাদনও কমেছে। সয়াবিন তেলের কর্পোরেট আগ্রাসনে হারিয়ে গেছে স্বাস্থ্যসম্মত সরিষার তেল। সয়াবিনের ব্যাপক প্রচলনের ফলে সরিষা তেলের ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে। 

সয়াবিন তেলের বিকল্প হিসেবে সূর্যমুখী তেলকে বিবেচনা করা হয়। এই তেল দেহের জন্য উপকারি, এটি বিপাক ক্রিয়া তরান্বিত করে। এই তেল প্রচুর পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটসমৃদ্ধ। এর স্মোক পয়েন্ট অনেক বেশি (২২৭ ডিগ্রি)। দৈনিক যেকোনো রান্নার জন্য উপযোগী। সানফ্লাওয়ার তেলে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ আছে, যা রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। সূর্যমুখী তেল উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি হ্রাস করে। এতে থাকা অসম্পৃক্ত ফ্যাট দেহের ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় এবং খারাপ কোলেস্টরলের মাত্রা কমায়।কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকায় যারা ডায়েট করেন তাদের জন্য এটি উপযোগী। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ভাজাপোড়ার ক্ষেত্রে এই তেল প্রযোজ্য নয়। এই তেল ভাজাপোড়া করার সময়ে এলডিহাইড নামের ক্ষতিকর উপাদান তৈরি করে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

রাইসব্রান তেল মনো-আনস্যাচুরেটেড ও পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটসমৃদ্ধ। এর স্মোক পয়েন্ট (২৫৪ ডিগ্রি) বেশি হওয়ায় যেকোনো খাবার রান্নায় ব্যবহার উপযোগী। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এই তেল রক্তের কোলেস্টেরল ও রক্তচাপ কমায়। এ ছাড়া টাইপ টু ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ব্লাড সুগারের মাত্রাও কমায়। তবে যাঁদের ব্লাড প্রেসার কম, তাঁদের চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এই তেল ব্যবহার করা উচিত।

জলপাই তেল। রান্নায় জলাপাই তেল বা অলিভ অয়েলের ব্যবহারের ইতিহাস অনেক আগের। শত শত বছর ধরে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে এই তেল ব্যবহার করা হচ্ছে। আচ্ছাদিত জলপাই থেকে এই তেল তৈরি করা হয়। সয়াবিনের বিকল্প হিসেবে এই তেল ব্যবহার করা যায়। কোলেস্টেরল কম থাকায় এটি হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। জলপাই তেলের বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ, স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ, হাড় মজবুত করা, ওজন কমানো, মনকে প্রফুল্ল রাখা এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। শুধু খাবারেই নয়, ত্বকের যত্নেও জলপাই তেল উপকারী। তাই শীতে ত্বক ও চুলের যত্নে নিয়মিত জলপাই তেল ব্যবহার করতে পারেন।

চিনাবাদাম তেল। স্বাস্থ্যকর তেল হিসেবে বিবেচিত হয় চিনাবাদাম তেল। এই তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট কম থাকে। এটি প্রাকৃতিকভাবে চর্বিমুক্ত। এটি রক্তনালীতে চর্বি জমা হ্রাস করে। সয়াবিনের পরিবর্তে এই তেলও ব্যবহার করা যায়। 

খাবারে যে তেলই ব্যবহার করুন না কেন, এর দোষ-গুণ নির্ভর করে কিভাবে এবং কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন তার ওপর। তাই তেল কেনার আগে অবশ্যই পুষ্টিমান দেখে কিনুন। একটি কথা অবশ্যই বিবেচনা করা জরুরি, তেল যতই ভালো হোক, খাবারে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং মাত্রাতিরিক্ত ভাজাপোড়া সবার জন্যই ক্ষতিকর।

আমাদের দেশে পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন হচ্ছে। ধানের উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে অতিরিক্ত ফসল হিসাবে আরও কোথায় কোথায় এসব তৈলবীজ জাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। চর এলাকার পতিত প্রত্যেকটি জমি আবাদের আওতায় আনার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী তেলবীজ বা তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চরাঞ্চলে অবস্থিত পতিত জমি ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে এসকল জমিতে তেল জাতীয় ফসল সয়াবিন, সূর্যমুখী ও সরিষার আবাদ করা যেতে পারে। তেল জাতীয় ফসল আবাদে উৎপাদন খরচ কম এবং লাভ বেশি। এছাড়া শেখ হাসিনার কৃষিবান্ধব সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় বীজ, সার, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণসহ সক সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাসও রয়েছে ।

কোথায় কোথায় সরিষার উৎপাদন বাড়ানো যায় সেটা নির্ধারণ করে এক্সটেনশন সিস্টেম ডেভেলপ করতে হবে, যাতে দ্রুত এর উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তেল উৎপাদনকারী পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হলে গবেষণায় ফলাফল মাঠ পর্যায়ে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। তা কি ফলাফল বয়ে আনছে সে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। এটি করতে পারলে আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে ভোজ্যতেলের চাহিদা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হবে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭