ইনসাইড থট

ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ ও অসংক্রামক রোগের ব্যয় বহনের সামর্থ্য


প্রকাশ: 23/05/2022


Thumbnail

১৯ মে বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকায় আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়কে উদ্ধৃত করে ছাপা হয়েছে- “প্রতি বছর দেশে মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশই হয় অসংক্রামক রোগের কারণে। বৃহস্পতিবার (১৯ মে) বিকালে রাজধানীর বনানীতে হোটেল শেরাটনে আয়োজিত এক সায়েন্টিফিক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। জাহিদ মালেক বলেন, দেশে প্রতিবছর ১০ লাখ মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। তার মধ্যে ৭০ শতাংশই মারা যায় বিভিন্ন ধরনের অসংক্রামক রোগে। অসংক্রামক রোগে প্রতিদিন ১ হাজার ৯০০ মানুষ মারা যান। ভালো চিকিৎসা সেবা দিতে গেলে গবেষণা দরকার। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে আছে, তবে অসংক্রামক রোগ বেড়ে গেছে”।

আমার ক্যান্সার প্রকল্পের গুরু প্রফেসর রিচার্ড লাভ যিনি দুনিয়ার খ্যাতিমান ক্যান্সার চিকিৎসকদের অন্যতম একজন, বাংলাদেশে আমার সাথে তার কাজের রেশ টেনে ধরে প্রায়ই বলেন এই দেশে ক্যান্সার রোগ নির্ণয়ের ও চিকিৎসার অন্যতম বাধা হলো “চিকিৎসার সুযোগ, ব্যয় বহনের সামর্থ্য ও মানের ঘাটতি”। ২০০৭ সালে আমি যখন তার সাথে ক্যান্সার নিয়ে কাজ শুরু করি তখন মানুষের জন্যে ‘চিকিৎসার সুযোগ’ সৃষ্টিকেই আমরা গুরুত্ব দেই, ফলে গ্রামে কেমন করে সেই সুযোগ তৈরি করা সম্ভব সেরকম চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়ে আমাদের দুইজনের পথ চলা। রিচার্ড লাভ তখন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। চিকিৎসা বৈষম্যের বিরুদ্ধে নামকরা এক প্রতিবাদী গবেষক, আর আমি মাইক্রোসফটের সহায়তায় বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে তরুণদের তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষা সম্প্রসারণ নিয়ে কাজ করি। আমার উদ্দেশ্যও একই, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে কেমন করে তথ্য-প্রযুক্তির সেবা-সুযোগ তৈরি করা যায়। রিচার্ড লাভ আমাকে বললেন, ওই মানুষগুলোর জন্যে ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ তৈরিতে, যা তখন নেই বললেই চলে, যদি কাজ কর তাহলে তোমার “মিশন কমপ্লিট” হবে। আমরা তথ্য-প্রযুক্তির সাথে মিলিয়ে ক্যান্সার নির্ণয় ও সুলভে মান সম্পন্ন চিকিৎসার একটি ব্রত নিয়ে বাগেরহাটের রামপালে কাজ শুরু করলাম। ২০০৭ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এই দশ বছরে প্রফেসর রিচার্ড লাভ অন্তত অর্ধেক সময় বাংলাদেশে আসা যাওয়া করেছেন এই কাজে আর আমাদের দেশের এমন কোন পর্যায় নেই যেখানে যেয়ে তিনি বাংলাদেশের ক্যান্সার চিকিৎসার মান বাড়াতে তদবির করেননি। গবেষণা, প্রশিক্ষণ আর চিকিৎসা সেবা সহায়তায় বাংলাদেশের অগণিত ডাক্তারকে পরামর্শ দিয়েছেন ও তার বিশেষজ্ঞ বন্ধুদের এ দেশে ডেকে এনে আমাদের চিকিৎসকদের হাতে কলমে কাজ শিখিয়েছেন। আমার ধারণা বাংলাদেশের ক্যান্সার চিকিৎসার সাথে যুক্ত প্রায় সকলেই প্রফেসর রিচার্ড লাভের নাম জানেন ও সাক্ষাৎ পেয়েছেন। এমনকি আমার মতো অচিকিৎসক মানবিকের ছাত্রকেও তিনি অবিরাম প্রশিক্ষণ দিয়ে ও কাজ করিয়ে ক্যান্সার গবেষক বানিয়ে ছেড়েছেন! পৃথিবীর নামকরা বেশ কিছু জার্নালে আমার এখন ১৯টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে তার অনুপ্রেরণা থেকেই। 

২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আগ্রহে ও অনুপ্রেরণায় আমার কর্মস্থল রামপালে আমরা একটি ক্যান্সার চিকিৎসা ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের কাজে হাত দেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে স্থানীয় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পর্যন্ত এমন কোন মানুষ নেই যারা আমাদের এই কাজে সহযোগিতা করেননি। তাতেই আমাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে লেগেছে ছ’বছর! এই ২০২১ সালের শেষের দিকে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ওদিকে কাজের কাজ যা হয়েছে রিচার্ড লাভ অভিমান করে এখন আর এই দেশে আসতে চাইছেন না। কারণ এই দীর্ঘসূত্রিতার জন্যে কে দায়ী সেটা তিনি আমাকে নির্ধারণ করে জানাতে বলেছেন, আমি তা খুঁজে পাচ্ছিনা। পেলেই তিনি আসতে শুরু করবেন এই কথা আমাকে বলেছেন।

এই প্রসঙ্গের অবতারণা এই কারণেই যে, আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবার অন্তর্গত সমস্যা আমাদের ভালো করে বুঝা দরকার। গত এক যুগ ধরে গ্রামাঞ্চলে ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ তৈরি ও মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা দিয়েছি আমরা প্রায় বাইশ হাজার মানুষকে। আমাদের গ্রাম প্রকল্পের কর্মীদের কাছে সেবা নিতে আসা প্রতিটি মানুষের সকল প্রকার প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত (নাম ঠিকানা থেকে শুরু করে সমস্যা, নিরীক্ষার বিবরণ, ধাপ অনুযায়ী চিকিৎসা সেবার সকল তথ্য) তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে সংরক্ষণ করা আছে। আর সেসব তথ্য কোন কম্পিউটারে নয় ক্লাউড সার্ভারে যাতে সহজে মুছে না যায়। আমাদের কর্মীদের কাছে আছে ইন্টারনেট সমেত মোবাইল ফোন, যার মাধ্যমে নির্ধারিত অ্যাপের মাধ্যমে সে প্রতিদিন গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য তথ্য সংগ্রহ করে হালনাগাদ করে যার মধ্যে আছে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিরীক্ষা ও সেসবের তথ্য। আর এসব তথ্য দেশ বিদেশের যে কোন চিকিৎসক যে কোন সময় পর্যবেক্ষণ করে ‘চিকিৎসা গাইডলাইন’ অনুসারে মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা পরামর্শ অনলাইনেই দিতে পারেন।

এই দেশে তথ্য-প্রযুক্তিকে উপযুক্ত নিয়মে ব্যবহার করে স্বাস্থ্য সেবা বিশেষ করে দুর্বিনীত রোগ প্রতিরোধে যেমন ক্যান্সার, কিডনি জটিলতা, মস্তিষ্কের ও হৃদযন্ত্রের অসুখ বা যে কোন অসংক্রামক রোগের বিষয়ে আমরা কোন মনোযোগই দেইনি। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার (আইএআরসি)-র অনুমিত হিসাবসূত্রে, প্রতি বছর বাংলাদেশে নতুন করে এক লাখ ৫০ হাজার মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হন। আর মারা যান এক লাখ আট হাজার মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই হিসাবটা আমাদের নিজেদের কাছে নেই! আমরা যদি আমাদের সবগুলো চিকিৎসা কেন্দ্রে তথ্য-প্রযুক্তির ঠিকমতো ব্যবহার করতাম তা হলে সব রোগের তথ্যই আমাদের কাছে থাকতো। যে কারণে কোন পরিকল্পনা নিয়ে এগুলে একটা দীর্ঘসূত্রিতার বাধা এসে আমাদের সামনে দাঁড়ায়, কারণ বিষয়টা বুঝতে হলে সামগ্রিক যেসব তথ্য আমাদের নীতিমহলে থাকা দরকার ছিল তা তাঁদের কাছে নেই।

ডা লাভের উদ্বেগ অনুযায়ী মানসম্পন্ন চিকিৎসার কথাও যদি বলি তাহলেও এসে যাবে খরচের হিসাব। অকারণ পরীক্ষা ক্যান্সার নির্ণয়ের প্রধান বাধা। কারণ এতো খরচ আমাদের দেশের মানুষের সাধ্যের মধ্যে নেই। কিন্তু আমাদের জ্ঞানেও নেই এতো বাহুল্য পরীক্ষা কেমন করে আমরা বাদ দেবো, এর জন্যে দরকার গবেষণা ও পড়াশুনা যা আমাদের চিকিৎসক সমাজের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা। আমরা দেখেছি অভিযোগের একটি নির্ধারিত সূত্র ধরে এগুলে ঠিক ঠিক রোগটি ধরে ফেলা যায় যা সামান্য ইমেজ পরীক্ষা বা টিস্যু পরীক্ষার মাধ্যমেও সম্ভব। সন্দেহজনক না হলে কেন আমরা একটি মানুষের শরীর, মন আর আর্থিক সামর্থ্য নিয়ে এমন খেলায় নামি তার কোন কারণ আমরা বুঝে উঠতে পারিনা।

এখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ত্রুটিকে যারা গালমন্দ করেন তাদেরও ভুল আছে। ত্রুটি আমাদের সামগ্রিক সচেতনতার অভাব। আমাদের অজ্ঞতাকে যারা পুঁজি করে রোজগার করেন তাদের বিরুদ্ধে নীতিতে ব্যবস্থা নেই, আর নেই জনগণের মধ্যে প্রতিরোধের সাহস। এটা সম্ভব হতো যদি সরকার জনগণের পাশে আছে এটা জনগণ বুঝতে পারতো।

সবিনয়ে পাঠকবর্গকে জানাই, ক্যান্সার মোটেই ভয়ের কোন অসুখ নয়। এটা সঠিক নির্ণীত হলে আপনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। আর যাই-ই হোক হৃদরোগ আর মস্তিষ্কের স্ট্রোকের চেয়ে তো ভালো। যারা আমাকে-আপনাকে ক্যান্সার নিয়ে ভয় দেখায় তাদের অকারণ পরীক্ষার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে সরকার যেন একটা নির্দেশনা দেয় তার জন্যে সবাই মিলে কথা বলুন।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭